কৃষ্ণকলি পর্ব- ০৮

0
2514

কৃষ্ণকলি
পর্ব- ০৮
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

বহুকাল পর অচেনা কারো কন্ঠে সেই চিরচেনা নাম. . . . . . .
বাঁধন চমকে গেল।
থমকে গিয়ে পিছু ফিরে তাকালো বাঁধন।
“কি বললেন?”
অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করল নুসরাতকে।অনেক হয়েছে, আর নয়। এবার সময় এসেছে সত্যিটা বলার। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে মুখ খুলে নুসরাত।
“মানে বুঝতে পারেননি?আপনার…….. (……)…..?
কথার মধ্যিখানে থেমে যায় নুসরাত। বাঁধন বার বার জিজ্ঞেস করছে, কি হলো? বলুন….
কিন্তু নুসরাত যেন কোনো কথায় বলতে পারছে না। কারন- কথার মাঝখানে ফুলস্টপ’টা টেনে দিলাম আমি মায়া। ঐ মুহূর্তে আমি সামনে গিয়ে না দাঁড়ালে নুসরাতের হয়ত মনেই থাকত না আমার সাথে করার প্রতিজ্ঞার কথা।

সেদিন বাঁধনের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য ছুটে যাচ্ছিল নুসরাত। কিন্তু আমার কসমের কাছে হার মেনে যায় সে। থমকে যায় পথিমধ্যে। বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে ওকে সেদিন বলেছিলাম কখনো যদি আমার ব্যাপারে বাঁধনের সাথে কোনো কথা বলে তাহলে সেদিন বড়’ই অনর্থ ঘটে যাবে। ওকে বলেছিলাম, বাঁধন যাতে কখনো ওর গত হয়ে যাওয়া ভালোবাসার কথা জানতে না পারে………
আমি এসব ভাবতে ভাবতে বাঁধন নুসরাতকে হাজারটা প্রশ্ন করে ফেলেছে। নুসরাত বোকার মত চুপসে দাঁড়িয়ে আছে। এই মুহূর্তে বাঁধনের প্রশ্নের সঠিক জবাব দেওয়ার ক্ষমতা নুসরাতের নেই। আর একটা কিছু বলে যে বিষয়টা ধামাচাপা দিবে সেটাও মাথায় আসছে না।
এদিকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছে বাঁধন।
“গত রাত্রে ফেসবুকের একটা পেইজে মায়ার বাঁধন নামে একটা গল্প পড়ছিলাম আমরা। মন ছুঁয়ে যাওয়া গল্পটা পড়ে’ই নুসরাত আপনাকে মায়ার বাঁধন বলে সম্বোধন করল জনাব।”
পিছন থেকে কথাটা বলে উঠলাম আমি।
“ওহ্, তাই বলেন…”
বলেই বাসার দিকে পা বাড়ালো বাঁধন।

উফফ্, বাঁচালে খোদা!
আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কথাটা বলল নুসরাত।
আজ ভয়ংকর কিছু ঘটে যেত……
অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে নুসরাতের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে বাসার ভিতরে চলে গেলাম আমি।

দেখতে দেখতে অনেকগুলো দিন কেটে যায়। একটু একটু করে যে বাঁধনকে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম, সেই বাঁধনের জন্য’ই বুকের ভেতরে অল্প অল্প করে ভালোবাসার জন্ম হতে লাগল। ধীরে ধীরে বাঁধনের মায়ায় গভীর ভাবে জড়িয়ে যেতে লাগলাম। ওর কথা বলা, ওর খাওয়া, ওর চলা সব…..
সবকিছুর প্রেমে পরে যায় নতুন করে। সেদিন ছিল পহেলা বৈশাখ___
বাঁধন ও তার পরিবার প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ’টা ওদের গ্রামের বাড়িতেই উৎযাপন করেন। আর সে জন্য যথারীতি এবারো ওরা পহেলা বৈশাখের আগের দিন বিকেলে রওয়ানা দেয় গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে। ওদের পরিবারের সঙ্গে এবার আমরা দু’বান্ধবিও ছিলাম।
রাত্রি ৮টা…..
আমরা বাঁধনের গ্রামের স্টেশনে গিয়ে পৌঁছলাম। স্টেশনে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল স্বয়ং বাঁধনের দাদা। বাঁধনের কাছাকাছি পৌঁছেই বাঁধনের মা সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করল। সুইটি দাদাভাই, দাদাভাই করে জড়িয়ে ধরে দাদাকে। সুইটির কপালে চুমু খেয়ে বাঁধনের দাদা আমার দিকে এগিয়ে আসেন।
” এই তাহলে আমার আরেকটা গিন্নি”
কথাটা বলে বাঁধনের বাবা আমার গাল টেনে দিলেন। নুসরাতের সাথেও পরিচিত হলেন।
বাঁধন যখন আনমনে ফোন টিপাটিপিতে ব্যস্ত ঠিক তখন’ই ওর তলপেটে ব্যাথা অনুভূত হয়। ওহ্, বলে সামনে তাকাতেই দেখে ওর দাদা এখনো ঘুষি দিয়ে হাত ওভাবেই রেখেছে। দাদা তুমি…..???
কথাটা বলে’ই বাসার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে বাঁধন। পিছন দিয়ে বাকি সবাই যাচ্ছে।

বাড়িটা খুব পুরনো,
তবে ছিমছামও গুছানো।
চারদিকে শ্যাওলা পরা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা বাড়িটির ভিতরের বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে সুন্দর বাগান। বাগানটিতে নানারকম জানা অজানা ফুল ফুটে রয়েছে। ফুলের গন্ধে চারদিক মুখরিত।
বাগানটির ঠিক পাশেই রয়েছে বিশাল বড় দীঘি। যা বাড়ির সৌন্দর্যকে বহুগুনে বাড়িয়ে দিয়েছে। দীঘিটিতে উঠা-নামার জন্য সিড়িও রয়েছে। ঐ সিড়ি বেয়েই মহিলারা দীঘির জলে গোসল করত। বাগানের ক্ষাণিকদুরে আরেকটি জিনিস লক্ষ করলাম।
ছোট্ট করে একটা ছাউনির মত কি যেন একটা। সুইটির থেকে জানতে পারলাম এটা আসলে চা’য়ের জন্য নির্মিত।
গ্রীষ্মের পড়ন্ত বিকেলে কিংবা সন্ধ্যাবেলায় বাঁধনের দাদা সবাইকে নিয়ে এখানে বসেই চা আড্ডা দেয়।
বাঁধনের মায়ের থেকে জানতে পারলাম বাঁধনের দাদা পরদাদারা ছিলেন পুরনো ধনী। সমস্ত গ্রামের মধ্যে ওনারাই ছিলেন অধিকতর সম্পত্তির মালিক। আর সে হিসেবে ওনার এই এলাকায় রয়েছে যথেষ্ট দাপট। আর গ্রামের লোকের এ পরিবারের লোকদের যথেষ্ট শ্রদ্ধা এবং সম্মান করে। কোনো সমস্যা হলে এখানেই সবাই ছুটে আসে……

গ্রামে লোডশেডিং খুব কমন একটা ব্যাপার।
সেদিনও লোডশেডিং হয়েছিল।
বাঁধনের দাদা কাজের ছেলেকে চা বানাতে বলে সবাইকে বললেন হাতে একটা করে চেয়ার নিতে। আমরা সবাই হাতে একটা করে চেয়ার নিয়ে বাঁধনের দাদাকে অনুসরন করে হাজির হলাম দীঘির পাড়ে। দীঘি থেকে ক্ষাণিকটা দুরেই আমাদের অবস্থান। সেখানে সবাই যে যার মত চেয়ার পেতে বসে পরলাম।
প্রকৃতির শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশ,
মৃদু বাতাস,
দুরের পাখিদের বাসা ফেরার আয়োজন।
মাঝে মাঝে দু’য়েকটা পাখির কিচিরমিচির শব্দ।
সবমিলিয়ে ভালো’ই লাগছে……..

ইস!
এই সময় বাঁধন যদি কাছে থাকত,
ওর হাতটা ধরে যদি বসে থাকতে পারতাম
কিংবা ওর কাধে মাথা রেখে!
তাহলে মন্দ লাগত না।
আচ্ছা….
ওর কি আমার কথা একটুও মনে নেই?
ও কি আমাকে একটুও আর ভালোবাসে না?
আমার কথা কি ওর একটুও মনে হয় না?
মনে হয় না সেই স্বপ্নগুলোর কথা,
যা একসময় আমরা দু’জন দেখতাম?
বাঁধনকে নিয়ে যখন ভাবনার অতল গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছিলাম, ঠিক তখন’ই আমার ভাবনাচ্ছেদ ঘটে।
” কি বড় গিন্নী? আমাকে রেখে’ই হারিয়ে গেলা কল্পনাতে?”
ছি! দাদাভাই….
কি যে বলো না…..বলেই লজ্জায় মুখ লুকালাম আমি।
-তো গাচ্ছেন না কেন গান???
বাঁধনের কথা শুনে ওর দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকালাম। কিসের গান?!!!
আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলাম ওদেরকে।
দাদাভাই আমার সখি এখন ওর কল্পরাজ্যের রাজকুমারকে নিয়ে ভাবনার অতলে ডুবে আছে, ওর মন কি আর এখানে আছে???
নুসরাত কথাটা বলতেই ফিক করে হেসে দিল সবাই। আমি মুখ ভার করে বসে আছি।
তো যায় হোক!
হাসি পরে হবে। আগে রবীঠাকুরের কাব্যের নায়িকা কৃষ্ণকলি ম্যামের কন্ঠে একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনে নেই, কি বলো সবাই???
ইতিমধ্যে বাঁধনের মা এবং ওনার দুই জা ও তাদের ছেলেমেয়েরা এসে যোগ দিল।
সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে আমার কন্ঠে গান শুনার প্রতিক্ষায়। অন্যদিন হলে ঠিক বাঁধনের মুখের উপর বলে দিতাম এখন কোনো গান শুনাবো না তোমায়, গান যা শুনানোর ফুলশয্যার রাতেই শুনাবো। দুজন মিলে একসাথে আমাদের প্রিয় রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনব……
আজ তো তা বলতে পারব না।
কারন- ওর সাথে আমার মত কালো মেয়ের মিল তো কখনোই হবার নয়।
” কি হলো শুনান….!!!”
বাঁধনের কথা শুনে সম্ভিত ফিরল। ওর দিকে তাকিয়ে একটা শুকনো হাসি দিয়ে গান শুরু করলাম-

আমি এলেম, তারই দ্বারে….
আমি এলেম।
ডাক দিলেম অন্ধকারে,
হা রে……….
আমি এলেম, তারই দ্বারে……..
আমি এলেম।
আগল ধরে দিলেম নাড়া………
প্রহর গেল, পাইনি সাড়া;
দেখতে পেলেম না’যে তারে,
হা রে………..
আমি এলেম, তারই দ্বারে…….
আমি এলেম।
তবে যাবার আগে এখান থেকে,
এই লিখনখানি__
যাব রেখে………
তবে যাবার আগে এখান থেকে….!
দেখা তোমার পাইবা না পাই…..
দেখতে এলেম__
যেনগো তাই ফিরে যায় সুদূরের পাড়ে……
হা রে……
আমি এলেম, দ্বার’ই দ্বারে…..
আমি এলেম।
তবে যাবার আগে এখান থেকে,
এই লিখনখানি_
যাব রেখে…..
তবে যাবার আগে এখান থেকে….!
দেখা তোমার পাইবা না পাই…….
দেখডে এলেম___
যেনগো তাই ফিরে যায় সুদূরের পাড়ে……
হা রে……
আমি এলেম, তারই দ্বারে…….
আমি এলেম।
ডাক দিলেম অন্ধকারে…….
হা রে…….
আমি এলেম, আমি এলেম……!!!

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে