#কুয়াশায় ঘেরা আধার
#লেখিকা-জেনিফা চৌধুরী (ছদ্মনাম)
#সূচনা-পর্ব
প্রথম বিবাহ বার্ষিকীতে নিজের স্বামীকে নিজের হাতে সাজিয়ে গুছিয়ে অন্য একটা মেয়ের সাথে ফুলসজ্জার খাটে রেখে আসলো নুহা। নুহা কালেই জানতে পেরেছিলো নুহা মা হতে চলেছে এত বড় একটা খুশির সংবাদ সবাইকে জানানোর আগেই সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেলো। সবাই বেড়িয়ে যাওয়ার পর ভেতর থেকে দরজা আটকে দিতেই নুহা দরজায় পিঠ ঠেঁকিয়ে বসে হাটুতে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কান্না করে উঠলো। ওর কানে নিহানের বলা কথা গুলো বাজচ্ছে….
–এই বাচ্চা আমার না। আজকেই এই বাচ্চা নষ্ট করে দিয়ে তুমি এই বাড়ি থেকে চলে যাবে। আমি চাইনা তোমার কালো ছায়া আমাদের জীবনে পড়ুক।
নুহাকে আজ পৃথিবীর সব থেকে বড় অসহায় ব্যাক্তি মনে হচ্ছে। কান্নার মাঝে কাধে কারোর হাতের স্পর্শ পেয়ে হকচকিয়ে উঠে দাড়িয়ে সামনে তাকাতেই স্মৃতিকে চোখে পড়লো নুহার।স্মৃতিকে দেখেই ওকে ঝাপটে ধরে কান্না করে উঠলো নুহা। নুহার কান্না দেখে স্মৃতি আজ বাকরুদ্ধ। ও কথা বলার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছেনা।কি বলে স্বান্তনা দিবে ও নুহাকে। কান্না জড়ানো কন্ঠে স্মৃতি স্বান্তনা ভঙ্গীতে নুহার মাথায় হাত রেখে বললো,,,
-এত বড় একটা ডিসিশন নেওয়ার আগে একবার ও ভেবে দেখলি না কেনো? কিসের জন্য এত বড় একটা ডিসিশন নিলি তুই? কেনো নিজেকে সমাজের সবার চোখে এত টা নিচে নামিয়ে দিলি?আর কেনই বা এখন চোখের সামনে নিজের স্বামীকে অন্য একটা মেয়ের সাথে দেখে কষ্ট পাচ্ছিস? এসবের কারন কি নুহা?
নুহা কান্না থামিয়ে কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনেই কেউ একজন ওকে ধাক্কা মারতেই নুহা কয়েক হাত পেছনে ছিটকে পড়ে গেলো। ঘটনার আকস্মিকতায় নুহা আর স্মৃতি দুজনেই অবাক হয়ে পাশে তাকাতেই সিন থিয়া বেগমের রাগী চেহারা টা চোখে পড়লো।সিনথিয়া বেগম মানে নুহার শাশুড়ী নুহাকে ধাক্কা দিয়েই চেচিয়ে বলতে লাগলো….
_তোর মতো একটা নোংরা মেয়ে এখনো আমার বাড়িতে আছে কোন সাহসে। তোর মতো অলক্ষুণে মেয়েকে আর এক মিনিট ও আমি আমার বাড়িতে রাখবোনা।
বলেই তৎক্ষনাৎ নুহার হাত চেপে ধরে টানতে টানতে নিচে নেমে আসলো সিনথিয়া বেগম। নুহা কোনো টু-শব্দ না করে ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। স্মৃতি ওর মায়ের পেছনে এগিয়ে যেতে যেতে ওর মাকে বাধা দিচ্ছে। কিন্তু সিনথিয়া বেগম স্মৃতির কথায় কান না দিয়ে দরজায় সামনে গিয়ে ধাক্কা মেরে নুহাকে বাইরে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো……
__আজ থেকে এ বাড়ির দরজা তোমার জন্য বন্ধ।এক্ষুনি বেড়িয়ে যাও এ বাড়ি থেকে নয়তো দারোয়ান ডেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে ও এক মিনিট ভাববো না।
বলেই নুহার মুখের দরজার টা সজোরে বন্ধ করে দিলো সিনথিয়া বেগম। স্মৃতি সিড়ির সামনে দাড়িয়ে অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে ওর মায়ের দিকে। দরজা আটকে দিতেই নুহা দৌড়ে বাড়ির বাইরে বেড়িয়ে গেলো।
____________________________________________
নানা রকম ফুল দিয়ে সাজানো বিছানায় লাল শাড়ি পড়ে বড় একটা ঘোমটা দিয়ে বসে আছে তৃধা। ওর ঠিক সামনেই ড্রেসিং টেবিলের দিকে মুখ করে দাড়িয়ে আছে রায়মান। অশ্রুসিক্ত চোখে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আয়নায় দিকে। এ রুমে যে রায়মান ব্যাতিত অন্য একটা মেয়ে আছে সেদিকে ওর কোনো ধ্যান নেই। তৃধা অনেক ক্ষন বসে থেকে বিরক্ত হয়ে ঘোমটা তুলে খাটের থেকে নেমে এসে, রায়মান কে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতেই রায়মানের হুশ ফিরে আসলো। তৃধা রায়মানের পিঠে মাথা রেখে নরম কন্ঠে বলে উঠলো…..
_উফফ আমি ভাবতে পারছিনা। দ্যা গ্রেট সিংগার রায়মান খান নিহান আজ আমার বর। শেষ মেষ আমার স্বপ্ন টা সত্যি হলো। আমি আমার কল্পপুরুষ কে নিজের করে পেলাম। জানো রায়মান আজ আমার একটা বাংলা গান মনে পড়ছে।
“এ জীবনে যারে চেয়েছি আজ আমি তারে পেয়েছি” বলেই তৃধা রায়মানকে ছেড়ে হা হা করে হেসে উঠলো। দুই হাত মেলে চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে তৃধা হা হা করে হাসচ্ছে। ওর হাসির শব্দ পুরো খান বাড়ির আনাচে কানাচে বাজচ্ছে। তৃধা আবারো রায়মানের সামনে এসে রায়মানের হাত ধরতেই, রায়মান ঘুরে সজোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো তৃধার গালে। তৃধার গাল চেপে ধরে রাগী কন্ঠে চিৎকার করে বলতে লাগলো…..
—কি ভেবেছিস আমি তোকে বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছি বলে আমি তোর হয়ে যাবো। দুঃস্বপ্ন দেখছিস তুই।রায়মানের শরীরে এক বিন্দু রক্ত থাকতে রায়মান তোর হবেনা।
বলেই তৃধাকে ছিটকে ফেলে দিলো রায়মান। রাগে ওর শরীর কাপছে। সব কিছু ভেঙে চুড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। নিজেকে শান্ত করতে রায়মান বেলকনিতে গিয়ে দরজা আটকে দিলো। ওর দম বন্ধ হয়ে আসচ্ছে। রায়মান আজ নিরুপায়। না পারছে সত্যি টা সবাইকে বলতে, না পারছে এসব কিছু মেনে নিতে। নিজেকে এই মুহূর্তে রাস্তার একটা ক্ষুধার্ত পথশিশুর থেকেও বড় অসহায় মনে হচ্ছে ওর। এসব কিছু থেকে কি করে বের হবে ও?
রায়মান বেলকনিতে চলে যেতেই তৃধার রাগে ওর হাতের সামনে মোবাইল টা ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় ছুড়ে মারতেই ড্রেসিং টেবিলের আয়না টা চূর্ন-বিচূর্ন হয়ে চার দিকে ছড়িয়ে গেলো। তৃধা রাগে ওর শরীর থেকে গয়না গুলো খুলে চারদিকে ছুড়ে ফেলতে লাগলো। রাগ কমাতে একটা কাচের টুকরো নিয়ে নিজের হাতে এলোপাথাড়ি আঘাত করতে করতে বলতে লাগলো…..
—আমি কিছুতেই তোমাকে শান্তিতে বাঁচতে দিব না নুহা। কিছুতেই না। তোমার জন্য আজ আমি সব পেয়েও কিছুই পেলাম না শুধু মাত্র তোমার জন্য।তোমাকে আমি চিরদিনের জন্য আমাদের জীবন থেকে সরিয়ে দিব খুব শিঘ্রই।
বলেই আবারো অট্টোহাসিতে ফেটে পড়লো তৃধা।
____________________________________________
__তুমি ও জানতে মা নুহা কতটা নিস্পাপ মেয়ে তাহলে কেনো ওকে ওইভাবে কষ্ট দিলে মা? তুমি নিজেও জানতে নুহা নিজের ইচ্ছায় এসব কিছু করেনি। সব টা যেনে ও কেনো ওকে কু/কুরের মতো বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলে মা?
স্মৃতির করা প্রশ্নের উওরে সিন থিয়া বেগম স্মৃতির অগোচরে চোখের পানি টুকু দুই হাতে মুছে নিয়ে শক্ত গলায় বলে উঠলো…
—যা করেছি বেশ করেছি। যে মেয়ে নিজের স্বামীকে অন্য একটা মেয়ের সাথে এক ঘরে বাসর করার জন্য রেখে আসতে পারে সে মেয়ের আমার বাড়িতে থাকার কোনো অধিকার নেই। আমি কালেই ওর আর নিহানের ডিভোর্সের ব্যবস্থা করব। এ বাড়িতে আমার ডিসিশনেই শেষ ডিসিশন সেটা তুমি জানো স্মৃতি তাই আমি আশা করব এর পর যেনো এ বিষয়ে তোমার মুখ থেকে একটা শব্দ ও না বের হয়।অনেক রাত হয়েছে ঘুমাতে যাও।
মায়ের উপর কথা বলার সাহস স্মৃতির নেই তাই নিরবে মায়ের রুম ত্যাগ করলো স্মৃতি। স্মৃতি চলে যেতেই সিন থিয়া বেগম দরজা আটকে নিশব্দে কান্না করে উঠলো।
— এ ছাড়া আমার হাতে যে অন্য কোনো উপায় ছিলো না মা। আমাকে ক্ষমা করিস।
____________________________________________
রাতের নিস্তব্দ রাস্তায় গুটি কয়েক গাড়ি ধীর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। চারদিকে হাতে গোনা কয়েক টা চায়ের দোকান ছাড়া প্রায় সব দোকানের এই আলো নিভে গেছে। নুহা খালি পায়ে অশ্রু ভর্তি চোখে এগিয়ে যাচ্ছে অজানা গন্তব্যে। ওর কানে বার বার নিহানের বলা একটা শব্দ ভাসচ্ছে” আমি তোমাকে ভালোবাসি না আমি তৃধা কে ভালোবাসি। এই সন্তান আমি মানিনা, এই সন্তানের বাবা আমি না” । নুহা আর রায়মানের লাভ ম্যারেজ ছিলো। কাল ওদের বিয়ের ফাস্ট এনিভার্সারি ছিলো। আর কালেই নুহা ওর বিয়ের ফাস্ট এনিভার্সারির সব থেকে বড় গিফটা পেয়ে গেছে। নুহা এখনো বিশ্বাস করতে পারছেনা রায়মান ওকে ঠকিয়েছে কিন্তু নিজের চোখ কে মানুষ কি করে অবিশ্বাস করে? আর ভাবতে পারছেনা নুহা হাটু ভেঙে রাস্তার মাঝে বসে পাগলের মতো গলা ছেলড়ে চিৎকার করে কান্না করতে লাগলো।
—কি দোষ ছিলো আমার নিহান। কেনো এভাবে ঠকালে আমাকে? তুমি তো কাল আমাকে বলে গিয়েছিলো আমাদের ফাস্ট এনিভার্সারিতে তুমি আমাকে সারপ্রাইজ দিবে এই ছিলো তোমার সারপ্রাইজ।
বলেই নুহা আবারো কান্নায় ভেঙে পড়লো। কান্নার মাঝেই নুহার পেটে হাত লাগতেই ওর বাচ্চার কথা মনে পড়ে গেলো নুহার। নুহা পেটে হাত দিয়ে অসহায়ের মতো হাউমাউ করে কাঁদছে।
–তুমি বাবা হতে চলেছো নিহান। আমি আমাদের বাচ্চা কে কি পরিচয়ে বড় করব নিহান। ও তো বড় হয়ে ওর বাবার কথা জিজ্ঞেস করবে আমি কি উওর দিব। বলবো যে ওর বাবা এখন ঠক, প্রতারক, ওর মাকে ঠকিয়েছে। না নিহান আমি পারব না তোমাকে সবার সামনে ছোট করতে। কেনো এমন করলে তুমি??
#চলবে