#কুসুম কাঁটা
#পর্ব-৪
আফতাব সাহেব চশমার ফাঁক দিয়ে ছেলেটাকে আপদামস্তক দেখলেন। দেখতে বেশ ভদ্রই মনে হচ্ছে। সরাসরি তার চোখের দিকেই তাকিয়ে আছেন। এমন ছেলেদের আত্মবিশ্বাস প্রখর হয়।
“বাড়ি যেন কোথায় বললে?”
“হালিশহর। ”
“পড়াশোনা? ”
“পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ”
“চাকরি ঢাকায়? ”
“জি। ”
“বাড়িতে কে কে আছে?”
“মা, বাবা আর আপু। ”
“বোনের বিয়ে হয়ে গেছে?”
ছেলেটা এবার বিরক্ত হলো৷ পেয়িং গেস্ট আবশ্যক বিজ্ঞাপন দেখে এসেছে৷ অথচ প্রশ্ন করছে বিয়ের বাজারে পাত্রকে যেমন প্রশ্ন করা হয় তেমন।
ছেলেটার নাম মিশুক। একটা রিসার্চ ফার্মে চাকরি হয়েছে রিসেন্টলি। সেই সূত্রেই এখানে আসা। ঢাকায় ভাড়া বাসায় থাকার চেয়ে পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকার সুবিধা আছে। মিশুক হোটেলের খাবার তেমন খেতে পারে না। তাই খাবার ঝামেলা এড়াতে বিজ্ঞাপন দেখে এসেছে৷
আফতাব সাহেব আবারও প্রশ্ন করলেন,
“তোমার বয়স এখানে যেমন দেয়া আছে সেটা কী আসল বয়স?”
মিশুক এবার বিরক্তি প্রকাশ করে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনাদের এখানে থাকার জন্য সেটা জানানোও জরুরী?”
আফতাব সাহেব চশমার ফাঁকে আবারও একবার ছেলেটাকে দেখলেন। তিনি ওর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তুলিকে ডেকে বললেন,
“তুলি তিনতলার ডানদিকের চাবিটা নিয়ে আয় তো। ”
তুলি চাবি নিয়ে এসে বলল,
“দাদু তুমি এখানে থাকো। আমি ওনাকে নিয়ে যাচ্ছি। ”
***
তিনতলার ডানদিকের ফ্ল্যাট টা ছোট। দুই রুম, ড্রয়িং রুমের সঙ্গে ডাইনিং স্পেস। আর ছোট রান্নাঘর।
মিশুক জিজ্ঞেস করলো,
“এখানে থাকব?”
তুলি রুমদুটো খুলে দিয়ে বলল,
“দেখুন কোন টা পছন্দ হয়?”
মিশুক বড় রুম টা পছন্দ করলো। বারান্দাটাও সুন্দর। রুমে একটা খাট, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল রাখা। দেখেই বোঝা যায় নিয়মিত পরিষ্কার করে রাখে। মিশুকের পছন্দ হলো। বলল,
“পাশের রুমে কেউ থাকে না?”
“আমার ছোট বোন বাড়িতে এলে থাকে। আর মাঝেমধ্যে গেস্ট রা এলে। ”
“আচ্ছা। ”
“আপনার পছন্দ হয়েছে?”
“হ্যাঁ। ”
“টাকা পয়সার ব্যাপারে দাদুর সঙ্গে কথা বললেই হবে। আর রাতের খাবার আমরা সাড়ে নয়টায় খাই। আপনি চাইলে আগে খেতে পারবেন। চাইলে আমাদের সঙ্গে নিচেও খেতে পারবেন। ”
মিশুক স্মিত হেসে বলল,
“থ্যাংক ইউ। ”
“ঘর পরিষ্কার করবে আমাদের খালা। চাইলে কাপড়ও পরিষ্কার করবে। তবে এর জন্য আলাদা চার্জ লাগবে না। ”
“আচ্ছা। আমি কী যেকোনো দিন শিফট করতে পারব?”
“জি। আমাদের তাতে সমস্যা নেই। ”
“আচ্ছা। ”
তুলি নিচে নেমে এলো। দাদুর পাগলামী গেল না। রঙ্গনার জন্য পাত্র খোঁজে এভাবে। কতজন যে এমনি করে গেল! কেউই শেষমেস দাদুর মনমতো হয়ে উঠতে পারে না। আর রঙের কথা তো কিছু বলার ই নেই।
***
স্বপ্নীলের এখানে ভালো লাগছে না। সারাদিন খাওয়ার উপর থাকতে হয়। সকালে নাশতা খাবার পর পর ই শ্রাবণ্যর ভাবী এক থালা ভাপা পিঠা নিয়ে এলো। ভরা পেটে দুটো পিঠা খেতেই ওর কষ্ট হয়ে গেল। দুপুরে দশ পদের আইটেম দেখে ও একটুর জন্য অজ্ঞান হয় নি। মাছের মাথাটা যখন পাতে তুলে দিলো তখন ও শ্রাবণ্যর দিকে তাকালো। ও নিজের খাওয়ায় ব্যস্ত। স্বপ্নীলের দিকে ফিরেও তাকালো না। স্বপ্নীল এতো খাওয়া জীবনে খায় নি৷ বাড়িতেও অল্প খায়। এতসব খাবার দেখে ওর বলতে ইচ্ছে করে, আমাকে এসব না দিয়ে একটা ডিম ভাজী করে দেন। নাহলে এক পিস মাছ ভেজে সঙ্গে একটু পাতলা ডাল দিন। এক প্লেট ভাত আমি পেট ভরে খেতে পারব।
খাওয়া দাওয়ার এই অত্যাচার থেকে বাঁচতেই শ্রাবণ্যকে বলল,
“আমরা ঢাকায় ফিরব কবে?”
শ্রাবণ্য ঠোঁট উল্টে বলে, আপনার যেদিন ইচ্ছে।
“তুমি একটু বলো। আমার এখানে সমস্যা হচ্ছে। ”
“আপনি বলুন। আমি বললেও শুনবে না। এখানে আমার দাম দুই পয়সাও না। ”
স্বপ্নীল মনে মনে বলল,
“নিজের বাড়িতে কারোরই দাম থাকে না। দাদু এখনো সবার সামনে আমাকে গরু, গাধা বলে। ”
শ্রাবণ্য বলল,
“আপনি বাবাকে বলুন আর্জেন্ট কাজ আছে। ”
“শ্রাবণ্য, বড়দের সামনে আমি মিথ্যে বলতে পারি না। ”
শ্রাবণ্য হেসে ফেলল। বলল,
“ছোটদের সামনে পারেন?”
“ওভাবে গুছিয়ে পারি না। মিথ্যে বলাও আসলে একটা আর্ট। ”
শ্রাবণ্য মনে মনে ভাবলো, কী বোরিং মানুষ! ও যাদের সাথে মিশতো তারা কেউই এমন ছিলো না।
***
শ্রাবণ্য ভাবীকে যাবার কথা বলল। স্বপ্নীলের কাজ আছে শুনে বাবা, মা’ও আপত্তি করলেন না। শ্রাবণ্যরা সেদিন বিকেলেই রওনা হয়ে গেল। রেহানা দেখলেন, মেয়ে তার সাথে অতো বেশী কথা বললেন না। সারাদিন ঘরেই থেকেছে। বাইরে যেটুকু সময় থেকেছে সেটাও শিউলির আঁচল ধরে। স্বপ্নীলের সঙ্গে কেমন কী ভাব হলো সেটাও জানতে পারলেন না। তবে মেয়ের অভিমান বুঝলেন। অভিমান করলে করুক, বিয়ে দিয়েছেন ভালো করেছেন। ওর বাবার সিদ্ধান্ত কী আর ভুল হবে! এমনিতেই একজন যা ডোবানোর ডুবিয়ে গেছে। বাড়ির নাম খারাপ করেছে, বাপের মান খুইয়েছে। কতো আদরের মেয়ে ছিলো আকাশী। বাবা পাতের খাবার তুলে মেয়েকে দিতেন। সেই মেয়ে বাপের বুকে লাত্থি মেরে একটা ছোটলোকের সঙ্গে গেছে। একটা বার কারোর কথা ভাবে নি।
শ্রাবণ্য যাবার পর রেহানা শিউলি কে বললেন,
“শ্রাবণ্যর কানে ইচ্ছেমতো আমার বিষ ঢালতে পারছ তো?”
শিউলি বিস্মিত গলায় বলে,
“কী বলছেন মা?”
“সারাক্ষন তো তোমার আঁচল ধরেই ছিলো! ”
শিউলি স্মিত হেসে বলল,
“যে আঁচলে স্নেহ পাবে সেখানেই তো ঘুরবে মা।”
রেহানার গলার স্বর আরও রুক্ষ হয়। বলেন,
“আমার মেয়ের জন্য আমার চেয়ে তোমার দরদ বেশী?”
“তর্কে যাব না মা। তবে আপনারা আকাশীর শাস্তি কম বেশি ও’কেই দিয়েছেন। ”
রেহানার চোখ দিয়ে যেন আগুন বেরোচ্ছে। পারলে শিউলিকে এক থাপ্পড় দিতেন। মুখে মুখে তর্ক করা শিখেছে বে*য়াদব মেয়ে।
শিউলি শাশুড়ীর রাগ দেখেও চুপ করে রইলো। সত্যি সবসময় তেতো হয়। সেটা সবাই নিতে পারে না।
***
শুভ’র সঙ্গে আকাশীর দুটো ভালো কথা হলে দশ টা হয় মন্দ কথা। আকাশী যাই করে শুভর সেটা অপছন্দ। ও চায় প্রতি মাসে বেতনের সব টাকা আকাশী ওর হাতে তুলে দিক। তারপর নিজের ইচ্ছেমতো খরচ করুক। ইনকাম শুরুর প্রথম দিকে এমন ই করতো। কিন্তু পনেরো তারিখের পর দেখা যেত সংসারে অভাব লেগে আছে। ভর্তা ভাতের যোগান দিতেও হিমশিম খেতে হয়। এরপর থেকে আকাশী টাকা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বলেছে নিজে সংসার চালাবে।
পরশু রাতে ঝগড়া হলো খুব ই তুচ্ছ বিষয় নিয়ে। মাংসের বাটিটা দেখেই শুভ বিরক্ত গলায় বলল,
“আম্মা আজও ভাত খাইছে পাটশাক দিয়া। আর আমরা মাংস খাইতেছি। ”
আকাশীর মেজাজ খারাপ হলো। অমন শাক ভাত ওরাও কম বেশী খায়। কোনো কোনো দিন শুধু মসুর ডাল দিয়েও আকাশী ভাত গিলেছে। সংসারে অমন টানাপোড়েন যে হয় সেটা ও গত তিন বছরে বুঝেছে। তবুও শুভ’র ওই খোঁচা দেয়া স্বভাব যায় না।
আকাশীর নিজের কিছু খরচ আছে। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির পড়া বাদ দিয়ে ন্যাশনালে পড়ছে। গ্রাজুয়েশন এর সার্টিফিকেট হলে একটা চাকরিও জুটবে। পার্লারে গাধার খাটুনি আর ভালো লাগে না। শুভ সেটা বুঝবে না, ও শুধু নিজের টা বোঝে।
তিন বছর আগে যে ভালোবাসার জন্য ও বাড়ি ছেড়েছিল সেখানে আজ অশান্তি, ঝামেলা ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। জীবনের রঙ হারিয়ে গেছে। শুধু মনে হয় দিনগুলো কোনোরকম কেটে গেলেই হয়। রাতটা যেন না কাটে, নতুন একটা দিন শুরু যেন নাহয়। আবার তো সেই ঝামেলা। তারচেয়ে গভীর, নিশ্চুপ রাতে ঘুমিয়ে থাকুক। শান্তি তো শুধু ওইটুকুতেই পাওয়া যায়।
***
শ্রাবণ্যর এখন জেদ নিজের সঙ্গে। ওদের কলেজের প্রিন্সিপাল স্যার একবার বলেছিলেন, এই জগতে সবচেয়ে বেশী সাকসেসফুল তারাই হয়, যারা জেদের সঙ্গে আপোষ করে না। বাবার কথামতো নীরবে বিয়ে করেছে। জন্মদাতা, জন্মদাত্রীর প্রতি দায় এড়াতে কোনো সন্তান ই পারে না। ও পারে নি। তবে তাদের কাছে প্রত্যাশা নেই কিছুই৷ এখন ও শুধু নিজেকে নিয়ে ভাববে।
স্বপ্নীল মোবাইলে সময় দেখতে গিয়ে দেখলো শ্রাবণ্য কাঁদছে। ও হতভম্ব গলায় বলল,
“এই তোমার কী হয়েছে?”
শ্রাবণ্য চোখের পানি মুছে বলল,
“কিছু না। ”
স্বপ্নীলের লজ্জা লাগছিল। নাহলে ও শ্রাবণ্যর চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলতো,
“থাক কেঁদো না। আমি তো আছি। ”
স্বপ্নীল মনে মনে বলে, না আমি আছি কই! এই কথা তো শুধু পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি যাকে দেয়া যায় তাকে বলা যায়।
ওদিকে শ্রাবণ্য মনে মনে ভাবে, এই বিয়ে আমি মানব না। সুযোগ আর সময় আসলে আমি বেরিয়ে যাব এই সম্পর্ক থেকে। জোর করে চাপিয়ে দেয়া সম্পর্ক আমি জীবনেও মানব না। অনুশোচনার আগুনে সবাই সেদিন জ্বলবে।
দুজনের মনের কথা কেউই কাউকে বলতে চায় না। অবচেতন মন বাঁধা দেয়।
চলবে….
সাবিকুন নাহার নিপা