কুসুম কাঁটা পর্ব-০৫

0
414

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-৫
শ্রাবণ্য রঙতুলিতে মানিয়ে নিলো কয়েক দিনেই। বাড়ির লোকগুলো ভালোই। শিলা, তুলি, দাদী সবাই ই ও’কে ভালোবাসেন। দাদু মানুষ টা গম্ভীর। শ্রাবণ্যর সঙ্গে যখনই দেখা হয় গম্ভীর গলায় কথা বলেন। দাদী অবশ্য দাদুর নামে শ্রাবণ্যকে নিন্দে করেছেন। বলেছেন,

“বুঝলা ভাবী, লোকটা হইলো গিয়া একটা খাটাশ। আমার বাপে ভালো দেখে বিয়া দিছে। আমি তো জানি কী ঘাউড়া লোক। তবে জীবনে কোনোদিন বাপের বাড়ি গিয়া ব্যটার বদনাম করি নাই৷ আমার বুড়া বাপ কষ্ট পাবে তাই৷ ”

শ্রাবণ্য হেসে ফেলে। বলে,

“আপনি আমাকে নাম ধরে ডাকুন দাদী। ”

“নাম ধরে তো তোমারে সবাই ই ডাকে। কিন্তু ভাবী ডাকার কেউ তো নাই তাই আমিই তোমাকে ভাবী ডাকলাম। ”

শ্রাবণ্য হাসে। মানুষগুলো ভীষণ ভালো। এমনিতে অন্যদের সাথে মন্দ কিনা তাতে ওর কিছু যায় আসে না। ওর সঙ্গে ভালো হলেই হবে। এই বাড়িতে দাদু ছাড়া বাকীদের কাছে স্বপ্নীল ভীষণ প্রিয়। মা এখনো সুযোগ পেলে স্বপ্নীল কে ভাত মেখে খাইয়ে দেয়। ছেলেটাও এই বয়সে মায়ের হাতে ভাত খায়।

স্বপ্নীল তুলিকে বুবু ডাকে বলে শ্রাবণ্যও বুবু ডাকে। তুলিরও যে ভাইয়ের প্রতি দূর্বলতা আছে সেটা ও বুঝতে পেরেছে।

তবে এই বাড়িতে মন্টি, রিন্টি শ্রাবণ্যকে ভীষণ বিরক্ত করে। ওর লিপস্টিক ভেঙে ফেলেছে, নেইল পলিশের বোতলে পানি দিয়েছে।

এছাড়া আরও আছে মালেক মামা। উনি স্বপ্নীলের নিজের মামা নন। শিলার দু:সম্পর্কের ভাই প্লাস বাড়ির কেয়ারটেকার। বাড়ির সমস্ত দেখাশোনা সে করে। তিনি বাচাল স্বভাবের মানুষ। শ্রাবণ্যর সঙ্গে একদিন কথা হয়েছিল। ও’কে ভার্সিটিতে দিয়ে আসার জন্য গিয়েছিল। সারা রাস্তা লোকটা এতো কথা বলেছে যে ওর মাথা ব্যথা শুরু হয়ে গেছে।

রান্নার কাজে সাহায্য করেন বাতাসী খালা। তার খুব মেজাজ। তিনি মালেক মামাকে একদম পছন্দ করেন না। তাকে ডাকে কাইল্যা ব্যডা সম্বোধনে। অথচ লোকটার গায়ের রঙ ফর্সা। ওনার স্বভাব হচ্ছে সবার ই কম বেশী বদনাম করা। বেশীরভাগ সময়েই বদনাম শুরু করে তার ছেলে আর ছেলের বউকে নিয়ে। তারপর আস্তে আস্তে এই বাড়ির লোকেরা এসে যায়। এই বাড়িতে তিনি কাজ করেন তেরো বছর ধরে। বলতে গেলে বাড়ির সদস্যই।

***
আজ প্রথম শ্রাবণ্যর দেখা হলো রঙ্গনার সঙ্গে। ও’কে ভোরবেলা ঘুম থেকে তুলল স্বপ্নীল। বলল,

“একটু ওঠো। ছোটপা এসেছে। ”

শ্রাবণ্য বুঝতে না পেরে বলল,

“কে এসেছে?”

স্বপ্নীল গলা নামিয়ে বলল,

“আমার ছোটপা। ওর আবার রাগ বেশী। একটু ওঠো। ”

শ্রাবণ্য উঠতেই স্বপ্নীল দরজা খুলে দিলো। রঙ্গনা ভেতরে ঢুকে বলল,

“কই দেখি, দেখি নতুন বউকে দেখি। ”

শ্রাবণ্যর সঙ্গে রঙ্গনার এই প্রথম দেখা। রঙ্গনা দেখতে তুলির মতো সুন্দরী না। কাঁধ পর্যন্ত কোকড়া চুল। পরনে কালো শার্ট আর জিন্স। রোগা, পাতলা। গায়ের রঙ টা শ্যামলা ধরনের। রোদে পুড়ে কালো হয়ে গেছে। শ্রাবণ্য আপদামস্তক রঙ্গনা কে দেখলো। দাদি রঙ্গনার গল্প করেছে শ্রাবণ্যর সঙ্গে। লক্ষ্মীছাড়া মেয়ে, কারোর কথা শোনেনা। শ্রাবণ্য সালাম দিলো। রঙ্গনা সালামের জবাব দিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,

“কোন সাবজেক্টে পড়ছ?”

“ইতিহাস। ”

“থার্ড ইয়ার?”

শ্রাবণ্য মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। স্বপ্নীল চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণ্যর পাশে। রঙ্গনা আর প্রশ্ন করলো না। স্বপ্নীল কে বলল,

“তুই একটু আমার সঙ্গে আয়। ”

তারপর শ্রাবণ্যর দিকে তাকিয়ে বলল,

“তুমি ঘুমাও। ”

শ্রাবণ্য মৃদু হেসে মাথা নাড়লো।

***
রঙ্গনা স্বপ্নীল কে বাইরে নিয়ে গিয়ে বলল,

“দাদু তোর জোর করে বিয়ে দিয়ে দিলো কী করে?”

স্বপ্নীল কি বলবে বুঝতে পারছে না।

“কথা বলছিস না কেন? জোর করে কাউকে বিয়ে করানো যায়? কেমন ছেলে তুই? দুইবেলা জুতাপেটার উপর রাখতে হবে তোকে। একটা মানুষ কে কী করে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে করানো যায়!”

স্বপ্নীল চুপ করে রইলো। এমন বড় কথা আসলে রঙ্গনাই বলতে পারে। দাদু তার উপর জোর খাটায় নি। স্বপ্নীল কে তো এক ধমকেই রাজী করে ফেলেছে। অবশ্য মায়েরও এখানে গুরুত্ব কম না। তিনিও মাথায় হাত বুলিয়ে বুঝিয়ে পাঠিয়েছেন। তখন ওর মন টাও তো ভালো ছিলো না। নীলার ব্যাপার নিয়ে আপসেট ছিলো। এসব আসলে রঙ্গনাকে বলে ওর লাভ নেই। রঙ্গনা যুক্তি তর্কের ধার ধারে না।

রঙ্গনা আবারও বলল,

“চুপ করে আছিস কেন? বউ খুব মনে ধরেছে?”

স্বপ্নীল রঙ্গনার খোঁচা টা বুঝতে পারলো না। ও অবশ্য একটু বেখেয়ালে ছিলো। তবুও মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

রঙ্গনা হতাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এখন ওর যে কথাটা বলতে ইচ্ছে করছে সেটা স্বপ্নীল কে বলা ঠিক হবে না। বড় বোন বলে সংযত হলো। বলল,

“যা এখন। ”

রঙ্গনা ঘুরতে গিয়েছিল টেকনাফ। এমন এক অঞ্চলে গেছে যেখানে নেটওয়ার্ক পায় না। বাড়িতে কথা হয় নি তিন দিন। তিন দিন পর ফোন করে এই খবর শুনে ওর মাথাটা গরম হলো। তারচেয়েও বেশি মেজাজ খারাপ হলো স্বপ্নীলের উপর। বেকার ছেলে বিয়ে করে বসে আছে। এক ফোঁটা লজ্জা নেই।

***
শ্রাবণ্যর আর ঘুম হলো না। স্বপ্নীল ল্যাপটপ নিয়ে বসলো। ও সবসময়ই সকালে ওঠে। অনেক দিনের অভ্যাস বলে বেশী ঘুমানোর বদ অভ্যাস নেই। শ্রাবণ্য বলল,

“আপনার ছোট আপু একটু রাগী না?”

“একটু না, খুব। ওর কথাবার্তা খুব খারাপ। নিচের বস্তিতে ঝগড়া হলে যেসব পঁচা গালি দেয়, সেগুলো ও জানে। ”

শ্রাবণ্য শব্দ করে হেসে ফেলল। স্বপ্নীল নিজেও হাসলো। শ্রাবণ্যর সঙ্গে ওর কথা বলতে ভালো লাগে৷ ওর অবশ্য সবার সঙ্গেই কথা বলতে ভালো লাগে কিন্তু ও’কে তেমন কেউ পাত্তা দেয় না। বলে ওর সেন্স অফ হিউমার কম। কিভাবে সেন্স অফ হিউমার বাড়ানো যায় এই নিয়ে ইন্টারনেটে অনেক ঘাটাঘাটি করেছে। নীলক্ষেত থেকে একশ টাকায় একটা বইও কিনেছিল। সেগুলো দিয়ে লাভের লাভ কিছু হয় নি।

শ্রাবণ্য সেদিক দিয়ে ব্যতিক্রম। এখনো পর্যন্ত ও’কে একবারও বলে নি যে ও বোরিং। ওর কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনে।

“তুমি আজ ভার্সিটিতে যাবে না?”

“যাব। আপনি আমার একটা উপকার করতে পারবেন? ”

“হ্যাঁ পারব।”

“দাদুকে বলবেন যে মালেক মামাকে আমার সঙ্গে যাবার দরকার নেই। আমি একাই যেতে পারব। উনি এতো কথা বলেন যে আমার মাথা ধরে যায়। ”

“দাদু শুনবে না। তবে আমি তোমার সঙ্গে যেতে পারি। দাদু তাতে কিছু বলবে না। ”

“আচ্ছা তাহলে আপনিই চলুন। ”

স্বপ্নীল একটু খুশিই হলো। এই বাড়িতে মা আর বুবুর পর আরেকজন ও’কে বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে।

***
বাতাসী খালা নাশতার প্লেট নিয়ে উপরে গেল। মিশুক কে সে ভাইজান বলে ডাকছে। মিশুক অপ্রস্তুত গলায় বলল,

“খালা নাম ধরে ডাকুন। ভাইজান বলে ডাকতে হবে না। ”

খালা শুনছেন না। তিনি যতবার ভাইজান বলেন ততবার অস্বস্তিতে পড়ে। এত বয়স্ক একজন মানুষ ও’কে ভাইজান বলে ডাকছেন।

এই বাড়ির খাবার ভালো। এরা অতিরিক্ত তেল খায় না। এর আগে যে বাসায় ছিলো সেখানে দুদিন পর পর ই কঠিন ডাইরিয়ায় ভুগতে হতো।

বাতাসী খালা মিশুক কে খাবার টা দিয়ে পাশের রুম পরিস্কার করতে গেল। কিছুক্ষন পর এসে বলল,

“ভাইজান একটা কথা, আপনি বিয়ে করবেন না?”

মিশুক শুকনো কাশলো। বাসা বাড়ির খালারা বেশ ভালো ঘটকালিও করেন আজকাল। এসব করে দুই পক্ষের থেকে বড় অংকের টাকা পায়। সাইড বিজনেস বলা যায়।

মিশুক বলল, ওরকম কিছু ভাবিনি। সময় আরও একটু যাক। নিজেকে গুছিয়ে নেই।

“ভাবা উচিত। আপনার বিয়ার বয়স হইছে। ”

মিশুক চুপ করে রইলো। এই ব্যাপারে যত কম কথা বলা যায় ততই ভালো। নাহলে উনি আরও কথা বাড়াবেন।

খালা বললেন,

“আপনে এমন ফর্সা মানুষ, আপনের উচিত একটা শ্যামলা মাইয়া বিয়া করা। ভালো মানাইব আপনের পাশে। ”

মিশুক উঠে গেল। ফোন হাতে নিয়ে বারান্দার দিকে গেল। ভাব করলো যে ওর গুরুত্বপূর্ণ ফোন এসেছে।

বাতাসী খালা হাল ছাড়লেন না। তিনি কাজে মন দিলেন। খালুজান তাকে একশ টাকা দিছে। এই ব্যটার মনের খবর জানার জন্য৷ এই ব্যটার অন্য কোনো জায়গায় লাইন আছে কি না।

চলবে….

(নিয়মিত পাঠক রা সাড়া দিবেন।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে