কুয়াশায় ঘেরা আঁধার পর্ব -০৯

0
1129

#কুয়াশায় ঘেরা আঁধার
#লেখনীতে-জেনিফা চৌধুরী
#পর্ব-নয়

–ড্যাম ইট। যাদের মা/রার জন্য এত কিছু সেই সিনথিয়া বেগম আর আলিশা বেঁচে গেলো কি করে? উফফ এত বড় একটা মিস্টেক কি করে করলাম। আজ আমার ভুলে আমার ভাইকেও আমি খু/ন করলাম।

বলেই স্মৃতি সবার আড়ালে নিজের চুল খামচে ধরলো দুই হাত দিয়ে। সামনে থাকা লা/শ দুটোর দিকে তাকিয়ে ও ভেতরে ভেতরে পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে। আলিশা পা’গলের মতো চিৎকার করে কাঁদছে। আবরার কিছুতেই শান্ত করতে পারছেনা ওকে। পুলিশ ডিএন টেস্ট করে নুহা আর নিহানের লা/শ দুটো শনাক্ত করে দিয়ে গেছে। বিকেলের মন মাতোয়ারা পরিবেশটা আজ থমথমে। চারদিকের পরিবেশ নিস্তব্ধ। কি হাহা কার চলছে চারদিকে। ছেলে-মেয়ে হারানো দুই মায়ের আতৎনাদ, ভাই হারানো বোনের চিৎকার, বেস্ট ফ্রেন্ড হারানোর বিষাদ,সব মিলিয়ে পরিবেশটা বিষা’ক্ত হয়ে উঠেছে। বিষাদের আগুনে জ্ব’লে যাচ্ছে কয়েকটা জীবন্ত প্রান। জ্বলসানো লা/শ দুটোকে দা’ফন করার কার্যক্রম শেষের পথে। সিনথিয়া বেগম কান্না করতে করতে অস্থির হয়ে আছে। আজ যে তার বুকটা বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। নুহার মা বারবার জ্ঞা’ন হারাচ্ছে বলে তাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সিনথিয়া বেগমের গলা বসে গেছে। হঠাৎ করেই পা’গলের চিৎকার করে উঠতে আলিশা ওর মাকে ঝাপটে ধরতেই সিনথিয়া বেগম আলিশাকে বুকে চেপে বলতে লাগলো……

–আমি কি অন্যায় করেছিলাম? যার জন্য এত বড় শাস্তি পেতে হলো আমাকে। আমার বুকের ভেতর টা সব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। আমার বেঁচে থাকার আলো নিভে গেছে।

বলেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো দুজনেই। নাহ এই দৃশ্য চোখে দেখার মতো না। এই হাহাকার মেনে নিতে পারছেনা উপস্থিত সবাই। আবরার শক্ত কাঠ হয়ে দেয়াল ঘেষে দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে। ওর যে দম বন্ধ হয়ে আসচ্ছে। চোখের সামনে নুহা আর নিহানের বিধ্বস্ত, জ্বলসানো চেহারা স্পষ্ট ফুটে উঠছে। আবরার এত কিছুর মধ্যেও খেয়াল করছে স্মৃতির চোখে অসহায়ের কোনো ছাপ নেই, কোনো কষ্ট নেই, এই চোখে লুকিয়ে আছে অন্য কোনো রহস্য, হঠাৎ করেই ওর কালকে নুহার দেওয়া লাস্ট ম্যাসেজটার কথা মনে পড়লো। কাল নুহার দেওয়া লাস্ট ম্যাসেজ টা ছিলো…..

“বেঁচে থাকার রাস্তা খোলা নেই আমাদের কাছে। শেষ রহস্য উদ্ধার করতে পারলাম না আমরা। অসম্পূর্ণ রহস্য খুঁজে বের করার দায়িত্ব তোর উপর দিয়ে গেলাম। স্মৃতির পাতা ম/রন ফাঁদে এমন ভাবে আটকে গেছি আর উঠে আসার রাস্তা নেই”

হঠাৎ করে লাইন গুলো মনে উঠতেই আবরার বাড়ির বাইরে বেড়িয়ে এলো। লাইন গুলো বার বার নিজে নিজেই আওড়াতে আওড়াতে আবরার হঠাৎ থেমে গেলো।

—স্মৃতির ফাঁদে আটকে গেছি উঠে আসার রাস্তা নেই। স্মৃতির নাম কেনো বললো ও? আর কিসের ফাঁদ? সবটা কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে? কি বুঝাতে চাইলো নুহা। নাহ! আমাকে ভেঙে পড়লে চলবে না সব রহস্য উদঘাটন করতেই হবে। যে করে হোক। আগুন লাগাটা যদি এক্সিডেন্ট হয় ওকে ফাইন। কিন্তু এটা যদি কোনো পরিকল্পিত ঘটনা হয়ে থাকে তাহলে যে করেছে তাকে আমি কিছুতেই ছাড়ব না।

আবরারের মাথা কাজ করছে না হঠাৎ করেই সবটা এলোমেলো হয়ে গেলো।
____________________________________________
যে যাওয়ার সে যায় আর থেকে যায় সব স্মৃতি। নিহান আর নুহা ও চলে গেছে আজ এক সপ্তাহ হলো। পরিবেশ টা এখনো গমগমে। সিনথিয়া বেগম আর আলিশা দুজনেই মানসিক ভাবে ভেঙে গেছে।আবরার দিন রাত রহস্য উদঘাটন করায় ব্যস্ত। ইদানীং স্মৃতির ব্যবহার ঠিক লাগছেনা আবরারের। সিনথিয়া বেগমের জমানো কিছু টাকা দিয়ে থাকার মতো একটা ফ্লাট কিনেছে। সেখানেই উঠেছে সবাই।
আবরারের গাড়ি আইসক্রিমের কারখানার সামনে এসে থামতেই আবরার মুখে মাস্ক পড়ে নিলো। ইমন গাড়ি থেকে বেড়িয়ে এসে আবরারের পাশে দাড়িয়ে বললো…..

—তুই শিউর এখানে আব্দুল কে পেয়ে যাবি।

আবরার একটু কেশে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো…..

—হ্যাঁ। আমি খোঁজ না নিয়ে এখানে আসিনি। আমি খোঁজ নিয়েছি। ছেলেটার নাম রাহাত। আর এই আইসক্রিমের ফ্যাক্টরিটা ওর। আর এইসময় ও হিসাব নিকাশ নিতে এখানে উপস্থিত থাকে।

ইমন মাথা নাড়াতেই ওরা দুজনেই ভেতরে ঢুকলো।
দুজন অপরিচিত লোক কে ভেতরে ঢুকতে দেখে রাহাত এগিয়ে এসে কড়া কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো…..

—আপনারা কে? এখানে কি চান?

রাহাতের প্রশ্ন শুনে ইমন কিছু বলতে যাবে তখনি আবরার বলে উঠলো….

–আপনার সাথে একটু জরুরী কথা ছিলো। একটু বাইরে আসবেন প্লিজ……

রাহাত ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো……

—আমার সাথে আপনার কি কথা? আপনি কে বলুন তো মশাই। কিসের মতলবে এখানে ঢুকেছেন।

ইমন একটু জোরেই বললো…..

—বাইরে আসুন সবটা বলছি।

রাহাত বাধ্য ছেলের মতো ওদের সাথে বাইরে আসতেই ইমন লোক চক্ষুর আড়ালে রাহাতের পিঠে বন্ধু’কের নাল ঠেকাতেই রাহাত ভয়ে আতকে উঠে কিছু বলতে যাবে তখনি আবরার বলে উঠলো….

—একদম কথা নয়। যা যা প্রশ্ন করব সব প্রশ্নের সোজা উওর দিবি নয়তো। গাড়িতে উঠে বস।

রাহাত ভয় পেয়ে বাধ্য ছেলের মতো গাড়িতে উঠে বসতেই আবরার ওর দিকে প্রশ্ন ছুড়ে মারলো…..

—খান বাড়িতে কার কথায় আ’গুন লাগিয়েছিলি?

আবরারের প্রশ্ন শুনে রাহাত আমতা আমতা করতে লাগলো। ইমন জোরে ধমক দিতেই রাহাত গড়গড় করে বলা শুরু করলো……

—আমাকে মা/রবেন না দয়া করে। আমি স্মৃতি ম্যাডামের কথায় এইসব করেছি। ম্যাডাম আমাকে ওই বাড়িতে আ’গুন লাগাতে বলেছিলো। আমার কোনো দোষ নেই। আমি শুধু তাকে সাহায্য করেছি আগুন আমি দেইনি ওই বাড়িতে স্মৃতি ম্যাডাম নিজের হাতে দিয়েছে।

রাহাতের কথা শুনতে আবরার আর ইমনের মাথায় বাজ পড়লো। ওদের চোখ দুটো কোটর ছেড়ে বেড়িয়ে আসার উপক্রম। ইমন যেনো নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছেনা। আবরার আগের থেকে যেহেতু ব্যাপার টা বুঝতে পেরেছিলো তাই শক টাও কমেই লেগেছে ওর। ইমন রাগী স্বরে বলে উঠলো…..

—কেনো মিথ্যা বলছিস তুই? স্মৃতি নিহানের বোন। ও কেন ওর নিজের ভাইকে মা/রবে। সত্যি কথা বল নয়তো এক্ষুনি জেলে ভ’রে দিব।

রাহাত আবারো কঠিন স্বরেই বলে উঠলো…..

–মিথ্যা বলে আমার কি লাভ বলুন? আমি সত্যি বলছি। বিশ্বাস করুন…..

আবরার কে শান্ত দেখে ইমন ওর দিকে তাকাতেই আবরার একটু মলিন হেসে বললো……

—আমি আগেই জানতাম। নুহা আমাকে ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছিলো। আফসোস হচ্ছে জানিস অনেক আফসোস। কেনো আগে জানলাম না তাহলে হয়তো নুহা আর নিহান কে এইভাবে ম/রতে হতো না।

আবরারের চোখে পানি জমে আছে। যে কোনো মুহূর্তে গড়িয়ে পড়বে।
____________________________________________

—নিজের ভাই আর ভাইয়ের বউকে হ”ত্যা করলি তুই ? একবার ও বুক কাপলো না তোর। বউ মনিতো তোকে নিজের বোনের চাইতেও বেশি ভালোবাসে তার তাকেই তুই এই বিভৎস মৃ/ত্যু দিলি। কেনো এমন করলি তুই?

আলিশা রাগে চিৎকার করে কথা গুলো বলে কান্না করে উঠলো। আলিশার পাশে আবরার আর ইমন দাড়িয়ে আছে। স্মৃতি আলিশার সামনে বুকে হাত গুজে দায়সারা ভাবে দাড়িয়ে আছে। ওর চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছেনা ওর মধ্যে কোনো অনুতপ্ত হচ্ছে। আলিশার কথা শুনে স্মৃতি ডোন্ট কেয়ার ভাবে জবাব দিলো……

— হ্যা নিহান আমার ভাই ছিলো। ওকে আর নুহাকে মা/রা আমার উদ্দেশ্য ছিলো না। উদ্দেশ্য ছিলো তোর মা আর তোকে মা/রার। কিন্তু নুহা বড্ড চালাক হওয়ায় ওর জীবন দিতে হলো। কিন্তু কি আর করার যে ম/রে গেছে সে তো আর ফিরে আসবে না। আমার ভাইয়ের মৃত্যু হয়তো এমন করেই লেখা ছিলো।

স্মৃতির কথা বলে থামতে দেরি কিন্তু ওর গালে সজোরে থা’প্পড় পড়তে দেরি হলো না। আবরার স্মৃতির গালে সজোরে একটা থা’প্পড় মে/রে বলে উঠলো…..

—নিজের ভাই কে নির্মম ভাবে খু/ন করে বড় মুখে স্বীকার করছো। তোমার লজ্জা হচ্ছেনা একটুও। আবার বলছো আলিশা আর ওর মাকে মা/রা উদ্দেশ্য ছিলো। ছিঃ এতটা জ’ঘন্য তুমি। নিজের মা আর বোন কে খু/ন করতে চেয়েছিলে।

আবরারের কথা শুনে স্মৃতি আবরারের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চেচিয়ে বলে উঠলো…..

–মা বোন মাই ফুট। কে মা? কে বোন? আমি ওই বাজে ম’হিলার মেয়ে না। শুনতে পেরেছো তোমরা। আলিশা আমার বোন না। সিনথিয়া বেগমের মতো বাজে মহিলা আমার মা না।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে