কৃষ্ণকলি পর্ব- ০৭

0
2447

কৃষ্ণকলি
পর্ব- ০৭
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

মাঝরাত্রে রিংটনের আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে যায় বাঁধনের মায়ের। ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে ফোন রিসিভ করে চমকে উঠেন ওনি। অজানা বিপদের আশংকায় ভিতরটা মুচড় দিয়ে ওঠে ওনার।
“গেইটের সামনে মানে….?”
কাঁপা স্বরে ওনি জিজ্ঞেস করেন।

হ্যাঁ, ঠিক’ই শুনেছেন আপনারা!
এই মুহূর্তে আমি বাঁধনের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। সাথে আছে বান্ধবী নুসরাত। হাজার অনুনয়-বিণয় করেও ওকে ওর কথা থেকে টলাতে পারিনি। গেইটের সামনে এসে ফোন করলাম বাঁধনের মাকে।
” আন্টি! গেইট’টা খুলেন। আমি গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।”
ফোন রিসিভ করার সাথে সাথে কথাটা বাঁধনের মাকে বললাম। এত রাত্রে এ ধরনের কথা শুনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। ঘাবড়ে যান ওনি। তাড়াতাড়ি বাঁধনকে ডেকে তুলে গেইটের সামনে গেলেন ওনি। গেইটের বাইরে থেকেই লক্ষ্য করলাম মা-ছেলে দু’জনের চোখে মুখেই আতঙ্কের ছাঁপ। নুসরাতের কথায় এত রাত্রে এভাবে ছুটে আসা মোটেও উচিৎ হয়নি আমার। মনে মনে নুসরাতকে হাজারটা গালি দিলাম। তারপর মাথা নিচু করে গেইট অতিক্রম করে বাসার ভেতর ঢুকলাম।

এই মুহূর্তে আমাদের অবস্থান ড্রয়িংরুমে। সোফায় মাথা নিচু করে বসে আছি আমি। আর আমার দিকে কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে কয়েক জোড়া চোখ। যে চোখগুলোতে রয়েছে হাজারো প্রশ্ন, হাজারো কথা। মিনিট দুয়েক নিরবতার পর মুখ খুলেন বাঁধনের মা।
“এত রাত্রে তুই চলে আসছিস? কি হয়েছে তোর? তুই ঠিক আছিস তো? তোর কোনো সমস্যা হয়নি তো?”

একনিশ্বাসে করা একগাদা নাগরিক প্রশ্ন।

“আসলে আন্টি ও খুব বাজে স্বপ্ন দেখেছে। আর সেটা দেখেই চিৎকার দিয়ে উঠল ঘুম থেকে। তারপর থেকে অদ্ভুত সব পাগলামী করতে থাকে। আমি বাসায় যাব, বাসায় যাব, আন্টির কাছে যাব। তাই বাধ্য হয়ে নিয়ে আসতে হলো।”
বাঁধনের মাকে দ্বিত্বীয় বার প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ না দিয়ে কথাগুলো বলে নুসরাত। বাঁধনের মা দৌঁড়ে আমার কাছে আসলেন। জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলাতে থাকেন। নুসরাতের দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকালাম। কারন- আমার পক্ষে ঐসকল প্রশ্নের কোনো সঠিক উত্তর দেওয়া সম্ভব ছিল না। আবার মিথ্যেটাও বলতে পারতাম না। কারন- ওনার মাঝে আমি আমার মাকে খুঁজে পায়!!!

চলে গেল আরো কয়েক মাস….
এর’ই মাঝে আমার সাথে সাথে নুসরাতও পরিচিত হয়ে গেল এ বাসার প্রত্যেকটি সদস্যের কাছে। এখন আর আমাকে নুসরাতের বাসায় যেতে হয় না। কাজের ফাঁকে ফাঁকে, কখনো বা পেলে নুসরাত’ই ছুটে আসে তার পরাণের বান্ধবীকে দেখার জন্য। সেদিনও নুসরাত এ বাসায় এসেছিল।
” কিরে মা?তুই এত শুকাচ্ছিস কেন? তুই কি খাস না নাকি?”
রাত্রে খাবার টেবিলে সবাই যখন খাবার নিয়ে ব্যস্ত তখন আচমকা’ই প্রশ্নটি করে বাঁধনের মা নুসরাতকে।
“হসপিটালে সারাক্ষণ রোগী নিয়ে ব্যস্ত থাকি। তারউপর বাসায় গিয়ে রান্না, গোসল, খাওয়া। ঘুমানোর আর সময় হয়ে উঠে না আন্টি।”
মাথা উচু করে গম্ভীর হয়ে কথাগুলো বলে নুসরাত।

রান্নার জন্য বুয়া রেখে নাও। আর গ্রামের বাড়িতে কেউ নেই? মানে আপনজন!!!ওখান থেকে একজনকে নিয়ে আসো। যে কিনা অলস সময়ে তোমাকে সঙ্গ দিতে পারবে।
“আমার আবার আপনজন!
ঐ যে সামনে যে মেয়েটি বসে আছে না?!!! যাকে আপনি আপনার মেয়ের স্থান দিয়ে এ বাসায় স্থান দিয়েছেন তার কপাল আর কপাল একই। আমরা একসাথে একই স্কুল+কলেজে পড়েছি। আমরা পাশাপাশি গ্রামের মেয়ে ছিলাম। আমাদের দুজনের মা’ই মারা গেছেন সেই ছোট্ট কালে। দু’জনের বাবা’ই পরবর্তীতে বিয়ে করেছেন। ওর সৎ মা অবশ্য মারা গেছেন কিন্তু আমার সৎ মা??? বেঁচে ছিলেন। ২য় মা মারা যাওয়ার পর আমার বাবা আরেকটা বিয়ে করেন। প্রথমজন যাও একটু মারার পাশাপাশি আদর করত, পড়াশুনার ব্যাপারে সাপোর্ট করত। কিন্তু এখন যেজন আছেন ওনি? ওনার কথার আঘাতে প্রতিনিয়ত আমায় জর্জরিত হতে হয়।খুব বাজে বাজে কথা বলে আমাকে নিয়ে আমার বাবার সাথে। যা একজন মেয়ে হিসেবে আমার জন্য ভিষণ লজ্জাকর ছিল। বহু সংগ্রাম করে মেডিকেল কোর্সটা কমপ্লিট করলাম। তারপর সেই যে বাড়ি ছাড়লাম আর যায়নি। কিসের জন্য যাব বলেন? ওখানে গেলে যে আমি মানসিক শান্তির পরিবর্তে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যায় আরো।
একটা শুকনো হাসি দিয়ে কথাগুলো বলে চুপ করল নুসরাত।

বাঁধনসহ ওর মা, বোন আর বুয়ার চোখে জল চিকচিক করছে নুসরাতের কথা শুনে। খাবার টেবিলে এই মুহূর্তে থমথমে ভাব বিরাজ করছে। কিছুটা সময় নিরবতা, তারপর আচমকা বাঁধনের মা বলে উঠল__
” কে বলছে তোর কেউ নেই? তোর জন্য আমি আছি, এ পরিবারের সবাই আছে। আজ থেকে তুই এ বাসায় থাকবে। আর এখান থেকেই হসপিটালে যাবি। বাঁধন রোজ তোকে দিয়ে আসবে। আর বাঁধন?!!!
তুই কালকে একবার নুসরাতকে নিয়ে ওর বাসায় যাবি। ওখান থেকে ওর সব জিনিসপত্র নিয়ে আসবি। কি মনে থাকবে তো?!!!”

– আচ্ছা….. (বাঁধন)

নুসরাতের সাথে আমার চোখ দুটোও জলে ছলছল করে উঠল।

পরদিন সকাল বেলা_
” এই, উঠবি নাকি পানি ঢালব???”(মা)
– উফ্, মা! আরেকটু ঘুমাই না।(বাঁধন)
– ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখছিস কয়টা বাজে? বেলা ১১টা বাজে। নুসরাতের জিনিসপত্র গিয়ে কখন আনবি?(মা)

ধরমরিয়ে শুয়া থেকে উঠে বসে বাঁধন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে বলে ১১টা? মা, তুমি আগে ডাক দিবা না? বাঁধন দৌঁড়ে ওয়াশরুমে গেল। ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট করে গাড়িতে করে নুসরাতকে নিয়ে পৌঁছে গেল কাঙ্খিত স্থানে। নুসরাত ওর যাবতীয় জিনিসপত্র গুছাতে গুছাতেই কাটিয়ে দেয় ৩ঘন্টা। দুপুর ০২টা নাগাদ ওখানকার সমস্ত ঝামেলা শেষ হলো। আধঘন্টার মধ্যে বাসায় পৌঁছল ওরা। গাড়ি থেকে নেমে বাঁধন একটা একটা করে জিনিস দাঁড়োয়ান চাচার হাতে এগিয়ে দিতে লাগল আর দাড়োয়ান সেগুলো বাসার ভিতর নিয়ে রেখে আসতে লাগল। সবশেষে ড্রাইভারকে গাড়ি ভেতরে নিতে বলে বাঁধন যেই না গেইটের ভিতরের দিকে পা বাড়ালো ওমনি পেছন থেকে ডেকে উঠে নুসরাত।
এই যে মায়ার বাঁধন শুনোন?!!!

থমকে যায় বাঁধন।
দীর্ঘ অনেকগুলো বছর পর সেই প্রিয় নাম!
চমকে উঠে পেছনে তাকালো বাঁধন…..

চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে