কৃষ্ণকলি
পর্ব- ১২
লেখা- অনামিকা ইসলাম।
চোখ খুলে অবাক মায়া চোখের ভ্রম ভেবে চোখটা বার কয়েক কচলায়। তারপর আবারো এদিক-ওদিক তাকায়। মায়া নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। এটা কি সত্যি’ই! বাঁধনের পুরো পরিবার আমার সামনে???
না, না! এ হতে পারে না।
এ সত্যি নয়। আমি স্বপ্ন দেখছি। শুধু’ই স্বপ্ন।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে নিজে নিজেকেই চিমটি কাটে মায়া। সাথে সাথে ব্যথায় কুকিয়ে উঠে চিৎকার করে উঠে সে। বাঁধনের বাবা তখন মায়ার পাশেই দাঁড়িয়ে।
” স্বপ্ন নয়গো বন্ধু, স্বপ্ন নয়। আমরা সত্যি সত্যি তোমাদের বাসায় চলে আসছি।”
মায়ার দৃষ্টি এতক্ষণে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাঁধনের বাবার দিকে গেল। যেহেতু ফেসবুকে একাধিকবার মায়া তার বন্ধু শফিকের ছবি দেখেছে, তাই জনাব শফিক সাহেবকে চিনে নিতে খুব বেশী বেগ পেতে হয়নি মায়াকে। আজ শফিক সাহেব বাঁধনের বাবার স্থানে না থাকলে মায়া কত গল্প’ই না জুড়ে দিত ওনার সাথে।
কিন্তু আফসোস! ওনি এমন একজন ব্যক্তি হিসেবে ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন যার সাথে প্রয়োজনীয় কথা বলা যায়, গল্পও করা যায়। কিন্তু রসিকতার ছলে হাসি তামাশা করা যায় না। কারণ- ওনি বাঁধনের বাবা।
ছি, কি লজ্জা!
আমি কি না আপন বাপের সাথে তার ছেলের ব্যাপারে নানা ঘটনা শেয়ার করেছি!
ফোনে কথা বলে ভেবেছিলাম আমার মায়া বন্ধু ভিষণ হাসি খুশী আর খোলামনের অধিকারী। এখনটু দেখছি তার উল্টো’টা। মুখ ভাপা পিঠার মত ফুলিয়ে গম্ভীর করে রেখেছে। মায়ার দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হাসি দিয়ে কথাটা বললেন বাঁধনের বাবা।
জি, না— আমার বান্ধবী মোটেও গুমড়ামুখী না। আপনার প্রথম ধারনা’ই ঠিক। আমার বান্ধবী ভিষণ খোলামনের একজন মানুষ। বাঁধনের বাবার প্রশ্নের জবাবে কথাটা বললেন নুসরাত।
বাঁধনের বাবা আড়চোখে মায়ার দিকে তাকিয়ে বললেন-
” তার নমুনা তো আমি দেখতেই পাচ্ছি। এতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি, আমায় একটা বার Hi,Hlw কিংবা সালামটাও দিতে পারেনি। জিজ্ঞেস করতে পারে নি বন্ধু আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?”
বাঁধনের বাবার কথাগুলো শুনার পরও চুপ করে আছে মায়া। আসলে ও এরকম এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে যে, জড়তা কাটিয়ে যে একটু কুশল বিনিময় করবে সেটাও পারছে না। কথা বলতে চেয়েও বলতে পারছে না মায়া। কেন জানি মনে ও ওর বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। তা না হলে একসময়কার প্রিয় ব্যক্তিত্ব, মন খারাপের সাথী বন্ধু শফিকের সাহেবের সাথে কথা না বলে থাকতে পারত না।
পুরো রুম জুড়ে থমথমে নিরবতা। মায়ার হঠাৎ আগমন সবার সব উচ্ছ্বাস বন্ধ করে দিয়েছে কিছুক্ষণের জন্য।
” ভাইয়া! ওয়াশরুমটা কোনটিকে?”
সবার সব নিরবতা ভেঙে প্রশ্ন করে বাঁধন।
মায়ার ভাই জনাব মামুন আঙ্গুল উঁচু করে বলেন, সোজা গিয়ে ডানে। মায়া ওকে একটু ওয়াশরুমটা দেখিয়ে দিয়ে আয়’তো!!!!
ভাইয়ের কথায় জি আচ্ছা বলে মৃদু মাথা নাড়ে মায়া। তারপর সামনের দিনে চলা শুরু করে। পিছনে মায়াকে অনুসরন করে বাঁধন চলছে। কিছুদুর গিয়ে থেমে যায় মায়া। বাঁধনের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয় সে। মাথা নিচু করে বলে- সামনেই ওয়াশরুম।
ধন্যবাদ আপনাকে—–
কথাটা বলে ওয়াশরুমে প্রবেশ করে বাঁধন।
মিনিট পাঁচেক পর ভেঁজা শরীর নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে বাঁধন। বাঁধনের হাত, মুখ, শার্টের ক্ষাণিকটা অংশ ভিঁজে একাকার হয়ে আছে।
“তোর এই অবস্থা কেন?”
প্রশ্ন করেন বাঁধনের বাবা তার ছেলে বাঁধনকে। বাঁধন মাথা নিচু করে জবাব দেয়, আসলে শরীর মুছার জন্য কিছু নিয়ে যায়নি ওয়াশরুমে…..
মায়ার ভাইয়া বসা থেকে উঠে ডাক দেয় মায়াকে। ভাইয়ার ডাক পেয়ে রুম থেকে ছুটে আসে মায়া।
” জি, ভাইয়া! কিছু বলবে?”
অতিথিরা বাড়িতে এলে তাদেরকে অজু গোসলের পানি তুলে দেওয়ার সাথে সাথে তাদের দিকে গামছা বা তোয়ালে এগিয়ে দিতে হয়,সেটা তুমি জানো না???
কিছুটা রাগী স্বরে প্রশ্ন করেন মামুন ওনার বোন মায়াকে।
” ইসরে! কি ভুল’টাই করে ফেললাম”….
মনে মনে কথাটা বলে মায়া।
” কি হলো? ওর থাকার জন্য একটা রুম দেখিয়ে দে, আর একটা তোয়ালে দে….”
জি, আচ্ছা…
আসুন ভাইয়া বলে বাঁধনকে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায় মায়া। একটা রুমের সামনে গিয়ে থেমে যায় মায়া। বাঁধনের দিকে না তাকিয়েই বলে, আপনি রুমে যান। আমি তোয়ালে নিয়ে আসছি। বাঁধন রুমে যায়। বেশ সুন্দর, ছিমছাম, গুছানো একটা রুম। মনে হচ্ছে প্রতিদিন রুমটা মুছা হয়+আসবাবপত্র পরিষ্কার করা হয়। একটা বড়সড় ক্লান্তির নিঃশ্বাস ফেলে সোফায় ধপাস করে বসে পরে বাঁধন। মায়া ততক্ষণে তোয়ালে নিয়ে এসে হাজির। বাঁধনের দিকে তোয়ালে’টা বাড়িয়ে দিয়ে বলে-
” এই নিন”…..
বাঁধন তোয়ালে না ধরে মুগ্ধ চোখে মায়ার গভীর কালো চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। এ চোখে আমার জন্য এত মায়া, এত ভালোবাসা রয়েছে সেটা আমি এত কাছাকাছি থেকেও বুঝতে পারলাম না আমি অভাগা। উল্টা পাল্টা কথা শুনিয়ে দিনের পর দিন ওকে শুধু কষ্ট’ই উপহার দিয়েছি। মায়ার চোখের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে বাঁধন।
এদিকে বাঁধনের এরকম ঢ্যাবঢ্যাব করে তাকিয়ে থাকায় লজ্জা পায় মায়া। আমতা আমতা করে বলে উঠে-
” আ… আ…আপনার তোয়ালে…”
মায়ার কথায় ঘোর কাটে বাঁধনের। চোখ ফিরিয়ে নেয় মায়ার চোখ থেকে। দাও বলে মায়ার থেকে তোয়ালে’টা নিয়ে নেয় বাঁধন।
তোয়ালে দিয়ে মায়া যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। কোনো রকম তাড়াহুড়ো করে বের হচ্ছিল রুম থেকে। পিছন থেকে ডাক দেয় বাঁধন_
” ও ইয়ে শুনেন….”
ফিরে তাকাই মায়া। নিচের দিকে তাকিয়েই বাঁধনকে জিজ্ঞেস করে সে, কিছু বলবেন?
বাঁধন তোয়ালে’টা এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে দেখে বলে-
” বেশ পুরনো।”
বাঁধনের কথা শুনে চমকে তাকাই মানে। বাঁধন আবারো বলে,
” তোয়ালে’টা বেশ পুরনো। মনে হচ্ছে কেউ ইউজ করেছে।”
হ্যাঁ, এটা আমার। ইউজ করেছি, তবে পুরনো নয়। মাত্র আজকেই কিনে এনেছে ভাইয়া আমার জন্য। আচ্ছা, আপনার প্রবলেম হলে দিয়ে দিতে পারুন এটা। মাথা নিচু করে কথাগুলো বলে মায়া।
বাঁধন মায়ার হাতে তোয়ালে’টা তুলে দেয়। তোয়ালে হাতে নিয়ে চটজলদি রুম থেকে কেটে পরতে চাইছিল মায়া। পিছন থেকে আবারো বাঁধনের ডাক।
” ও ইয়ে…….”
মায়া ফিরে তাকাই। দূর থেকেই বলে, কিছু বলবেন?
‘এতদূর থেকে বলা যাবে না।’
বাঁধন মায়াকে কাছে ডাকে। মায়া একপা দুপা করে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।
” জি, বলুন….”
বাঁধন এদিক-ওদিক তাকিয়ে আস্তে করে বলে, আপনার তোয়ালে’টা তো নিয়ে গেলেন। এদিকে প্রচন্ড গরমে আমার শরীর থেকে যে ঘাম ঝরতেছে সেটার কি হবে?
—- আমি টিস্যু এনে দিচ্ছি, একটু ওয়েট করেন। কথাটা বলে চলে যাচ্ছিল মায়া। পিছন থেকে বলে উঠে বাঁধন, শুনোন!আমার টিস্যুতে হবে না…..
তাহলে? ঘাম মুছবেন কিভাবে?
প্রশ্ন করে মায়া।
~ ওড়না দিয়ে….
দুষ্টু হেসে জবাব দেয় বাঁধন। মায়ার অবাক মাত্রাটা এবার দ্বিগুন বেড়ে যায়। বোবার মত হয়ে বাঁধনের দিকে জিজ্ঞাসো দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মায়া।
” কি হলো? বুঝতে পারছেন না? আপনি আপনার ওড়নার কথা বলছি। আবারো দুষ্টু হাসি দিয়ে কথাটি বলে বাঁধন।”
এদিকে লজ্জায় মায়ার নাক মুখ লাল হয়ে গেছে। কোনো কথা না বলে নিচের দিকে তাকিয়ে হাতের আঙ্গুল মুচড়াচ্ছে সে।
কি হলো?
আপনি মুছে দিবেন নাকি আমি’ই মুছব?
সোফা থেকে উঠে কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে কথাটা বলে চুপ করে সোফায় গিয়ে বসে পরে বাঁধন। মায়া লজ্জায় একেবারে মাটির দিকে মিশে যাচ্ছে। বাঁধনের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মত শক্তি এবং সাহস কোনোটাই এই মুহূর্তে ও খুঁজে পাচ্ছে না। এদিকে বাঁধন?!!!
একটু একটু করে মায়ার দিকেই এগিয়ে আসছে। মায়ার কাছে এসে দাঁড়িয়ে যেই মায়ার ওড়নায় একপাশে হাত দিবে ওমনি মায়া চোখ বোজে বলে উঠে-
” আমি দিচ্ছি, আমি দিচ্ছি, আমি দিচ্ছি, আমি দিচ্ছি, আমি দিচ্ছি……”
জি, দিন….
বলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাঁধন। মায়া গায়ে পরা অবস্থায়’ই ওর ওড়নার একপাশ হাতে নেয়। ওড়না হাতে নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে মায়া। আসলে কি করতে কি করবে ও বুঝে উঠতে পারছে না।
এটা দেখে বাঁধন আবারো বলে উঠে_
” ওড়নাটা দিন’তো।
আপনার মুছতে হবে না।”
মায়া কাঁপা কাঁপা গলায় বলে-
” না, না! আমি মুছে দিচ্ছি।”
মায়ার ভীরু হাতদুটো বাঁধনের মুখের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বাঁধন যদিও চোখ বোজে আছে, তবুও আড়চোখে মাঝে মাঝে মায়ার দিকে তাকাচ্ছে। বাঁধন মায়ার থেকে অনেক লম্বা। মায়ার তাই বাঁধনের মুখের নাগাল পেতে কষ্ট হচ্ছে। মায়া পা উঁচু করে আপ্রাণ চেষ্টা করছে বাঁধনের ঘামে ভেঁজা মুখটা মুছে দিতে। কিন্তু পারছে না।
মায়া ওর Hight এর জন্য মনে মনে নিজেকে নিজেই গালি দিচ্ছে আর পা দুটো আরেকটু উঁচু করার চেষ্টা করছে। বাঁধন চোখ বোজে ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করছে আর মনে মনে হাসছে। অপরদিকে মায়া চেষ্টা করেই যাচ্ছে।
এদিকে বাঁধনের বাবা রুমে প্রবেশ করছে-
” মায়া! কইরে তুই? একটু বাঁধনের রুমে আয়……”
আওয়াজটা এদিক থেকেই আসছে ভেবে চোখ খুলে বাঁধন। এদিকে মায়া ভয় পেয়ে উঁচু করা পা দুটো নিয়ে হেলে পরে বাঁধনের দিকে। অতঃপর…………
চলবে………