টং দোকানে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তেই ঝমঝমিয়ে আকাশ থেকে বৃষ্টি নেমে এলো। একটু আগেও আকাশে গোমরা মুখের মেঘ গুলোকে ঝুলে থাকতে দেখেছিলাম। এতো তাড়াতাড়ি ওরা মান অভিমান ভেঙ্গে নেমে আসবে ভাবিনি। আজ রাস্তাঘাটও প্রায় ফাঁকাফাঁকা। মানুষ জন সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফিরে গেছে। টং দোকান গুলোও ফাঁকা পরে আছে। দ্রুত চায়ের কাপ হাতে ছাউনির নিচে গিয়ে দাঁড়ালাম।
সিগারেট শেষ হলেই ভিজতে নামবো। আজ মনটা কেমন যেন শুষ্ক হয়ে আছে। এক পশলা বৃষ্টির জলে মনটা ভেজানো খুব প্রয়োজন। ছোট টং দোকানের ছাউনির নিচে দুই জন কাস্টমার দাঁড়িয়ে আছি। টিনের ছাউনির উপরে রিমঝিম বৃষ্টির শব্দ। হুট করে নূপুরের শব্দ তুলে কোথা থেকে একটা মেয়ে দৌড়ে এসে ছাউনির নিচে দাঁড়ালো। খুব চেনা চেনা নূপুরের শব্দটা। একটু সাইডে চলে গেলাম। মেয়েটা পাজামা থেকে কাদার ছিটা ঝাড়ছে। ওড়না দিয়ে কপাল মুখ মুছে নিচ্ছে। আমার হাতের সিগারেটের দিকে এক পৃথিবী ঘৃণা নিয়ে তাকিয়ে নাকে ওড়না চাপা দিলো। মেয়েটার ঘৃণাটাও খুব চেনা চেনা লাগছে।
সিগারেট ফেলে দিবো কিনা ভাবছি। বেচারির হয়তো অন্যসব মেয়েদের মতোই সিগারেটের গন্ধ সহ্য হয় না। মেয়েদের আর কি দোষ আমার নিজেরই তো সহ্য হয় না। অন্য কেউ সিগারেটের ধোঁয়া উগড়ে দিলে গন্ধে আমার মাথা ধরে। মেয়েটা আরো দুইবার আড় চোখে তাকালো। আমি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছি একটা ভিন্ন কারণে। এই মেয়েটাকে আমি চিনি। হঠাৎ করেই চিনতে পেরেছি।
গতকালই স্বপ্নে আমাদের দেখা হয়েছিলো। এই যে এতোক্ষণ ধরে যা হচ্ছে সবই আমি স্বপ্নে দেখেছি। এরপরে কি হবে আমি তাও জানি। আমি মেয়েটাকে জিজ্ঞাস করবো আপনার নাম কি সামান্তা। মেয়েটা অবাক হয়ে মুখ থেকে ওড়না নামাতে নামাতে বলবে, “হ্যাঁ!” আমি এরপরে আর কিছু না বলেই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে রাস্তায় নেমে পরবো। অনেকটা এগোনোর পরে একটা রিক্সা এসে থামবে আমার পাশে। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখবো মেয়েটা। ও আমায় ডাক দিয়ে বলবে, “এই যে উঠে আসো। চল রিক্সায় করে ভিজি।” বলেই মেয়েটা আমায় জায়গা করে দিবে বসার জন্য। আমি মেয়েটার পাশে বসবো। মেয়েটা চোখ বন্ধ করে গান ধরবে, “আজি ঝর ঝর মুখরো বাদল দিনে…।”
সবই আমি স্পস্ট দেখতে পাচ্ছি। আমার সব মনে পরে যাচ্ছে একের পর এক। পুরো স্বপ্নটাই সেলুলয়েড ফিতায় দেখতে পাচ্ছি বাস্তবে। একটা ঘোরে চলে যাচ্ছি আমি। স্বপ্ন আর বাস্তবের দোলায় দুলছি। টং দোকানের চাচাকে চা সিগারেটের বিল দিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরালাম। খুব সংকোচে মেয়েটার পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাস করলাম।
“আ… আপনি কি সামান্তা!”
মেয়েটা অবাক না হয়ে চোখ দিয়ে আরো ঘৃণা ঢেলে দিয়ে মুখের উপর থেকে ওড়না না সরিয়েই বলল, “না।” আমি আর কথা খুঁজে পেলাম না। সিগারেটে লম্বা টান দিয়েই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে রাস্তায় নেমে পরলাম। আমার মন বলছে মেয়েটা মিথ্যা বলছে। আমার স্বপ্ন ভুল নয়। মেয়েটা অবশ্যই মিথ্যা বলছে। হয়তো যাচাই করে নিচ্ছে, মেয়েটা যে কাল আমার স্বপ্নে এসেছিলো সেই আমি এই আমি কিনা।
আমি জানি সামান্তা ঠিক ঠিক আসবে। একটু পরেই রিক্সায় চেপে আমার পাশে এসে রিক্সা দাঁড় করাবে। আমি হাঁটছি। গাছের পাতায় বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ। রাস্তায় কিছু কিছু জায়গায় পানি জমে আছে। আমি সেই পানির উপরে পা ফেলে এগুচ্ছি। পানির ছলছলাৎ শব্দে কেমন এক মাদলতা। বুকের ভিতরটা কেমন যেন করছে। হাহাকার নাকি উত্তেজনা বুঝতে পারছি না। কিন্তু ফাঁকাফাঁকা লাগছে।
স্বপ্নে সামান্তা গান গাইতে গাইতে আমার হাতটা ধরে বলেছিল, “এতো দেরি করে এলে কেন!” আমার স্পস্ট মনে আছে। সামান্তার চোখে পানি ছল ছল করছিলো। আমি এক হাত দিয়ে চোখ মুছে দিয়ে ওর হাতটা আরো শক্ত করে চেপে ধরে বলেছিলাম, “এলাম তো। তোমার কাছেই এলাম।” ও আমার আরো কাছ ঘেঁষে বসলো। ওর কোমর জড়িয়ে ধরলাম। আমার কাঁধে মাথা রেখে আবার গান ধরলো। আমি গানের সুরে বিলীন হতে লাগলাম। আকাশ ফুটো হয়ে সব বৃষ্টি যেন আমাদের উপরে ঝরছে। হঠাৎ গান থামিয়ে সামান্তা আমার গালে হাত রেখে ওর দিকে ফেরালো আমায়। ওর ঠোঁট কাঁপছে। কি যেন বলতে চায়।
“কিছু বলবে সামান্তা?”
“কিছু না। তুমি চলে যাবে নাতো!”
“কোথায় যাবো? এই যে দেখো তোমার হয়ে আছি।”
“তুমি সব সময় চলে যাও। শুধু বৃষ্টি এলে আসো। কেন আমার বুকটা জুড়ে থাকো না আমার গুমরে কাঁদা দিন গুলোতে।”
“তুমি তোমার বুকের মেঘে আমায় পুষে রেখো। দেখবে আর যাবো না। আমায় তুমি চোখের শ্রাবণে সিক্ত করে রাখো।”
সামান্তা আর কিছু বলল না। আবার গান ধরলো। আমার বুকের কাছে খামচি দিয়ে শার্টটা ধরে আছে। ওর কোমর জড়িয়ে আরো কাছে টানলাম। থরথর করে কাঁপছে সামান্তা। ওর গানের কথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিলাম আমি। স্বপ্নেই আমি নিজেকে প্রশ্ন করলাম, কে এই সামান্তা? যাকে এতো নিবিড় করে আঁকড়ে আছি। আমরা এক রিক্সায় কেন? কোথায় যাচ্ছি আমরা? কেন যাচ্ছি?
স্বপ্নে তখন কি দেখছিলাম কিছু বুঝতে পারছিলাম না। এরপরেই হঠাৎ দেখি আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। সামান্তা চলে যাচ্ছে। সামান্তার সাথে আমার কি হলো। কি করেই বা রিক্সা থেকে নামলাম কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। স্বপ্নের ভিতরে লজিকও কাজ করছিলো না। আমি কেবল অবিরাম বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজলাম। কতোক্ষণ ভিজলাম আমি জানি না। কখন স্বপ্ন দেখাটা শেষ হয়েছিলো তাও জানি না।
আমি হাঁটছি। বৃষ্টি আরো বাড়ছে। হাতের সিগারেট ভিজে গেছে। আমি একটা ঘোরের মধ্যে ডুবে যাচ্ছি। কোন ভাবে হয়তো স্বপ্নে দেখা সামান্তা নামের মেয়েটার সাথে টং দোকানে দাঁড়ানো মেয়েটার মিল আছে। আমার নার্ভাস সিস্টেম অহেতুক আমাকে উলোটপালোট অনেক কিছুই ভাবাচ্ছে। আস্তে আস্তে আমার লজিক কাজ করতে শুরু করেছে। ঘোর কেটে যাচ্ছে। স্বপ্ন আর বাস্তবতা আলাদা করতে পারছি। কি যে সব আগডুম বাগডুম ভাবলাম এতোক্ষণ।
নিজেকে খুব গালি দিতে ইচ্ছে করছে এখন। স্বপ্নে কি না কি দেখলাম। তাই নিয়ে কি সব গাঁজাখুরি চিন্তা ভাবনা করলাম। বৃষ্টি কমে আসছে। এমন দিনে বৃষ্টির কোন ঠিক নেই। এই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি, এই আবার নেই। বৃষ্টি আরেকটু কমে আসতেই গলির মুখের এক দোকান থেকে সিগারেট কিনে ধরালাম।
ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে সিগারেট খাওয়ার একটা মজা আছে। বৃষ্টির ছাঁট থেকে সিগারেট বাঁচিয়ে খাওয়ার মাঝে একটা রোমাঞ্চকর ব্যাপার আছে। পুরো রাস্তাটা একেবারেই নির্জন। চারিদিকে শীতল শীতল ভাব। মাথা থেকে স্বপ্নটা এখনো যাচ্ছে না। এতো গভীর করেও যে স্বপ্ন অনুভব করা যায় তা আমার এতোকাল জানা ছিল না। নার্ভাস সিস্টেম আমায় নিয়ে আবার খেলার চেষ্টা করছে। কিন্তু এবার আমি আমাকে নিয়ে খেলতে দিবো না। আমি জানি এসবই চিন্তার মরিচিকা। বারবার নার্ভাস সিস্টেম আমায় ফিসফিস করে বলছে, টং দোকানে দাঁড়ানো মেয়েটা রিক্সা নিয়ে এসে পাশে দাঁড়াবে।
নার্ভাস সিস্টেমকে ভুল প্রমাণ করার জন্য আমি পিছন ফিরে তাকালাম। পুরো রাস্তা ফাঁকা। মনে মনে গাল পারলাম- দেখলি তো স্টুপিড কোন রিক্সা নাই। ঠিক তখনি ডান পাশের গলি দিয়ে একটা রিক্সা আসতে দেখলাম। টং দোকানের সেই মেয়েটা! একটা ছেলের কাঁধে আলতো করে মাথা রেখেছে। আমার সামনে দিয়ে মোড় ঘুরে আমার রাস্তায় উঠার সময় দেখলাম ছেলেটা মেয়েটার কোমর জড়িয়ে আছে। মেয়েটা গাইছে, “আজি ঝর ঝর মুখরো বাদল দিনে…।”
আবার আকাশ থেকে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমে এলো। হাতের সিগারেট নিভে গেল। আমার লজিক এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আমার সামনে দিয়ে আরেকটা ছেলের সাথে সামান্তা রিক্সায় চেপে চলে যাচ্ছে। আমি কি ডাক দিবো। সামান্তা কি শুনতে পাবে। বৃষ্টি বাড়ছে। সামান্তা দূরে চলে যাচ্ছে। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে।
মাথার ভিতরে কে যেন বলে উঠলো, “সামান্তা কেউ না। তুমিও কোন স্বপ্ন দেখনি। তুমি বলেও কেউ নেই। কোথাও কেউ নেই। কেউ কখনো ছিল না কোথাও। তুমি কোথাও দাঁড়িয়েও নেই। কোন বৃষ্টির জল তোমায় ছোঁয়নি। তুমি বলে কাউকে তুমি চিনো না। তুমি কেবলই একটা কল্পনা। শুধুই কল্পনা…”
#শাকিল_রনির_পোস্ট_সমগ্র