কৃষ্ণকলি
পর্ব- ০৬
লেখা- অনামিকা ইসলাম।
“কেমন আছে এখন মায়ার বাঁধন?”
বেশ ভালো!
ছোট্ট করে বলে থেমে গেলাম আমি। কিছু সময় নিরবতা তারপর জনাব শফিক সাহেবের প্রশ্ন- কতজনের নানা হলাম?
শফিক সাহেবের এমন উদ্ভট প্রশ্ন শুনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। তাইতো চনকে উঠে ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম, মানে?
মানে হলো আমার মায়া বন্ধুর কোল আলো করে এ পর্যন্ত কয়জন এলো? আমি কতজন ছেলে মেয়ের নানা হতে পেরেছি?
বন্ধু শফিকের কথা শুনে কন্ঠ’টা স্তব্ধ হয়ে আসে। উত্তর দিতে গিয়েও দিতে পারিনি। কেন জানি মনে হচ্ছিল কথারা সব বুকের ভেতর প্রকান্ড এক পাথর রুপ ধারন করেছে। প্রচন্ড এক যন্ত্রণায় ভেতরটা ছটফট করে উঠল। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম আমি।
পৃথিবীর সবচেয়ে আপন মানুষটিকে এত সহজে হারিয়ে ফেলার বেদনায় জমে থাকা নীল কষ্টের তুষারগুলো গলে গলে পড়তে শুরু করল অশ্রু হয়ে।
এই মুহূর্তে বাঁধনের সঙ্গে ঘটে যাওয়া পেছনের স্মৃতিগুলোই আমাকে পীড়া দিচ্ছে। বাঁধনের স্মৃতিগুলো বার বার হৃদয়ের ক্যানভাসে ভেসে উঠছে। হুশ হয় বন্ধু শফিকের কথায়।
এই মেয়ে! কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে তোর?
চোখের অশ্রু মুছে হাসিমুখে উত্তর দিলাম, কই? কিছু না তো!!!
ভুলে গেলি? আজকে রাত পোহালে শুক্রবার। আজকের দিনেও তুই মিথ্যে বলবি?
উফ্! বন্ধু শফিকের কথায় মনে পরল আজকের দিনটা একটা সময় আমার আর বাঁধনের জন্য কতটা স্পেশাল দিন ছিল। ২০১০ সালের এই দিনে দু”জন দু’জনকে ভালোবাসার কথাটা বলছিলাম।
ইস! কতই না সুন্দর ছিল সেই দিনগুলো….
কখনো যদি বাঁধনের সাথে ঝগড়া হতো, আর সেটা যদি হতো শুক্রবার দিন, তাহলে বাঁধনের মুখ থেকে এই একটা কথায় শুনতাম-
” মায়া! আজ না শুক্রবার?!!! আজকের দিনেও তুমি ঝগড়া করবে? রাগ করে থাকবে?”
বাঁধনের এই একটি কথায় থেমে যেত সব ঝগড়া, উড়ে যেত সব রাগ।
বাঁধনকে বলতাম- এই দেখো! চুপ করলাম।
আর ঝগড়া করব না। এবার হলো তো???
আর রাগ? সেটা কি আদৌ গেছে?(বাঁধন)
– হ্যাঁ, গেছে। আমি আর রেগে নেই।
আমার কথা শুনে বাঁধন গম্ভীর গলায় প্রমান চাইত। আমি যে রেগে নেই তার প্রমাণ হিসেবে একটা হাসি দিতে বলত। জোর করে হলেও হাসি দিতাম এভাবে-
” হি হি হি হি হি হি হি হি হি হি হি হি”
হাসি হাসি মুখে বাঁধন বলত, এইতো আমার পেত্নী হাসছে।
প্রেমিকরা ওদের প্রেমিকাদের হাসির বর্ণনা কত সুন্দর, কত নিঁখুত ভাবে গল্প-উপন্যাসে তুলে ধরেন। আর বাঁধন?!!!
আমার হাসিকে পেত্নীমার্কা হাসির সাথে তুলনা করত।
রাগান্ধিত স্বরে বলতাম- আমি পেত্নী, নাহ?
সিরিয়াস ভঙ্গিতে বাঁধন বলত- হ্যাঁ, তুমি পেত্নী।
আচ্ছা, আচ্ছা। রাখি।
রাগ দেখিয়ে ফোনটা কেটে দিতে যাব, তখনই ও বলে উঠত-
শুনো! তুমি শুধু আমার পেত্নী। আর কারো না। এ পেত্নীটা শুধুই আমার।
বাঁধনের এই একটা কথায় আমার সমস্ত রাগ দুরে সরে যেত। ভিতরের আনন্দটা চেপে বলতাম- শয়তান!
বাঁধনও আমার সাথে সাথে লম্বা করে বলত- শয়তান!
তারপর আবার সেই হাসি।
পেত্নী মার্কা হাসি।
Oh, hlw mem!
কিছু’তো বলুন। সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি। শফিক সাহেবের কথায় সম্ভিত ফিরে। একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সেদিন বাঁধনের সাথে দেখা করতে যাওয়ার পর থেকে ওনার বাসায় আশ্রয় নেওয়া পর্যন্ত সবটা খুলে বললাম। আমার কথা শুনে জনাব শফিক সাহেব চুপসে গেলেন। শুধু চুপসে নয়, কিছুক্ষণের জন্য ওনি হয়তো নির্বাকও হয়ে গেছেন। যার কারনে ওনি কোনো কথা বলতেছেন না। টানা ৫,৬মিনিট নিরবতা চলল। ওনার কথা বলার কোনো আভাস’ই পাচ্ছি না।
নিরবতা ভেঙ্গে মুখ খুললাম আমি। বন্ধু শুনতে পাচ্ছেন?
হ্যাঁলো, হ্যাঁলো বলতে বলতে পিছনে ঘুরে তাকালাম। নুসরাত অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে এভাবে দেখে চমকে উঠলাম আমি।
ফোন’টা কান থেকে নামিয়ে, তু তু তু তু….ইই……????
হ্যাঁ, আমি। মায়ার বাঁধনের বর্তমান অবস্থান জানার জন্য’ই ঘুম থেকে জেগে উঠা। আমার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে নুসরাতের জবাব।
ই ইয়ে মানে আসলে নুসরাত আমি তোকে…..
সম্পূর্ণ কথাটা বলতে পারিনি। তার আগেই আমার মুখ থেকে কথাটা কেড়ে নিয়ে রাগান্বিত ভঙ্গিতে জোর গলায় বলতে থাকে নুসরাত, তুই কিভাবে এমনটা করলি?
কিভাবে তুই আমার থেকে এত বড় সত্যি’টা লুকাইলি? আমি কি কখনো’ই কোনো ভালো বন্ধু ছিলাম না???
নুসরাত কথা’টা তো শুন।
চুপ!
একদম চুপ। তুই কোনো কথা বলবি না।রাগান্বিত স্বরে নুসরাতের জবাব। আমি আর কোনো কথা বাড়ালাম না। চুপ করে আছি। নুসরাত ১ঘন্টার আলাপকে সাড়ে ৩ঘন্টা বানালে প্যাঁচাল পেরে। প্যাঁচাল শেষে যখন হাফিয়ে উঠে আমার দিকে তাকালো। আমি তখন সোফায় বসে ঝিমুচ্ছি। নুসরাত আমার কাছে দৌঁড়ে গিয়ে আমার দু’বাহু ঝাকিয়ে বলে-
এই ঘুমোবে না একদম!
তুই এখন এই মুহূর্তে আমার সাথে চলবি।
আধো ঘুম আধো জাগরিত অবস্থায় আমি নুসরাতকে বললাম-
” কোথায় যাব?”
নুসরাত আমার কানের কাছে এসে জোরে জোরে বলতেছে-
” কোথায় আবার? বাঁধনের বাসায়। আমায় তুই বাঁধনের বাসায় নিয়ে চলবি। ঐ হারামজাদাকে আমি দেখতে চাই। দেখতে চাই কেমন বেকুব যে গার্লফ্রেন্ডের কন্ঠ শুনেও গার্লফ্রেন্ডকে চিনে না।”
কি?!!!
চমকে উঠে চোখ মেলে তাকালাম।
এই মুহূর্তে আমার চোখ থেকে নিদ্রাদেবী প্রস্থান করেছে।
কি, কি করিস না;
আমি বাঁধনের বাসায় যেতে চাচ্ছি। ওর সাথে আমার কথা আছে। নিয়ে চল আমায় সেখানে……
চলবে……….