কুসুম কাঁটা পর্ব-১২+১৩

0
416

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-১২
স্বপ্নীল অফিসে এসে দেখলো ওর মতো আরও কয়েকজন এসেছে। সবাই ই ফর্মাল ড্রেসে। কিন্তু তাদের দেখতে ভালো লাগছে। ও’কে কেমন যেন অন্যরকম লাগছে। চারজনের মধ্যে একজন মেয়ে আছে। সে বোধহয় একটু বেশি বিরক্ত। কেমন যেন বিরক্তি নিয়ে সবার দিকে তাকাচ্ছে। স্বপ্নীলের ভীষণ নার্ভাস লাগলো৷ ইচ্ছে করছে বেরিয়ে যেতে, কিন্তু সেটা যাবে না। এই চাকরি টা যদি করতে পারে তাহলে দাদু নাকি ও’কে আর গাধা, গরু ডাকবে না।

কিছুক্ষন পর ওদের টিমে ভাগ করে দেয়া হলো। প্রথম দিন তেমন কাজ নেই, সবার সঙ্গে হাই, হ্যালো করলো। অন্যদের কাজ দেখলো, কফি খেল। সবাইকে দেখে বুঝলো যে এমন সেজেগুজে না আসলেও চলবে। অফিসের পরিবেশ টা ভালোই। ফ্যামিলি টাইপ ভাইব পাওয়া যায়৷ দুপুরের দিকে মনে হলো এখানে খারাপ লাগবে না৷

***
শ্রাবণ্য শপিংমলে গিয়েছিল একটু। নিজের দরকারী কিছু জিনিস কিনলো। একাই চকলেট, কফি খেয়ে ঘুরে বেড়ালো। দুপুরের দিকে স্বপ্নীল ফোন করে জিজ্ঞেস করলো,

“শ্রাবণ্য তুমি পৌছে গেছ?”

“না আমি একটু বসুন্ধরায় এসেছি।”

“ওহ। একা গেলে কেন? আমাকেও বলতে।”

“একা একা ঘুরতে ভালো লাগে আমার। আপনার কী খবর? অফিস কেমন লাগছে? ”

“তেমন ভালো না।”

“আস্তে আস্তে লাগবে। এখন রাখি।”

“আচ্ছা।”

***
শ্রাবণ্য বাড়ি ফিরে দেখলো বাবা, মা এসেছেন। আজ যে আসবে সেটা ও’কে জানায় নি। বাবা ও’কে দেখে বললেন,

“তোমার সঙ্গে কথা আছে।”

শ্রাবণ্য বুঝতে পারলো কি বিষয়ে কথা বলবে। বাবার কাছে সব খবর যায়। যতই আকাশীকে অস্বীকার করুক, তার খবর বাবা জানেন। শ্রাবণ্য নির্লিপ্ত গলায় বলল,

“আমি ফ্রেশ হয়ে আসি। ”

মা গেলেন শ্রাবণ্যর সঙ্গে। তিনি অস্থির প্রকৃতির মানুষ। বললেন,

“তোর সাহস দেখে আমি অবাক হই। কত বড় বেয়াদব মেয়ে হইছিস তুই।”

শ্রাবণ্য জবাব দিলো না। মা যে ওর শ্বশুর বাড়ি এসে এভাবে কথা বলছেন এই বিষয়ে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই৷ আসলে মা কোনোদিন ই ওদের পক্ষের লোক না৷ সে সবসময় বাবার হয়ে কথা বলেন। বাবার অনুপস্থিতিতে ওরা ভুল কিছু করলেও সে বাবাকে সেটা বলে দিতেন। তার মাথার মধ্যে এটা ঢুকে গেছে, জগতে সব সঠিক কাজ শুধু তার স্বামীই করেন।

মা আবারও বললেন,

“তুই তোর বাবার কথা অমান্য করলি কোন সাহসে?”

শ্রাবণ্য মায়ের চোখে চোখ রেখে বলল,

“এখন তো আর বাবার বাড়িতে থাকি না যে অমান্য করা যাবে না। এখানে তো যা খুশি তাই করতে পারি। ‘

রেহানা রেগে গেলেন সঙ্গে সঙ্গে। বললেন,

“এক থাপ্পড় মারব। দুদিন হলো বিয়ের, এরমধ্যে এতো ডানা গজিয়েছে। তুই যা খুশি করতে পারিস না। তুই চলবি এই বাড়ির নিয়মে। স্বপ্নীল, আর বড়দের কথা শুনে।”

শ্রাবণ্য এই কথার জবাবে কিছু বলল না। রেহানাকে ওভাবে রেখেই বেরিয়ে গেল।

***
শ্রাবণ্যর বাবা মুনসুর আলী ব্যবসায়ী মানুষ। পৈতৃক সম্পত্তি কে বাড়িয়ে চাড়িয়ে অনেক কিছু করেছেন। তিনি গম্ভীর, রাগী স্বভাবের। নিজের যুক্তিতে চলেন। মান, মর্জাদা নিয়ে খুব ই খুতখুতে ধরনের। তিনি যে সিদ্ধান্ত নেন, সেটার নড়চড় খুব কম ই হন। ছেলেমেয়েদের প্রতি যে মায়া মমতা আছে সেটার বহিপ্রকাশও ঘটে খুব কম।

শ্রাবণ্য বাবার মুখোমুখি বসলো। একটু পর রেহানা এসে বসলেন। ওদের ফ্যামিলির আলাপ বলে কেউ এদিকে ভিড়ছে না। মন্টি, রিন্টি পর্দার ফাঁক থেকে মাঝেমধ্যে দেখে যায়। মামীর মোচওয়ালা বাবাটাও ওদের বাবার মতোই। চকলেট, জুস আনে ঠিকই। কিন্তু ভীষণ রাগী।

মুনসুর শ্রাবণ্যকে জিজ্ঞেস করলেন,

“আকাশীর কথা এই বাড়ির লোকজনকে তুমি কী বলেছ?”

শ্রাবণ্যর জবাবও বাবার মতো সোজা সাপ্টা। বলল,

“স্বপ্নীল ছাড়া আর কাউকে কিছু বলিনি। স্বপ্নীল চাইছিল আমি আপুকে হেল্প করি।”

“আকাশী এখন কোথায়? ”

“আমি যেখানে ছিলাম। ”

রেহানা শ্রাবণ্যকে কিছু বলতে গেলে মুনসুর থামিয়ে দিয়ে বলল,

“ও কী ওই ছেলের সঙ্গে থাকবে না?”

“সেরকম ই জানালো৷ ”

মুনসুর কিছু সময় নীরব থেকে বলল,

“আকাশীকে তুমি জানাবে, ও যদি আমার কথা শুনে চলে তাহলে আরও একবার আমার ঘরে ওর জায়গা হবে। সব মানুষের ই আরেকবার সুযোগের দরকার হয়। তবে এটাই লাস্ট সুযোগ। এবং ও’কে আমার কথা শুনে চলতে হবে। আমি যে ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেব তাকে বিয়ে করতে হবে।”

শ্রাবণ্য মায়ের দিকে তাকালো। মায়ের মুখ টা থমথমে। বাবার সিদ্ধান্ত এমন কিছু হবে সেটা আশা করে নি৷

এই সুযোগে বাড়ির লোক আকাশীর কথা জেনে গেল। দাদু, তুলি সবাই বলল আকাশীকে এখানে এনে রাখতে। শ্রাবণ্যর সেটা মন:পুত হলো না। ও কাউকে কিছু বলল না অবশ্য।

***
স্বপ্নীল সন্ধ্যেবেলা ফিরলো ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে। একটা দিন অফিস করেই হাপিয়ে গেছে বেচারা। শ্রাবণ্যর ভীষণ হাসি পেল। ওর মাঝেমধ্যে ভাবতে কষ্ট হয় যে এই ছেলেটা বয়সে বড় একজন কে পছন্দ করেছিল। সবকিছুতে যে অল্পেই বিচলিত হয় সে কিভাবে এরকম দু:সাহসিক কাজ করলো।

স্বপ্নীল ঘরে ঢুকে শ্রাবণ্যকে বলল,

“তুমি তো আমাকে বললে না যে আমাকে হাস্যকর লাগছিল।”

শ্রাবণ্য হেসে ফেলল। বলল,

“কেউ বলেছে?”

“হ্যাঁ। অফিসের একটা মেয়ে হাসলো আমাকে দেখে। ”

“অফিস কেমন লাগলো? ”

“ভালো না। আমার আসলে লোকজন ভালো লাগে না। ”

“তাহলে চাকরি কিভাবে করবেন?”

“মনে হয় করতে পারব না। ওখানে সবাই কাজে ভীষণ দক্ষ, আমি ওদের সঙ্গে পারব না। ”

শ্রাবণ্য ঠোঁট টিপে হেসে বলল, অনেক কিছুই ভালো লাগে না, এই যে আপনার পায়ের কাছে মাথা রেখে আমি ঘুমাই, মানে একটা মেয়ের সাথে বেড শেয়ার করতে ভালো লাগে?

স্বপ্নীল শ্রাবণ্যর দিকে তাকালো। একটা মেয়ে শব্দটাই তো অদ্ভুত। দূরের কারো কথা বললে এমন লাগে। শ্রাবণ্য তো দূরের কেউ না।

স্বপ্নীল বলল, তুমি একটা মেয়ে কেন হবে? তুমি তো আমার বউ।

শ্রাবণ্যও স্বপ্নীলের দিকে অন্য চোখে তাকালো। স্বপ্নীল চোখ নামিয়ে নেয়। ও নীলাকে ভালোবাসে, তবুও শ্রাবণ্য ওর জীবনে কেমন যেন অন্যরকম একজন।

শ্রাবণ্য মনে মনে ভাবে, একটা কিছু সমস্যা হচ্ছে। স্বপ্নীল দিন দিন জীবনের অংশ হয়ে যাচ্ছে। না চাইতেও সবচেয়ে বেশী কথা ওর স্বপ্নীলের সঙ্গেই হয়।

***
মাস খানেক পরের ঘটনা।

মিশুক এই বাড়িতেই আছে। বাতাসী খালা এখন ওর সঙ্গে কথা কম বলেন। অল্প কিছু সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করে চলে যান। তার দু:খের গল্পগুলোও এখন আর মিশুকের সঙ্গে শেয়ার করে না।

বাড়ির লোকজন আগে যেমন ছিলো তেমন ই আছে। স্বপ্নীলের সঙ্গে সম্পর্ক আপনি থেকে তুমিতে এসেছে। স্বপ্নীল ওর কাছ থেকে ইকোনমিকস এর বইগুলো নিয়ে পড়ছে ইদানীং।

দাদু আগের মতোই গম্ভীর স্বরে কথা বলেন। দাদী এসেছেন অনেক দিন বাদে। তিনি মিশুকের সামনে আসেন। পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখেন। মন্টি, রিন্টি আঙ্কেল ডাকার পরিবর্তে মামা বলে ডাকে। মিশুক অবশ্য বাচ্চা দুটোকে অতো সিরিয়াসলি নিচ্ছে না। বাচ্চা দুটো ইচড়ে পাকা। ওর নিজেরও একটা ভাগ্নে আছে। বাসার বাইরে খেলতে গিয়ে প্রতিবার ই মার খেয়ে আসে। এই বাচ্চাদের মতো না।

একদিন সন্ধ্যেবেলা শ্রাবণ্য এলো কিছু বরফি, সন্দেশ নিয়ে। এসে বলল,

“আপনি ভালো আছেন?”

“হ্যাঁ। আপনি?”

“আমিও ভালো। আমাকে তুমি করে বলুন। আমি ইউনিভার্সিটি তে পড়ছি এখনো। এই নিন মিষ্টি খান।”

মিশুক প্লেট টা হাতে নিয়ে বলল,

“থ্যাংক ইউ। কিসের মিষ্টি? ”

এই বাসায় প্রতি শুক্রবারে মিলাদের মিষ্টি আসে। আজ শুক্রবার না বলেই মিশুক জিজ্ঞেস করলো।

শ্রাবণ্য স্বাভাবিক গলায় বলল, ছোট আপুর বিয়ের।

মিশুক মুখ ফসকে জিজ্ঞেস করলো,

“কার?”

“রঙ আপুর। বিয়েতে মত দিয়েছে।”

মিশুক স্বাভাবিক ভাবেই দুটো মিষ্টি খেল। বিষয় টা স্বাভাবিক ই। তবুও ওর কৌতূহল গেল না। কোথায় বিয়ে ঠিক হয়েছে, কার সঙ্গে হয়েছে এগুলো জানার ইচ্ছে হলো খুব।

রঙ্গনার সঙ্গে ওর এই এক মাসে দুটো কথা হয়েছে। কারেন্টের লাইনের কাজ চলছিল তখন বলেছিল, সবকিছু অফ রাখতে। এছাড়া বাড়তি কথা হয় নি।

***
রঙ্গনা বিয়েতে মত দিয়েছে। তার জন্য পাত্রকে হতে হবে পুলিশ অথবা পাইলট। ভুড়ি থাকলে চলবে না। আর গায়ের রঙ যেন ফর্সা হয়। কারণ ওর অনেকগুলো সুন্দর সুন্দর ছেলেমেয়ে লাগবে। নিজের রঙ টা ঘষেমেজে ফর্সা বানালেও লাভ নেই। দুদিন পর আগের রঙেই ফিরে আসে।

চলবে….

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-১৩
আকাশী শ্রাবণ্যর দুটো টিউশনি থেকে সাত হাজার পায়। এর আগে যেগুলো ও করেছে তাতে এতো টাকা পেত না। শ্রাবণ্য পরীক্ষার অজুহাতে এই দুটো ও’কে পাইয়ে দিয়েছিল। আরও দুটো যদি এমন জুটে যায় তাহলে ওর আর আপাতত অন্য ইনকাম সোর্স না খুঁজলেও হবে। পার্লারের টাকাটা রয়ে গেছে। চব্বিশ দিনের টাকা পাবে। সেটা আনতে যেতেও ইচ্ছে করছে না। হ্যাপি আপার মুখ টা দেখার আর ইচ্ছে নেই। ওই এলাকায় গেলে শুভর সঙ্গে দেখা হবে ভেবেও যেতে ইচ্ছে করছে না। এখানে ও বেশ আছে। কিছু মেয়ের সাথে ওর দারুন বন্ধুত্ব হয়েছে। শ্রাবণ্যর ইউনিভার্সিটির কাছের হোস্টেল বলে ও মাঝেমধ্যে আসে। আকাশীর এতেই ভালো লাগে। পড়াশোনা করছে ভালো মতোই। এবারের পরীক্ষা টা শেষ হয়ে গেলে বাকী থাকবে আর একটা বছর৷ তারপর অনেক টা সহজ হবে জীবন। জীবন সম্পর্কে আকাশী এখন আর ভাবে না। ভেবে আসলে কিছু হয়ও না। ও যা ভেবেছে ওর সঙ্গে তা কিছুই হয় নি৷ তাজা গোলাপ দেখে যে প্রেমিকে মুগ্ধ হতো সেই প্রেমিক বিয়ের কয়েকমাসেই হারিয়ে যায়। সংসারের চাল, ডালের হিসাব নিকাশের ব্যপারটাও আকাশী বুঝে যায় তখন। গোলাপের প্রতি সেই আকর্ষনও মরে যায়।

শ্রাবণ্যর দেয়া নতুন সিম কার্ডটা ব্যবহার করে। পুরোনো ফেসবুক একাউন্টটাও ডিলিট করে দিয়েছে। ওর আসলে শান্তি দরকার এখন। বিয়ের মাস পাঁচেক পর থেকে যে অশান্তি, অনিশ্চয়তার জীবন শুরু হয়েছে সেটাতে ও ক্লান্ত হয়ে গেছে। যারা অভাব দেখে বড় হয় তারা সহজে অভাব মানিয়ে নিতে পারে। কিন্তু সব পেয়ে বড় হওয়া মানুষের জীবনে অভাব জিনিসটা গলার কাঁটার মতো। প্রতিনিয়ত দিন গুনতে হয় সেই কাঁটা কবে নামবে গলা থেকে।

আকাশী এখানে ভালো আছে। শ্রাবণ্য হোস্টেলের টাকা এই মাসেও দিয়ে গেছে। ও বারন করার পর বলেছে,

“তোর টাকা তোর থাকুক, আমি যেটা দিচ্ছি সেটাও বাবার ই দেয়া। আমাকে দিয়েছিল বিয়ের পর। যেন প্রয়োজনে খরচ করতে পারি৷ তোকে সেখান থেকে দিচ্ছি। নিজের যেটা আছে সেটা খরচ করিস না। রেখে দে লাগবে, বিপদে মানুষ লাগে না। টাকাই লাগে সবার আগে।”

আকাশী চমৎকৃত হয়েছে। শ্রাবণ্য ওর মতো হয় নি৷ নরমের মধ্যে শক্ত ধাঁচের। বোধহয় বাবার স্বভাব পেয়েছে খানিকটা। ওর ই বা কত বয়স! তবুও সব টা কী সুন্দর গুছিয়ে ম্যানেজ করে!

শ্রাবণ্য আকাশীকে বাবার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। শুনে আকাশীর বোধহয় খুশি হওয়া উচিত ছিলো। এই তিন বছরে বাবা, মা’কে একবার চোখের দেখাও দেখতে পারে নি৷ মা’কে ফোন করলে সে অভিশাপ দিতেন। তবুও তার কন্ঠস্বর শোনার সৌভাগ্য ওর হয়েছিল। বাবাকে কখনো ফোন করার সাহস ও পায় নি।

আকাশী শ্রাবণ্য কে বলেছে, তুই বাবাকে বলিস আমাকে যদি ক্ষমা করে দেয় তাহলে যেন একবার সামনাসামনি দেখা করার সুযোগ দেয়। আর কিছু আমার চাই না। যা কিছু ভুল আমি করেছি সেগুলো একান্ত আমার ই। এর দায় আমার, এর জন্য মাশুল যা গুনতে হবে গুনব। বাবাকে আর কষ্ট দিতে চাই না।

শ্রাবণ্য বাবাকে সেকথা জানিয়েছেন। বাবা নাকি জবাবে কিছু বলে নি৷ তবে আকাশীর ভীষণ লোভ হয় বাড়ি যাবার। আনন্দের দিন গুলো সবার সাথে কাটাতে। সেই সুযোগ কোনোদিন আসবে কিনা ওর জানা নেই।

***
আজ স্বপ্নীল ছুটি নিয়েছে। একটা মাস যে কিভাবে গেল! ও বুঝে গেছে যে চাকরি বাকরি ও’কে দিয়ে হবে না। তবুও আরও দুটো মাস কাটাতে হবে। চুক্তি অনুযায়ী মেজর কোনো প্রবলেম না হলে তিনটা মাস কন্টিনিউ করতে হবে৷ স্বপ্নীল সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে যে তিন মাস পর ও আর অফিসে যাবে না। বাসায় থাকবে, দাদু যা বলে বলুক। গাধা, গরু যা বলছে মুখে বলছে। ওর গায়ে তো আর লাগছে না।

স্বপ্নীল ভেবে লজ্জা পায় যে ও নীলাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। নীলার বাচ্চার দায়িত্বও নিবে। চাকরি করে খাওয়াবে। নীলা ঠিকই করেছে৷ দেখা যেত বেচারি ও’কে বিয়ে করে না খেয়ে আছে। এই কটা টাকায় কী ই বা খাওয়াতে পারতো৷ ওর নাহয় এক পিস মাছ, একবাটি ডালে হয়ে যায়। নীলা তো প্লেট সাজিয়ে ভাত খেত। তাছাড়া বাচ্চার স্কুলের খরচ আছে।

স্বপ্নীল আর ভাবতে চায় না। ইশ! জীবন এতো জটিল কেন! টাকা ইনকাম করা এতো কষ্টের কেন!

শ্রাবণ্য আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে ফেসপ্যাক লাগাচ্ছে। ও আবার রুপের ব্যাপারে ভীষণ সচেতন। খায়ও অল্প। ওর সেমিস্টার ফাইনাল শেষ হলো৷ রাত জেগে পড়াশোনা করতে গিয়ে কটা পিম্পল হওয়ায় কী দু:খই না পেয়েছিল। স্বপ্নীল হেসে ফেলল সেই কথা ভেবে।

শ্রাবণ্য পেছনে ফিরে ও’কে একবার জিজ্ঞাসু চোখে দেখে আবার আয়নার দিকে তাকালো। শ্রাবণ্য সাজতেও ভীষণ ভালোবাসে। কাজল, লিপস্টিক না পরে বেরোয় না। সেদিন সবাই মিলে ফুচকা খেতে গেল, সেখানেও সেজে গেছে। অবশ্য সাজলে ও’কে ভীষণ ভালোও লাগে। চোখে কাজল পরলে একদম অন্যরকম লাগে। ওর চুলগুলোও ভীষণ সুন্দর। কিন্তু সেটা বাইরের কেউ দেখার সুযোগ পায় না। হিজাব পরে সবসময়। স্বপ্নীলের মাঝেমধ্যে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। লজ্জায় ছুঁয়ে দেয় না।

স্বপ্নীল হঠাৎ জিজ্ঞেস করে,

“শ্রাবণ্য, তোমার কী কোনো প্রেমিক আছে? ”

শ্রাবণ্য আবার ওর দিকে তাকায়। ও’কে দেখতে অদ্ভুত লাগে। অরেঞ্জ কালার মুখ।

শ্রাবণ্য বলে,

“না। কেন?”

“তুমি তো অনেক সুন্দর এজন্য। ”

শ্রাবণ্যর মুখ টা হাসি হাসি হয়ে যায়। স্বপ্নীল আবারও বলে,

“আজ ছোটপাকে দেখতে আসবে? তোমাকে সুন্দর দেখাতে হবে কেন?”

“কেন? আমাকে সুন্দর দেখালে ক্ষতি কী”

“না এমনি জিজ্ঞেস করলাম। ”

শ্রাবণ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলল। স্বপ্নীল বুঝলো না সেটা। ওর প্রেমিক ছিলো না কেউ। বাবার ভয়ে কাউকে কখনো ধারে, কাছে ঘেঁষতে দিতো না। তবে মনে মনে চাইতো সুন্দর হ্যান্ডসাম একজনের সঙ্গে ওর বিয়ে হোক। শাহরুখ খানের মতো রোমান্টিক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকুক। ওগুলো শুধু স্বপ্নই থেকে গেল! বাস্তব তো……!

***
রঙ্গনাকে আজ দেখতে আসবে। পাইলট পাত্র পাওয়া গেছে একজন। দাদুর ইচ্ছে ছিলো পুলিশের সঙ্গে বিয়ে দেবার। কিন্তু বাড়ির লোক এই ছেলেটাকে পছন্দ করেছে। বিয়েতে দাদু খুব একটা মাতব্বরি করতে পারছে না। রঙ্গনার মা মেয়ের বিয়ে নিয়ে ভীষণ সিরিয়াস। তিনি শ্বশুর কে বিশেষ পাত্তা দিচ্ছেন না।

সন্ধ্যেবেলা আসার কথা। বাড়িতে এলাহি আয়োজন। বিরিয়ানি, রোস্ট, দুই তিন পদের কাবাব করা হয়েছে। ডেজার্টে কাস্টার্ড, পায়েশ, পুডিং। এছাড়া নাশতায় সিঙ্গারা, সমুচা, লুচি, হালিম জাতীয় অনেক খাবার।

রঙ্গনাকে দেখে মনে হচ্ছে বিয়েতে ভালোই সিরিয়াস। চুল রিবন্ডিং করে এসেছে। ফেশিয়াল, পেডিকিওর, মেনিকিওর কিচ্ছু বাদ দেয় নি। শাড়ি বাছাবাছি করলো অনেক সময় নিয়ে। শ্রাবণ্য আর তুলিকে দিয়ে সাজগোজ ঠিকঠাক করলো।

শিলার একটু সন্দেহ হয়। রঙ্গনাকে বললেন,

“তুই কী উল্টাপাল্টা কিছু ভাবছিস? বিয়ে নিয়ে তোকে জোর করব না। কিন্তু খবরদার রেগে উল্টাপাল্টা কিছু করবি না। ”

রঙ্গনা হেসে বলল, না না এবার বিয়ে করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেব।

শিলা মেয়েকে বিশ্বাস করেন না। ভয়ে থাকেন, মেয়ে না জানি কী অঘটন ঘটায়।

***
স্বপ্নীল গিয়ে মিশুক কে বলে আসলো নিচে আসার কথা। দাদু থাকতে বলেছেন। মিশুক বলল,

“তোমার শ্বশুর বাড়ি থেকে গেস্ট আসছে?”

“আরে না ভাইয়া, ছোটপাকে দেখতে আসছে। ”

মিশুক কয়েক সেকেন্ড স্বপ্নীল কে দেখলো। তারপর বলল,

“তোমার ছোট আপা সত্যিই বিয়ে করছেন?”

“বোধহয়। আজ দেখতে আসবে। পছন্দ হলে তারপর। অবশ্য ছবি দেখে আগেই দুজন দুজন কে পছন্দ করেছে।”

মিশুক গম্ভীর গলায় বলল,

“আচ্ছা। ”

স্বপ্নীল চলে যাবার পর মিশুক দরজা বন্ধ করে রইলো। ও আজ আর বেরোবে না। বোধহয় সবাই মিলে ও’কে সূক্ষ্ম অপমান করতে চাইছে। অবশ্য অপমানের বিষয় টা মোটেও আসবার কথা না, ও তো রঙ্গনাকে রিজেক্ট করে নি সেভাবে। মানে, ব্যাপার টা তো হতে হতেও হয়ে ওঠে নি।

রঙ্গনা উপরে এলো নিজের কিছু একটা খুঁজতে। মিশুক টের পেল, হিলের শব্দ। কান সজাগ করে রইলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই টের পেল রঙ্গনা শ্রাবণ্যকে ডাকছে। ও ঘর থেকে বেরোলো। রঙ্গনাও তখন বেরিয়েছে। দুজনের চোখাচোখি হলো। রঙ্গনা সুন্দর সেজেছে। সাদার সঙ্গে রানী গোলাপি ব্লাউজে খুব মানিয়েছে। চুলের কারনে ভীষণ অন্যরকম লাগছে। মিশুক হেসে বলল,

“হাই রঙ্গনা।”

রঙ্গনা বিস্ময় লুকিয়ে বলল,

“হ্যালো মিশুক। ”

“সুন্দর লাগছে ভীষণ। ”

রঙ্গনা কপালে কৃত্রিম ভাজ এনে বলল,

“রিয়েলি? থ্যাংক ইউ সো মাচ।”

“বাই দ্য ওয়ে, কনগ্রাচুলেশন। ”

“থ্যাংক ইউ। ওয়ান্স এগেইন। ”

মিশুক আরও একবার রঙ্গনাকে আপদামস্তক দেখে বলল,

“আপনার বিয়ের যেকোনো কাজে আমাকে ডাকবেন। প্রয়োজনে অফিস থেকে সিক লিভ নেব। ”

রঙ্গনার ঠোঁটে দুষ্ট হাসি। দুজনে চোখে চোখ রেখে কথা বলছে।

শ্রাবণ্য সিড়ির কাছে এসে রঙ্গনাকে ডাকলো। রঙ্গনা এগিয়ে যাচ্ছে ওর চোখের দৃষ্টি তখনও মিশুকে আবদ্ধ। হঠাৎ দরজার কাছে গিয়ে পেছনে ফিরে তাকালো। মিশুক হাত ভাজ করে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রঙ্গনা বলল,

“তুমি নিচে এসো, সবার ভালো লাগবে। আর তোমারও লাগবে। ”

মিশুক ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়লো।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে