কুয়াশায় ঘেরা পর্ব-০৭

0
767

#কুয়াশায় ঘেরা
#পর্ব_০৭
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

হসপিটালে পৌঁছে ইলানের সাথে একটি কথাও বললনা আশরাফুল। ভীষণ রাগ হচ্ছে তার। কেনো জানেনা বারবার মনে হচ্ছে প্রভাতির এই অবস্থার জন্য ইলান দায়ী। অথচ এসবে ইলানের কোনো হাত নেই। প্রভাতিই অকারণে জড়িয়ে গিয়েছে কে’সটিতে। যদি না সে জঙ্গলে যেতো, আর না মা’র্ডারারের অবয়ব দেখতো। তাহলে এতকিছু হতোনা। এই পর্যায়ে এসে মাকে কিছু না জানিয়ে থাকতে পারলোনা আশরাফুল। আনোয়ারা জাহান মেয়ের জন্য হাসপাতালে ছুটে এসেছেন। স্বামীর চিহ্ন হিসেবে এই দুটো ছেলেমেয়ে উনার কাছে আছে।

ইলান মুনিরের ফোন কলে বেরিয়ে পড়ে।
মুখোমুখি বসে আছে স্বপন মির্জা আর ইলান মুনতাসীর। ইলান গলা পরিষ্কার করে প্রশ্ন করলো,
-“তুর্শি তো আপনার মেয়ে না। এটা কি সত্যি?”

চমকে উঠলেন স্বপন মির্জা। ভড়কানো গলায় বললেন,
-“ক কি যাতা বলছেন? তুর্শি আমার মেয়ে।”

ইলানের তীক্ষ্ণ চোখজোড়ার নড়চড় হলোনা। একইভাবে তাকিয়ে রইলো স্বপন মির্জার দিকে।
-“মি’থ্যে বলার চেষ্টা করবেননা। যথেষ্ট প্রমাণ আছে আমাদের কাছে।”

তুর্শির নিবন্ধন কার্ড বাড়িয়ে দিয়ে ইলান বলল,
-“এখানে তুর্শির বাবার নাম সারোয়ার মির্জা। তাছাড়া এই নামটা ও আপনার স্ত্রীর নয়, তুর্শির মায়ের নাম। ভুল হোক বা অজানাতে তুর্শির নতুন নিবন্ধন হয়নি। সমাপনী পরীক্ষা দেওয়ার পর ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তির সময় আপনার চোখে পড়ে বাবার জায়গায় আপনার ভাইয়ের নাম। এখন ঝামেলা,পরে ঠিক করবেন বলে আর ঠিক করা হয়নি। আমি ঠিক বলছি তো?”

মাথা নিচু করে রইলেন স্বপন মির্জা। ইলান যা যা বলছে সব সত্যি। একটা মেয়ের শখ ছিলো তার। ভাই মা’রা যাওয়ার পর মেয়েটাকে নিজের মেয়ে বলে বড় করে। মানুষের মুখ টাকা দিয়ে বন্ধ করে দেয়। লোকের কথা শুনে বড় হয়ে মেয়েটা যদি চলে যায়? তাকে আর বাবা না ডাকে?”

নিরবতা সম্মতির লক্ষণ। ইলান দ্বিতীয় প্রশ্ন করলো,
-“আপনার ছেলে কোথায়? খু’ন হওয়ার পর থেকে তার দেখা নেই। বোনের প্রতি দরদ নেই নাকি? নাকি চাচাতো বোন বলে।”

স্বপন মির্জা বললেন,
-“তুর্শির মৃ’ত্যুর পর একবার এসেছিলো। ও নাকি বন্ধুদের সাথে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে আছে।”

ইলান লক্ষ্য করলো পাশে দাঁড়ানো জাকিয়া মেয়েটি অনবরত ঘামছে। এসি অন করার পরও ঘামবে কেনো?

স্বপন মির্জার সাথে আলাপ শেষে সরাসরি জাকিয়ার দিকে প্রশ্ন তাক করলো ইলান।
-“আপনি ঘামছেন কেনো? আমার জানামতে এখানে আমি বা কেউই কোনো অস্বাভাবিক কথা বলেনি। কি লুকোচ্ছেন আপনি?”

জাকিয়া ওড়না দিয়ে কপাল, গলার ঘাম মুছে নিয়ে হাসার চেষ্টা করলো,
-“কোথায় ঘামছি?”

ইলান হালকা হেসে বলল,
-“ঘাম মুছে বলছেন কোথায় ঘামছেন? ম’রার ভ’য় নেই নাকি?”

কেঁদে ফেললো জাকিয়া।
-“স্যার প্লিজ স্যার আমি কিছু জানিনা।”

ইলান মেয়েটির দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলল,
-“আগে পানি পান করুন।”

জাকিয়া সময় নিলোনা। বাচবিচার ভুলে এক ঢোকেই পানি পান করলো।

ইলান শান্ত ভঙ্গিতে বলল,
-“এবার বলুন।”

-“আমি একটা সত্য গোপন করেছি। বড় স্যার মানে স্বপন মির্জার ছেলে ফরহাদ স্যার আমাকে নির্দেশ দিতেন তুর্শির খাবারে ঘুমের ঔষধ দিতে। ওর নাকি রাতে ঘুম হয়না।
প্রথমে আমি সেটাই করতাম। পরে কয়েকদিন লক্ষ্য করলাম উনি রাত হলে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, তখন তুর্শির ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দেন।
একদিন আমার মুখোমুখি হয়ে যাওয়ায় বললেন,
-“এ কথা কেউ জানলে জানে মে’রে দেবো।”

সেই ভ’য়ে আমি কিছুই বলিনি।”

ইলান সোজা স্বপন মির্জার দিকে তাকালো।
-“আপনি তো বলেছিলেন তুর্শি প্রায়ই ঘুমের ঔষধ নিতো ডাক্তারের পরামর্শে।
মি’থ্যে কেনো বলেছিলেন?”

স্বপন মির্জা কসম কে’টে বললেন,
-“তুর্শিকে ডাক্তার ঘুমের ঔষধ দিয়েছিলো। ও নিয়মিত নিতোনা, কিন্তু মাঝেমাঝেই ঔষধ নিতো। আপনি ডাক্তারের সাথে কথা বলে দেখুন।”

-“ফরহাদ এই মুহূর্তে কোথায় আছে? সাবধান তাকে পূর্বেই সতর্ক করে দিলে হাজত বাস হবে আপনার।”

স্বপন মির্জা জানালেন বন্ধুদের সাথে আছে, কিন্তু ঠিক কোন জায়গায় আছে সেটা জানেননা।

ইলান বলল,
-“ফোন, ম্যাসেজ কিছু করে?”

জাকিয়া বলল,
-“মাঝেমধ্যে আমার কাছ থেকে কে’সের তথ্য নেওয়ার জন্য ফোন করে।”

ইলানের ইচ্ছে করছে জাকিয়া মেয়েটাকে ঠা’টিয়ে দুটো চ’ড় মারতে। তনুশ্রী সাথে থাকলে নিশ্চিত তাকে দিয়েই চ’ড় মা’রতো। সমস্ত ইনফরমেশন লুকিয়ে রেখে এখন জানান দিচ্ছে। ইলান নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,
-“নিশ্চয়ই আবার ও ফোন করবে? কোনো ইনফরমেশন দেবেননা।”

জাকিয়া মাথা দুলিয়ে সায় জানালো। ইলান বেরিয়ে পড়লো। মুনিরের উদ্দেশ্য বলল,
-“জাকিয়া মেয়েটার ফোন ট্র্যাক করার ব্যবস্থা করো।”

———————

আজ একটু তাড়াতাড়িই বাসায় ফিরলো ইলান। মাহিনের সাথে তেমন কথা হয়নি তার। গোসল সেরেই মিহানের ঘরে গেলো। কিন্তু মিহান নেই। ওয়াশরুম থেকে জোরেসোরে পানি পড়ার শব্দ আসছে। মিহান নিশ্চিত ওয়াশরুমে আছে ভেবে ইলান বেরিয়ে যেতে নিলো। যেতে নিয়েও পা জোড়া থামিয়ে ফেললো। বেডসাইড টেবিলের পাশে কিছু একটা দেখলো। শিওর হওয়ার জন্য চটপট জিনিসটি হাতে নিয়ে খুলে দেখলো। শিওর হলো এটা মিহানের পাসপোর্ট।
এমন সময় মিহানের ফোন বেজে উঠলো। ”F” দ্বারা সেইভ করা নাম্বারটি। হাতের জিনিসটির সাথে ফোন সম্পর্কিত হতে পারে ভেবে রিসিভ করলো ইলান। ইলানের ঠোঁটের কোনে তাচ্ছিল্য মাখানো বাঁকা হাসি। দ্রুত পা চালিয়ে বেরিয়ে পড়লো।

খাবার টেবিলে বাবা মায়ের সাথে একসঙ্গে খেতে বসলো দুই ছেলে ইলান, মিহান। খাওয়ার এক পর্যায়ে ইলান কেশে উঠে বলল,
-“তোমাদের ছোট ছেলে ইন্ডিয়াতে স্যাটেল হওয়ার প্ল্যান করছে।”

ইলানের বাবা আর মা বিস্মিত হলেন। চমকে উঠলো মিহান ও। খাবার প্লেটেই হাত থেমে রইলো। আর হাত চললোনা।
মা বাবার জেরার মুখে পড়ে কোনো ভাবে পাশ কা’টিয়ে উঠলো মিহান।

রাতের অন্ধকারে মুখোমুখি দাঁড়ালো দুটি পুরুষ অবয়ব। কারো চোখে জলন্ত আগুনের লাভা, আর কারো ঠোঁটের কোনে এক টুকরো হাসির ঝলক।

-“ইন্ডিয়াতে স্যাটেল হচ্ছিস?”

ইলানের প্রশ্নের প্রতিত্তোরে মিহান ক্ষোভ মেশানো গলায় বলল,
-“তুমি যে পরিকল্পনা আঁটছো, সেটাতে সফল হতে পারবেনা।”

ব্যাগ পত্র নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলো মাহিন। মাঝরাস্তায় পথ আটকে দাঁড়ায় ইলান। মাহিনের কথায় কেবল হাসলো ইলান।
-“তুই যেভাবে আমাকে নিচ্ছিস। আমি কিন্তু এতটাও সোজা নই। আমার পরিকল্পনা তোর ভাবনার চেয়ে দুকাঠি উপরে।”

মিহান হুট করেই আ’ঘাত করে বসলো ইলানকে। আ’ঘাত পাওয়ার পূর্বেই শ’ত্রু মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত ছিলো ইলান। মিহানের হাতের চা’কু নিয়ে উল্টো তাকেই আ’ঘাত করে বসলো। টে’নে’হিঁ’চড়ে নিয়ে গেলো গাড়ির দিকে।

ইলান গুপ্তচর দিয়ে খোঁজ নিলো মিহানের বন্ধুদের মধ্যে কতজন সদস্য আছে? এবং তাদের ডিটেইলস।
ফরহাদ নামটি দেখে থমকালোনা ইলান। যেনো এমন কিছু হবে সে আগেই টের পেয়েছিলো। মিহানকে নিজের টিমের হাতে তুলে না দিয়ে তাকে আলাদা ট্রিট করার জন্য নিজের কাছে রাখলো। থেরাপি দেওয়ার সকল সরঞ্জাম রেডি। এখন শুধু স্পেশাল থেরাপি আর মুখ দিয়ে কথা বের করানো বাকি।

-“ফরহাদ কোথায় আছে?”

মিহান জেদ বজায় রেখে বলল,
-“বলবোনা।”

ইলানের ভেতরের হিং’স্র সত্তা জেগে উঠলো। চোখের সামনো ভেসে উঠলো নিষ্পাপ তিনটি মুখ। দুজন মৃ’ত, একজন অর্ধমৃ’ত তার ভালোবাসা। রডের আ’ঘাত আরও তীব্র হলো। মিহান চিৎকার করছে তবুও সত্য বলতে নারাজ।

ইলান ক্ষুব্ধ হয়ে বলল,
-“এর আগের বার ও তোকে আমি বাঁচিয়ে দিয়েছি। ভেবেছি শুধরে গিয়েছিস। বেআইনি কাজে আর জড়াবিনা। কিন্তু না, আমি ভুল ছিলাম। কুকুরের লেজ বারো বছর টে’নে রাখলেও সোজা হয়না।”

কথা শেষ করে প্রচন্ড জোরে মিহানের পিঠে আ’ঘাত করলো ইলান। শেষবার মা উচ্চারণ করে অচেতন হয়ে পড়ে মিহান। ইলান হাতের রড ছুড়ে ফেলে দিলো। মিহানের হাত পায়ের বাঁধন খুললেনা। মিহানকে উপুড় করে তার হাত পা বেঁধে রাখা হয়েছে।

রাতে বাড়ি ফিরে গেলো।
সকালে মায়ের আতঙ্কিত চেহারা নজরে পড়লো। আতঙ্ক, ভালোবাসা, ভ’য়, কষ্ট সবকিছুর সংমিশ্রণে মায়ের চোখে ছলছল করা পানির দেখা মিললো।
-“মিহান সত্যি সত্যিই ইন্ডিয়া চলে গিয়েছে। ঘরে ওর কোনো জিনিসপত্র নেই।”

ইলান দুঃখী চেহারার আড়ালে দুর্বোধ্য হাসলো।
#চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে