কুয়াশায় ঘেরা আঁধার পর্ব -১১(শেষ পর্ব)

1
1652

#কুয়াশায় ঘেরা আঁধার
#লেখনীতে-জেনিফা চৌধুরী
#পর্ব-এগারো

–আমার পাপের শাস্তি এত বছর ধরে আমি পেয়ে এসেছি। সব পেয়েও আমি যেনো কিছুই পাইনি। এত গুলো বছর প্রত্যেক টা দিন, প্রত্যেক টা মুহূর্ত নিজের ভেতর গুমড়ে ম-রেছি।

পেছন থেকে উপরোক্ত কথাগুলো ভেসে আসতেই সবাই পেছনে তাকিয়ে দেখলো সিনথিয়া বেগম দাড়িয়ে আছে। সিনথিয়া বেগম কে দেখেই স্মৃতির ক্ষত নাড়া দিয়ে উঠলো। স্মৃতি লাফিয়ে উঠে দাড়িয়ে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সিনথিয়া বেগমের দিকে। আলিশা ঘৃনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর মায়ের দিকে। সিনথিয়া বেগম ধীর পায়ে এগিয়ে এসে স্মৃতির পায়ের কাছে বসে পড়তেই স্মৃতি পিছিয়ে গেলো। সিনথিয়া বেগম হাত জোড় করে বলতে লাগলো…..

–আমি যেই পাপ করেছি আমি জানি তার ক্ষমা হয়না। তোরা আমাকে যে শাস্তি দিবি আমি তাই মেনে নিব। শুধু একবার আমাকে ক্ষমা করে দে মা।

সিনিথিয়া বেগমের কথা শুনে আলিশা রাগী স্বরে চিৎকার করে বললো…..

—তুমি ক্ষমা চাচ্ছো। তুমি একটা খু/নী। তোমাকে নিজের মা বলতেও আমার ঘৃনা হচ্ছে। তোমাকে আমি পুলিশে দিব। আর তোমার যেনো ফাঁ/সি হয় সেই ব্যবস্থা ও আমি করব। তোমার দিকে তাকাতেও আমার ঘৃনা হচ্ছে। লজ্জা করছে তোমাকে মা বলে পরিচয় দিতে। তুমি এতটা নিচে নেমে গেলে। ছিঃ

বলেই আলিশা মুখ ঘুরিয়ে নিলো। ওর রাগে শরীর কাপছে। এক্ষুনি মন চাচ্ছে ওর মাকে নিজের হাতে শাস্তি দিতে। আলিশার চোখ থেকে পানি পড়ছে। কিন্তু এখন আর শব্দ করে কাদছে না ও। স্মৃতি দাত কড়’মড় করছে দাড়িয়ে। ওর চোখ থেকে আগুন ঝড়ছে।

—আমি আমার ভুল অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু তোদের হারানোর ভয়ে আমি কিছু বলতে পারিনি। বিশ্বাস কর আমাকে। কিন্তু আজ আমি সব হারিয়ে ফেলেছি। আমার ছেলে আমার ছেলের বউ। সব কিছু হারিয়ে আজ আমি রাস্তার ফকির। কিছু নেই আমার। আমাকে একবার ক্ষমা করে দে তারপর যা শাস্তি দিবি আমি মাথা পেতে নিব।

সিনথিয়া বেগম কথাগুলো বলতেই আলিশা আবারো বলে উঠলো….

–শুধু মাত্র তোমার জন্য আজ তিনটা মানুষকে নিজেদের প্রান হারাতে হয়েছে। আমার জীবন টা নষ্ট করে দিলে নিজের হাতে। এইযে এই মেয়েটাকে দেখো মেয়েটা প্রতিশোধের নেশায় নিজের সুন্দর লাইফ টা নষ্ট করলো। এর পর আর কি বাকি আছে তোমার।

আলিশার কথা শুনে সিনথিয়া বেগম আর কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই স্মৃতি আচমকা ড্রাইনিং টেবিলের উপর থেকে ফল কাটার ছু/ড়ি নিয়ে সিনথিয়া বেগমের গলায় বসিয়ে দিলো। সিনথিয়া বেগমের গলা দিয়ে গলগল করে র’ক্ত পড়তে লাগলো। সিনথিয়া বেগম গলা দিয়ে আর আওয়াজ বের হলো না। সে মাটিতে পড়ে ছটফট করতে লাগলো। স্মৃতি রাগে জোরে বলতে লাগলো……..

—শুধু মাত্র তোমার জন্য আমি আমার বাবা কে হারিয়েছি, আমার ভাই-আমার বোনের মতো ভাইয়ের বউকে আমি নিজের হাতে খু/ন করেছি। এইসব কিছুর জন্য তুমি দায়ী। আমি অন্যায় যেহেতু করেছি সেহেতু নিজের হাতে নিজের বাবার খু/নীকে শাস্তি দিয়ে গেলাম। এখন আর আমার আফসোস নেই।

বলেই স্মৃতি পা’গলের মতো হেসে উঠলো। আলিশা, আবরার, ইমন, যেনো বো’বা হয়ে গেছে। আলিশার চোখের সামনে ওর মাকে মৃ/ত্যু যন্ত্রনা ভোগ করতে দেখে ও আর সহ্য করতে পারলো। চোখের সামনে ভ’য়ংকর দৃশ্যটা সহ্য করতে না পেরে আলিশা ঢুলে পড়ে গেলো। স্মৃতি হাসতে হাসতে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো।
____________________________________________
কেটে গেছে সময়। সময় সময়ের গতিতে বয়ে চলেছে। সময় প্রবাহ মান। কারোর জন্য থেমে থাকেনা। সময় এবং স্রোত কখনোই কারোর জন্য থেমে থাকেনা। ঘড়ির কাটা আপন মনে ঘুরে চলে।সিনথিয়া বেগমের মৃ/ত্যুতে আলিশা অনেক টা ভেঙে পড়েছে। আলিশার এখন আর আপন বলতে কেউ বেঁচে নেই। আজ পাঁচ দিন হয়ে গেছে সিনথিয়া বেগম নেই। সেদিন স্মৃতি নিজের ইচ্ছায় গিয়ে পুলিশের কাছে স্যা’লেন্ডার করেছে। আলিশাকে এই কয়েকদিন আবরার আর নুহার মা সামলিয়েছে। ওদের সম্পর্কের কথা যেনে আবরারের পরিবার আলিশা আর আবরারের বিয়ের আয়োজন করেছে ঘোরোয়া ভাবে। আজ ওদের বিয়ে। আলিশার মনের অবস্থা ভালো নেই। আর বিয়ে করা ছাড়া আবরার আলিশার পাশেও থাকতে পারছেনা। নানারকম মানুষ নানা কথা বলে। মেরুন কালার শাড়ির সাথে, খোলা চুল,মুখে কোনো মেকাপ নেই,ঠোঁটের হালকা লিপস্টিক, দেখতে আলিশাকে বড্ড সুন্দর লাগছে। এত সুন্দর মুখে হাসিটা মিসিং। আবরার আলিশার পাশে বসে আলিশার হাতটা শক্ত করে চেপে আছে। আলিশার চোখের কোনে পানি। সুন্দর ভাবে ওদের বিয়েটা সম্পন্ন হলো। রাতে আবরার রুমে ঢুকে চারদিক ফাঁকা দেখে বেলকনিতে যেতেই দেখলো আলিশা বেলকনির রেলিং এ মাথা ঠেকিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আবরার পেছন থেকে আলিশার কাধে হাত রাখতেই আলিশা চেনা স্পর্শ পেয়ে আবরারকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। আবরার আলিশার মাথায় ধীরে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে উঠলো…….

—-আর কত কাঁদবে? দেখো পরিস্থিতির উপর আমাদের হাত থাকেনা। তোমার ভাগ্যে হয়তো এমন টাই লেখা ছিলো। আর কেঁদো না প্লিজ। আমি আছি তো। আমি তোমাকে সারাজীবন আগলে রাখবো। প্রমিস।

আবরারের কথা শুনে আলিশার কান্নার বেগ আরো বেড়ে গেলো। আলিশা কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলো…..

–আমার কেউ নেই আবরার। আমার মা,আমার বাবা,আমার ভাই,বউমনি কেউ নেই আমার পাশে। আজ আমার জীবনে এত বড় একটা খুশির দিন কিন্তু দেখো আমার পাশে আমার আপনজন কেউ নেই। আমার এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে একজন ও নেই।
আমি আজ খুশি হতে পারছিনা আবরার। কিছুতেই পারছিনা।

আবরারের চোখের কোনেও জল। আবরার আলিশার মুখটা তুলে দুই হাতে ওর চোখের জল মুছিয়ে ওর কপালে ঠোঁট ছুয়ে দিয়ে বলে উঠলো…..

—আমি আছি তো। আমি সারাজীবন তোমার পাশে ছায়ার মতো থাকবো। একদম কাঁদবে না। আর এক ফোটা ও চোখের পানি ফেলবে না।

আলিশার চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। আলিশা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে উঠলো….

–স্মতি আপুর জীবন টা এইভাবে জেলের ভেতর নষ্ট হবে আবরার?

বলেই আলিশা করুন চোখে আবরারে দিকে তাকাতেই আবরার ভাবুক স্বরে বলে উঠলো….

—দেখো স্মৃতি অন্যায় করেছে। অনেক বড় অন্যায়। আমরা হয়তো স্মৃতির পরিস্থিতি বুঝতে পেরেছি কিন্তু আইন স্মৃতির অন্যায়টা দেখবে। স্মৃতিকে আদালত ফা/সির রায় ঘোষনা করেছে। আমাদের হাতে কিছু নেই। তাই এইসব ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করো। আমরা কিছু করতে পারব না।

আবরারের কথা শুনে আলিশার চোখ থেকে নোনা জল গড়িয়ে পড়লো। সত্যিই সব ভুলে যাওয়া ছাড়া ওদের কিছু করার নেই। আলিশা বড় করে নিশ্বাস ছেড়ে মুখে হাসির রেখা টানার চেষ্টা করলো। আবরার আচমকা আলিশার ঠোঁটে লম্বা একটা চুমু দিয়ে বলে উঠলো…..

—অতীত মনে রাখতে নেই। তাই অতীত ভুলে আজ থেকে আমরা নতুন জীবন শুরু করব। সব #কুয়াশায়_ঘেরা_আধার কাটিয়ে আমাদের জীবনে নতুন সূর্য উঠবে।

বলেই আলিশাকে জড়িয়ে ধরলো। আলিশা ও পরম আবেশে আবরার কে জড়িয়ে ধরলো। এখন আবরারেই বেঁচে থাকার এক মাত্র অবলম্বন। ওরা ওদের জীবনের সব আধার কাটিয়ে ভালো থাকুক। ওদের জীবনে নতুন ভোরের আলোয় চারদিকে ঝলমলে হয়ে যাক। বেঁচে থাকুক ওদের ভালোবাসা।
___________________________________________
স্মৃতি কারাগারের দেয়ালে মাথা হেলিয়ে বসে আছে। ওর চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। ওর জীবন টা এইভাবে নষ্ট হয়ে যাবে ও ভাবতেও পারেনি কখনো। স্মৃতি ভাবছে ওর নিশ্চয়ই ফা/সি হবে। চারটা খু/নের শাস্তি তো ফা/সিই হবে। যদি ফা/সির থেকে বড় কোনো শাস্তি থাকতো তাহলে সেই শাস্তিটা স্মৃতি পেতো। এইসব ভেবেই স্মৃতি শান্ত কন্ঠে বলে উঠলো….

—আমি খু/নী। হ্যাঁ, আমি খু/নী। কিন্তু আমার একটুও আফসোস হচ্ছেনা। ওই মহিলাকে আমি তার পাপের শাস্তি দিতে পেরেছি। বাবা আমি তোমার খু/নের বদলা খু/ন করেই নিলাম। ভাই আমাকে কোনো দিন ক্ষমা করিস না। আমি তোদের নিজের হাতে নির্মম ভাবে মে-রেছ। কোনো দিন ক্ষমা করিস না। তোরা উপরে ভালো থাক। আমিও আসচ্ছি খুব শিঘ্রই।

বলেই হাটুতে মুখ গুঁজে কেঁদে উঠলো। যতদিন না ফাঁ/সি হচ্ছে ততদিন ওকে এউ চারদেয়ালের মাঝে বন্দি থাকতে হবে।

#সমাপ্ত

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে