#কুসুমিত_কামিনী ( ৫ )
#রেহানা_পুতুল
মাহতিম তড়িঘড়ি করে রেডি হয়ে নেয়। মিনারার কাছে বলে চলে যায়। জান্নাত ও নুপুর ঘুম থেকে উঠলে মিনারা তাদের সব জানায়।
নুপুর নাস্তা খাওয়ার পর বলে,
ভাবি আমি ফুফাকে দেখতে যাব। তুমি যাবা?
হ্যাঁ মা। তোর ও যাওয়া উচিত। জামাই খুশি হবে। আদেশ দিয়ে বলল মিনারা।
আচ্ছা আম্মু যাব। নুপুর মাহতিমকে ফোন দিয়ে ওয়ার্ড নং জেনে নেয়। তারা হাসপাতালের বারান্দায় যেতেই দেখল
মাহতিমসহ আরো দু একজন হাসপাতালে ছুটাছুটি করছে রক্তের জন্য। কিন্তু নেগেটিভ রক্ত পাওয়া কঠিন। জান্নাতের কানে রক্তের গ্রুপের নাম পৌছানো মাত্রই সে বলে উঠল,
আমার ব্লাডগ্রুপ ‘ ও নেগেটিভ’। আমি আংকেলকে ব্লাড দিব।
মাহতিমসহ সবাই ভীষণ খুশী হয়ে উঠে। কারণ মাহতিমের জীবনে এই খালেদের অবদান রয়েছে।
মাহতিম জান্নাতের হাত ধরে আসো,
বলেই দ্রুত নিয়ে যায় ব্লাড দেওয়া রুমে। রক্ত দেওয়া শেষ হলে মাহতিম জান্নাতকে স্যালাইন ও ডাব এনে খাওয়ায়। কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে জান্নাত উঠে বসে। মাহতিমকে বলে আংকেলকে দেখব এখন।
আসো তাহলে।
নুপুর জান্নাতের সাথেই ছিল এতসময়। তাই সেও তার ফুফাকে দেখতে পায়নি। তারা ওয়ার্ডে সিটের পাশে গিয়ে থামল। খালেদ প্রাণহীন পাথরের ন্যায় পড়ে আছে বেডের মাঝে। সব প্রসেসিং শেষ করে খালেদের শরীরে প্রবেশ করছে জান্নাতের শরীরের রক্ত। খালেদের মুখ দেখেই জান্নাতের বুকের ভিতর কেমন খচখচানি শুরু হলো। বেকুব বনে গেল যেন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরখ করে চাইলো খালেদকে। আস্তে করে বাইরে চলে এলো।
ব্যাগ থেকে মুঠোফোনটা হাতে নিল। মাকে ফোন দিল।
হ্যালো মা তোমার ফোন থেকে আমাকে একটা ছবি এক্ষুনি পাঠাও।
কার ছবি কামিনী?
মিনারা কামিনীকে জান্নাত পরিচয়ে বড় করে তোলে। তাই মধুলতা ছাড়া কেউই কামিনী বলে ডাকেনা তাকে।
আমাকে জন্ম দেওয়া খালেদ নামের জা’নো’য়া’রের।
কি হলোরে মা? তুই এমন হাঁপাচ্ছিস কেন?
অবাক কন্ঠে জানতে চাইলো মধুলতা।
এত বলার সময় নেই। দ্রুত ছবি দাও বলছি।
ক্যামনে দিব মা?
উফফস! তুমিতো ইমু ছাড়া পারবানা। ইমুতেই দাও। হারিআপ।
মিনিট ব্যবধানেই ছবি চলে আসে। জান্নাত ফের সিটের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মোবাইলের ছবি আর বেডে শোয়া লোকের ছবি বারবার দেখে মিলিয়ে নেয়। কাউকে কিছু বলেনা। আস্তে করে মাহতিমের পাশে গিয়ে বলে,
আমার খুব খারাপ লাগছে। বাসায় যাব।
হঠাৎ করে ব্লাড দেওয়াতে তোমার এমন লাগছে। আচ্ছা তুমি আর নুপুর বাসায় চলে যাও। আমি এখানেই আছি।
আচ্ছা। আপনি আংকেলকে যত দ্রুত সম্ভব সুস্থ করে তুলুন প্লিজ।
তারা দুজন রিকসাযোগে বাসায় চলে যায়। মাহতিমের মা মেহনাজ ও তার বাবা রবিউল ওদের দেখেই এগিয়ে আসে। খালেদের কথা জিজ্ঞেস করে,
আমরা রেডি হচ্ছি যাওয়ার জন্য। এখন কি অবস্থা তোর ফুফার?
আম্মু তোমার বউমা ফুফার জীবনদাতা বলা যায়। যদিও এভাবে বলা উচিত না। কারণ জীবন দেওয়া নেওয়ার মালিক কেবল একজনই। তবুও বলছি এজন্য। কোথাও নেগেটিভ রক্ত পাওয়া যাচ্ছেনা। তিন ব্যাগের দরকার। দুই ব্যাগ ম্যানেজ হয়েছে। একব্যাগ নিয়েই বিপদ হয়ে গিয়েছে। ব্লাডব্যংক থেকে আনতে আনতে লেট হয়ে যেত। ভাবির সাথে মিলে গেল। কি কাকতালীয় না? আমাদের কারো সাথেই মিললনা। কিন্তু আমাদের ঘরের বউর সাথে মিলে গেল।
মাহতিমের বাবা মা কৃতজ্ঞতার চোখে জান্নাতের দিকে চায়। তাকে বুকে চেপে মাথায় আশীর্বাদের পরশ বুলিয়ে দেয়। এবং বলে,
জানো মা আমাদের পারিবারিক জমিসংক্রান্ত একটা ঘটনায় তোমার এই ফুফা শশুরের বহু ত্যাগ রয়েছে। সে সুস্থ হলে দেখবা তোমাকে মাথায় তুলে আদর করবে। আমার ননদ মানে তোমার ফুফু শ্বাশুড়ি আচমকা মারা যাওয়ার পর সে পাগল হয়ে গিয়েছে। কত মেয়ে দেখালাম। তার মনেই ধরেনা। তাই আর জীবনে বিয়েটাও করলনা। শেষ জীবন যে তার কিভাবে কাটবে আল্লাহ জানে। অন্তত যদি একটা সন্তান ও থাকতো। বলেই গভীর পরিতাপের দম ফেললেন মাহতিমের মা।
আমি রুমে যাই মা? বেশ ক্লান্ত লাগছে রক্ত দেওয়াতে।
হ্যাঁ হ্যাঁ। যাও মা। আমিওনা কি শুরু করেছি।
এটাতো তোমার পুরানা স্বভাব। কোন কাহিনীর একটু রেশ পেলেই শুরু করো ইতিহাসের বয়ান। খোঁচা মেরে হেসে বলল রবিউল।
তারা দুজন গিয়ে হাসপাতালে খালেদকে দেখে আসল।
সেদিন রাতেই জারা ফোন দেয় মাহতিমকে। নাকি নাকি স্বরে বলে,
সুইটহার্ট ওই মেয়েটাকে ডিভোর্সের পিপারেশন নিচ্ছ?
জারা,আমার আপন বড় ফুফা এক্সিডেন্ট করেছে। উনাকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়ঝাঁপ করতে হচ্ছে। ফোন রাখ।
বারে। তুমিতো বললা তাকে ছেড়ে দিবা।
বলছি সেটা অতীত৷ বর্তমান হলো তাকে আমি ছাড়ছিনা।
হোয়াট! কি কারণে তোমার ডিসিশন চেঞ্জ হলো ডিয়ার? রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে জানতে চাইলো জারা।
দেখ জারা, তুমি আমার লাইফের পাস্ট। আর জান্নাত আমার লাইফে প্রেজেন্ট। সো আমি প্রেজেন্ট নিয়ে ভালো থাকতে চাই। আমি তাকে বাসর রাত উপহার দিইনি। চূড়ান্তভাবে ইনসাল্ট করেছি। তবুও সেই মেয়েটাই আমার ফুফাকে ব্লাড দিয়ে বাঁচিয়েছে। ক্যান ইউ ইমাজিন? সে মানুষ হিসেবে কতটা ভালো। ‘ ও নেগেটিভ ‘ ব্লাড টাইমলি ম্যানেজ করা কতটা দুঃসাধ্য। আশাকরি এটা তুমিও অবগত রয়েছ। জান্নাতের মাঝেই খুঁজে নিতে চাই আমার সুখের জান্নাত।
হাউ ফানি বলে ফোনের ওপাশে উদভ্রান্তের ন্যায় কটাক্ষ হাসি হেসে বলল জারা,
এক ব্যাগ রক্ত দিয়েই সেই দুই টাকার সস্তা মেয়েটা তোমার হৃদয় হরণ করে ফেলল? আমি তাকে জানে মে’রে ফেলব কিন্তু।
মুহুর্তেই মাহতিম মোবাইলের সুইচড অফ করে দিল। আর নেয়া যাচ্ছেনা জারা নামের স্বার্থবাদী মেয়েটার আচরণ।
জারা জান্নাতকে নিয়ে নানারকম ফন্দী আঁটায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে বনের অভুক্ত শিকারীর ন্যায় । মাহতিম ভাবতে থাকে কিভাবে জান্নাতকে আগলে রাখা যায় নিরাপদে।
ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুইঁ ছুইঁ। জান্নাতের মুঠোফোন বেজে উঠল। হ্যালো জান্নাত কি করছ? খেয়েছ?
মাহতিমের আবেগঝরা কন্ঠে জান্নাত বিস্মিত হলনা। কারণ সে তার ফুফাকে রক্ত দিয়েছে আজ দুপুরেই।
হ্যাঁ খেয়েছি। আপনি খেয়েছেন? আপনার ফুফার কি অবস্থা এখন? স্বাভাবিক গলায় জানতে চায় জান্নাত।
হ্যাঁ ইমপ্রুভমেন্ট হচ্ছে৷ জ্ঞান ও ফিরেছে বেশ আগেই। তুমি রুমে একা ভয় পেলে বেড শেয়ার করতে পার নুপুরের সাথে।
না আমি ঠিক আছি।
তোমার পায়ে ফোসকা পড়েছে? কয়েলে পড়ল যে পা?
নাহ পড়েনি।
আচ্ছা ঘুমাও। আমি আছি ফুফার কাছেই।
ফোন রেখে জান্নাত বি’ ষা’ ক্ত মন নিয়ে রাতে খালি রুমে পায়চারি করছে৷ তার কাছে মাত্র দুটো অপশন খালেদকে নিয়ে। কিন্তু ক্ষণ ভেবেই একটা পথই বেছে নিল খালেদের জন্য। এটাই খালেদের মতো পুরুষের জন্য যোগ্য ও উপযুক্ত শাস্তি। যারা নারীকে মানুষ মনে না করে ভোগের বস্তু মনে করে। খেলনা ভেবে খেলাশেষে ছুঁড়ে ফেলে দেয় নর্দমার কীটের মতো। যার জন্য তার ফুলসজ্জা রজনী কেটেছে উপেক্ষায়, অনাদরে,অপমানে।
তার পরেরদিন জান্নাত ফার্মেসির কথা বলে বিকেলে বাসা থেকে বের হয়। বোরকা পরে মুখ নেকাব দিয়ে ঢেকে নেয় বরাবরের মতই। সত্যতা প্রমাণের জন্য একটি প্যাড কিনে নেয়। নয়তো বাসায় যদি ধরা পড়ে যায়৷ এরপর খুঁজে বের করে কাঁচাবাজারের মার্কেট। চলে যায় দা বটি ছুরির দোকানে। কিনে নেয় একটি ধারালো ছুরি।
দুদিন পরে সন্ধ্যার পরে জান্নাত মাহতিমের সাথে হাসপাতালে যায় খালেদকে দেখতে। জান্নাত কৌশলে মাহতিমকে বলে,
আমি উনার কাছে আছি। আপনি চিকেন স্যুপ নিয়ে আসেন উনার জন্য।
মাহতিম সাথে সাথে বের হয়ে যায় কেবিন থেকে। দরজা বন্ধ করে দেয় ভিতর থেকে জান্নাত। সে মুখের নেকাব বন্ধ রেখেই ব্যাগের ভিতর থেকে বড় ছুরিটি বের করে নেয়। সাথে করে আনা একটি জর্জেট ওড়না দিয়ে খালেদের গলা পেঁচিয়ে ফেলে। খালেদ গোঙানো ছাড়া আর কিছুই বলতে পারছেনা।
দরজায় আবার টোকা পড়টেই জান্নাত তড়িতেই ছুরিটি লুকিয়ে ফেলে।
মাহতিম বাইরে থেকে জানালা দিয়ে ভিতরের দৃশ্য দেখে ফেলে। জান্নাত দরজা খুলে কাঁপতে কাঁপতে সরে দাঁড়ায়।
মাহতিম জান্নাতের চুলের মুঠি চেপে ধরে হুংকার দিয়ে বলে,
তুই দেখি শধু নষ্টাই নয়। একজন ডাইনীও। আমার ফুফাকে কেন মারতে যাচ্ছিস?
মাহতিম খালেদের গলা থেকে ওড়না সরিয়ে ফেলে। খালেদ কাশি দিতে থাকে অনবরত।
জান্নাত ছুরিটি আবার হাতে নেয়। তার মাথায় খু’ন চেপে আছে। শরীরের সমস্ত র’গ দাপাদাপি করছে। মাথার মগজ টগবগ করে ফুটছে। সে রণমূর্তি ধারণ করে ক্ষিপ্রকন্ঠে বলে উঠে,
খবরদার বলছি। একদম চুপ। এই অমানুষের সাথে এখন আপনাকেও খু’ন করে ফেলব আমি। তারপর নিজেই ধরা দিব থানায়।
মাহতিম ও খালেদ অচেনার মতন জান্নাতের দিকে চেয়ে থাকে স্তম্ভিত চোখে।
চলবেঃ