কেশের মায়া পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0
3

#গল্পঃ #কেশের_মায়া
#লেখিকা – #চন্দ্রাবতী
#পর্ব – ২ বা সমাপ্তি_পর্ব

সেই বদলা নেবো বলে বিভিন্ন কৌশল ছলাকলা অনেক কিছুই তার উপর ট্রাই করেছি। এমনকি নিজের শরীরকে কষ্ট দিয়ে টানা একসপ্তাহ জ্বরে ভুগেছি। যাতে ডাক্তারকে দিয়ে বলা যায় এই এতো বড়ো ভিজে চুলের জন্যই জ্বর এসেছে। এগুলো যেনো ছোটো করে ফেলি। কিন্তু ওই আমার পোড়া কপাল, ডাক্তার সেই কথা বলার পরও কোনো কাজ হয়নি। আমার পতিদেব রোজ সকালে উঠে পুরো চুল ভিজিয়ে চান করার শাস্তি হিসেবে তিনদিন আমার ফোন ল্যাপটপ বাজেয়াপ্ত করে রেখেছিলেন। আমার ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল ও কোনো কাজে আসেনি। তবে বলাবাহুল্য আমার শরীরখারাপের কটা দিনে সে নিজে আমার চুলের যত্ন নিয়েছে। হেয়ার ড্রায়ার আরও কি কি সব প্রোডাক্ট অনিয়েছে তারপর নিজেই সেগুলো নিয়ে মাখিয়ে দিয়েছে। এরপর থেকে আমিও তেমন একটা ঝামেলা করিনি। কারন এই চুলের ঝামেলা ছাড়া সে আমায় মাথায় করেই রাখে বলতে গেলে। এইটুকু তো মেনে নেওয়াই যায়।

এইভাবেই বরকে লাই দিয়ে মাথায় উঠিয়ে আবার ঝামেলায় পড়েছি। আমার চুল বেশ ঝরছে কয়েকটা দিন ধরে। তাকে কিছু সেসব নিয়ে বলিনি। বলেছি চুল কাটা দরকার এখন একটু। কিন্তু ওই সে কোনো কারণ শুনতে রাজি না বলে কি

– ” এই তো কয়দিন আগে চুল কাটলে না ..? ”

– ” সেটা অলরেডি পাঁচ মাস পেরিয়ে গেছে রাজ ”

– ” ওহ, তাও এতো ঘন ঘন চুল কাটা উচিত না। আবার কয়েকটা মাস পরে কাটবে ”

–” তোমার সাথে চুল নিয়ে কথা বলাই বেকার। ধূর ”

আমি রেগে উঠে চলে এলাম ঘরে। শরীরটা ভালো নেই আজকাল। কেমন গা গুলায় বমি পায় এইসব লক্ষণ প্রেগন্যান্সির। অথচ আমি টেস্ট করে দেখেছি রেজাল্ট কিন্তু নেগেটিভ। রাজ সারাদিন বাইরে কাজে থাকে তাই আর তাকে এইসব ব্যাপারে জড়াইনি। আমর শরীর এমনিই নাজুক। কয়েকদিন উল্টোপাল্টা খেয়েছি বোধ্হয়। ওষুধ খেলই ঠিক হয়ে যাবে।

কয়েকদিন ধরে টানা ওষুধ খাওয়ার পর যখন দেখলাম শরীরের অবনতি হচ্ছে বেশি। রাজকে জানাতেই সে ভাবলো আমি আবার চুল কটা নিয়ে নাটক জুড়েছি। ভাবাই স্বাভাবিক। আমি আগে এমনটা বহুবার করেছি। তবে তার কিছুদিনের মধ্যেই আমার শরীর বমি করে এতটাই দূর্বল হয়ে পড়ল যে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইলাম ঘরে।

আমাদের কাজের দিতি মাসি এসে দেখে চিৎকার করে সঙ্গে সঙ্গে রাজকে ফোন দিলেন। রাজ ছুটে এলো। আমায় কোলে তুলে বিছানায় রেখে মুখ ধরে বলল

– ” এই ইশা এই, একদম নাটক করবেনা। চোখ খোলো, খোলো বলছি চোখ। তুমি কি আমায় একদন্ড শান্তি দেবেনা..? আচ্ছা কেটো চুল হয়েছে। এবার ওঠো ”

আমি তখনও নিস্তেজ দেখে দিতি মাসি এবার বলে উঠলেন

– ” রাজবাবা ইশা মায়ের মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি জ্ঞান হারিয়েছে। এমনিও কয়দিন ধরেই শরীরটা খারাপ ছিল। তুমি এক্ষুণি ডাক্তার ডাকো হয়তো খুশির খবর হবে ”

রাজ আর কিছু না ভেবে ডক্টরকে ফোন করলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডক্তর এসে দেখে বলল ইমিডিয়েটলি যেনো হসপিটালে ভর্তি করা হয়। রাজ আর দিক বেদিক না দেখে দৌড়ালো ইশাকে নিয়ে হসপিটাল।
.
.
.
– ” আপনিই ওনার হাসবেন্ড..? ”

– ” ইয়েস ডক্টর, ওর জ্ঞান ফিরছেনা কেনো..? ”

– ” ইনজেকশন দিয়েছি। কিছুক্ষণ পরই ফিরে যাবে। কয়েকটা টেস্ট ওনার দ্রুত করা লাগবে। আপনি প্লিজ তার রিপোর্ট গুলো তাড়াতাড়ি করার চেষ্টা করুন ”

– ” ওকে ডক্তর ”

রাজ ক্লান্ত মুখ নিয়ে সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করে রিপোর্ট করে নিলো।
আমায় জ্ঞান ফেরার পরই কিছু টেস্ট করিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হলো।
রাজ রয়ে গেল সেখানে। ভিতরের ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে একটু বেশি তাড়াতাড়িই করে ফেলল বৈকি সে রিপোর্ট গুলো। এমনিও রাজের টেনশনে মাথা কাজ করছেনা। কেনো যে তখন অসুস্থতাকে নাটক ভেবে উড়িয়ে দিলো সেই ভাবনাই কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে তাকে। রিপোর্ট গুলো নিয়ে ডক্টরের কাছে যেতেই তিনি কিছুক্ষণ তা দেখে চুপচাপ বসে বললেন

– ” মিস্টার রাজ, যা বলছি তা মন শক্ত করে শুনবেন। মনে রাখবেন আপনিই পারবেন তাকে এইজয়গা দিয়ে বের করে আনতে”

রাজ আগেই বুঝতে পেরেছিল এতো রিপোর্ট দেখে। তাই এবার আর বেশি অবাক হলো না। তবে আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠলো ক্ষণে ক্ষণে। তাও নিজের মনকে শক্ত করে বলল

– ” আপনি বলতে পারেন ”

– ” ওনার গলব্লাডারে ক্যান্সার ধরা পড়েছে ”

রাজের চোখ ঘোলা হয়ে এলো। বারবার ঢোঁক গিললো। বারবার মন চাইলো এটা একটা স্বপ্ন হোক। ইশার সাজানো কোনো নাটক হোক আবার। এবার সত্যি সে ইশাকে আর বকবে না।

– ” মিস্টার রাজ আপনি ভেঙে পড়বেন না। বেশি দেরি এখনও হয়নি। ট্রিটমেন্ট শুরু করার পরামর্শ দিচ্ছি দ্রুত। তার আগে ঠাণ্ডা মাথায় আপনি তাকে বোঝান। আমি ভর্তির ডেট লিখে দিচ্ছি। ”

– ” ওকে ডক্টর ”

_____________________________

আমি ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। রাজ সেই যে আমায় বাড়ি পাঠিয়ে দিলো গাড়িতে তারপর তার আর পাত্তাই নেই। এখন বাজে রাত একটা। এখনও বাড়ি আসলনা..? কই সে একটা ফোন করি তো।

ফোন করতেই তার রিংটোন মেইন ডোরের সামনে বেজে উঠলো। আমি ফোন কেটে দৌড়ে গেলাম সেখানে।

– ” কিগো আজ এতো দেরি হলো..? রিপোর্ট গুলো কবে দেবে বললো কিছু..?”

রাজ আমার দিকে মলিন চোখে তাকালো। তারপর জুতো খুলে বলল

–” হুম, খেতে দাও। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি”

আমি আর কথা না বাড়িয়ে খেতে দিলাম। রাজ এসে বসে খাওয়ার সময় আমার মুখেও তুলে দিলো দু-য়েক লোকমা। আমি হাসলাম, এই স্বভাবটা শত বলেও আমি তার শোধরাতে পারিনি। খাওয়ার সময় সে নিজের পাত থেকে একটু আমার মুখে তুলে দেবই যতোই আমার পেট ভরা থাকুক। এখন আমিও বারণ করিনা আর আমার অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে এগুলো।
.
.
.
বাসন গুছিয়ে বেডরুমে যেতেই দেখলাম রাজ এক হাত কপালে ভাঁজ করে শুয়ে আছে। আমার ভালো ঠেকলো না এটা। কারন এমন ভাবে ও তখনই শোয় যখন সে খুব চিন্তিত কোনো বিষয়ে। কিন্তু যাই হোক সে আমায় আগে খুলে বলে। তাতে নাকি তার মন হালকা হয় তাহলে আজ কি হলো..?

আমি ডিম লাইটটা শুধু জেলে রাজের দিকে একহাতে ভর দিয়ে কাত হয়ে শুয়ে রাজের মাথায় হাত বুলাতেই রাজ চোখ খুললো। অস্পষ্ট আলোতেও আমি তার চোখে ভয় দেখলাম। কিন্তু তার আবার কিসের ভয়..?

আমার কিছু বলার আগেই রাজ পাশ ফিরে আমায় নিজের কাছে টেনে নিয়ে আমার বুকে মুখ গুঁজে শুয়ে রইলো। আমি বেশ অবাক হলাম। রাজের মাথায় অনবরত হাত বুলাতে বুলাতে আদুরে গলায় বললাম

– ” রাজ কি হয়েছে..? আমাকে বলো। তোমায় এত অশান্ত দেখাচ্ছে কেনো..? আমার কিন্তু ভালো লাগছে না দেখো। ”

রাজ এবার মাথা তুললো। আমায় পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে নিজে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ের কাছে মুখ ঘষতেই আমি খিলখিল করে হেসে উঠলাম। রাজ পুনরায় একই কাজ করলো। আমি আরোও করে হেসে বললাম

– ” আমার সুরসুরি লাগছে রাজ ছাড়ো বলছি ”

রাজ এবার নিজে মুচকি হেসে মিলন কন্ঠে বলল

– ” আমার ঘরের লক্ষী তুমি। তোমায় ছেড়ে দিলে তো আমি নিজেই ছন্নছাড়া হয়ে যাবো। তুমি ছাড়া আর আপন আছেই বা কে বলোতো আমার। আমার যে সব তোমাতেই শুরু, তোমাতেই শেষ। ”

রাজের কথাগুলো আমার কানে বড্ড ঠেকলো যেনো আজ। আমি জানি রাজের বাবা – মা কেউই নেই। এক বড়ো ভাই ছিল, সেও সম্পত্তির লাভে যোগাযোগ রাখে না রাজের সাথে। অথচ রাজের নিজেরই যথেষ্ট আছে তার থেকে। কোনোদিন সে দাবিও রাখেনি সম্পত্তির। প্রকৃতপক্ষেই তার আমি ছাড়া আপন কেউ নেই। কিন্তু আজ একথা বলার কারণ..? রাজ তো এতো ইমোশনালি কোনোদিনও কিছু বলে না। সে নিজেকে সবসময় শক্ত মানব হিসেবেই জাহির করে। আমি এবার সিরিয়াস হলাম

– ” কি হয়েছে রাজ..? এমন করে কেনো বলছো বলোতো..? যেনো আমি কোথাও চলে যাচ্ছি ”

রাজের আমার মাথাটা নিজের বুকের সাথে লাগিয়ে নিল সঙ্গে সঙ্গে।

– ” কোথাও যাচ্ছ না তুমি। তুমি আমার সাথেই থাকবে সারাজীবন। আমি বিনা মুক্তি নেই তোমার ”

– ” রিপোর্টে কি আছে..? ”

রাজ বোধ্হয় চমকালো খানিক। তারপর ধীর গলায় বলল

– ” যাই থাকুক। তুমি দ্রুত সুস্থ্ হয়ে যাবে। ”

– ” আমি জানতে চেয়েছি রাজ ”

রাজ কিছুক্ষণ চুপ করে গেলো। তারপর শান্ত গলায় বলল

– ” গলব্লাডার ক্যান্সার ”

আমার নিজের কানকে বিশ্বাস হলো না। আমার বরাবরই ভীতি এইসবে। দাদুকে যখন ছোটবেলায় ক্যান্সারে মারা যেতে দেখলাম ঠিক তখন থেকেই। সেই ভীতি যে আজ আমার উপর এসেই বর্তাবে তা গুণাক্ষরেও টের পাইনি আমি।
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম

– ” আমার বেঁচে থাকার মেয়াদ কতদিন তাহলে..? ”

রাজ আরও শক্ত করে আমায় আমায় জড়িয়ে ধরলো। কাতর কন্ঠে বলে উঠলো ” এই কথা আর মুখে আনবেনা তুমি ইশা। তেমন কিছুই হয়নি তোমার ডক্টর বলেছেন ট্রিটমেন্ট করতেই তুমি ঠিক হয়ে যাবে। তাই আমার আমার থেকে দূরে যাওয়ার কথা মাথাতেও আনবেনা। ”

আমি আর কিছু না বলে রাজকে জড়িয়ে ধরলাম। রাজের থেকে দূরে যাওয়ার ভয় আমায় চেপে ধরলো।

__________________________________

শুরু হলো আমার ট্রিটমেন্ট। আমায় নিয়ে গিয়ে রাখা হলো বাপের বাড়িতে। কারন ফ্ল্যাটে রাজ আমায় একা রেখে যেতে মোটেও রাজি না। বাড়ির লোক মা-বাবা দাদা সবাই আমার সুস্থ হওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা শুরু করলো। রাজ কাজ ছেড়ে সবসময় আসতে না পারলেও কষ্ট করে কাজের শেষেই ছুটে আসত আমার কাছে।

ট্রিটমেন্ট চলাকালীন আর কেমোথেরাপির আমার ওঢেল সৌন্দর্যে ভাটা পড়ল। ওজন চর চর করে তো কমলোই সাথে চোখের নীচে জমলো ডার্ক সার্কেলস। চুল পড়ার কথা তো বাদই দিলাম। রোজ চুলে হাত দিলেই এক মুঠো চুল উঠে হাতে চলে আসতো। আমি বিষন্নতায় ডুবে যেতে লাগলাম ধীরে ধীরে। আমার শুধু মনে হতে লাগলো রাজ আমায় আর নিজের কাছে রাখবে না। আর রাখলেও দয়া করে। কেনো রাখবে সে আমার মতো অসুস্থ, অসুন্দর এক বোঝাকে।

রাজ এলো বিকেলে। দেখেই বোঝা গেলো কতটা ক্লান্ত সে। এসে বসলোও না। আমায় নিয়ে ছুটলো হসপিটাল চেকাপে। আমি পুতুলের মত গেলাম তার সাথে। ডক্টর চেকাপ করে আমায় বাইরে বসতে বললেন। আমায় রাজ বাইরে বসিয়ে নিজে ভিতরে গেলো।

– ” ডক্টর আমার ইশা ভালো হয়ে যাবে তো..? ”

– ” দেখুন, ভালো হওয়ার চান্স আছে আমি আপনাকে আগেও বলেছি। কিন্তু ওর যা অবস্থা দেখলাম ও মানসিক ভাবে প্রচন্ড ডিপ্রেসড। এবার পেশেন্টের নিজেরই যদি বাঁচার ইচ্ছে না থাকে তাহলে আমাদের কোনো ওষুধই কোনো কাজে আসবেনা। আপনি আশা করি বুঝতে পেরেছেন”

রাজ ঘাড় নাড়ল। আসলেই তো, সে ইশার অসুস্থতার পর শুধু তার যত্ন হসপিটালে নিয়ে আসা টাইমে টাইমে তার খাবার ওষুধ পত্রের খোঁজ নিয়েছে। তার মনের খোঁজ তো নেয়নি। তার নিজের দোষে যদি সে ইশাকে হারিয়ে ফেলে তাহলে তারও যে আর বেঁচে থাকা হবে না।

– ” মিস্টার রাজ, আপনি বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ মানুষ। আসা করি আমার কথার অর্থ বুঝেছেন। এই সময় আপনার স্ত্রীয়ের সাইকিয়াট্রিস্টের থেকেও বেশি আপনার পাশে থাকা বেশি কাজে লাগবে। ”

রাজ দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে টুকটাক কথা বলে আমায় নিয়ে চলে এলো বাড়ি।
.
.
.

– ” দেখো তোমার জন্য কি এনেছি। আজ ছাড় তোমার নাও। যা খুশি খেতে পারো। ”

আমি রাজের হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে আবার মুখ নীচু করে নিলাম। যেমন বসে ছিলাম তেমনই বসে রইলাম।

রাজ হতাশার দৃষ্টি দিয়ে আমায় দেখল। তারপর বিছানায় বসতেই চারিদিকে চুল আর চুল নজরে এলো তার। রাজ উঠে গিয়ে খবরের কাগজ চেয়ার নিয়ে বাথরুমের আয়নায় সামনে রাখলো। তারপর কোনো কথা ছাড়াই আমায় কোলে তুলে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিলো চেয়ারে।

আমি এতক্ষণে বুঝলাম কি হতে যাচ্ছে আমার সাথে। আমার মাথায় বাঁধা রুমালে হাত দিয়ে আর্তনাদ করে উঠলাম

– ” না আমি চুল কাটবো না। কাটবে না তুমি আমার চুল। যাও যাও বলছি এখান থেকে। ”

আমার চেঁচামেচি শুনে সবাই দৌড়ে এলো আমার রুমে। তারপর রাজের ইশারাতে আবার বেরিয়েও গেলো। কিন্তু আমার মাথা কাজ করছেনা। অস্থির হয়ে উঠছি আমি। পাগলের মত লাগছে নিজেকে। শুধু মনে হচ্ছে রাজ আমায় আর ভালোবাসবেনা। আর কাছে টানবে না আগের মতো। আর চুলে মুখ ডুবিয়ে বসে থাকবে না ঘণ্টার পর ঘন্টা। এখন যে আমার কিছুই নেই সৌন্দর্য বলতে।

রাজ আমার গালের পাশে দুই হাত দিয়ে ধরে ধীরে ধীরে আমার মাথায় চোখের পাতায় চুমু খেলো। আমি শান্ত হয়ে এলাম এবার। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো জল। রাজ সযত্নে তা মুছে আমার মুখোমুখি হয়ে বসে বললো

– ” ইশা, তোমার এমন কেনো মনে হচ্ছে তোমার সৌন্দর্যের জন্য আমি তোমায় এত ভালবাসি..? তোমার #কেশের_মায়া অবশ্যই ছিল আমার।কিন্তু তা যে তোমার থেকে বেশি নয়। বৃদ্ধ বয়সে যে দুজনেরই এই সৌন্দর্য রূপ এমনিই মলিন হয়ে আসবে। তাই এসবের কোনোটাই আমার ভালোবাসা বিন্দু পরিমাণ কমাতে পারবেনা। আর বাকি রইলো তোমার ওই লম্বা চুল। সে আমরা আবার ফিরে পাবো নিশ্চই, যদি তাও না পাই তাহলে নাই। কিন্তু তোমাকে আমি কোনমতেই নিজের থেকে দূরে যেতে দেবোনা এই কারণে। তুমি নিজেও জানো তুমি আমার জন্যে কি। সো প্লিজ ইশা… আমার সাথে কোয়াপরেট করো। তোমার সুস্থ হওয়ার পর যত রাগ হয় দেখিও আমি আর কোনো বকাবকি করবো না। ”

আমি এবার হু হু করে কেঁদে ফেললাম। তবে আর বাঁধা দিলাম না। রাজ আমার মাথাটা নিজের সাথে চেপেই আমার সমস্ত চুল রেজার দিয়ে ফেলে দিলো। ভাগ্য কি অদ্ভুত খেলা খেলে তাই না..? যেই চুল কাটার জন্য আমি শত শত বায়না নাটক করতাম সেই আমিই আজ চুল কাটতে চাইছি না। আর যে আমার হাফ ইঞ্চি চুল কাটা নিয়ে সারা বাড়ি মাথায় উঠিয়ে ফেলতো সে কি সানন্দে আমার চুল সব ফেলে দিচ্ছে। যদিও আমি নিজেও জানি এতে আমার চেয়ে বেশি হয়তো রাজই কষ্ট পাচ্ছে। শুধু আমি ভেঙে পড়ব বলে দেখাচ্ছেনা।

– ” দেখো তো আমার বউ টাকে এখন কত্ত মিষ্টি লাগছে”

আমি আয়নায় চোখ তুলে তাকাতেই রাজ হেসে রেজার নিজের চুলেও চালিয়ে দিল। আমি এবার এতটাই অবাক হলাম যে মুখ দিয়ে আর কথা বেরোলো না। মাথায় কথাটা নাড়াচাড়া দিতেই চেঁচিয়ে উঠলাম আমি

– ” এ কি করলে রাজ..? পাগল হলে নাকি..?”

রাজ মুচকি হাসলো। তারপর নিজের সম্পূর্ণ চুল ফেলে বলল

– ” হ্যাঁ পাগলই বটে তোমার প্রেমে। তবে তুমি যদি নিজের #কেশের_মায়া ত্যাগ করতে পারো তবে আমি কেনো না..? ”

আমি চেয়ার থেকে উঠে রাজকে জড়িয়ে ধরে পুনরায় হু হু করে কেঁদে উঠলাম। রাজ আমায় জড়িয়ে ধরে পকেট থেকে দুটো টুপি বার করে বলল

– ” নাও লালটা তোমার নীলটা আমার ”

রাজের বলার ধরন দেখে আমি ফিক করে হেসে ফেললাম। রাজ এবার আমার চোখ ভালো করে মুছিয়ে আমায় কোলে তুলে নিয়ে বলল

– ” এসব ছাড়ো। আসল কথা বলো, এইকটা দিন আদর কম পড়েছে বলে ম্যাডামের মন খারাপ”

আমি এবার খানিক লজ্জা পেয়ে রাজের বুকে মুখ লুকিয়ে বললাম

– ” হ্যাঁ তাই ”

রাজ হেসে আমায় নিয়ে বেডের দিকে অগ্রসর হলো।

_________________________________

সেই অভিশপ্ত সময় কেটে গেছে প্রায় পাঁচ বছর। এখন ডক্টরের কথামত আমি ফিট। তাই বেবি প্লানিং করতে পারি। কিন্তু ডক্টরের বলার আগেই যে আমি টের পেয়েছি আমার ভিতর নতুন প্রাণের। আপাতত ডক্টর আর রাজের কড়া রুটিনে বাঁধা আমি।

রাজের বোঝানোয় ধীরে ধীরে আমি সেই ডিপ্রেশন থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। প্রেগন্যান্সির পর যেনো আবার আমি আগের সৌন্দর্য ফিরে পেয়েছি। সব কিছু আগের মতো হলেও শুধু আমার চুলটাই আগের মতো ওতো বড়ো হয়নি। সেটা পিঠ পর্যন্তই রয়েছে। তবে এতে রাজের আর কোনো আফসোস দেখিনা আমি। সে আগের মতোই এখনও সময় পেলেই আমার চুলের যত্ন নেয়। আমি সত্যিই ধন্য এই মানুষটাকে এই জীবনে পেয়ে।

এইভাবেই কেটে গেছে গোটা নয় মাস ছয় দিন। আমার ডেলিভারির ডেট কাল বাদ পরশু। কিন্তু আমি ভালোই বুঝতে পারছি অতটা আর দিন গুনতে হবে না বোধহয়। আমার ধারণা সত্যি করে আমার লিভার পেইন উঠলো বিকেলেই। আমি বাপের বাড়িতেই ছিলাম বিগত দুই মাস। তাই মা বাবা দাদা সবাই গেলো আমার সাথে হসপিটালে। রাজকে দেখলাম না আমি। হয়তো খবর পেয়ে সেও রাস্তায় আছে। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছে। আমি কষ্টে চোখ বোধ করে নিলাম।

চোখ পিট পিট করতেই দেখলাম রাজ হাসি মুখে একটা ছোট্ট প্রাণ কোলে নিয়ে আমার দিকে হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। আমি হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকতেই রাজ সেই ছোট্ট প্রাণকে আমার হাতে দিতে দিতে বললো

– “দেখো ইশা আমার মেয়ের কত্ত সুন্দর চুল হয়েছে”

আমি হাসলাম। আদর করে দিলাম আমার মেয়েকে। আসলেই মেয়েটার চুল গুলো সাধারণের তুলনায় একটু বড়োই হয়েছে। রাজ চুমু আঁকলো আমাদের মা মেয়ে দুজনেরই কপালে। আমি তার পিঠে গা এলিয়ে বসলাম। তারপর দুজনেই মেয়েকে নিয়ে কথাবার্তায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

জীবন সুন্দর আমি আজ আবার উপলব্ধি করলাম। আমি আগে ভাবতাম রাজের শুধু আমার #কেশের_মায়া- ই আছে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। তার যে আমার প্রতি তার চেয়েও দ্বিগুণ অশেষ মায়া আর ভালোবাসা আছে। আর কি চাই জীবনে..? এভাবেই কেটে যাক আমাদের সুখের সংসার।

_________________সমাপ্ত_________________

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে