#কুসুম_কাঁটা
#৩৯ও শেষ পর্ব
পাথরবাড়িতে সময় কাটিয়ে অবশেষে সবাই বাড়ি ফিরলো। যাবার সময় যতটা আনন্দ ছিলো, ফেরার পথে আনন্দ যেন দ্বিগুণ হলো। সবার মনের থমথমে ভাবটুকু যেন কেটে গেছে। তৌহিদ তুলিকে একশবার সরি বলেছে। রঙ্গনা বলেছে এক লক্ষ বার সরি বলতে। বুবু এমনিতে ঠান্ডা মানুষ হলে কী হবে, তার রাগ কিন্তু কঠিনের চেয়েও কঠিন। তৌহিদ হাল ছাড়ছে না। ঢাকায় ফিরে খাতা কলমে সরির হিসাব লিখে রাখবে।
***
ঢাকায় ফিরে সবাই সবার মতো ব্যস্ত হয়ে গেল। শ্রাবণ্যর পড়াশোনা, স্বপ্নীলের জব সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। স্বপ্নীলের এখন আর নিজেকে কোথাও বোকা বোকা লাগে না। কনফারেন্স রুমে যখন দাঁড়িয়ে ব্রিফ দেয় তখন নিজেকে সবার মধ্যে স্মার্ট লাগে। কেউ আর ও’কে খুঁচিয়ে কিছু বলতে পারে না। কাউকে কটু কথা না বলতে পারলেও ইগ্নোরটুকু ভালো করতে পারে।
একদিন শ্রাবণ্যকে নিয়ে সায়েন্সল্যাব আড়ং এ গিয়েছিল কিছু গিফট কিনবে বলে। সেখানে হঠাৎ একটা পরিচিত গলা শুনতে পেল। পরিচিত কন্ঠস্বর ডেকে উঠলো,
“এই স্বপ্নীল না!…
স্বপ্নীল তাকালো। পরিচিত মানুষ টাকে দেখে ও জমে গেল। নীলা….
নীলা এগিয়ে এলো। ঠোঁটে মিষ্টি হাসি। স্বপ্নীলকে জিজ্ঞেস করলো,
“এই তুই কেমন আছিস?”
স্বপ্নীলের জবাবের অপেক্ষা না করেই প্রশ্ন করলো,
“তোর বউ? কী নাম ওর?”
স্বপ্নীলের গলা শুকিয়ে আসছে। সেই শুকনো গলায় ই জবাব দিলো। ওর নাম শ্রাবণ্য।
নীলা শ্রাবণ্যকে দেখে মুগ্ধ গলায় বলল,
“বাহ! কী মিষ্টি দেখতে! এই ও কী তোমাকে শ্রাবণ বলে ডাকে? ”
শ্রাবণ্য এতক্ষনে অবশ্য বুঝতে পারলো চটপটে দারুণ মানুষ টা বোধহয় নীলা। বেচারা স্বপ্নীলের করুন চেহারা অবশ্য সেটা বুঝিয়ে ছাড়লো৷ শ্রাবণ্য হেসে বলল,
“নাহ!”
নীলা এক নাগাড়ে অনেক গুলো কথা বলল। জোর করে পাশের ফুডকোর্টে নিয়ে গেল। শ্রাবণ্য একদম সহজ, স্বপ্নীল ঘাবড়ে গেছে। স্বপ্নীল কিছুই খাবে না। আড়চোখে শ্রাবণ্যর দিকে তাকাচ্ছে বারবার। শ্রাবণ্য পেস্ট্রি আর ব্রাউনি অর্ডার করলো। নীলা চকলেট কফি নিলো৷ জোর করেও স্বপ্নীল কে দিয়ে কিছু অর্ডার করানো গেল না।
নীলা বলল,
“এই তুই কিছু নিচ্ছিস না কেন? বিল নিয়ে ভাবিস না, আমি দেব তো। ”
স্বপ্নীল কোনো কিছুতে জবাব দিচ্ছে না। নীলা নিজেই বলল,
“শ্রাবণ্য, ও যেহেতু আমার পরিচয় দিচ্ছে না, আমি কী নিজের পরিচয় দেব?”
শ্রাবণ্য হেসে বলল,
“আমি জানি, আপনি নীলা আপু। ”
নীলা স্বপ্নীলের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভাই তুই তো জিতছিস! তোর বউয়ের অনেক বুদ্ধিও কিন্তু। ”
স্বপ্নীল একটু হাসার চেষ্টা করলো। শ্রাবণ্যকে এতটা সহজ দেখে ওর নার্ভাসনেস কেটে গেছে। নীলা বলল,
“কী বলেছিলাম তোকে, খুব সুন্দর একটা বউ পাবি! আমার কথা মিলল তো, বড়দের কথা মিথ্যে হয় না।”
স্বপ্নীল শ্রাবণ্যর দিকে তাকালো। শ্রাবণ্য মিষ্টি করে হাসছে। নীলা আরও কিছুক্ষন গল্প করলো। যাবার সময় বলল,
“এই ছেলেটা এমনিতে ভীষণ ভালো বুঝলে। এতো পিওর, ডাউন টু আর্থ! ওর সবকিছুই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করতো। শুধু যেদিন বলল আমাকে ভালোবাসে সেদিন একটা থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করলো। এখন নিশ্চয়ই ভালোবাসার সংজ্ঞা বুঝবে। ”
যাবার সময় স্বপ্নীল কে বলল,
” এই তুই ভীষণ ভালো থাকবি। পরেরবার দেখা হলে আমাকে ট্রিট দিবি কিন্তু। আর এমন বিশ্রী এটিচ্যুড দেখাবি না কিন্তু। ”
নীলা চলে যাবার পর শ্রাবণ্য জিজ্ঞেস করলো,
“ওনার সঙ্গে এমন কেন করলে? ভালো করে দুটো কথাও তো বলতে পারতে?”
স্বপ্নীল চোখ নামিয়ে বলল,
“লজ্জা লাগছিল, ভয়ও। ”
“লজ্জা? ভয়? কেন?”
স্বপ্নীল হাসলো। ওর অমূলক ভয়ের কথা শ্রাবণ্যকে জানালো না। গাঢ় গলায় বলল,
“আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি, শুধু তোমাকেই। ”
শ্রাবণ্য ঠোঁট টিপে হাসলো। একবার বলতে ইচ্ছে করলো, এতবার বলার কী আছে, আমি জানি তো। কিন্তু স্বপ্নীলের সুন্দর অভিব্যক্তি টুকু দেখে আর কিছু বলল না।
***
রঙ্গনাদের সুন্দর ছিমছাম একটা সংসার হলো। রঙ্গনা ভীষণ আনন্দ নিয়ে সংসার সাজাচ্ছে। মিমি, তুলিরাও সঙ্গ দিচ্ছে দারুন। মিশুক সবকিছুতেই রঙ্গনার সাথে আছে, যেমনটা থাকার কথা ছিলো। মাঝেমধ্যে মনে হয় এই মেয়েটাকে পাহাড়ে জঙ্গলে যেমন মানায় তেমনি সংসারেও মানিয়ে গেছে। ভাত, ডাল, মাছের ঝোল রান্নার পারদর্শীতা দেখে আরও একবার মনে মনে বলে, এই মেয়েটা আসলে ঠিক স্পেশালও না। ঠিক যেন ম্যাজিশিয়ান।
***
রাফাতের গল্পটা বোধহয় গতানুগতিক ই থেকে যাবে। রাফাত শহরের নামী রেস্টুরেন্টে অপেক্ষা করছিল মায়ের পছন্দ করা পাত্রী দিয়ার জন্য। এইসব মেয়েদের মা কিভাবে ম্যানেজ করে সেটা ও ধারণা করতে পারে না। মেয়েটা এলো। শাড়ি পরে এসেছে। ভীষণ গর্জিয়াস শাড়িটার দাম সম্পর্কে ওর আইডিয়া না থাকলেও বুঝতে পারলো এটা অনেক দামী। শাড়িটারির ব্যাপার ও যতটুকু জেনেছে সেটা আকাশীর জন্য। দিয়া মেয়েটার কথা বলার ধরনও অন্যরকম। ভীষণ স্মার্ট। মেনিকিওর করা হাত, চকচকে মুখ। তবুও রাফাতের চোখ জুড়োয় না। অতি সাধারণে যে মুগ্ধ হয় তার সম্ভবত গর্জিয়াস অতো পছন্দ হয় না। রাফাত দিয়াকে বলল,
“তোমাকে কিছু কথা জানানো প্রয়োজন। ”
“আমি সব জানি, সব শুনেছি।”
রাফাত বিরক্ত গলায় বলল,
“মায়ের মিথ্যের সঙ্গে আরও কিছু মিথ্যে যুক্ত করে সত্যি বানানো গল্পটা নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেছ।”
দিয়া অত্যন্ত নরম গলায় বলল,
“তোমার মায়ের প্রতি এই অভিমান টুকুও আমি জানি। আমি সব সামলে নেব। ”
রাফাত হাসলো। এই মেয়েটাকে ও স্মার্ট ভেবেছে, ভুল ভেবেছে। স্মার্ট হবার অভিনয়ে এখনো বেশ কাঁচা।
রাফাতের পরের কথাটা ছিলো।
“আমার ব্যাংক, ব্যালেন্স কিচ্ছু নেই। যা ইনকাম সব ইচ্ছেমতো উড়িয়ে খরচ করে দেউলিয়া হই। এতো দামী শাড়ি, জুয়েলারি আমি জীবনেও কিনে দিতে পারব না। ”
মেয়েটা একটুও সময় না নিয়ে জবাব দিলো,
“ইটস ওকে। আমি নিজেও তো ইনকাম করি। নিজের শাড়ি কেনার মতো ক্যপাবিলিটি আমার আছে। ”
রাফাত হেসে বলল,
“তাহলে এবার অর্ডার করা যাক। আজকের বিল টা যেহেতু তুমি পে করবে তাহলে ইচ্ছেমতো অর্ডার করতে পারি তাই তো?”
দিয়া ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“শিওর। ”
রাফাত তেমন কিছু অর্ডার করলো না। স্যুপ, পাস্তা আর কফি৷ খাওয়া শেষে বিল টা নিজেই দিলো। দিয়া বলল,
“বিল টা আমার দেয়ার কথা ছিলো তো… ওকে, নেক্সট টাইম। ”
রাফাত প্লাস্টিকের হাসি ঝুলিয়ে বলল,
“নেক্সট টাইম কেন? আমাদের আর কোনো টাইমেই দেখা হবে না। ”
দিয়া ভ্রু কুঁচকে তাকালো। জিজ্ঞাসু চোখে। রাফাত বলল,
“তুমি ঠিক আমার ফ্যামিলি টাইপ দিয়া। কিন্তু আমার টাইপ না। আমি এতটা অভিনয়ে অভ্যস্ত নই। উঁহু আমি অভিনয় জানিনা। ”
“তুমি আমাকে অপমান করছ?”
“সরি। ওকে ফাইন, আমি সবটুকু দোষ নিজের মাথায় নিলাম। আমি তোমার পাশে বেমানান। এতো স্টাইলিশ, এতো স্মার্ট জীবনেও হতে পারব না।”
দিয়ার মুখের কোমলভাব টুকু ফিরে এলো। বলল,
“ওকে আই উইল ম্যানেজ। ”
রাফাত বিরক্ত হলো। এই মেয়েটাকে ওর আর কিছু বলতে ইচ্ছে করলো না। মেয়েটা ওর হাত ধরে বলল,
“সব ঠিক হয়ে যাবে। সব ঠিক করে দেব আমি। ”
“তুমি সেই মানুষ নও। আই এম সরি। ”
****
রাত নয়টার কাছাকাছি৷ আজ আকাশী এতো ব্যস্ত ছিলো। হঠাৎ মনে হলো, বাজার করা দরকার৷ ফ্রিজে তেমন কিছু নেই। চার, পাঁচ দিনের রান্না করে রাখতে হবে। কাঁচা বাজারে গিয়ে কিছু সবজি, মাংস কিনলো৷ আসার সময় স্টেশনারি দোকান থেকেও কিছু জিনিস কিনলো। দুই হাতে দুটো ব্যাগ নিয়ে গেটের কাছাকাছি আসতেই চমকে উঠলো। রাফাত! রাফাত অবশ্য ওর নাম ধরে ডেকেছিল। আকাশী উচ্ছ্বসিত গলায় বলল,
“আপনি? কখন এলেন?”
“তুমি ব্যাগ গুলো রেখে আসবে? আমার এই মুহুর্তে কফি খাওয়া দরকার। ”
“আমার সঙ্গে চলুন। আমি কফি বানিয়ে খাওয়াব। ”
রাফাত বিনাবাক্য ব্যয়ে আকাশীর সঙ্গে গেল। আকাশী তালা খুলে ঘরে ঢোকা অবধি ও চুপচাপ ছিলো। ঘরে ঢুকে এদিক ওদিক তাকালো। আকাশী বলল,
“আফরিনের আসতে লেট হবে। ওর একটা রিসার্চ প্রজেক্টের জন্য ব্যাচমেট দের সঙ্গে থাকতে হবে। ”
বাসায় কেউ নেই সেই কথাটাই বোধহয় বলার জন্য এভাবে বলা। আকাশী সবকিছু বের করে ফ্রিজে গুছিয়ে রাখলো। রাফাত ডাইনিং স্পেস টা দেখছে। এতটুকু বাসাটা কী সুন্দর গুছিয়ে রেখেছে।
আকাশী রাফাত কে দেখে বলল,
“কোথাও গিয়েছিলেন নাকি? সাজগোজ অন্যরকম যে।”
রাফাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“হ্যাঁ। পাত্রী দেখতে। ”
আকাশীর অভিব্যক্তি টা অন্যরকম হলো। রাফাত দেখতে পেল না। প্রশ্ন করলো,
“বিয়ে কবে?”
“খুব শিগগিরই। ”
“গ্রেট। ”
“তোমার কাছ থেকে শাড়ির ডিজাইন করাব ভাবছি। পারবে না? ডোন্ট ওরি, আমি ডাবল পেমেন্ট করব। ”
আকাশী হেসে ফেলল। বলল,
“ডেট ফিক্সড হয়েছে?”
“হ্যাঁ। মেয়ে আমাকে বিয়ে করার জন্য পাগল। পারলে আজই বিয়ের মালা পরিয়ে দিতো। ”
“বাহ!”
“এটাই হওয়া উচিত তাই না? অথচ রঙ্গনা বলে আমি নাকি বিয়ের জন্য পাত্রী পাব না। ”
আকাশী সেই কথার জবাব দিলো না। কফির মগ টা হাতে দিয়ে বলল,
“বারান্দায় বসবেন? আপনাকে এতো অস্থির লাগছে কেন?”
রাফাত কফির মগে চুমুক দিয়েই মুখ পুড়িয়ে ফেলল। আকাশী বলল,
“কী করছেন? এতো অস্থির কেন হচ্ছেন? ”
“এতো ভালো করে কফি করার কোনো দরকার ছিলো না। আমার ব্ল্যাক কফি দরকার। ”
আকাশী কোমল গলায় বলল,
“আপনি শান্ত হয়ে বসুন তো। ”
রাফাত বসে পড়লো। কফির মগ টা টেবিলে রেখে বলল,
“তোমাকে যে ইমেইল গুলো পাঠিয়েছি সেগুলো তুমি পড়ো নি?”
আকাশী অন্যদিকে তাকিয়ে জবাব দিলো
“পড়েছি। ”
রাফাত বলল,
“আকাশী আমার দিকে তাকাবে প্লিজ। অন্যদিকে তাকিয়ে কথা বলছ আমার তাতে খারাপ লাগছে। ”
আকাশী তাকিয়ে বলল,
“আপনার বিয়ের ডেট টা বললেন না যে?”
“যে মেয়েটার সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে, তাকে আমার পছন্দ হয় নি৷ সে সুন্দর, স্মার্ট। কিন্তু আমার টাইপ না। আমার ফ্যামিলি তাকে পছন্দ করেছে। মেয়েটা আসলে তাদের টাইপ। আমি তাদের মতো না। আমি জীবন কে সহজ ভাবে দেখি। আমি যাকে পছন্দ করি সে একশ তে একজন। তাকে দেখলে অনুপম রায়ের ওই গান টার কথা মনে পড়ে।
‘আমি একলা ক্লান্ত ঘুড়ি, যে আমাকে বাসবে ভালো তার আকাশে উড়ি৷’
আমি সেই মানুষটার আকাশে উড়তে চাই।
আকাশী চুপ করে রইলো। কফির মগ টা স্থির হয়ে আছে দুই হাতের মাঝখানে। রাফাত তাকিয়ে আছে গভীর চোখে। আকাশী চোখ ফিরিয়ে নিতে চায় পারে না। রাফাত গভীর গলায় বলে,
“এখানে আসার আগে আমি শ্রাবণ্য কে ফোন করেছি। ওরা বিয়ের সব আয়োজন করে ফেলবে। তোমার বাবা, মা’কে ম্যানেজ করার দায়িত্বও ওর। তুমি কিছু বলো। ”
আকাশী যা বলতে চায় সব গুলিয়ে যায়। কোনোভাবে বলে,
“আপনি এখন আসুন। ”
“এটাই তোমার উত্তর? ”
“হ্যাঁ। ”
“আর আসব না?”
এই প্রশ্নটার জবাব দিতে আকাশী সময় নেয়। বলে,
“কাল তৈরী হয়ে থাকব। ক’টার সময় আসবেন আপনি? ”
রাফাত ঝড়ের গতিতে এগিয়ে এসে আকাশীর কপালে চুমু খেল। অনেকটা সময় নিয়ে। আকাশী যখন ওর চোখের দিকে তাকালো তখন দেখলো চোখভর্তি জল।
সমাপ্ত….