কৃষ্ণকলি
পর্ব:- ০৫
লেখা- অনামিকা ইসলাম।
এফএমে লাখো মানুষের শ্রোতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলা’টা তো খুব ভাগ্যের ব্যাপার। তাহলে আংকেলকে সবাই কেন এমন করত? আমি আজ’ই আন্টির কাছে যাব। আন্টির কাছের কাছে গিয়ে আংকেলের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে বলব। কারন- আংকেল অবশ্যই একবার হলেও ফোন দিয়েছিল আন্টিকে।
-খবরদার!
যা বলছো এখানেই। এই কথা’টা যাতে মায়ের সামনে না বলা হয়।
তাহলে কিন্তু…… (……)……???
আমার দিকে তাকিয়ে ভয়ার্ত চোখে কথাটা বলল বাঁধন। কেন? ওনি কি এফএমকে ভালোবাসেন না? প্রশ্ন করলাম বাঁধনকে।
তাচ্ছিল্যের স্বরে বাঁধনের জবাব,
” ভালোবাসা?!!!
হা, হা। ঘৃণা করে মা। শুধু ঘৃণা না, ভয়ংকর ঘৃণা। এই নামটাই ওনি সহ্য করতে পারেন না আমার মা। এফএমের “ফ”টাও সহ্য করতে পারেন না।
বাঁধনের কথা শুনে আর কোনো কথা বলতে পারলাম না। বলতে পারলাম না, বাঁধন!
আমিও তো এফএমে প্রোগ্রাম করতাম একসময়। প্রতি বৃহস্পতি’বার দিন আমায় সেখানে যেতে হতো প্রোগ্রাম করার জন্য। অবশ্য মধ্যিখানে অনেকটা দুরে সরে গিয়েছিলাম রেডিও থেকে। কিন্তু আজ এতবছর পর লাখো শ্রোতার ভালোবাসায় আপ্লুত হয়ে যখন সিদ্ধান্ত নিলাম আমি আবার প্রোগ্রাম’টা শুরু করব, তখন…..(……)…..???
যাক!
এখন কথা না বলাটাই শ্রেয়।
আর তাই আমিও কোনো কথা বললাম না।
চুপ করে বাঁধন গাড়ি চালালো।
বাকি রাস্তা একটা কথাও হলো না আর।
সেদিন বান্ধবী ডাঃ নুসরাত কল দিয়ে বলল, ও ঢাকায় ট্রান্সফার হয়ে এসেছে। আমাকে দেখতে ওর ভিষণ ইচ্ছে হচ্ছে। আমি যেন ওর বাসায় যায়। কলিজার টুকরা বান্ধবীর ইচ্ছে বলে কথা। ফেলতে পারিনি। বাঁধনের মায়ের থেকে অনুমতি নিয়ে ছুঁটে চললাম নুসরাতের বাসার উদ্দেশ্যে। ১ঘন্টার মধ্যে’ই নুসরাতের ওখানে গিয়ে পৌঁছলাম। ওকে দেখে বুঝতে পারলাম এতক্ষণ ধরে আমার’ই অপেক্ষায় গেইটের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে দেখে সেকি খুশি! ওর কাছে যাওয়ার সাথে সাথে জড়িয়ে ধরল আমায়। অনেক দিনের দুঃখ কষ্ট জমে পাহাড়ের মত হয়ে গিয়েছিল আমার ভিতর। সেই দুঃখ-কষ্টের একটু একটু ওকে বলতে লাগলাম। ঘন্টা দু’য়ের মধ্যে’ই মনে হলো আমার ভিতর যে বরফগলা পাহাড় ছিল,
সেটি একটু একটু করে গলতে শুরু করেছে।
সন্ধ্যায় হালকা নাস্তা করা শেষে দু’বান্ধবীর মধ্যে কিছু কথা হয়। কথোপকথনগুলো এমন ছিল__
নুসরাত:- তারপর?
তোর প্রোগ্রামের কি খবর? এখনো
করিস প্রোগ্রাম’টা?
আমি:- না। তবে কথা দিয়েছিলাম শুরু করব। কিন্তু আমি মনে হয় ওদের কাছে দেওয়া কথাটা রাখতে পারব না। শুরু করতে
পারব না প্রোগ্রাম’টা?
নুসরাত:- কেন? কেন???
আমি:- বাড়িওয়ালাী এফএম নামটা সহ্য
করতে পারে না, ঘৃণা করে।
নুসরাত:- মানে?!!! মানে কি মায়া???
নুসরাতের সাথে বাঁধনের বলা কথাগুলো’ই পুনারবৃত্তি করলাম। আমার কথা শুনে নুসরাত চিন্তিত মনে বাহির পানে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ ওর চোখে মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল। লাফ দিয়ে আমার কাছে এসে বলল, আইডিয়া!
– কি idea?
তোর তো প্রতি বৃহস্পতিবার রাত্রে প্রোগ্রাম, তাই না?
– হুম।
আর সেই বৃহস্পতিবার দিন কলেজ থেকে এসে আন্টিকে আমার বাসায় থাকার কথা বলে তুই যদি আমার এখানে চলে আসিস, তারপর রাত্রে আমি তোকে রেডিও অফিসে দিয়ে আসি। তাহলে কেমন হয় ব্যাপার’টা?
– Yes.
খুশিতে নুসরাতকে জড়িয়ে ধরলাম।
কিন্তু পরক্ষণে মুখটা নিকষ কালো অন্ধকারের ন্যায় হয়ে যায়। নুসরাতের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বারান্দায় চলে গেলাম। বারান্দায় গিয়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে। নুসরাত পিছন থেকে গিয়ে কাঁধে হাত রাখে। নুসরাতের দিকে একবার তাকিয়ে চোখটা ফিরিয়ে নিলাম। আমার দৃষ্টি তখন বারান্দার রেলিংয়ের ভিতর দিয়ে দুর অজানায় চলে গেছে। বান্ধবী নুসরাত চুপটি করে পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মিনিট পাঁচেক পর মুখ খুলে নুসরাত।
তোকে খুব ভালোবাসেন ভদ্রমহিলা, তাইনা?
নুসরাতের দিকে না তাকিয়েই বললাম-
হ্যাঁ। বড্ড বেশীই ভালোবাসেন ওনি আমাকে। এরকম ভালোবাসা আমি আমার জীবনে পূর্বে একজনের কাছ থেকেই পেয়েছিলাম। তিনি ছিলেন- আমার মা। মা মারা যাওয়ার এই যে এত বছর পর আমি একটু তৃপ্তির হাসি দিতে পারি, সে ঐ মহিলার জন্য। যিনি আমার মা সমতুল্য। ওনি এমন একজন মানুষ যার মাঝে আমি মায়ের ছায়া খুঁজে পায়। খুঁজে পায় মায়ের সেই স্নেহমাখা ভালোবাসা, আদর-সোহাগ এবং শাসন। ওনার সাথে আমার পরিচয় তিনদিনের। অথচ দ্যাখ….
ওনি যেন আমার শিরায়-উপশিরায় মিশে আছেন।
– তো! কি করবি?(নুসরাত)
আমি করব না প্রোগ্রাম। আমি চাই না ঐ প্রোগ্রাম করতে যেটা করতে গিয়ে মায়ের সাথে দিনের পর দিন মিথ্যা কথা বলতে হবে। মাকে ঠকানো হবে। আমি আমার মায়ের সাথে এরকমটা করতে পারব না। ওনার স্নেহের মূল্য আমি এভাবে দিতে চাই না। এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে থেমে গেলাম।
নুসরাত আমার কাছে এসে বলল, তুই তাহলে রেডিওর জগত থেকে নিজেকে সরিয়ে আনতে চাচ্ছিস, এই তো?!!!
হ্যাঁ, ঠিক তাই।
আমি এ জগত থেকে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছি। তুই প্লিজ আমায় জোর করিস না।
নুসরাতের দিকে তাকিয়ে বিনীত ভঙ্গিতে কথাটা বলছিলাম।
তোর যা ভালো মনে হয়।
নুসরাত রুমে চলে গেল। নুসরাতের পিছু পিছু আমিও রুমে গেলাম।
রাতের রান্নাটা দু’বান্ধবি মিলে করলাম।
অনেক দিন পর দু’বান্ধবী একসাথে খাবার খেলাম।
বুঝলি মায়া! একেই বলে সত্যিকারের বন্ধুত্ব। এই যে দুজন দুজনকে ছেড়ে এতটা দিন এতটা দুরে ছিলাম, অথচ সম্পর্কে একটুও ফাটল ধরে নি। সেই আগের মতই হাসি, আনন্দ, খুনসুটিতে ভরপুর আমাদের সম্পর্ক। খাওয়া শেষে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে কথাটা বলল নুসরাত।
মনের টান’টাই আসল নুসরাত। আর দূরত্ব কখনো কোনো সম্পর্কের অন্তরায় হতে পারে না, যদি সেখানে একে অপরের প্রতি টান, ভালোবাসা, বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা থাকে। তা যে কোনো সম্পর্ক’ই হোক না কেন। নুসরাতের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে জবাব দিলাম।
একদম ঠিক কথা বলছেন ম্যাম। এখানে মনের টান’টাই মূখ্য। (নুসরাত)
ডাক্তার সাহেবা! রাত’তো অনেক হয়েছে। তাই দয়া করে ঘুমান। কালকে সকালে তো আপনাকে আবার হসপিটালে যেতে হবে, তাই না? (আমি)
Okey, good night…..(Nusrat)
Good night….(Myself)
ঘন্টা দেড়েক হয়ে গেছে শুয়ে আছি। নুসরাত মনে হয় এতক্ষণে ঘুমিয়ে গেছে। বিছানা থেকে উঠে বসলাম। বালিশের নিচ থেকে ফোনটা বের করে ধীর পায়ে জানালার দিকে এগিয়ে গেলাম। ফেসবুক লগইন করলাম। দীর্ঘ ৬বছর পর চিরচেনা সেই “মায়া” আইডিতে ঢুকলাম। শত শত মেসেজ। মেসেজ পাঠিয়েছে মায়ার পাগল ভক্তরা। হ্যাঁ, ওরা আমার সেই পাঠক যারা একটা সময় আমার লেখা গল্প,কবিতা না পেলে পাগল হয়ে যেত। মেসেজের পর মেসেজ দিত। কখনো গল্প, কবিতা দিতে দেরি হলে আমার প্রতি ওদের অভিযোগের অন্ত ছিল না। আজ এই যে এতদিন এফবিতে ঢুকলাম মনে হচ্ছে ওরা এতটা দিন আমার নামের পাশে সবুজ বাতিটা জ্বলার অপেক্ষায়’ই ছিল। আজ যখন সবুজ বাতিটা জ্বলে উঠল তখন ওরা ঝাপিয়ে পরে ইনবক্সের উপর। শত শত পাঠকের শত শত মেসেজ। তন্মধ্যে একটা মেসেজের মধ্যে চোখটা আটকে গেল। যেখানে লেখা ছিল-
Very bad, Maya.
Very bad.
সখাকে পেয়ে বন্ধুকেই ভুলে গেলে?!!!
সবার সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে উত্তর দিলাম ঐ মেসেজকৃত আইডিতে। যে আইডির লোকটি সাথে ফেসবুকে প্রথম পরিচয় আমার। লোকটি প্রবাসী। নাম “শফিক”।
বয়স আনুমানিক পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে। চোখে সানগ্লাস। পরনের ধূসর কালো গেঞ্জিটা ধূসর বর্ণের চাদরে আবৃত। মুখের মিষ্টি হাসিটা যেন সবসময় লেগে থাকে।
লোকটার ছবি দেখলে কেমন যেন এক ভালো লাগা কাজ করে। বাঁধনের চেহারার সাথে লোকটার চেহারার অদ্ভুত মিল রয়েছে।
বাঁধনের সাথে পরিচয়ের শুরু থেকে শেষ অবধি এই লোকটার জানা।
ওনার সাথে শেষ কথা হয় সেদিন, যেদিন বাঁধন শেষ বার আমার এলাকায় গিয়েছিল। বাঁধনের সাথে দেখা করার আগ মুহূর্ত শফিক সাহেবকে ফোন দিলাম আমি। বুকটা তখন ধুরু ধূরু করে কাঁপছে। সেদিন বন্ধু শফিকের কাছে কাঁপা গলায় দোয়া চেয়েছিলাম। বলেছিলাম-
“দোয়া করবেন বন্ধু। দেখা করতে চাচ্ছি।”
সেদিন সেই কথাগুলোই ছিল বন্ধু শফিকের সাথে আমার শেষ কথা।
তারপর আর কথা হয়নি ওনার সাথে। ফেসবুক আইডি, সিম কোনোটাই আর ইউজ করা হয়নি বাঁধনের কাছে প্রত্যাখিত হওয়ার পর থেকে।
মেসেঞ্জারটা ওপেন করার সাথে সাথে বন্ধু শফিকের কল। কোনো দ্বিধা না করে কলটা রিসিভ করে ফেললাম।
ওপাশ থেকে এক মধ্য বয়স্ক লোকের কন্ঠে ভেসে উঠে__
” কেমন আছে এখন মায়ার বাঁধন?”
চলবে……