#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-৩২
স্বপ্নীল কয়েকদিন শ্রাবণ্যকে ভীষণ বিরক্ত করলো। সকালে, দুপুরে, সন্ধ্যায় ফোন করে বলছে,
“এই শ্রাবণ্য আমি তোমাকে একটা কথা বলতে চাই। ”
শ্রাবণ্য স্বাভাবিক গলায় বলে,
“বলুন। ”
স্বপ্নীল দুটো অক্ষর বলে থেমে যায়। শ্রাবণ্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে। স্বপ্নীল বলে,
“না থাক। এখন না, পরে। ”
“এখন কী সমস্যা? ”
স্বপ্নীল মিথ্যে জবাব দেয়,
“আমার লজ্জা করে।”
আসলে স্বপ্নীলের লজ্জা করে না। লজ্জা খানিকটা ভেঙে গেছে ওইদিন চুমু খাবার পর। ওইভাবে লজ্জা করে না এখন আর।
কিন্তু কথাগুলো ও গুছিয়ে বলতে চাইছে। শ্রাবণ্য যতবারই বলে বলুন ততবারই সব গুলিয়ে যায়।
শ্রাবণ্য প্রথম দু’বার ফোনের ওপাশে নীরবে হেসেছে। এখন বিরক্ত হয়। বিরক্ত হয়ে বলে,
“আচ্ছা থাক আপনাকে কিছু বলতে হবে না।”
স্বপ্নীল অধৈর্য গলায় বলে,
“তুমি আপনি আপনি করো বলে আমি বলতে পারছি না। ”
শ্রাবণ্য হাসি আড়াল করে গম্ভীর গলায় বলে,
“তোমার যদি গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথা না থাকে তাহলে ফোন টা রাখো। আমার স্যার চলে আসবে এক্ষুনি। ”
স্বপ্নীল আচ্ছা বলে ফোন রেখে দেয় মন খারাপ করে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ওর মুখ উজ্জ্বল হয়। শ্রাবণ্য ও’কে তুমি করে বলল না! কথাটাও একটু কেমন আদুরে গলায় বলল! সেই ভরদুপুরে স্বপ্নীল চোখ বন্ধ করে কল্পনায় খানিকক্ষণ আকাশে উড়ে বেড়ালো।
স্বপ্নীলের কথা গোছানো হয়ে ওঠার আগেই শ্রাবণ্যকে শহর ছাড়তে হয়। ইউনিভার্সিটি থেকে চব্বিশ দিনের জন্য সীতাকুণ্ড যেতে হয়। স্বপ্নীলের এতো মন খারাপ হলো। কাতর গলায় বলল,
“শ্রাবণ্য, না গেলে হয় না?”
শ্রাবণ্য হেসে বলে,
“না হয়না। ”
“আমি বৃহস্পতিবার যাব কেমন! ”
“নাহ! তার দরকার নেই, আমরা এতো ঝামেলার মধ্যে থাকব। কোথায় না কোথায় থাকব তার ঠিক নেই। আজ এক জায়গায়, কাল আরেক জায়গায় এভাবেই তো কেটে যাবে। ”
স্বপ্নীল আর কিছু বলল না। দ্রুত প্রস্থান করলো।
শ্রাবণ্যর যখন যাবার সময় হয় তখন বাড়ির সবার সামনেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। বাড়ির লোকজন ছুটে এলো ও’কে সামলানোর জন্য। শ্রাবণ্যর এতো অসহায় লাগলো! এভাবে কাঁদলে ওর কী যেতে ভালো লাগবে। রঙ্গনা স্বপ্নীল কে কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
“গাধা তুই? জীবনে মানুষ হবি না। মেয়েটা যাচ্ছে কী আজীবনের জন্য! সীতাকুণ্ড গিয়ে কী ও আরেকটা ছেলেকে বিয়ে করে ফেলবে আজব!”
রঙ্গনা শ্রাবণ্যকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“চলো ওর যেতে হবে না। আমি তোমার সঙ্গে যাচ্ছি।”
শ্রাবণ্য নিচে নেমে বারান্দার দিকে তাকালো একবার। স্বপ্নীল বারান্দায় নেই। রঙ্গনা স্মিত হেসে বলল,
“ভ্যা ভ্যা শেষ হয় নি৷ কাঁদুক তো, চলো যাই।”
গাড়িতে বসে শ্রাবণ্যর চোখ টা ভিজে উঠলো। বিয়ের পর নরসিংদী গিয়ে ঠিকঠাক দুদিনও থাকে নি। বাবা, মায়ের অভিমানের কারণে যায় নি। এতটা সময় একসঙ্গে থেকে কখন যে স্বপ্নীল ওর অভ্যাস হয়ে গেল!
রঙ্গনা টিস্যু বক্স এগিয়ে দিলো। শ্রাবণ্য জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো।
রঙ্গনা হেসে বলল,
“চোখ মুছে ফেলো। কাঁদছিলে তুমি! স্বপ্ন’র চেয়ে কম যাও না তুমিও। ”
শ্রাবণ্য ঠোঁট চেপে হাসার চেষ্টা করলো। রঙ্গনা বলল,
“দাদুর চয়েজ ঠিকঠাক হয় বুঝলে। এই সত্যিটা আমি স্বীকার করি না কারোর সামনে। কিন্তু মনে মনে ঠিকই স্বীকার করি। আমিও অন্যদের মতো ভাবতাম আমার এই বোকাসোকা ভাইকে কে বুঝবে। বিয়ে ওর আটকে থাকবে না ঠিকই, কিন্তু ওকে বোঝার, ভালোবাসার মানুষ টা আসবে তো।”
শ্রাবণ্য শুধু শুনছিল। মন টা ভীষণ খারাপ লাগছে। কিছু ভালো লাগছে না।
রঙ্গনা খেয়াল করলো শ্রাবণ্য অন্যমনস্ক। হঠাৎ কিছু না বলে ওর মাথায় হাত রাখলো। শ্রাবণ্য এক পলক দেখলো রঙ্গনাকে। পরের পলকেই জমে থাকা জল চোখ বেয়ে পড়লো।
ওরা স্টেশনে পৌছালো আগেই। বাকীদের কেউ কেউ এসেছে। রঙ্গনা পানি কিনে এনে শ্রাবণ্যকে বলল,
“মুখ টা মুছে নাও। কী বিশ্রী লাগছে তোমাকে ইশ!”
শ্রাবণ্য হেসে ফেলল। রঙ্গনা বলল,
“কিছু খাবে? পেয়ারা, ঝালমুড়ি?”
“না। ”
“তোমার মন খারাপ কমেছে?”
শ্রাবণ্য হেসে বলল,
“না। ”
রঙ্গনা হেসে ফেলল শ্রাবণ্যর সরল জবাবে। ট্রেন ছাড়া পর্যন্ত রঙ্গনা অপেক্ষা করলো।
****
রঙ্গনা মিশুকের সঙ্গে বিয়ে নিয়ে যে দ্বিধায় ছিলো সেটা কেটে গেছে প্রায়। ওদের সম্পর্ক দিন দিন সহজও হয়েছে। তবে রঙ্গনা এবারও নিজেকে ছাড় দিয়েছে। মিশুকের পরিবারের তাতে আপত্তি নেই। মিশুকেরও কোনো কিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি টাইপ ব্যাপার নেই। এটা ভালো, কিছুদিন আগে রঙ্গনা সলো ট্রিপে গেল। মিশুক আপত্তি করে নি, রঙ্গনা ভেবেছিল এটা নিয়ে হয়তো একটা ইস্যু ক্রিয়েট হবে। কিন্তু মিশুক ভীষণ কেয়ারফুল থাকে এসব ব্যাপারে। রঙ্গনাকে কোনো কিছু নিয়েই কিছু বলে না।
তবে এই ট্রিপে গিয়ে রঙ্গনা একটা বিষয় বেশ টের পেল। মিশুক ও’কে ভালোই মিস করেছে। পাহাড়, জঙ্গলে নেটওয়ার্ক কম থাকায় মিশুক একদিন ও’কে ফোনে পেল না। সারাদিনে কারোর সঙ্গে ও যোগাযোগ করতে পারলো না। সন্ধ্যেবেলা নেটওয়ার্ক পেয়ে ফোন করতেই মিশুকের অস্থির গলা। ও রওনাও হয়েছিল রঙ্গনা যেখানে আছে সেখানে যাবার জন্য। এই বিষয়টাও ওর ভালো লেগেছে। ভান মনে হয় নি, মনে হয়েছে সত্যিই ওর জন্য ছিলো ওই স্পেশাল ফিলিংস টুকু।
মিশুক দিল্লীতে গিয়েছিল হেড অফিসের একটা মিটিং এর জন্য। তিন দিনের জায়গায় ওদের সাতদিন থাকতে হলো। রঙ্গনা যতবারই ফোন করেছে মিশুক আফসোসের সুরে বলেছে, তোমাকে নিয়ে আসা উচিত ছিলো। এতোদিন থাকতে হবে বুঝলে নিয়ে আসতাম।
রঙ্গনা ফোনের এপাশে মিষ্টি করে হাসলো। কয়েক দিন আগেই ও স্বপ্নীল কে ভীষণ বকাবকি করছিল। কিন্তু মিশুকের এই অস্থিরতা ভালো লাগছে।
***
এক সপ্তাহ পর মিশুক ফিরলো। বেচারা ক্লান্ত বিধ্বস্ত। বাড়ি ফেরার পর রেস্ট নেবার আগে সবার সঙ্গে দেখা করতে যেতে হলো। রঙ্গনা আশেপাশে নেই, একবার একটু দর্শন দিয়ে যে গেছে আর দেখতে পেল না।
মিশুক ঘরে এসে দেখলো রঙ্গনা ঘরে বসে আছে। ফোন দেখতে ব্যস্ত। মিশুক দরজাটা বন্ধ করে রঙ্গনাকে ভালো করে দেখলো। সাদা জর্জেটের শাড়ি, স্লিভলেস ব্লাউজ, চুলগুলো পেঁচিয়ে খোঁপা করে। কোনো জুয়েলারি নেই, তবুও কী সুন্দর লাগছিল। মিশুকের ধারণা এই সুন্দর লাগার ব্যাপার টা আসলে ওর চোখের সমস্যা। এমন মিষ্টি সমস্যা থাকুক, সারাজীবন থাকুক।
রঙ্গনা মিশুক কে অপলক তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল,
“দরজায় ওভাবে দাঁড়িয়ে আছ যে! আর তোমার এই অবস্থা কেন? ভীষণ বিশ্রী দেখাচ্ছে। অন্যসময় অবশ্য খুব সুশ্রী দেখায় ব্যপার টা তেমন না। ”
মিশুক তবুও তাকিয়ে রইলো। রঙ্গনাও খানিকক্ষণ তাকিয়ে হেসে ফেলল। মিশুক বলল,
“তোমার বিরহে আমার এই অবস্থা। ”
“সিরিয়াসলি! সস্তা ফিল্মি ডায়লগ। ”
“হোক সেটা। তবুও কথাটা সত্যি। ”
মিশুক এগিয়ে এসে আচমকাই রঙ্গনাকে জড়িয়ে ধরলো। রঙ্গনা আলিঙ্গন প্রত্যাখ্যান করলো না। মিশুক ঘাড়ের পাশে চুমু খেয়ে গাঢ় গলায় বলল,
“আই লাভ ইউ রঙ্গনা। ”
রঙ্গনা নিশ্চুপে হেসে বলল,
“ওহ! থ্যাংক ইউ।”
***
রেহানা ভালো করে সবকিছু দেখছে। খুটিয়ে খুটিয়ে জিনিসপত্র দেখছিল। আকাশীকে বলল,
“একাই থাকিস তোরা?”
“আমি আর আফরিন মা।”
“আর কেউ আসে না?”
“আসে, আফরিনের মা আসে। শ্রাবণ্য আসে, তুমিও এলে। এইতো….
রেহানার আর কেউ কথাটার মিনিং স্পষ্ট বুঝলো আকাশী। কোনো ছেলে বন্ধু আসে কিনা।
রেহানা আবারও বলল,
“তোর বাবা চাইছেন বাড়ি গিয়ে থাক।”
“এখানে আমার সব কাজ। সুযোগ পেলে বাড়িতে বেরিয়ে আসব।”
রেহানা খাটের উপর বসে বলল,
“যা বলতে আসছি বলি, তোর রিনা খালা একটা বিয়ের প্রস্তাব এনেছে। ছেলে ভালো, একবার বিয়ে হয়েছিল কিন্তু বউ থাকে নি। পার্সোনাল ইস্যু। কথা বলে দেখব?”
আকাশী কঠিন গলায় বলল,
“না।”
“কেন?”
“আমি এখন বিয়ে করতে চাই না। ”
“এবার আমরা দেখেশুনে বিয়ে দেব। আমাদের সিদ্ধান্ত ভুল হবে না। শ্রাবণ্যকে দেখেছিস কতো ভালো আছে! তুই নিজের কপাল নিজে পুড়িয়েছিস।”
“আমি তো আগেই বলেছি মা, নিজের ক্ষত তে প্রলেপ লাগাতে আমি পারব।”
রেহানা আর কিছু বললেন না। আকাশীর সঙ্গে এবার আর মেজাজ দেখালেন না। তার মেজাজের কারণে মেয়েরা নাকি তার সঙ্গে সহজ হয় না। মুনসুরের এই অভিযোগ। মেয়েদের সঙ্গে তার ভালো করে কথা বলতে হবে। এজন্য এবার নরম গলায় কথা বললেন। তিনি নিজেও ব্যাপার টা উপলব্ধি করছেন। মেয়েরা আসলেই তার মাঝে দেয়াল তুলে দিয়েছে। এতটা নিষ্ঠুরও তো সে না।
রেহানা চলে যাবার পর আকাশীর রাফাতের কথা মনে পড়ে গেল। রাফাত সেই রাত ভোর হওয়া দিনটার পর আর ওর সঙ্গে দেখা করে নি। আকাশীর মন খারাপ হয়েছে। কোথাও গিয়ে মনে হয় একটা অনুভূতি ওর মনেও সৃষ্টি হয়েছিল। ভীষণ খারাপ লাগছিল। প্রায় ই ফোন টা হাতে নিয়ে রাফাত কে ফোন করতে গিয়ে থেমে যায়। ও কী আরেকবার তাড়াহুড়ো করে ফেলছে! বোধহয়। সেই ভাবনা থেকে আর যোগাযোগ করা হয় না।
****
রাফাত জয়েন করেছে মাস খানেক। তিন মাসের ছুটির প্ল্যান ক্যান্সেল করেছে। কাজে ডুবে থাকলে সব ভুলে যাবে। একটু একটু করে স্বাভাবিক হচ্ছে। আকাশীকে ওর অনুভূতি জানানো হয়েছে। হ্যাঁ, মুখে কিছু বলে নি। কিন্তু ওর আচরণ স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছে। বাকী সিদ্ধান্ত আকাশীর। ও যদি রাফাত কে নিজের জীবনে রাখার যোগ্য মনে করে তো রাখবে। জোর করে কিছু চাপিয়ে দিবে না।
রোজ রাতে রাফাত আকাশীর একাউন্ট, পেজ চেক করে। শাড়ি,জামাকাপড় এর ছবি দেখে। এতে মনে হয় যেন আকাশী ওর পাশেই আছে। আজ রাতে একটা আনন্দের ব্যাপার ঘটলো। আকাশী ও’কে মেসেঞ্জারে টেক্সট করেছে।
“আপনি কেমন আছেন? ”
রাফাতের এতো আনন্দ হলো! ভালোবাসার কথা বললেও বোধহয় এমন আনন্দের অনুভূতি হবে না। রাফাত লিখলো,
“তুমি কেমন আছ? ”
অনেক দূরে রাতের শহরে একা মেয়েটি মোবাইল হাতে নিয়ে মেসেজ টির দিকে তাকিয়ে রইলো। উত্তরে কী লিখবে সেটা বুঝে উঠতে পারছে না।
চলবে….
#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-৩৩
শ্রাবণ্য ট্রেন থেকে নামলো। ভোরের ট্রেন, শহরে এখন একটু একটু শীত নেমেছে। ওর গায়ে পাতলা চাদর চাপানো। শ্রাবণ্য প্ল্যাটফর্মে নেমে এদিক ওদিক খুঁজলো। স্বপ্নীল কোথায়! কাল রাত থেকে অন্তত দশবার ফোন করে বলেছে। আসব, আসব! এখন কোথায়! শ্রাবণ্য অস্থির নয়নে এদিক ওদিক খুঁজছিল। ফোন হাতে নিয়ে নাম্বার ডায়াল করার আগেই স্বপ্নীল তারস্বরে ডাকলো,
“এই শ্রাবণ্য, এই যে আমি!”
শ্রাবণ্য পেছনে ফিরে তাকালো। স্বপ্নীল ছুটে আসছে। ছুটে আসার ধরন টা সন্দেহজনক। ভয়ংকর কোনো ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে না তো আবার! ওহ মাই গড! হালিশহরের সেই মোমেন্ট রিক্রিয়েট হতে যাচ্ছে! শ্রাবণ্য এদিক ওদিক তাকালো। ব্যাচমেট রা এখনো প্ল্যাটফর্মে আছে। তাদের সামনেই ঘটতে যাচ্ছে কেলেঙ্কারি ঘটনা। শ্রাবণ্য ভীষণ নার্ভাস হলো, এই তো স্বপ্নীল কাছাকাছি এসে গেল!
স্বপ্নীল ছুটে এসে সত্যি সত্যিই শ্রাবণ্যকে জড়িয়ে ধরলো। এবার আর হুমড়ি খেয়ে পড়লো না। শ্রাবণ্যও সতর্ক থাকার জন্য দু’হাত বাড়িয়ে স্বপ্নীল কে ধরলো। প্ল্যাটফর্মে মানুষজনের অভাব নেই। কেউ কেউ দেখলো দৃশ্যটা। কেউ কেউ বিরক্তও হলো। শ্রাবণ্য হাসলো, স্বপ্নীল ও’কে ছেড়ে দিলো প্রায় মিনিট খানেক পর। ব্যস্ত প্ল্যাটফর্মে ওই মিনিট খানেক একজন আরেকজন কে জড়িয়ে ধরে রাখলো। শ্রাবণ্যর ফ্রেন্ডরা কেউ কেউ ছবি তুলে, ভিডিও করে রাখলো।
কমলাপুর স্টেশন থেকে বেরিয়ে ওরা রিকশা ধরলো। সকালের মিষ্টি রোদ টা উঠেছে কেবল। স্বপ্নীলের চোখে, মুখে বাচ্চাদের মতো ঈদ আনন্দ। স্বপ্নীল হড়বড় করে কথা বলে যাচ্ছে।
“জানো কী হয়েছে, রিন্টির একটা দাঁত পড়ে গেছে। সেকি ভয়ংকর কান্না! মা ব্যাপার টা বুঝিয়ে বলল, তবুও বুঝতে চায় না। মন্টির কেন পড়লো না, ওর একার কেন পড়েছে এই নিয়ে ভীষণ ঝামেলা করেছে পা*জি দুটো।
এদিকে ভাইয়ার সঙ্গে ছোটপার আবার তর্কযুদ্ধ হলো। খুব ই সিরিয়াস!
শ্রাবণ্য হঠাৎ স্বপ্নীলের হাত চেপে ধরে গাঢ় গলায় বলল,
“তুমি আমাকে কী যেন বলতে চাইছিলে না! বলো নি কিন্তু…!
স্বপ্নীল সুন্দর করে হাসলো। এই সুন্দর সকালে ওর একটা ভয়ংকর কাজ করতে ইচ্ছে করলো।
***
শ্রাবণ্য বাড়ি গিয়ে দুটো খবর পেল। প্রথম খবরটাতে ওর মন খারাপ হয়ে গেল। তুলির পাসপোর্ট সংক্রান্ত জটিলতা শেষ হয়ে গেছে। মাস দুয়েকের মধ্যে রিন্টি, মন্টিকে নিয়ে যেতে পারবে। আর দ্বিতীয়ত খবর টি হলো বাড়ির সবাই মিলে ঘুরতে যাবার প্ল্যান করেছে। শুধু বাড়ির লোক না সঙ্গে মিশুকের বোন, দুলাভাই, বাবা, মা আর আকাশীও যাবে। শ্রাবণ্যকে সারপ্রাইজ দেয়া হবে বলে আগে থেকে কিছু জানায় নি।
তুলির চলে যাবার খবরটায় শ্রাবণ্যর ভীষণ মন খারাপ হলো। শিলা হেসে বললেন, এই মন খারাপ অমূলক না। সবার ই ভীষণ খারাপ লাগবে। কিন্তু পরে ঠিক হয়ে যাবে। দিনশেষে ছেলে মেয়েরা আনন্দে আছে, হাসিখুশি আছে এটাই আসল। আমি মন খারাপ করব না, তোমরাও করবে না কেমন!
রিন্টি তার দু:খের গল্প মামীকে শোনালো। শোনাতে গিয়ে কেঁদে ফেলল। চিপসের প্যাকেট দাঁত দিয়ে ছিড়তে গিয়ে ওর দাঁত টা ভেঙে গেছে। আর ওই চিপস ও খাবে না। এমন ভাঙা দাঁত নিয়ে বিদেশে যেতে ওর খুব লজ্জা লাগবে। কী করবে ও! মন্টিকে মা, বাবার সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়ে ও মনির কাছে থেকে যাবে।
শ্রাবণ্য হাসলো রিন্টির কথা শুনে। এই বাড়িটা সত্যিই নিষ্প্রাণ হয়ে যাবে ওদের ছাড়া। দাদুও ভীষণ কষ্ট পাবে। তুলিকে সে অন্যরকম পছন্দ করে, এটা টের পাওয়া যায়। অনেক সিদ্ধান্ত সে মেনে নেয় শুধু তুলির জন্য।
শ্রাবণ্য সারা দুপুর শুয়ে কাটালো। স্বপ্নীল অফিসে আছে। এতদিন পর বাড়িতে ফিরে মন টা খারাপ হয়ে গেল। নানান ভাবনারা এসে মাথায় উঁকিঝুঁকি দেয়। এই বাড়িতে যেদিন প্রথম এসেছিল সেদিনও ভাবেনি একদিন এটাকে নিজের বাড়ি ভাববে। এখন এটাই ওর বাড়ি। স্বপ্নীল ওর জীবনের ব্যক্তিগত মানুষ। বাড়ির মানুষগুলো ওর ই আপনজন। সকালে ওর ক্লাশ থাকে, ঘুম ভাঙতেই কোনোরকম তৈরী হয়ে বেরিয়ে যেতে হয়। ওর জন্য আলাদা করে খাবার বানানো থাকে। এই কাজ টা কেউ না কেউ করেই। হয় তুলি নাহয় শিলা। একদিন দেখলো দাদী ওর জন্য খাবার বানাচ্ছেন। কী সুন্দর একটা ব্যাপার! একবারও মনে হয় না এটা শ্বশুর বাড়ি, মানুষগুলো ওর নিজের নয়।
শ্রাবণ্য উঠে ল্যাপটপ টা খুলল। এলোমেলো কিছু মনের কথাটা লিখছে। দু’হাতে টাইপ করছে। লিখছে বাবাকে, এই কথাগুলো বাবার জানা উচিত। বাবা, মায়ের সঙ্গে ও যে নীরব দেয়াল টা তুলে দিয়েছিল সেটা মা বুঝতে না পারলেও বাবা বুঝেছেন। তিনি হয়তো অপরাধবোধে ভুগছিল। কখনো কিছু জিজ্ঞেস করে নি শ্রাবণ্যকে। হতে পারে শ্রাবণ্যর মনের ভুল। তবুও ওর মনে যে কথাগুলো অব্যক্ত ছিলো, সেগুলো বাবার জানা উচিত।
বাবা,
সামনাসামনি এই কথাগুলো বলতে পারব না বলেই এভাবে বলা। তোমার প্রতি আমার আসলে কোনো অভিমান নেই। যা আছে সব ই রাগ। রাগ আর অভিমান শব্দ দুটো যেমন আলাদা তেমনি অর্থও আলাদা। স্রেফ তোমার অবাধ্য হয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যাবার মতো তুচ্ছ ঘটনায় যে শাস্তি হিসেবে আমার বিয়েটা হতে পারে সেটা আমার কাছে কল্পনাতীত ছিলো সবসময় ই। আমি বিশ্বাস করতে পারিনি যে আমার সঙ্গে সত্যিই ওরকম কিছু ঘটনা ঘটতে পারে। আমি ভেবেছিলাম বিয়ের পর জীবন টা দূর্বিষহ হয়ে উঠবে। সেটার জন্য অনেকটা আমিও দায়ী থাকব। কোনো বিধিনিষেধ মানামানির ধারে, কাছে যাব না। আমার যা ভালো লাগবে করব। কেউ যদি না মানতে পারে তাহলে সেটা নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপও থাকবে না। বিয়ে নামক শেকল তো আর আমি নিজে গলায় জড়াই নি।
বাবা আমার সেই ভাবনা ধূর হলো কয়েক মাসেই। আমি যেটাকে শেকল ভেবেছি সেটা আসলে ফুলের মালা। যা ইচ্ছে হয় সেটা আমি করতে পারি। কেউ প্রশ্ন করে না। কোনো বিধিনিষেধ না মেনেও দেখেছি, কিছুই বদলায় নি। এই বাড়ির মানুষ গুলো ভালো, তাই না? বাবা আমিও কিন্তু একেবারে খারাপ নই। এঁরা সেটা জানে, কিন্তু তোমরা সেটা কখনো জানার বা বোঝার চেষ্টা করো নি। রাত করে বাড়ি ফিরলে এই বাড়ির মানুষজন শুধু অস্থির হয় বিপদে পড়েছি কিনা সেটা ভেবে। এক ফোঁটা অবিশ্বাসও করে না। আপু আর আমি দুজন আলাদা মানুষ বাবা। আমাদের চিন্তা, ভাবনা, ধ্যান, জ্ঞান, পছন্দ অপছন্দ সব আলাদা। চরিত্রও আলাদা। যে ভুল আপু করেছে সেটা আমিও করতে পারি ভেবে তোমরা তটস্থ থাকতে। অথচ আমরা দুজন আলাদা সব দিক থেকেই। বাবা, তোমাদের মেয়ে বলেই কিনা জানিনা, আমারও খুব ইচ্ছে হয়েছিল খুব বড়সড় একটা ভুল করতে বিয়ের পর। যাতে তোমাদেরও আফসোস হয়। পরে সেই সিদ্ধান্ত আপনাআপনিই মাথা থেকে বেরিয়ে যায়। স্বপ্নীল ভীষণ ভালো সৎ একজন মানুষ। মনে যা, মুখেও তাই। এমন মানুষ ঠকে বেশী। আমার তাই আর ও’কে ঠকাতে ইচ্ছে করে নি। বরং এখন মনে হচ্ছে আমি নিজেই জিতে গেলাম।
আমি যতটুকু ভালো আছি তার সব কৃতিত্ব আমার। আমি এখানে তোমাদের কোনো ক্রেডিট খুঁজে পাচ্ছি না আসলে। কথাটা স্বার্থপরের মতো হলেও এটাই সত্যি যে স্বপ্নীল আর ওর পরিবার কে আমি ডিজার্ভ করি বলেই ওরা আমার ভাগ্যে আছে। আমার এই কথাটা আপুর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ঠিক, ভুলের হিসাব কী মানুষ করতে পারে! ভাগ্য নির্ধারণ তো করেন উপরে যিনি আছেন তিনি।
আপুকে তার মতো ছেড়ে দাও। তোমরা দেখেশুনে বিয়ে দিবে বলে ভাগ্য খুলে যাবে এই ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত।
শ্রাবণ্য লেখা শেষ করে চোখ ভুলিয়ে নিলো একবার। অনেক দ্বিধা দ্বন্দের পর লেখাটা বাবাকে পাঠিয়ে দিলো। কিছু কথা, কিছু ব্যাপার জানা উচিত।
***
আকাশী দিন রাত এক করে পরিশ্রম করছে। ব্যবসায়ে সময় দিতে হয় সারাক্ষণ। এক, দুই ঘন্টা কাজ করলে হয় না। নিজের একটা ইয়ারের পড়া শেষ হলো এসব ব্যস্ততার মধ্যে। বিজনেস টাকে আরেকটু বাড়ানোর প্ল্যান আছে৷ অনলাইনের দিক টা সামলানোর জন্য একজন লোক রাখলো। অফলাইনেও একজন লোক রাখা আবশ্যক হয়ে গেছে। তাহলে যদি একটু দম ফেলার সুযোগ পায়। দিনশেষে যখন বিছানায় গা এলিয়ে দেয় তখন অন্য কিছু ভাববার সময় পায় না। চোখে ক্লান্ত ঘুমেরা এসে ভর করে। তবুও হঠাৎ এক উদাস দুপুরে আকাশীর মনে হলো অবেলার কফিটা শেয়ার করার জন্য একজন লোক জীবনে থাকা দরকার৷ ওর ক্লান্ত গল্প, স্বপ্ন, পরিশ্রম সবকিছুর মন্ত্রমুগ্ধ একজন শ্রোতা থাকলে ভালো হতো। এমন ভাবনা কেন মাথায় আসে কে জানে! রাফাতের কথাও মনে পড়ে ওর! সেই বেচারা কতো অভিমান পুষে রেখেছে। আকাশী বুঝতে পারে। ফোনের ওপাশে হ্যালো বলার ধরনে বুঝে যায়। আকাশী তবুও স্বার্থপর ই থেকে যায়৷ নিজের সীমা অতিক্রম করতে চায় না৷ বড় হতে চায় নিজের ছায়ার চেয়েও বেশী।
সেই উদাস দুপুরে আকাশী রাফাত কে ফোন করলো। একবা, দুবার, তিনবার! রাফাত ফোন টা ধরলো না। হয়তো উড়ছিল ওই মাঝ আকাশে। তবুও আকাশী ফোন করেছিল বারবার। রাফাত ফোন করলো ঘন্টা চারেক পর। আকাশী তখন ফেসবুকে লাইভ করছিল। বেশ কিছু টিশার্ট কালেকশন দেখাচ্ছিল। রাফাতের ফোন পেয়ে লাইভ টা বন্ধ করে দিলো। ফোন রিসিভ করে কথা বলল। রাফাত যখন জিজ্ঞেস করলো কেমন আছ! তখন আকাশীর মনে হলো ওর অবস্থাও ঠিক রাফাতের মতো। কয়েকমাস আগে রাফাত যেমন ছিলো। ছুটে আসতো বারবার ওর কাছে। বটবৃক্ষেরও মনে হয় মাঝেমধ্যে ছায়ার দরকার হয়।
চলবে….