#কুয়াশায় ঘেরা আঁধার
#লেখনীতে-জেনিফা চৌধুরী
#পর্ব-দশ
–ওই মহিলাকে মা বলতেও আমার ঘৃনা লাগে। আমার বা’বার হ/ত্যাকারীকে আমি নিজের হাতের খু/ন করতে চাইছিলাম। কিন্তু আমার ছোট্ট ভুলের জন্য একটা খু/নী আজ বেঁচে গেলো।
স্মৃতির রাগে দাতকড়মড় করতে করতে কথাগুলো বলে উঠলো। উপস্থিত সবাই যেনো বিস্ময়ের চরম পর্যায়। আরিশা রাগে চিৎকার করে বলে উঠলো……
—কি বলছিস কি তুই? তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আর একবার মায়ের নামে একটা বা’জে কথা বলে দেখ আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। উনি তোর মা হয়। আর তুই কিনা তার নামে। ছিঃ লজ্জা করছে না তোর?
আরিশার কথা শুনে স্মৃতি শব্দ করে হেসে উঠে বলে উঠলো……
—মা। হা হা মা শব্দটার মতো পবিত্র শব্দ ওই মহিলার সাথে মানায় না।
স্মৃতির এহেতুক কথা শুনে আলিশা সমস্ত শক্তি দিয়ে স্মৃতির গালে পর পর দুইটা থা”প্পড় মে/রে তৃতীয় থা”প্পড় দেওয়ার জন্য হাত উঠাতেই স্মৃতি আলিশার হাতটা মুচ’ড়ে ধরে রাগী স্বরে চিৎকার করে বললো….
—আমি তোর বড়। আমার গায়ে হাত উঠানোর সাহস তোর হয় কি করে?
আবরার আলিশাকে স্মৃতির থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে শান্ত কন্ঠে স্মৃতির দিকে প্রশ্ন ছু’ড়ে দিলো….
–কেনো এমন করেছো তুমি? ওরা তো তোমার নিজের মানুষ তাহলে কেনো এমন করছো? কি কারনে? কিসের রাগ তোমার?কেনো এতো নিচে নামলে?
আবরারের কথা শুনে স্মৃতি আচমকা কেঁদে উঠলো। সামনের চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লো। স্মৃতি কে দেখতে এই মুহূর্তে অসহায় মনে হচ্ছে। উপস্থিত মানুষ গুলো ওর দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষনের নিরবতা কাটিয়ে স্মৃতি বলতে শুরু করলো……
—আলিশা আমার নিজের বোন না আর সিনথিয়া খান ও আমার নিজের মা না। আমার নিজের মা তো ভাইকে জন্ম দেওয়ার সময় পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছে। আমি তখন সবে মাত্র চার বছরের একটা কন্যা। ভাইকে সামলানো, অফিসের কাজে সব মিলিয়ে বাবা হিমশিম খাচ্ছিলো। সব দিক ঠিক রাখতে পারছিলোনা কিছুতেই। তাই দ্বিতীয় বিয়ে করে সিনথিয়া খান কে এ বাড়িতে নিয়ে এলো।। সিনথিয়া খান এসে পাকা হাতে আমাদের সংসারের হাল ধরলো। আমাকে নিজের মায়ের মতোই ভালো বাসতো। এক বছরের মাথায় কোল আলো করে আলিশা এলো। সত্যি একটা বোন পেয়ে আমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম। সবার কাছে শুনেছিলাম সৎ মা নাকি আপন মা হতে পারেনা। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছিলো সিনথিয়া খান আমার নিজের মা। কখনো মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি। এভাবেই হাসি, আড্ডা, খুশিতে আমাদের জীবন চলছিলো। মনে হয়েছিলো আমাদের খান বাড়িটা একটা সুখের রাজ্য আর সেই রাজ্যের সদস্য আমরা। কিন্তু হঠাৎ করেই…….
বলেই স্মৃতি থেমে গেলো ওর গলা আটকে আসচ্ছে।
স্মৃতি কে থেমে যেতে দেখে আলিশা কাঁপা কন্ঠে বললো……
—কিন্তু কি? বলো প্লিজ? কি হয়েছিলো?
আলিশার কথা শুনে স্মৃতি দুই হাতে চোখের জল মুছে নিয়ে বলতে শুরু করলো…
–১২ সেপ্টেম্বর সেদিন ভাই তিন বছরে পা রাখলো। বাবা বড় করে ওর জন্মদিন পালন করার আয়োজন করলো। সবটা ঠিক ঠাকেই চলছিলো। সন্ধ্যায় যখন সবাই নিহান কে নিয়ে ব্যস্ত তখন উপস্থিত সবার মাঝে আমি বাবা-মা কে খুঁজে না পেয়ে বাবা মায়ের রুমের দিকে যেতেই আমার কানে কিছু কথা ভেসে আসে কথা গুলো এমন ছিলো…..
—তুমি আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারো না? আমি তোমাকে আমার সব লিখে দিলে আমার ছেলে মেয়ের ভবিষ্যৎ কি হবে?
—আমি তোমার ছেলে মেয়ের কথা এত ভাবতে পারব না। আমার মেয়ে আলিশার নামে সমস্ত সম্পত্তি লিখে না দিলে আমি সব শেষ করে দিব।
এইসব কথা নিয়েই বাবা মায়ের মধ্যে ঝগড়া চলছিলো। বাবা কিছুতেই আলিশাকে সব দিতে রাজী হচ্ছিলো না। আমি পর্দার আড়াল থেকে লুকিয়ে সবটা দেখছিলাম। ঝগড়ার এক পর্যায়…..
বলেই স্মৃতি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আলিশা শক্ত কাঠ হয়ে দাড়িয়ে আছে। আবরার আবার প্রশ্ন করতেই স্মৃতি নিজেকে সামলে বললো……
—ঝগড়ার এক পর্যায় মা রেগে সামনে থাকা ফল কা/টার ছু/ড়ি দিয়ে বাবার বুকে আঘাত করে। বাবা মুহূর্তেই মৃ/ত্যুর কোলে ঢুলে পড়ে। একটা সাত বছরের বাচ্চা চোখের সামনে নিজের বাবা কে খু/ন হতে দেখলো তাও কার হাতে নিজের সৎ মায়ের হাতে। তুই সহ্য করতে পারতি এই দৃশ্য……
শেষ কথাটা স্মৃতি আলিশার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো। আলিশা কয়েক পা পিছিয়ে পড়ে যেতে নিলে আবরার ধরে ফেললো। সবার চোখে পানি সবার মাঝে নিরবতার প্রতিযোগিতা চলছে। সবাই যেনো কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। নিরবতা ভেঙে স্মৃতি বললো…..
—খুব সহজেই বাবার খু/ন টাকে আমার উকিল মা আত্ম/হত্যা বলে চালিয়ে দিলো। সাত বছর থেকে সেই রাগ টা মনের মধ্যে পুষে রেখেছিলাম। যার কারনে আজ আমি খু/নী। হ্যাঁ, আমি খু/নী আমার ভাইয়ের খু/নী, তৃধার খু/নী। কিন্তু, আমি এদের মা-রতে চাইনি বিশ্বাস কর। আমি তোকে আর তোর মাকে মা-রতে চেয়েছিলাম। আমার বাবার খু/নের প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মাঝ খান থেকে আমার নিজের ভাই আর ভাইয়ের বউকে নির্মম ভাবে ম-রতে হলো। যাদের জন্য এইসব কিছু করা তারাই যখন বেঁচে আছে তখন আমার আর কিছু করার নাই। আমাকে যা শাস্তি দেওয়া হবে আমি সব মাথা পেতে মেনে নিব।
স্মৃতি নিরবে চোখের জল ফেলছে। আলিশা মুখে হাত চে-পে কান্না আটকানো চেষ্টা করছে। স্মৃতির বলা প্রত্যেক টা কথা আলিশার চোখের সামনে ভাসচ্ছে। আলিশা স্মৃতির কষ্টের পরিমান টা বুঝার চেষ্টা করছে। নাহ! এই কষ্টটা আলিশা সহ্য করতে পারতো না। তাহলে একটা সাত বছরের মেয়ে কি করে সেই ভ-য়ংকর দৃশ্য সহ্য করেছে। আলিশা আর ভাবতে পারলো না। দৌড়ে এসে স্মৃতির পায়ের সামনে বসে স্মৃতি কে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। স্মৃতি শক্ত হয়ে চোখের পানি ফেলছে। আবরার আর ইমনের চোখের কোনেও পানি জমে আছে। ওই মেয়েটার বুকে হাজার কষ্ট চা/পা পড়ে আছে। সেইটা এত বছরে কেউ বুঝতে পারেনি। স্মৃতি ঠোঁট কা/মড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে। আজ নিজেকে ওর অসহায় লাগছে। নিজের হাতে নিজের ভাইকে আগুনে পু’ড়িয়ে নির্মম ভাবে মে/রেছে। ভাবতেই স্মৃতির বুক ফে’টে যাচ্ছে। এই কয়েকদিন প্রতিশোধের নেশায় ওর মধ্যে থেকে এই শোক টা হারিয়ে গিয়েছিলো। আজ তা সব বাধ ভেঙে বাইরে বেড়িয়ে এসেছে। আলিশা কাঁদতে কাঁদতে স্মৃতি দুই হাত আকড়ে ধরে বলে উঠলো….
—কি করে সহ্য করেছিলি এত কিছু? আমার মা কে এতটা নিচে নামতে পারে আমি ভাবতে পারছিনা। কি করে এত বছর মুখ বুঝে সব সহ্য করেছিলি। আমাকে কেনো মে/রে ফেললিনা। আমাকে মে/রে ফেললে আজ আমার মায়ের নোং’রা মুখোশ টা আমার দেখতে হতো না। এত ভালো চেহারার পেছনে এত কুৎসিত একটা মুখোশ ছিলো আমি ভাবতে পারছিনা। ভাবতে পারছিনা আমি।
বলেই আবারো কেঁদে উঠলো। স্মৃতি শান্ত কন্ঠে জবাব দিলো……
—আমি আমার ভাই কে হারিয়ে ফেলেছি। আমার ভাইকে আমি নিজের হাতে মে-রেছি। আমার দম বন্ধ হয়ে আসচ্ছে। প্রতি’শোধের নে’শায় আমি পা’গল হয়ে গিয়েছিলাম। আমিও ভুল করে গিয়েছি একের পর এক। আমার শাস্তি হওয়া দরকার। আমার ও আমার ভাইয়ের মতো নির্মম মৃ/ত্যু হওয়া উচিত। আমি এই অপরাধের বোঝা মাথায় নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবো না।
স্মৃতির কথা শুনে আবরার শান্ত কন্ঠে জবাব দিলো…..
–তোমার ভাইকে মে/রে ফেলার অপরাধ বোধে তোমাকে ম/রতে হবে না…….
#চলবে