কেউ কথা রাখেনি পর্ব-০১

0
1684

#সূচনা_পর্ব
#কেউ_কথা_রাখেনি
#নিঝুম_জামান

যখন ক্লাস নাইনে পড়ি তখন বাবা-মায়ের সম্মানের কথা না ভেবে প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়ে চলে আসি। তখন কল্পনাও করি নি এর পরবর্তী ফলাফল যে আমার জীবনটাকে নরকতুল্য করে তুলবে।

নাইনে পড়ি বয়স আর কতই বা পনেরো কিংবা ষোলো! চোখে তখন হাজারো রঙিন স্বপ্ন! আবেগের বশে ভালো- মন্দ কিছুই চিন্তা করে নিজের সুখের আশায় আরাফের সাথে পালিয়ে যাই।
পালিয়ে যাওয়ার দুইদিন পরে বাবা-মা আমাকে পুলিশের মাধ্যমে খুঁজে নিয়ে আসে। বাড়িতে এনে আমাকে মা অনেক মারে; কিন্তু মারলে আর কি হবে! মান-সম্মান যা নষ্ট হওয়ার তা তো হয়েই গিয়েছে।পুরো এলাকায়, বিশেষ করে চায়ের দোকানগুলোতে আমাকে নিয়ে খবর-বৈঠক চলতো।
আমাদের বাড়িতে দুই পরিবারের মধ্যে বিচার-শালিশ ডাকা হয়। বিচারে আমার বাবা- মা আমাকে আরাফের কাছে দিতে চায় নি। তারা আমাকে আরাফের কাছ থেকে নিয়ে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি ভীষণ জেদ করেছিলাম। বলেছিলাম আরাফকে না পেলে আমি বি/ষ খাব।
আমার জেদের কাছে হেরে বাবা-মা আমাকে আরাফের হাতে তুলে দিলো। আমার মা তখন কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল,

“জীবনে অনেক ভুল করলি রে মিথি!! খোঁজ নিয়ে জেনেছি আরাফ মোটেও ভালো ছেলে না। বখাটে টাইপের ছেলে। তবে মা হিসেবে তোকে দোয়া করে দিচ্ছি, জীবনে যাতে সুখী হস।”

মায়ের কথাগুলো সেদিন শুনতে আমার বিরক্ত আর অসহ্য লাগছিল। মনে হচ্ছিল মা দুই লাইন বেশি বোঝে।
.
.
বাবা-মায়ের মতামতের মূল্য না দিয়ে শ্বশুরবাড়িতে নতুন সংসার বাঁধার আশায় পা রাখি।
শ্বশুরবাড়ির কেউই আমাকে দুইচোখে দেখতে পারত না। একমাত্র আমার হাজবেন্ড আরাফ ছাড়া। আরাফ ছিল বেকার। যার কারণে উঠতে-বসতে সকলের কথা শুনতে হতো। বাড়ির সবকাজ আমাকে দিয়ে করাতো। বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে হওয়ায় জীবনে নিজের কোনো কাজই করি নি। সেই আমি প্রতিদিন ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে ঘরের রান্না থেকে শুরু করে সব কাজ করতাম। বাসন মাজা, পরিবারের সব সদস্যর কাপড় ধোয়া, ঘর মোছা ; এককথায় বলতে গেলে বাড়ির চব্বিশ ঘণ্টার কাজের বুয়া। যখন একটু অবসর পেতাম তখন একটু বিশ্রাম নিতে গেলে শ্বাশুড়ি চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিত। তার সাথে ইন্ধন যোগাতো আমার ছোট ননদ তুলি। আর সংসারে শ্বশুর ছিল কাঠের পুতুল।শ্বাশুড়ি কথাই ছিল আসল কথা,তার মুখের ওপর কেউ কথা বলার সাহস পেত না।
.
আরাফ সারাদিন টো-টো করে ঘুরে বেড়াতো। কিন্তু এভাবে তো আর চলে না। পড়াশোনা করে নি আরাফ। ম্যাট্রিকে ফেল করার পর পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিল। ওকে বললাম কোনো দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ নিতে। আমার কথা শুনে আরাফ আট হাজার টাকার বেতনে দোকানে কাজ নেয়। দোকানে কর্মচারী হিসেবে খাটবে একথা শুনে শ্বাশুড়ি তো আমার ওপর রেগে আগুন। তার ছেলে হয়ে অন্যের দোকানে কর্মচারী খাটবে, ব্যাপারটা তার মানসম্মানে লাগে। লোকে কি বলবে?

আমি তখন সাহস করে উত্তর দেই যে, বেকার বসে থাকার চেয়ে দু’টাকা উপার্জন করা ভালো।

আমার কথা শুনে শ্বাশুড়ির মুখে যত খারাপ কথা আছে সব আমাকে শোনায়। বাবা-মা তুলে গালিগালাজ করে। মনে মনে অনেক খারাপ লাগছিল কিন্তু এত গালি শোনার পরও আমি কোন প্রতিবাদ করতে পারি নি। ছোটবেলা থেকেই আমি চাপা স্বভাবের। কাউকে কিছু বলতাম না। ছোটবেলায় খেলতে গিয়ে দোষ না থাকা সত্ত্বেও মার খেয়ে আসতাম। আবার আমাকে কেউ হাজারকথা শুনিয়ে দিলেও আমি কোন উত্তর দিতাম না। এখনো কেউ কিছু বললে তার প্রতিবাদ করতে পারি না। শুধু নিজেকে এককথা বলে সান্ত্বনা দেই,
” একচুপ শত সুখ।”
.
এর মাঝে অনেকদিন কেটে গেছে।একদিন হঠাৎ শ্বাশুড়ি আমাকে ডেকে বলেন,
— মিথিলা মা আমার, এদিকে আয়। তোর সাথে কিছু কথা আছে।

শ্বাশুড়ির মুখে ‘মা’ ডাক শুনে সপ্তাশ্চর্য হয়ে গেলাম। এবাড়িতে আসার পর থেকে তিনি কোনোদিন ভালো করে ডাক দিয়ে দেখেন নি, সারাক্ষন ঝাড়ির ওপর রাখতো। আজ তিনিই কিনা ‘মা’ বলে সম্বোধন করছেন। আমি তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলাম তার দিকে। আমি আমাকে সোফায় তার পাশে বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

— দেখ.. আরাফ যদি অন্যের দোকানে কর্মচারী খাটে, তাহলে ব্যাপারটা আমাদের জন্য কেমন অসম্মানের দেখায় না? তার চেয়ে তুই এক কাজ কর তোর বাপের বাড়ি কিছু টাকা নিয়ে আয় সেই টাকা দিয়ে আরাফ ব্যবসা করবে না হয় বিদেশে চলে যাবে।

আমি কিছু টাকার কথা শুনে আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম,

–কিছু টাকা বলতে আসলে কত টাকা আম্মা?

–এই ধর, পাঁচ-সাত লাখ টাকা। তোর বাপের তো টাকা-পয়সার কমতি নেই। একটাই মেয়ের জামাই,তাকে দিবে না তো কাকে দিবে?

ওনার কথা শুনে আমার মাথা রীতিমতো ঘোরাচ্ছে।
পাঁচ-সাত টাকা নাকি কিছু টাকা মনে হয়। তবে বাবা-মায়ের কাছে আবদার করলে না দিবে এমন না কিন্তু আমি টাকা চাইব কোন মুখে? তাদের কথার তোয়াক্কা না করে আরাফের সাথে চলে এসেছি, এখন টাকা চাইতেও তো লজ্জা লাগবে।

–কিরে মা? কিছু বলবি না।

আরাফের মায়ের এমন মধুর সুরের কথা শুনে মিথিলা বলল,

–আচ্ছা, আম্মা আমি ভেবে দেখব।

মিথিলার এমন অনিশ্চিত কথা শুনে আরাফের মায়ের ভালো লাগলো না। মিথিলার আড়ালে মুখ ভেংচি কাটলো।
.
.
.
বিয়ের পরে এই প্রথম আমাদের বাড়ি গেলাম। আমার মা আমাকে দেখে আমাকে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না! মায়ের কান্না দেখে আমিও কেঁদে দিই।
মা আমার গালে-মুখে চুমু দিতে দিতে ভরিয়ে ফেলে।তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করে,

— শ্বশুরবাড়িতে ভালো আছিস তো মিথি? তোকে সবাই ভালোবাসে তো?

আমি কি উত্তর দিব ভেবে পাচ্ছি না। আরাফ ছাড়া কেউ আমার সাথে ভালো ব্যবহার করে না। সকলে ঝাড়ির ওপরে রাখে। বাড়িতে থাকতে আমাকে খারাপ ব্যবহার তো দূরে থাক, কেউ কোনোদিন গলা উচু করে একটা ধমকও দেয় নি। সেই আমার সাথে শ্বশুরবাড়িতে কি খারাপ ব্যবহার করে! তার একমাত্র কারন আমি পালিয়ে বিয়ে করেছি। মাকে চোখমুখ মুছে হাসি মুখে উত্তর দিলাম,

–হ্যাঁ, মা খুব আছি। তারা আমায় খুব ভা-ভালোবাসে।

মাকে মিথ্যা বললাম কারণ মা জানলে ওই বাড়িতে আমাকে আর যেতে দিবে না আর আমিও আরাফকে ছাড়া থাকতে পারব না। আমার এক কাজিন রীতি আপুকে বলতে শুনতাম, শ্বশুরবাড়িতে সবকিছু চুপচাপ মানিয়ে নিতে হয়। না হয় সংসারে অশান্তি হয়।

–তোর কথা বলার ধরণ শুনে বিশ্বাস হচ্ছে না মিথি।
তারপর মা নিজে নিজেই বিলাপ করে কেঁদে কেঁদে বলা শুরু করলো,

–তুই কেনো একাজটা করলি? কেনো পালিয়ে গেলি? তোর বয়সই বা কত? তুই সংসারের তো কিছুই বুঝিস না। আমি জানি ওরা আমার মেয়েটাকে ভালোবাসে না। কষ্ট দেয়, অনেক কষ্ট দেয়।

মায়ের কথা শুনে আমার চোখ বেয়ে নি:শব্দে পানি পড়তে লাগলো। সত্যিই পনেরো বছরের একটা ছোট মেয়ে আমি তার ওপর শ্বশুরবাড়িতে সবকাজ একা হাতে সামলাই।

–মিথি, তুই ঠিকমত পড়াশোনা করিস তো? নাকি সেটাও ছেড়ে দিয়েছিস?

–মা, আমি আরাফকে আমার পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলাম। ও বলেছে ওর মায়ের কথা-ই শেষ কথা। আমার শ্বাশুড়ি মা পড়তে দিতে চান না। তিনি বলেন, বাড়ির বউদের এতো পড়ে কি লাভ? বেশি পড়লে বউরা জামাইয়ের মুখের ওপরে কথা বলে। গুরুজনদের সম্মান করতে চায় না। যেখানে আরাফই স্কুলের পাঠ চুকাতে পারে নি সেখানে তার বউয়ের শিক্ষিত হলে ওকে দাম দিবে না।

আমি শ্বাশুড়ি আম্মাকে অনেক বোঝানোর ট্রাই করেছি । কিন্তু তিনি আমার পড়াশোনার ব্যাপারে কোন কথাই শুনতে চান না।

— ছিঃ তোর শ্বাশুড়ির মন-মানসিকতা এত নিচ! তারা মোটেও ভালো মানুষ না।
কিন্তু তোকে তো উচ্চ শিক্ষিত হতে হবে। তোর পায়ের তলার মাটি শক্ত করতে হবে। আমারও খুব ইচ্ছে ছিল নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। উচ্চ মাধ্যমিক দিয়ে ইউনিভার্সিটির প্রস্তুতি নেওয়ার আগেই আমার পরিবার বাধ্য করে বিয়ের পিঁড়ি বসতে। বিয়ের আগে তোর নানা আমাকে বলে বিয়ের পরে যত ইচ্ছে পড়িস তারা বলেছে তোকে পড়াবে। কিন্তু বিয়ের পরে তোর দাদীর সাথে পড়াশোনার ব্যপারে কথা বলতে গেলে তিনিও তোর শ্বাশুড়ির মত কথা বলেন।
জানিস মিথি আমার না খুব ইচ্ছে ছিল আমি পড়তে পারি নি তো কি হয়েছে! তোকে উচ্চ শিক্ষিত বানিয়ে সেই আশা পূরণ করব। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস!

কেঁদে কেঁদে কথাগুলো মা বললেন। মায়ের কথা শুনে আমার বুকের ভিতর মোচর দিয়ে উঠল। সত্যিই তো মেয়ে হিসেবে আমার উচিত ছিল মায়ের স্বপ্ন পূরণ করা। কিন্তু নিজের দেখা আবেগীয় রঙিন স্বপ্ন দেখে জীবনটাকে শেষ করে দিয়েছি, যার পরিণাম এখন ভোগ করছি। হয়ত বাবা-মায়ের অমতে বিয়ে করার শাস্তি পাচ্ছি আমি।
.
রাতে বাবা বাড়ি ফিরলে আমাকে দেখে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখে। আমি বাবা বলে গলা জড়িয়ে ধরতেই বাবার সব মান-অভিমান নিমিষেই চলে গেল। অনেকদিন পরে বাবা-মা এবং ছোট ভাইয়ের সাথে রাতের খাবার খেলাম।
.
পরদিন মায়ের সাথে আমি স্কুলে যাই। মা স্কুলের আগের বেতন পরিশোধ করে স্যার-ম্যাডামদের সাথে আমার পড়াশোনার কথা বলে যাতে আমি রেগুলার স্কুলে যেতে না পারলেও যাতে তারা আমাকে পরীক্ষা দিতে দেয়; আরো অনেক কথাবার্তা বলে। বাড়ি এসে আমার নিজেকে অনেক হালকা লাগে, অন্তত এতদিনে মায়ের একটা স্বপ্ন পূরণ করার লক্ষ্যে নেমেছি।
বাড়ি আসার দুইদিন পরে মাকে কথায় কথায় শ্বাশুড়ির টাকা চাওয়ার ব্যাপারটা খুলে বলি। আমার কথা শুনে মা কিছুক্ষন আমার মুখের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। তারপর আমাকে বলে বাবা বাড়ি ফিরলে মা এ নিয়ে কথা বলবেন। বাবার সাথে মা এ ব্যাপারে কথা বললে বাবা কিছু বলে না। আমি ভেবেছি হয়ত বাবা টাকা দিবে না, কিন্তু শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় বাবার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় বাবা আলমারি খুলে আমার হাতে আড়াই লাখ টাকা দিয়ে বলে,

–“আরাফকে বলিস এ টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করতে। অযথা খরচ করিস না। তোর বিয়ের জন্য টাকাগুলো জমানো শুরু করেছিলাম ব্যাংকে। ”

বাবাও আমার বিয়ে নিয়ে হয়ত অনেক স্বপ্ন দেখছিল। কিন্তু আমি কি কাজটা করেছি? নিজের কাছেই নিজেকে অনেক ছোট মনে হচ্ছে। বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম তারপর সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। আমার শ্বশুরবাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে বেশি দূরে না। রিকশা দিয়ে যেতে আধাঘন্টার মতো সময় লাগে। আমি একাই বাপের বাড়ি গিয়েছিলাম এখন একাই ফিরছি, শ্বশুরবাড়ির কেউ আমার সাথে যায় নি। এমনকি আরাফও না। কারণ আমাদের বাড়ির সাথে শ্বশুরবাড়ির সম্পর্ক খুব একটা ভালো না।
শ্বশুরবাড়ি ফিরে শ্বাশুড়ির হাতে টাকা দিয়ে বললাম,

— এই নিন টাকা আম্মা। বাবা বলেছে এই টাকা দিয়ে আরাফকে ব্যবসা করতে, অযথা খরচ করতে নিষেধ করেছে।

আমার হাতে টাকাগুলো দেখে শ্বাশুড়ির চোখে-মুখে হাসির ঝলক দেখা গেল। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

–যাও মা, হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে হয়ে নাও। তুমি আজকে কি খাবে সেটা আগে বলো?

শ্বাশুড়ি আম্মার কথা শুনে আমি এক মুহূর্তে কথা হারিয়ে ফেললাম। আমাকে মা বলে সম্বোধন করছে, তার ওপর আবার আমি কি খাব? সেটা জানতে চাইছে।একটা মানুষ কীভাবে এতো পরিবর্তন হয়ে গেল? আমি একটা মুচকি হাসি দিয়ে রুমে চলে এলাম।
.
রাতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো আরাফ মার্কেটে একটা দোকান ভাড়া নিয়ে সেখানে কসমেটিকসের বিজনেস করবে। তবে শ্বাশুড়ি আম্মা আকারে-ইঙ্গিতে আমাকে বারবার আরো বেশি টাকা এনে দেওয়ার কথা বলছিল। আমি সব বুঝেও না বোঝার ভান করে রইলাম।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে