কৃষ্ণকলি
পর্ব:- ১৩(অন্তিম পর্ব)
লেখা- অনামিকা ইসলাম।
অন্যদিকে হেলে যাওয়ার সময় বাঁধন মায়াকে ধরে ফেলে। অতঃপর মায়া বাঁধন আর বাঁধন মায়ার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ এভাবে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকার পর মুখ খুলে বাঁধন। মায়ার কানের খুব কাছে মুখ নিয়ে যায় বাঁধন। ফিসফিসিয়ে বলে-
” বাবা আসছে। বাবাকে বলব নাকি আগেভাগেই উঁচু রেখে একটা আরএফএল চেয়ার বানিয়ে রাখতে?”
বাঁধনের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাই মায়া। মায়ার এরকম দৃষ্টি দেখে ঢোক গিলে বাঁধন। মুখে দুষ্টু হাসির রেখা টেনে বলে-
” না মানে বলছিলাম কি আমি যখন অফিস থেকে ফিরব, তখন তো আমি ক্লান্ত শরীরে ঘেমে একাকার হয়ে যাব। তখন আমার সেই ঘামে ভেঁজা মুখটা তো আমি মুছতে পারব না, মুছবে আমার বউ! এখন ঘটনা হলো__
আমার বউ যেরকম পিচ্চি, মনে হয়তো না ও উঁকি দিয়েও ও আমার মুখ নাগাল পাবে। তাই একটা আরএফএল চেয়ার বানালে দু’জনের’ই ভালো হয় আর কি।”
সংসার শুরু না হতে’ই আরএফএল চেয়ার? ব্যাপারটা কি? প্রশ্নটা করতে করতে রুমে প্রবেশ করে বাঁধনের বাবা। মায়া বাঁধনের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে চুপটি করে। বাঁধন মায়ার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলে,
” কি! বলব নাকি বাবাকে???”
বাঁধনের দিকে একবার মাথা উঁচু করে তাকিয়ে লজ্জায় দৌঁড়ে রুম থেকে চলে গেল মায়া।
পরদিন বাঁধনের পরিবার মায়া-বাঁধনের বিয়েটা ঠিক করে রওয়ানা দিতে চাচ্ছিল। কিন্তু বাঁধ সাধে মায়ার ভাবি। আপনারা প্লিজ আজকের দিনটা থেকে যান। মায়ার ভাবির বোনের বিয়ে। ভাবির আপন বলতে বাবা আর বোনটা ছিল। বাবা মারা গেছেন একবছর আগে। এখন মায়ার ভাবি চাচ্ছে ছোট্ট বোনটার বিয়ে এ বাড়ি থেকেই হোক। আর সে মতেই সমস্ত আয়োজন করা হয়েছে। মায়ার ভাই- ভাবির জুড়াজুড়িতে সেদিনের মত থেকে যায় বাঁধন ও তার পরিবার। ঠিক হয় যে, বিয়ে খেয়েই তবে রওয়ানা দিবে ঢাকার উদ্দেশ্যে।
বিকেল থেকেই মেহমানরা আসা শুরু করে বিয়ে বাড়িতে। একে তো বিয়ে বাড়ি, তারউপর এত এত মেহমান। জায়গার সংকুলান হচ্ছিল না দেখে বাঁধনের আড্ডা ঠিক করেন ওনি ওনার নাতি নাত্নি নিয়ে রাত্রে ঘুমোবেন না। রাতভর আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে দিবেন রাতটা। যেই কথা, সেই কাজ। রাত্রে মায়া বিছানায় শুইলেও সুইটি, নুসরাত, দাদা ও বাঁধন নিচে শুইল। শুধু মায়া বিছানায় শুয়ে ফেসবুকে বন্ধু শফিকের সাথে চ্যাটিংয়ে ব্যস্ত। চ্যাট করতে করতে আর বিছানায় গড়াগড়ি দিতে দিতে কখন যে মায়া বিছানার একদম কিনারায় চলে যায় বুঝতে পারেনি। বুঝতে পারে তখন, যখন ধপাস করে কারো উপর পরে যায়। খাটের পাশেই ফ্লোরে শুয়েছিল বাঁধন।
খাট থেকে মায়া বাঁধনের বুকে’ই পরে, আর সেটা টের পায় বাঁধনের ‘উহ্’ করে উঠার পর। কি হয়েছে, কি হয়েছে বলে লাইট অন করে সুইটি। মায়া তখনও বাঁধনের বুকে। এটা দেখে সবাই ফিক করে হেসে দেয়। মায়া লজ্জায় ইয়ে মানে, না, আসলে করতে করতে বাঁধনের বুক থেকে সরে যায়।
সে রাতে মায়া কিংবা বাঁধন কারো’ই ভালো ঘুম হয়নি।
পরদিন দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষে বাঁধন ও তার পরিবার চলে যায়। যাওয়ার আগে বাঁধন মায়ার বিয়ের ফাইনাল ডেট দিয়ে যায়। বিয়ের ব্যাপারে বাঁধনের বাবার তাড়াহুড়োটা একটু বেশী’ই ছিল। তাই আসছে সপ্তাহের শুক্রবার বিয়ের দিন ধার্য করা হয়।
একসপ্তাহ চোখের পলকে শেষ হয়ে গেল। যদিও বাঁধন-মায়ার জন্য তা ছিল একবছরের সমতুল্য।
যায় হোক। নির্দিষ্ট দিনে বিয়েটা সম্পূর্ণ হয়ে যায়। রাত্রি সাড়ে নয়টা নাগাদ বউ নিয়ে বাসায় পৌঁছে বাঁধন ও তার পরিবার। বিয়ের বিভিন্ন রীতিনীতি পালন করতে যেয়ে ঘড়ির কাটা সাড়ে নয়টা থেকে সাড়ে দশটায় চলে যায়। এগারোটার মিনিট পাঁচেক আগে মায়াকে বাসরঘরে পাঠানো হয়। তার মিনিট পাঁচেক পর রুমে প্রবেশ করে বাঁধন। মায়া তখন ফুলের বিছানায় জড়োসড়ো হয়ে বসে ছিল। বাঁধনকে রুমে প্রবেশ করতে দেখে চিরাচরিত নিয়মে খাট থেকে নেমে পা ছুঁয়ে সালাম করে মায়া।
বাঁধন কোনো কথা না বলে মায়াকে নিয়ে নামাজ পড়তে যায়। দু’জন মিলে একসাথে নামাজ আদায় শেষে খাটে গিয়ে বসতে যাচ্ছিল মায়া। পিছন থেকে ডাক দেই বাঁধন।
দাঁড়িয়ে পরে মায়া। বাঁধন মায়াকে ঐ রুমে থাকতে বলে যে রুমে ও আগেও থেকেছিল। অবাক দৃষ্টিতে বাঁধনের দিকে তাকাই মায়া।
” কি হলো? শুনতে পাচ্ছো না? আমি খুব টায়ার্ড। তাড়াতাড়ি রুমটা খালি করো, আমায় একটু একা থাকতে দাও।”
মুখে বিরক্তির ভাব এনে কথাটা বলেছিল বাঁধন। প্রচন্ড অভিমানে রুম ত্যাগ করে মায়া। আগেকার সেই রুমে প্রবেশ করে দরজার ছিটকিনি এটে হাউহাউ করে কেঁদে উঠে মায়া। কাঁদতে কাঁদতে একটা সময় দরজায় হেলান দিয়ে ক্লান্ত হয়ে বসে পরে সে।
এদিকে বাঁধন চটজলদি রুম থেকে বের হয়ে গেল। বন্ধু শফিক সবুজ বেনারসি আর আরএফএল চেয়ার নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে’ই ছিল। সবুজ বেনারসি আর আরএফএল চেয়ারটা গাড়িতে রেখে কতগুলো রেশমি চুড়ি আর একজোড়া নূপুর কিনে আনে বাঁধন। পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক নুসরাতকে ডাক দেয় বাঁধন। নুসরাতের হাতে সবুজ বেনারসি শাড়িটা ধরিয়ে দিয়ে বলে,
” তাড়াতাড়ি যান।”
নুসরাত শাড়ি হাতে মায়া মায়া করতে করতে দরজায় কড়া নাড়ে। ভিতর থেকে দরজা খুলে দরজা খুলে মায়া। চোখ মুখের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে খুব করে কেঁদেছে পাগলীটা। রুমে প্রবেশ করে দরজাটা বন্ধ করে নুসরাত। মায়া অবাক দৃষ্টিতে সবুজ বেনারসিটার দিকে তাকিয়ে আছে।
” কি হলো?
তাড়াতাড়ি আয়! মধুর রাত যে বয়ে গেল।”
মায়া কোনো কথা না বলে ছোট্ট বাচ্চাদের মত হাত উপরে তুলে দাঁড়িয়ে আছে। নুসরাত মায়াকে শাড়ি পরিয়ে দিচ্ছে। শাড়ি পরানো শেষে নুসরাত মায়াকে নিয়ে বাঁধনের রুমের সামনে যায়। বাঁধন আগে থেকেই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল মায়ার অপেক্ষায়। নুসরাত বাঁধনের দিকে তাকিয়ে বলল, এই নিন আপনার বউ!
আর মায়া!!!
যদি পারিস তো মুখের ঐ মেকাপ, লিপস্টিক ধূয়ে নিস। না হলে বেচারার পেট খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
দুষ্টু হাসি দিয়ে চলে যায় নুসরাত। নুসরাত চলে যাওয়ার পর বাঁধন নুসরাতকে একটানে রুমে নিয়ে নেয়।
রাত্রি তখন এগারো’টা ঊনষাট মিনিট। বাঁধন মায়াকে বলে, “চোখ বন্ধ করো।”
মায়া চোখ বন্ধ করতেই বাঁধন রেশমি চুড়ি আর নূপুর জোড়া মায়ার হাতে, পায়ে পরিয়ে দিয়ে বলে, চোখ খোল।
চোখ খুলে মায়া অবাক। প্রায় মিনিট পাঁচেক বাঁধনের দিকে চেয়ে থেকে, কেঁদে ফেলল। বাঁধন মায়ার চোখের জল মুছে দিয়ে বলল, কান্না নয়! আবার চোখ বন্ধ করো।
মায়া চোখ বন্ধ করলে বাঁধন লুকিয়ে রাখা আরএফএল চেয়াটা মায়ার সামনে রাখে। মায়া চোখ খুলে চেয়ারটা দেখে বাঁধনের দিকে ঢ্যাবঢ্যাব করে তাকালো। বাঁধন দুষ্টু হাসি দিয়ে মায়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
এ শুধু ঘাম মুছার জন্য নয়,
এ কিন্তু আমাদের অন্য কাজেও লাগবে।
লজ্জায় মায়া বাঁধনের বুকে মুখ লুকালো। বাঁধন মায়ার মাথায় হাত রেখে ডাকল। তারপর মায়া এমন একটা হাসি দিল, মনে হলো সারা ঘর ওর হাসিতে কেঁপে উঠল। দালান ঘরে হাসিটা চার দেয়ালে প্রতিধ্বণিত হতে লাগল। বাঁধন বিশ্বাস করতে পারছিলনা__মায়া এভাবে হাসতে পারে। সেদিনই বাঁধন মানল, মায়ার মত পৃথিবীতে আর কেউ হাসতে পারে না। বাঁধন মুগ্ধ হয়ে মায়ার হাসি দেখছিল। তা দেখে মায়া লজ্জা পেয়ে বাঁধনের বুকে মাথা রাখল।
বাঁধন চুপিচুপি বলল-
ওঠো, খেয়ে নিই। আজ তোমাকে অনেক ভালোবাসা দেব। আর তা নিতে তো শক্তির প্রয়োজন তাই, না?
মায়া বলল, চলো খেয়ে নিই।
তারপর আবার সেই হাসি, মায়াবী হাসি।
♦সমাপ্ত♦
[ দুটি কথা:- কেউ কাউকে না দেখেও ভালোবাসতে পারে। কারন সত্যিকার ভালোবাসা সৃষ্টি হয় মন থেকে, রূপ থেকে নয়।। আর ভালোবাসা মন দিয়ে উপলব্ধি করতে হয়।]