#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-৩
শ্রাবণ্য বাবার বাড়িতে যেতে চাইলো না। এই কথাটা ও শাশুড়ীকে জানিয়েছে। শিলা নরম গলায় বললেন,
“বাবা তোমার আড়ম্বরহীন বিয়ে দিয়েছে বলে রেগে আছ?”
শ্রাবণ্য মৃদু হেসে বলল,
“না। ”
“আমার শাশুড়ী বলেন যে বিয়েতে আড়ম্বর কম হয়, সেই বিয়েতে অনেক বেশী আল্লাহর রহমত নাজিল হয়। তুমি বাবা মায়ের উপর রেগে থেকো না। ”
শ্রাবণ্য কিছু বলে না। ও ওর মনের কথাটা কাউকে বলতে পারছে না। ভাবী ফোন করেছিল তার সঙ্গেও তেমন কথা বলে নি।
এভাবে বিয়েটা শিলারও ভালো লাগে নি। তবে একটা ব্যাপারে সে খুশি। স্বপ্নীলের বাবার ইচ্ছে ছিলো শ্রাবণ্যদের পরিবারে আত্মীয়তার সম্পর্ক করার। তিনি চেয়েছিলেন মেয়েদের কারো সঙ্গে শ্রাবণ্যর ভাইয়ের বিয়ে দিতে। সেটা সম্ভব হয় নি। তুলি বিয়ে করেছে নিজের পছন্দে৷ রঙ্গনা নিজের মর্জিতে চলে। পরিবারের নিয়মে সে আটকে থাকে নি।
স্বপ্নীল কে দিয়ে সেই ইচ্ছেটা পূরণ হলো অবশেষে। এখন ছেলে মেয়ে দুটো ভালো থাক। যুগ এখন বদলেছে, আগের যুগের মতো নেই। ছেলে মেয়েরা নিজেদের পছন্দে বিয়ে করে। পছন্দ টা মানানসই হলে পরিবারের কোনো অমত থাকে না। কিন্তু ছেলেমেয়েগুলোও যে অবুঝ। সাময়িক আবেগ কে প্রশ্রয় দিয়ে সবাইকে নিয়েই নরকযন্ত্রনা ভোগ করে।
শিলা স্বপ্নীলের পছন্দ মেনে নিতে পারে নি। সমাজে ওরা এতটাও বোল্ড এখনো পর্যন্ত হয়ে উঠতে পারে নি। স্বপ্নীলের বাবা, দাদুর সম্মান আছে। দশজনের কাছ থেকে যে শ্রদ্ধা এখন পায়, দেখা যেত তারাই উঠতে বসতে কটুকথা বলছে। আর স্বপ্নীলও এমন জেদ করলো! অবশ্য সেটা ওর দোষ না। কিছু টা বয়স আর অনেকটা পরিস্থিতির দোষ। ছেলেটার পাশে বাবা থাকলে অনেক কিছুই সহজ হতো।
শিলার শ্রাবণ্যকে ভালো লেগেছে। কী সুন্দর মিষ্টি মেয়ে! প্রথমবার যখন তাদের বাসায় এসেছিল তখন অনেক দিন পর দেখা হয়েছিল। ওর বাবা মাঝেমধ্যে আসলেও ওরা আসতো না। এখন স্বপ্নীল সবকিছু সহজ ভাবে মেনে নিলেই হয়।
***
শ্রাবণ্যকে বাবার বাড়িতে যেতে হলো। বাবা নিজে এসেছেন। ওর সাধ্য নেই তার মুখের উপর না বলা। স্বপ্নীলও যাওয়া নিয়ে তেমন একটা অনাগ্রহ দেখালো না। দেখালে ওর জন্য ভালো হতো।
শ্রাবণ্য যাবার আগে স্বপ্নীল কে বলল,
“আমরা কিন্তু বেশী দিন থাকব না। ”
স্বপ্নীল চুলে ব্রাশ করতে করতে জবাব দিলো,
“আচ্ছা। ”
“আপনি বলবেন যে এখানে কাজ আছে?”
“কেন? বাড়িতে থাকতে কোনো সমস্যা? ”
“না আসলে… আমি ক্লাশগুলো মিস করতে চাইছি না। ”
“কিন্তু আমি তো বেকার মানুষ। যদি জিজ্ঞেস করে কী কাজ?”
স্বপ্নীলের প্রশ্ন শুনে শ্রাবণ্যও বোকার মতো তাকিয়ে থাকে।
শ্রাবণ্য কে বিশাল বড় দুটো ট্রলি নিতে দেখে স্বপ্নীল প্রশ্ন করে,
“তুমি না বললে অল্প কিছুদিন থাকবে? তাহলে এতো জিনিস কেন নিচ্ছো?”
শ্রাবণ্য একটু লজ্জা পেল। মা ফোন করে বলেছে, সবকিছু নিয়ে যেতে। ওখানে গেলে নাকি সবাইকে সব দেখাতে হবে। তাড়াহুড়ায় সেদিন শ্বশুর বাড়ি থেকে দেয়া জিনিসপত্র সবাই দেখতেও পারে নি।
শ্রাবণ্য জবাব না দিয়ে মিষ্টি করে হাসলো। যখন ও কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে চায় না তখন ওভাবে হাসে। স্বপ্নীল এটার সঙ্গে পরিচিত না। তবে শ্রাবণ্যর হাসি দেখে ও বিব্রতবোধ করলো।
বাবা গাড়ি নিয়ে এসেছিলেন ওদের জন্য। যখন রওনা হলো তখন গোধূলি বেলা। মন্টি, রিন্টি ওদের সঙ্গে যাবার জন্য অস্থির হয়ে গেল। শ্রাবণ্যর বাবাও নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু শিলা, তুলি কেউ দিতে চাইলেন না। শ্রাবণ্য অবশ্য একবার বলেছিল। পাশে এসে স্বপ্নীল বলল,
“এই দুটো বুবুকে ছাড়া গেলে ভয়ানক হয়ে যায়। দেখা গেল ওদের পিছনে ছুটতে ছুটতে কেউ স্ট্রোক করে মারা গেছে। আর বলার দরকার নাই। ”
শ্রাবণ্যও তাই আর বলল না।
***
গাড়িতে বসে শ্রাবণ্য টের পেল ফোন বাজছে। বাবা বসেছেন ড্রাইভারের পাশের সিটে। পিছনে স্বপ্নীল আর ও। আর একদম পিছনের সিটে ওর ফুপাতো ভাই রিপন আর বাবার সার্বক্ষণিক সঙ্গী জাহিদ।
শ্রাবণ্য ফোন কেটে দিলো। আফরিন ফোন করেছে। স্বপ্নীল একবার তাকালো, দ্বিতীয় বার ফোন বাজার পর বলল,
“ফোন টা ধরো, যে ফোন করেছে তার কাছে মনে হয় জরুরী মনে হচ্ছে। ”
শ্রাবণ্য বলল,
“না থাক। ও আমার রুমমেট ছিল। এমনিই ফোন করেছে হয়তো। ”
স্বপ্নীল আর কিছু বলল না।
ওদের নরসিংদী পৌছুতে রাত হলো। শ্রাবণ্য গাড়ি থেকে নেমে মায়ের কাছে আগে না গিয়ে ভাবীর কাছে গেল। শ্রাবণ্যর মা রেহানার সেটা চোখে লাগলো। তিনি মন খারাপ করে ফেললেন।
স্বপ্নীল এই পরিবেশে একটু অপ্রস্তুত হলো। তবে বাকীরা ও’কে সামলে নিলো।
রাতে খাওয়া দাওয়ার আয়োজনও হলো ভালোই। শ্রাবণ্য পটল ভাজা আর শসা কুচি দিয়ে কয়েক লোকমা পোলাও খেল। স্বপ্নীলকে থালা সাজিয়ে এতো এতো খাবার দিলো যে ও ভালো করে কিছু খেতেও পারে নি। সেই সঙ্গে শ্রাবণ্যর কাছের দূরের কিছু কাজিন এসে রসিকতা শুরু করেছে। পোলাওয়ের মধ্যে এক চামচ পাতলা ডাল দিয়ে দিলো। বেচারা স্বপ্নীল এদিক ওদিক তাকিয়ে শ্রাবণ্যকে খুঁজলো। ও ছাড়া বাকীরা সবাই ই তো অচেনা।
রেহানা এসে সামলে নিলেন। তিনি সবাইকে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে পাশে বসলেন। তাতে স্বপ্নীলের অস্বস্তি কমার বদলে আরও বাড়লো।
****
“হ্যালো শ্রাবণ্য?”
“হ্যাঁ বল। কেন ফোন করেছিস?”
আফরিন একটু সময় নিলো। বলল,
“তোর আপু এসেছিল। তুই নাকি তাকে ব্লক করে রেখেছিস!”
শ্রাবণ্য জবাব দিলো না। আকাশী ওর আড়াই বছরের বড়। ছোটবেলা থেকে কী সুন্দর একটা সম্পর্ক ছিলো। আকাশী কখনো ও’কে বকে নি। ওদের সব জিনিস একই রকম ছিলো। সবার ছোট হলেও শ্রাবণ্য কখনো অবাধ্য ছিলো না। সেই সুন্দর সম্পর্ক টা বদলে গেল আকাশীর নিজের সিদ্ধান্তের কারণে। যে একবারও নিজের বাবা, বোনের কথা ভাবে নি।
“শ্রাবণ্য শুনছিস?”
“হ্যাঁ। আমি কারোর সঙ্গে দেখা করতে চাই না। আমার কাউকে লাগবে না। কেউ আমার সঙ্গে দেখা করতে এলে আমাকে আর ফোন করবি না। ”
আফরিনের খারাপ লাগলো। ওর ইচ্ছে ছিলো সাকিবের ব্যাপারে বলার। একদিনে এতবার শ্রাবণ্যর মন খারাপ করিয়ে দেয়ার আসলে কোনো মানে হয় না!
***
রাতের এই সময়টায় রান্নাঘর ফাঁকা পাওয়া যায়। এক চুলায় ভাত আরেক চুলায় ডাল বসিয়ে পাটায় মশলা বাটতে বসলো আকাশী। আজ একটা মুরগী এনেছে। একটু ভালো, মন্দ যা রান্না হয় সেটা শুক্রবারেই হয়। মাসের ১৭ তারিখে টানাটানি কম না। তবুও শাকভাত কেন যেন মুখে তুলতে ইচ্ছে করে না।
আকাশী একটা পার্লারে চাকরি করে। সকালে বেরিয়ে যায়, সন্ধ্যায় ফেরে। সপ্তাহে ছয় দিন ই এমন নিয়ম। দুপুরে অবশ্য এক ঘন্টার রেস্ট আছে। বেতন সব মিলিয়ে তেরো হাজারের মতো। শুভ চাকরি করে একটা মোবাইলের দোকানে। সেখানে বেতন পায় বারো হাজারের মতো। বাড়িতে দেবার পর সংসারে দেবার মতো কিছু থাকে না। আকাশীর এই টাকাটাই সংসারে ভরসা।
এই রান্নাঘর টা পাঁচ জনের সঙ্গে শেয়ার করতে হয়। মোহাম্মদপুরের বেঁরিবাধে কমের মধ্যে এই বাসাটা পাওয়ায় সুবিধাই হয়েছে ওদের। নাহলে ঢাকা শহরে বাসা ভাড়ার সঙ্গে কুলানো যায় না। প্রতিবেশী ভাড়াটিয়ারাও আকাশীকে পছন্দ করে। পাশের রুমের মিনা ভাবীর ফ্রিজে জিনিসপত্র রাখে। কখনো রাগ করে না। মাঝেমধ্যে এটাসেটা রেঁধে দেয়।
আকাশী ডাল উঠিয়ে নেয়। ভাতটাও হয়ে গেছে। মাংস টা আগে রেঁধে ফেলতে হবে। শুভ ঘরে ঢুকেই ভাত খেতে চাইবে। রান্না হয় নি দেখলে মেজাজ খারাপ হয়ে যাবে। সেই মেজাজ খারাপ ঝগড়াঝাটিতে রুপ নিবে। আকাশী নিজেকে দেখে অবাক হয়। বাড়িতে ও বাবা মা’কে জীবনেও ঝগড়া করতে দেখে নি। অথচ ও নিজে শুভর সঙ্গে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করে।
আকাশীর মন টা খারাপ হয় আবারও। ভাবী শ্রাবণ্যর কথা জানিয়েছে। শ্রাবণ্যর জীবনে বাবার কঠিন অনুশাসনের জন্য ও দায়ী। ওর জন্য ছোট্ট বোনটাকে কতকিছু সহ্য করতে হচ্ছে!
চলবে….