#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-৩০
ডিভোর্স পেপার টা হাতে নিয়ে বসে রইলো শুভ। রাগে গা রীতিমতো কাঁপছে। শ্রাবণ্য দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে শক্তমুখে। সঙ্গে রাফাত আর স্বপ্নীল। একা শ্রাবণ্যকে দেখলে শুভ ভয় পাবে না। রাফাত কে পরিচয় দিলো পুলিশের লোক হিসেবে। শুভ শ্রাবণ্যকে বলল,
“আমি সই করব না। আকাশীর সাথে কথা বলতে চাই আমি। ”
শ্রাবণ্য বলল,
“কেন সই করবে না তুমি? ফা*ইজলামি পাইছ? ”
স্বপ্নীল শক্ত গলায় বলল,
“অবশ্যই সই করবেন। আপনার কী মনে হয় আপনি সই না করলে আমরা চুপচাপ বসে থাকব? কোনোভাবেই বসে থাকব না, আমরা যথাযথ স্টেপ নেব।”
শ্রাবণ্য স্বপ্নীলের দিকে তাকালো। এই মুহুর্তে ওর ভীষণ হাসি পাচ্ছে। হেসে পরিবেশ টা হালকা করতে চাইছে না। স্বপ্নীল সুযোগ পেলেই আজকাল মেজাজ দেখায়। যেখানে দেখানো লাগে না, সেখানেও ভয়ংকর ভাবে ফোঁস করে ওঠে৷
রাফাত চুপ করে আছে। আকাশী এমন হা*রামি ছেলের পাল্লায় পড়লো! আহারে এমন চমৎকার মেয়ে!
শুভ রাফাত, স্বপ্নীল কাউকেই চিনলো না। দুজনকে দেখে ভয়ও পেল না। ওর ভাবনায় অন্যকিছু। আকাশী একমাত্র মানুষ যে ও’কে এই জাহান্নাম থেকে বাঁচাতে পারবে! ওর পাঁচ লাখ টাকা দরকার। আকাশী পাঁচ লাখ টাকা দিলে প্রয়োজনে ও সারাজীবন ওর পা ধরে থাকবে ।
শ্রাবণ্য আবারও জিজ্ঞেস করলো,
“ডিভোর্স পেপারে সাইন করতে সমস্যা কী?”
শুভ নির্লিপ্ত গলায় বলল, আমার ইচ্ছে। তুমি যে বা* করবা করো।
ঠিক সেই সময়ে জেরিন উপস্থিত হলো। অফিস থেকে স্পেশাল ট্যুরে গিয়েছিল৷ আরও কয়েক দিন পরে আসার কথা, কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলার কারণে চলে এলো।
জেরিন সকলের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলো,
“আপনারা কারা?”
রাফাত শ্রাবণ্যকে জিজ্ঞেস করলো, উনি কে?
“ওনার বউ।”
“সিরিয়াসলি! তোমরা এই লোক কে এইভাবে হ্যান্ডেল করতে আসছ?”
“ও এই কাজ টা করছে তাতে আপুর লাভ হইছে। ডিভোর্স নিলেই হবে। ”
রাফাতের ভীষণ রাগ হলো। জেরিন বলল,
“কী সমস্যা? ”
শ্রাবণ্য সমস্যা বলল। জেরিন শুভ কে বলল,
“সাইন চাইছে দিয়া দাও না ক্যান? তাও ভালো টাকা, পয়সা দেয়া লাগতেছে না।”
শুভ আবারও নির্লিপ্ত গলায় বলল,
“সাইন করব না। কী করবি তুই মা**
রাফাত শুভ’র নাক বরাবর ঘুষি মারলো প্রথমে। তারপর হঠাৎই বেল্ট দিয়ে পি*টাতে শুরু করলো। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই হতভম্ব হলেও কেউ শুভ কে বাঁচাতে এলো না। জেরিন কে দেখে বোঝা গেল তার শোকতাপ কিছুই নেই।
শান্ত,ভদ্র রাফাত হঠাৎই এতো রেগে গেল! এই রাগ ভয়ংকর রাগ। শুভ কে পুলিশে দেয়া হলো। জেরিন কে বলা হলো যেন না ছাড়ায় জেল থেকে। সবকিছু এতো জলদি হয়ে গেল যে শুভ কিছু ভাবার সময় পেল না। ডিভোর্স পেপারে সাইন নেবার সময় রাফাত দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আকাশীর আশেপাশে যদি তোকে দেখা যায় আর তাইলে কী অবস্থা হবে ভাবতেও পারবি না।”
শ্রাবণ্য, স্বপ্নীল সব টা দেখলো। শ্রাবণ্য মনে মনে অনেক কিছু ভাবছে। স্বপ্নীল বলল,
“তোমার আপুর সঙ্গে ওনার বিয়ে দিলে ভালো হবে। উনি মনে হয় তোমার আপুকে পছন্দ করেন। ভালোবাসা টাইপ পছন্দ। ”
শ্রাবণ্য হেসে বলল,
“আপনি কী করে বুঝলেন?”
“বুঝি। নীলাকে নিয়ে কেউ কিছু বললেও আমার ভীষণ রাগ হতো। আমি রাগ দেখাতে পারতাম না এমন। ”
শ্রাবণ্যর মন টা খারাপ হয়ে গেল। ওর জীবনের আরেকটা দীর্ঘশ্বাসের নাম নীলা। সেই মহিলাকে ও দেখে নি পর্যন্ত। এইদিকে ভাইয়ের বাসায় থাকতো। সবাই এলাকা ছেড়েছে। নীলা নাকি রংপুরে থাকে। এনজিও তে চাকরি করে। স্বপ্নীল নিশ্চয়ই এখনো সেই নীলাকে মিস করে!
স্বপ্নীল দেখলো শ্রাবণ্যর হাসি হাসি মুখ টা মিলিয়ে গেল। নীলার কথাটা যে বলা ঠিক হয় নি সেটা বুঝতে পারলো।
***
মিশুক ঘুমিয়ে আছে। হাত, পা ভেঙে শিশুদের মতো। রঙ্গনা নি:শব্দে হাসলো। ফেসবুকে হঠাৎ আকাশীর শাড়ির পেজ টা দেখতে পেল। ভালো লাগলো। শ্রাবণ্য কিছু বলে নি, আকাশী সেদিন এসেছিল ডিজাইন দেখাতে। দুজনের সঙ্গে ম্যাচিং করে কাপল ড্রেস বানাবে।
হঠাৎ একটা ছবিতে আটকে গেল। ছবিটা আকাশীর প্রোফাইলে হলেও চিনতে ভুল হলো না। রাফাতের হাত ওটা। ঘড়িটাও চেনা। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রঙ্গনা তেমন কোনো অনুভূতি হলো না। ও একবার মিশুকের দিকে তাকালো। এই ছেলেটা ভীষণ ডিস্টার্বিং ঠিকই তবে ডমিনেটিং না।
রঙ্গনা রাফাত কে টেক্সট করলো,
“তোমার কী অবস্থা? ”
টেক্সট করার আগেপিছে কিছু ভাবে নি। করার পর মনে হলো মিশুক কে একবার জিজ্ঞেস করা কী উচিত ছিলো? তারপর ভাবলো না, কোনো দরকার নেই। ও আগে যেমন ছিলো তেমন ই থাকবে। এতো বাছবিচার করে জীবন কাটাবে না।
রাফাত কিছুক্ষনের মধ্যেই জবাব পাঠালো। লিখলো,
“রঙ্গনা আমি তোমার কথা ভাবছিলাম আজ।”
রঙ্গনার মনে হলো ওর আসলে রাফাত কে টেক্সট করা ভুল হয়েছে। রাফাত কী এখন ইমোশনাল কথাবার্তা শুরু করবে?
রঙ্গনা লিখলো, রাফাত তুমি কী বোকা বোকা ইমোশনাল কথাগুলো বলবে? তাহলে আমি তোমাকে এক্ষুনি ব্লক করব!
রাফাত কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই কল করলো। রঙ্গনা বারান্দায় গিয়ে ফোন টা ধরলো।
“রঙ্গনা একটা জরুরী কথা বলার জন্য ফোন করেছি। ”
“কী তোমার জরুরী কথা? বোকাবোকা কথা বলবে না প্লিজ। আমি আমার ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসছি। উলটাপালটা কিছু বলবে না।”
“না না। সেসব কিছু না। পার্সোনাল কিছু কথা। ”
“কী কথা? ”
রাফাত একটু সময় নিয়ে বলল,
“আই এম ইন লাভ… আই থিংক। ”
রঙ্গনা হেসে বলল,
“আকাশী?”
“হ্যাঁ। কিন্তু আমার ভীষণ সংকোচ হচ্ছে। ”
“সংকোচ হলে হোক, তাতে সমস্যা কী?”
“আমার ধারণা আমি ভালোরকম প্রেমে পড়েছি। ঠিক বোঝাতে পারছি না, আসলে আলাপ করার সেরকম কেউ নেই। ভাবলাম তোমাকে বলি। ”
“কনগ্রাচুলেশন রাফাত।”
“থ্যাংক ইউ।”
“আকাশী চমৎকার মেয়ে। তুমিও ভালো, তবে তোমার ফ্যামিলি ভয়ংকর। আকাশী একবার ভয়ংকর লাইফ কাটিয়েছি। তাই তুমি যত ভালোই হও, ওর জন্য ক্ষতিকর। কথা টা শুনতে খারাপ লাগলেও সত্যি। ”
“ওটা এবার আমি সামলে নেব। এখন আমার কী করা উচিত? সরাসরি ও’কে ভালোলাগার কথা বলা উচিত? ”
“অবশ্যই। ”
“এক্ষুনি বলি?”
“বলো। ”
রাফাত আচ্ছা বলে ফোন রেখে দিলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আবারও ফোন করে বলল,
“হ্যালো রঙ্গনা, আমার কী কথা টা সামনাসামনি বলা উচিত? ”
“হ্যাঁ। রিয়েকশন বুঝতে হলে সামনাসামনি বলা উচিত। ”
“থ্যাংক ইউ।”
“আচ্ছা রাখি।”
রাফাতের ভীষণ নার্ভাস লাগছে। আকাশীর উত্তর যদি না হয়? না হলেও কিছু করার নেই, ও লেগেই থাকবে। তিন মাসের ছুটি আছে। এর মধ্যে বিয়ে হানিমুন সব সেড়ে ফেলা যায়। আকাশীকে হ্যাঁ বলতে হবে।
***
রঙ্গনা ঘরে এসে দেখলো মিশুক জেগে আছে। ও’কে বলল,
“এক কাপ চা দাও। ভীষণ মাথা ব্যথা করছে।”
রঙ্গনা বলল,
“তুমি লুকিয়ে আমার ফোনে কথা বলা শুনছিলে?”
“ছি:! আমি এতো ছোটলোক না। তাছাড়া আমার এতো ভয় কিসের! কাগজে,কলমে সম্পদ তো আমার ই। ”
রঙ্গনা স্মিত হেসে চা বানাতে গেল। রঙ্গনা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ও মিশুক কে একটা গোপন কথা বলবে।
***
স্বপ্নীল বুঝতে পারছে শ্রাবণ্য রেগে আছে। কথা বলছে কম। স্বপ্নীল বলল,
“শ্রাবণ্য আমি কী তোমার পাশে মাথা রেখে শুতে পারি?”
“না। আপনি রাতে নাক ডাকেন।”
এটা মিথ্যে কথা। স্বপ্নীল কে ক্ষ্যাপানোর জন্য বলল। স্বপ্নীল তবুও বালিশ নিয়ে এসে শুয়ে পড়লো। শ্রাবণ্য বলল,
“কী চান আপনি? ”
“তুমি আমাকে তুমি করে কেন বলো না? দুলাভাই হাসাহাসি করে, আমার ভালো লাগে না।”
শ্রাবণ্য মৃদু হাসলো। স্বপ্নীল সেটা দেখতে পেল না। স্বপ্নীল উঠে বসে শ্রাবণ্যর হাত ধরে বলল,
“শ্রাবণ্য ওঠো, আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই। ”
শ্রাবণ্য বিরক্ত গলায় বলল,
“কী সমস্যা বলুন। ”
“উঠে বসো।”
শ্রাবণ্য উঠে বসলো, স্বপ্নীলের মুখোমুখি। স্বপ্নীল হাত বাড়িয়ে চশমা টা নিলো। নিজের চুল ঠিক করে শ্রাবণ্যকে চমকে দেবার মতো একটা কান্ড করলো। আচমকাই শ্রাবণ্যর ঠোঁটে চুমু খেল। আনাড়ি চুমু, নিজে ভীষণ লজ্জা পেল। গাঢ় গলায় বলল,
“আমি তোমাকে একটা বিশেষ কথা বলতে চাই… শুনবে? শুনতে হলে আমাকে তুমি করে বলতে হবে। ”
চলবে…..
#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-৩১
রাফাত কে ভীষণ নার্ভাস দেখালো। এতো সকালে ও কি কারনে এখানে এসেছে সেটাও বলে নি৷ চোখ লাল, বোধহয় রাতে ঘুমায় নি। আকাশী আবারও জিজ্ঞেস করলো,
“আপনার শরীর খারাপ? ”
“হ্যাঁ। সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে যাওয়া দরকার। ”
“সাইকিয়াট্রিস্ট? ”
“না মানে আজ ডেট আছে। যেতেও পারি, নাও যেতে পারি৷ ”
“কেন? আপনি অনিয়ম কেন করছেন?”
রাফাত ঠিক করে গুছিয়ে কথাগুলো বলতে পারছে না। আকাশী ভদ্র মেয়ে, ও যদি রাফাত কে রিজেক্টও করে তাহলে ভদ্রভাবে করবে। ভয়ের কিছু নেই৷ কিন্তু সমস্যা হলো ও তো রিজেকশন চাইছে না। জীবনে প্রথম কোনো মেয়ের জন্য গোটা একটা রাত নির্ঘুম কেটেছে। আকাশী সেনসিটিভ মেয়ে বোধহয়। ও যদি বলে এরমধ্যে কী করে ওর প্রেমে পড়লো! সেটার জন্য একটা ঠিকঠাক জবাব রেডি করে রাখতে হবে। এখন মনে হচ্ছে এই ব্যাপার টা নিয়ে আরেকটু হোমওয়ার্ক করা উচিত ছিলো।
আকাশী ভাবনায় মগ্ন রাফাত কে দেখে চিন্তিত হলো। বেচারার উপর থেকে যে ধকল গেছে! আকাশী রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে রাফাতের কপালে হাত রাখলো। রাফাত চমকে উঠলো। রাফাত কে চমকে উঠতে দেখে আকাশী ভরকে গেল। বলল,
“আপনাকে দেখে অস্বাভাবিক লাগছিল, তাই দেখলাম জ্বর আছে কী না!”
রাফাত বোকার মতো তাকিয়ে রইলো। আকাশী বলল,
“আপনি একজন ডাক্তার দেখান তো। রুটিন চেকাপ গুলো করে নিন। ”
রাফাত কাতর গলায় বলল,
“ডাক্তারের কাছে একা যাওয়া যায় না? তুমিও চলো। ”
আকাশী হেসে ফেলল। বলল,
“আপনি কোথাও গিয়ে ঘুরে আসুন।”
রাফাত এবারও বলল,
“তুমিও চলো।”
আকাশী স্বাভাবিক গলায় বলল,
“আমি যেতে পারব না। আমার অনেক কাজ, অনেক কাজ হাতে নিয়েছি। সেগুলো কমপ্লিট করতে হবে। ”
রাফাত মূর্তির মতো বলল,
“আচ্ছা।”
“এখন যাই?”
“কোথায় যাবে?”
“রঙতুলিতে যাব। রঙ্গনা আপুকে কিছু ডিজাইন দেখাব। আপনি ডাক্তার দেখান।”
রাফাত যন্ত্রের মতো জবাব দিলো,
“আচ্ছা।”
আকাশী কিছুদূর গিয়ে ফিরে এসে বলল,
“আপনি সকালে কিছু খান নি তাই না?”
এই একটা প্রশ্নেই রাফাতের মন টা ভালো হয়ে গেল। মনে হচ্ছে আজকে দিন টাও ওর ভালো যাবে।
রেস্টুরেন্টে ভরপেট খেয়ে রাফাত রঙ্গনাকে ফোন করলো। রঙ্গনা ফোনের কাছে নেই। মিশুক ফোন টা দিতে গেল। রঙ্গনা রাফাত কে বলল,
“কী ব্যাপার? ”
“তোমার রিসিপশন কবে?”
“আগামী মাসের ১২ তারিখ। কেন?”
“এমনি। ”
“এটা জানার জন্য ফোন করেছ?”
“না। ”
“তাহলে? ”
“আমার আসলে নার্ভাস লাগছে। ”
“লাগতেই পারে, স্বাভাবিক। তোমাকে দেখে মনে হয় না।”
“আসলে আমিও নিজেকে দেখে চিনতে পারছি না।”
“ইটস ওকে। এরকম হয়। হতে পারে তোমার ফ্যামিলির ওই ঝামেলার পর কনফিডেন্স লেভেল জিরোতে নেমে গেছে। ”
“আচ্ছা আকাশীর আমাকে রিজেক্ট করার সম্ভাবনা কতটুকু? ”
“হান্ড্রেড পার্সেন্ট। ”
রাফাত আতঙ্কিত গলায় বলল,
“কি!?”
“হ্যাঁ। ”
“কেন?”
“অবশ্যই তোমার খ*বিশ পরিবার। আমার ধারণা তুমি দুই, চার দশ বছরে বিয়ের জন্য মেয়ে পাবে না। ”
“কী বলছ এসব! রাগ ঝাড়ছো?”
“না এটা সত্যি। ”
রাফাত কথা শেষ না করে ফোন কেটে দিলো। রঙ্গনার কথাগুলো খটোমটো হলেও ঠিক। লজিক আছে, এড়ানো যায় না।
***
মিশুক অফিসে যাবে। রঙ্গনার মোবাইলে রাফাতের নাম টা স্ক্রিনে দেখেও কোনো প্রশ্ন করলো না। রঙ্গনা নিজেই জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি কী আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইছ?”
“কোন ব্যাপারে?”
রঙ্গনা চোখ নাচিয়ে বলল,
“যেকোনো ব্যাপারে? ”
“না তো।”
“আমার ফোন কল নিয়েও কিছু না?”
মিশুক হেসে ফেলল। বলল,
“না। ”
“শিওর?”
মিশুক দুই পা এগিয়ে কাছে এলো। রঙ্গনার কানের পাশের চুল সরিয়ে বলল,
“যার বউ এতোটা স্মার্ট আর বোল্ড, তার হাজবেন্ড কেও খানিকটা ওরকম হতে হয়। ”
রঙ্গনা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। চোখের ইশারায় প্রশ্ন করলো, আচ্ছা!?
মিশুকও চোখের ইশারায় জবাব দিলো।
***
স্বপ্নীলের অফিসে কাজে মন বসছে না। দুপুরে ব্রেক নিয়ে বাসায় চলে যাবে ভাবছে। এই অফিসে ও একদিনও ছুটি নেয় নি এখনো পর্যন্ত, কারণ এমনিতেই ও’কে দেখে সবাই ভাবতো কাজ পারবে না। ছুটি নিলে মান, সম্মান যাবে এমন একটা ব্যাপার হবে ভেবে কখনো ছুটি নেবার কথা ভাবে নি।
স্বপ্নীলের নিজের একটা ডেস্ক আছে। ডেস্কটা সুন্দর করে গুছিয়েছে। ওর এই গোছানো স্বভাব টা বুবুর থেকে পাওয়া। বুবুও সব কিছু সুন্দর করে গুছিয়ে রাখে। অগোছালো কিছু তার পছন্দ না, তবে স্বপ্নীল কে সেটা কখনো বলতো না।
স্বপ্নীল ডেস্কের একপাশে গুছিয়ে নিজের জিনিসপত্র রাখলো। লাঞ্চবক্স, মোবাইল, চার্জার, পানির বোতল, ওয়ালেট ডায়েরি এসব। সেইসব জিনিসের সঙ্গে যুক্ত হলো শ্রাবণ্যর একটা ছবি। এই ছবিটা ঝাপসা, স্পষ্ট না। তবুও ছবিটা ওর পছন্দ কারণ ও ছবি টা তুলেছে। অফিসে থাকাকালীন অসংখ্য বার এই ছবিটা দেখবে।
দিতি আপা ফটোফ্রেম টা দেখে বলল,
“স্বপ্নীল ভাই একটা কথা বলি, তুমি কিন্তু মিয়া নায়িকা বিয়ে করছ। যেমনি স্মার্ট, তেমনি সুন্দর। ”
স্বপ্নীল আনন্দে ঝলমল করে ওঠে। শ্রাবণ্যকে কেউ ভালো বললে তাকে ওর আপন মানুষ লাগে। খারাপ বললে তাকে ভালো লাগে না। এমন ব্যাপার আগে মায়ের ক্ষেত্রে হতো। ওদের কিছু আত্মীয় আছে যারা মা’কে তেমন পছন্দ করতো না। তারা স্বপ্নীল কে যতই ভালোবাসুক, স্বপ্নীল তাদের পছন্দ করতো না। ওদের এক চাচা আছেন মিজান। মিজান আঙ্কেল বলে ডাকেন। সেই মিজান আঙ্কেল কী কারণে যেন একবার মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করলেন। স্বপ্নীলের মনে নেই। স্বপ্নীল যখন এইচএসসি তে ভালো রেজাল্ট করলো তখন মিজান আঙ্কেল একটা ঘড়ি পাঠালেন। স্মার্ট ওয়াচ তখন মার্কেটে অল্প কিছু সৌখিন মানুষজন ব্যবহার করে। স্বপ্নীল সেই দামী উপহার ফিরিয়ে দিলো। সবাই ভীষণ অবাক!
***
স্বপ্নীল অফিস ছুটি নিয়ে মায়ের কাছে গেল। বহুবছর পর এমন ঘটনা ঘটলো। শিলা স্বপ্নীল কে দেখে ভীষণ খুশি হলো। জিজ্ঞেস করলো,
“বাবু তুই? কোনো সমস্যা নেই তো?”
স্বপ্নীল মিষ্টি করে হেসে বলল,
“এমনিই মা। আজ তোমার সঙ্গে বাসায় যাব।”
শিলার বহুদিন পর আনন্দে চোখে পানি এসে গেল। মাঝেমধ্যে তার ভীষণ স্বার্থপর হতে ইচ্ছে করে। বলতে ইচ্ছে করে, তুই এমন ই থাক বাবু। তোর একটুও চেঞ্জ হবার দরকার নাই। তুই একটুও বদলাস না। তুই আমার সহজ সরল স্বপ্নীল ই থাকিস।
***
রঙ্গনা আজ মিমি আপুর বাসায় গেল। দুলাভাই এখন অনেক সুস্থ। মিমি আপু রঙ্গনাকে খুব পছন্দ করেন। রঙ্গনার শ্বশুর, শাশুড়ী এরাও। মিশুকের কাছের, দূরের সব আত্মীয় স্বজনরা রঙ্গনাকে এক নজর দেখার জন্য অস্থির। যারা ও’কে দেখেন নি। এতে শ্বশুর শাশুড়ীর ক্রেডিট অনেকখানি। তারা স্পেশাল ফিল করাচ্ছে।
মিমি আপু রঙ্গনাকে বলল,
“এই রঙ্গনা তোমাকে এতো শাড়ি পরতে হবে না। তোমার যা ভালো লাগে তাই পরবা। ওয়েস্টার্নে কম্ফোর্ট ফিল করলে ওয়েস্টার্ন পরবা। কে কী ভাবছে সেটা নিয়ে ভাববে না।”
রঙ্গনা হাসলো। এই হাসির আড়ালে ওর আরও একবার মনে পড়ে গেল এক ধুরন্ধর ফ্যামিলির কথা৷
***
রাফাত বসে আছে রাস্তায়। আকাশী আসবে। এখন ঘড়িতে বাজে এগারো টা বেজে তেইশ মিনিট। আকাশী আসছে। পরনে সাধারণ সালোয়ার কামিজ। গরমে চুল একত্র করে উপরে উঠিয়ে বাঁধা৷ রাফাত হঠাৎ খেয়াল করলো এই মেয়েটা দিন দিন ছোট হয়ে যাচ্ছে। দ্যাট মিনস রোগা হচ্ছে৷
আকাশী ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। বলল,
“এতো রাতে? কী যেন বলবেন বলছিলেন? ”
“আমার বাসায় একা থাকতে ইচ্ছে করলো না।”
আকাশী এক পাশে বসলো। ঢাকা শহরে রাত এগারো টা বেশী কিছু না। এখনো কত রিকশা, গাড়ি, মানুষ ছুটছে। ব্যস্ত শহরে সবাই ব্যস্ত।
আকাশী বলল,
“আমি বেশীক্ষন বসতে পারব না। বারোটার মধ্যে গেট অফ হবে। ”
“আচ্ছা।”
“আপনার কী মন খারাপ? ”
“বুঝতে পারছি না।”
“একটা কথা বলি, আপনি বাড়ি ফিরে যান। আপনার একা ভালো লাগছে না, বাড়িতে গেলে ভালো লাগবে। ”
রাফাত হেসে বলল,
“বাড়ির মানুষের সঙ্গে আমার নীতির মিল নেই আকাশী। আমি যেমন করে জীবন কে ভাবি ওরা তেমন ভাবে না। আমার মামা পররাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ে চাকরি করে, তার কেমন স্যালারি হতে পারে! আশুলিয়ায় প্লট কিনেছে, আবাসিকে ফ্ল্যাট বুকিং দিয়েছে। মার্সিডিজ গাড়ি, ডায়মন্ড জুয়েলারি। এসব কোত্থেকে আসে আমি জানি, বাকীরাও জানে। তবুও তারা এই জিনিস টা বড় চোখে দেখে। ধনবান আত্মীয়ের সাথে সম্পর্ক রাখার জন্য মরিয়া হয়ে যায় সবাই। ”
আকাশী গভীর মনোযোগে কথাগুলো শোনে। স্মিত হেসে বলে,
“আপনি একজন অন্যরকম মানুষ। ”
“অন্যরকম তো তুমি। আমি সাধারণ ই।”
“আমিও সাধারণ। তবে সাধারণ থাকতে চাই না। অসাধারণ হতে চাই।”
“কেমন অসাধারণ হতে চাও?”
“আমি অনেক বড়লোক হতে চাই। পৃথিবীর সবচেয়ে দামী দেশগুলো তে ঘুরে বেড়াতে চাই। অনেক অনেক টাকা ইনকাম করতে চাই।”
রাফাত হেসে ফেলে বলল,
“টাকা ইনকামের সঙ্গে অসাধারণ হবার কী কোনো সম্পর্ক আছে?”
“আছে। আমি জীবনের লাস্ট তিনটে বছরে শিখেছি জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে টাকা। টাকা থাকলে আপনার সব আছে। ডিপ্রেশন, এংজাইটি এসবের জন্য আপনার সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে যেতে হলেও কিন্তু টাকা লাগবে৷ যদি অসুখে পড়েন, ভালো ট্রিটমেন্টের জন্যও টাকা লাগবে৷ আপনার মন খারাপ হলে কোথাও থেকে ঘুরে আসার জন্য টাকা লাগবে। ”
রাফাত তাকিয়ে রইলো আকাশীর দিকে। হেসে বলল,
“তুমি সাধারণ মেয়ে না। কী সুন্দর গুছিয়ে ব্যবসা করছ, এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি করছ। খুচরো পয়সা গুলোও সযত্নে জমিয়ে রাখছ। পড়াশোনা, বিজনেস, টিউশনি সব একসঙ্গে সামলাচ্ছ! তুমি কী করে সাধারণ হও? তুমি তো অসাধারণ ই। ”
আকাশী গভীর চোখে তাকিয়ে রইলো। রাফাত এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে বলল,
“তুমি যে পৃথিবী দেখছ, সেই পৃথিবীর বাইরে আরও একটা পৃথিবী আছে। মুদ্রার এপিঠ, ওপিঠ দুই পিঠ ই আছে। দুর্ভাগ্য তো সেই হতভাগা হা*রামজাদার। যে তোমার কদর বুঝলো না।”
আকাশীর গভীর চোখে জল টলমল করছে। বৃষ্টি ফোঁটা হয়ে পড়ার আগে রাফাত ওর ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো ওর কপালে।
সকাল হতে আর কিছুক্ষন বাকী! মসজিদের মাইকে আজান হচ্ছে। আকাশী চমকে উঠলো। এতক্ষন! মনে হলো মিনিট দশেক আগে ও বেরিয়ে এসেছে!
চলবে…..
সাবিকুন নাহার নিপা