#কুয়াশা_মিলিয়ে_যায়_রোদ্দুরে
#পর্ব_২৫
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা
“ভালোবাসার বিয়ে ছিল আমাদের। আহনাফ পরিবারের সবার আদরের ছেলে ছিল। ছোট থেকেই সব ভাই-বোনের থেকে ওকে বেশি ভালোবাসা দিত সবাই। এই নিয়ে বাকি ভাই-বোনদের রাগের সীমানা ছিল না। বিয়ের পর প্রায়ই দেখতাম আহনাফের বড়ো বোন আর দুই ভাই আহনাফের সবকিছু কেড়ে নিত। আহনাফ কিছু বলত না। চুপ করে থাকত। আমিও কিছু বলতাম না। কারণ আমাদের কম কিছু ছিল না। তাই অল্পস্বল্প নিলে আমাদের আহামরি ক্ষতি হবে না। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে তখন, যখন আহনাফ ধীরে ধীরে অনেক অসুস্থ হয়ে যায়। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পর ডাক্তার বলেছিল ওকে নাকি আগে থেকেই এমন কিছু খাওয়ানো হচ্ছে অল্প অল্প করে যার জন্য ওর অবস্থা ক্রমশ খারাপ হয়ে যাচ্ছে।”
এক পাতায় এতটুকুই লেখা ছিল। কুয়াশা পাতা উল্টিয়ে আবার পড়তে শুরু করে।
“আজ এক চরম সত্যের মুখোমুখি হয়েছি আমি। বাড়ির বাইরে বাগানের ধারে আহনাফের তিন ভাই-বোনের কথা শুনে আমি স্থির থাকতে পারছি না। আহনাফকে তারা ইচ্ছা করে মৃ ত্যু র দিকে ঠেলে দিয়েছে। কেন না আমার শ্বশুর আর শাশুড়ি মা রা যাওয়ার আগে আহনাফের নামে যেটুকু সম্পত্তি লিখে দিয়ে গিয়েছে সেই সম্পত্তি দরকার তাদের। আমি তো আগেই জানতাম ওরা আহনাফকে সহ্য করতে পারে না। কিন্তু তার জন্য এমন করবে তা আমি ভাবিনি। দুর্ভাগ্যবশত ওরা আমাকে ওদের কথা শুনতে দেখে নেয়। আমি ছুটে গিয়ে আহনাফকে সব বলে দিই। আমার বলা শেষ হওয়ার আগেই আমার ভালোবাসার মানুষটা আমার সামনে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। এরপর আমার হাত ধরে বলে ওঠে, আমাদের সন্তানদের নিয়ে বহুদূরে চলে যাও। ওদেরকে বাঁচাও আর্শিয়া। আর কিছু বলতে পারেনি সে। নিজের স্বামীর মৃ ত্যু নিজের চোখে দেখেছি আমি। ওরা আমার স্বামীকে মে রে শান্ত হয়নি। আমাকে আর বাচ্চাদেরও মা র তে চেয়েছে। আমি কোনো রকমে পালিয়ে বেঁচেছি।”
আর কিছু পড়ার শক্তি হয় না কুয়াশার। চোখ ঝাপসা হয়ে উঠেছে। চোখ থেকে পানি পড়ছে অনর্গল। পৃথিবীতে এমন মানুষও হয়? এ যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না সে। আজ তার একটা কথা ভীষণ বলতে ইচ্ছা করছে,
“পৃথিবীতে ভাই-বোনের সম্পর্ক ততদিনই সুন্দর, যতদিন তাদের মধ্যে লোভ জন্ম না নেয়!”
আবারো পাতা ওল্টায় সে। পড়তে শুরু করে পুনরায়।
“বাচ্চাদের নিয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। কিন্তু আর কতদিন? এবার আমার কিছু একটা করতে হবে। অন্তত বাচ্চাদের বাঁচাতে হবে। আমি বাঁচব কিনা জানি না। এমনিতেও আমি তো মনের দিক থেকে সেদিনই ম রে গিয়েছি যেদিন নিজের চোখের সামনে নিজের ভালোবাসার মানুষকে খু ন হতে দেখেছি। সেটাও কিনা আপন মানুষদের হাতে। আমি জানি ওরা আমাকে বাঁচতে দিবে না। কারণ ওদের সকল পাপকর্মের কথা আমি জানি। এমনকি ওদের খু ন করার দৃশ্য আমার কাছে আছে। সেদিন সিসিটিভি ক্যামেরা বন্ধ করতে তারা ভুলে গিয়েছিল। তাই সব প্রমাণ আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছি।”
কুয়াশা প্রমাণের কথা শুনে চমকে যায়। সমস্ত প্রমান তার মানে আর্শিয়ার কাছে ছিল। কিন্তু কোথায়? সেই মুহূর্তে কুয়াশার চোখে পড়ে একটা ধাঁধা। এবং তার নিচে লেখা,
“এই ধাঁধার মধ্যেই উত্তর লুকিয়ে আছে। প্রমাণ কোথায় আছে সেটা এখানেই লেখা আছে।”
দেখতে দেখতে শেষ পাতায় চোখ বুলায় কুয়াশা। শেষ পাতায় শুধুমাত্র একটা বাক্য লেখা।
“আমার স্বামীর খু নি দের যেন উপযুক্ত শাস্তি হয়। তবেই আমার আ ত্মা শান্তি পাবে।”
আর কিছু লেখা নেই। ডায়েরির পরের পাতাগুলো একদম ফাঁকা। কুয়াশা ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস নেয়। তার কাছে এখনো সবকিছু অবিশ্বাস্য লাগছে। মানুষ কি সত্যিই এতটা নিচে নামতে পারে? মনুষ্যত্ব আজ কোথায়? এটাই কি তবে পবিত্র সম্পর্কের বন্ধন?
আর কিছু ভাবতে পারে না সে। ফোনের রিংটোনের শব্দ পেয়ে কুয়াশা ফোন হাতে নেয়। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নাম দেখে খানিকটা অবাক হয় সে।
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কেমন আছিস বোন?”
তিন্নির ভেজা কন্ঠস্বর শুনে কুয়াশা পাল্টা প্রশ্ন করে,
“কী হয়েছে? আর তুমি আমাকে কল দিয়েছ কেন?”
“আমার সংসার ভেঙে যাচ্ছে কুয়াশা। জানিস? আমি একটুও ভালো নেই। আমার সংসারটা তুই বাঁচা বোন। আমি জানি একমাত্র তুই পারবি কিছু একটা করে আমার সংসারকে বাঁচাতে।”
এমন কথা শোনার জন্য বেচারি মেয়েটা একদম প্রস্তুত ছিল না। তিন্নির কথাগুলো তার বোধগম্য হতেই অনেকটা সময় লেগে গেল।
“মানে কী? কী বলছ এসব? কিছুই তো বুঝতে পারছি না।”
“ফয়সাল আমাকে আগের মত আর ভালোবাসে না। সে আমার দিকে ভালো করে তাকায় না পর্যন্ত। আমি একা হাতে সব সামলাতে সামলাতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি। আর পারছি না এভাবে চলতে।”
কুয়াশা মনে হয় তিন্নির কথায় ভারি মজা পেয়েছে। কিছুটা ব্যাঙ্গাত্মক স্বরেই বলে,
“এত মধুর প্রেম জানালা দিয়ে পালিয়েছে বুঝি? মৌমাছি কি এখন অন্য ফুলে মধু খুঁজতে গিয়েছে নাকি?”
“তুই মজা নিচ্ছিস? অবশ্য আমি তোর সাথে যা করেছি তাতে করে তোর রাগ করে থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তোর রাগ তো আমার উপর। আমাদের বাচ্চার উপর তো রাগ নেই। ওও তো তোর মেয়ের মত তাই না? আমার সংসার ভেঙে গেলে আমাদের মেয়েটা বাবা-মায়ের সমান ভালোবাসা পাবে না। আমরা আলাদা হয়ে গেলে ওর কী হবে বল? ওর কথা ভেবে হলেও আমাকে সাহায্য কর। দরকার হলে তুই যা বলবি আমি তাই করব। কিন্তু খালি হাতে আমাকে ফিরিয়ে দিস না বোন।”
কুয়াশা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উত্তর দেয়,
“ঠিক দুর্বল জায়গায় আঘাত দিলে। জানো আমি বাচ্চাদের অনেক ভালোবাসি। সেটারই সুযোগ নিলে তুমি। যাইহোক, বলো কী করতে হবে আমাকে?”
কুয়াশার এহেন কথায় তিন্নি খুশিমনে উত্তর দেয়,
“তুই এমন কোনো বুদ্ধি দে আমাকে যাতে করে ফয়সাল আগের মত আমাকে ভালোবাসে। ওর ভাষ্যমতে আমার সৌন্দর্য আগের মত নেই। তাই আমার কাছে আসার আগ্রহ জন্মায় না ওর মধ্যে।”
“জটিল সমস্যা। তা দেখা করতে পারবে একদিন? ফোনে এতকিছু বলা সম্ভব না। আর আসার সময় আমার মনি মা’কে নিয়ে এসো। জন্মের পর একদিনই দেখেছিলাম। তারপর আর দেখার সৌভাগ্য হয়নি।”
“আচ্ছা। আমি আগামীকাল তোর সাথে দেখা করব। তুই বগুড়াতেই আছিস তো?”
“হ্যা। আগামী পরশু ঢাকায় ফিরব।”
“ঠিক আছে। বাবু কাঁদছে। আমি এখন রাখি?”
“মানা করেছি নাকি আমি?”
অপর পাশ থেকে আর কোনো উত্তর আসে না। কল কে টে গিয়েছে। কুয়াশা ফোন একপাশে রেখে আনমনে ভাবে,
“একেই বুঝি নিয়তি বলে? যে বোনের জন্য আমার জীবনের সমীকরণ এত জটিল হয়ে গেল আজ তার জীবনও একই পথের দিকে ধাবিত হচ্ছে। স্বামী সুখ না পেলে কেমন লাগে এটা এখন আমার বোনও অনুভব করতে পারছে। আচ্ছা, আমার সাথে করা অন্যায়ের শাস্তি কি তবে পেতে শুরু করেছে সে? তাই হবে হয়তো। নিরব প্রতিশোধ তো এটাকেই বলে!”
এদিকে তুরাব বেচারা বউ হারানোর শোকে একদম ছন্নছাড়া হয়ে গিয়েছে। সারাদিন মদ নিয়ে বসে থাকা ছেলেটার এখন উচিত ছিল নিজেকে দেবদাস বানিয়ে ফেলা। কিন্তু সে তা না করে শয়তানি বুদ্ধি বের করছে তার অলস মস্তিষ্ক থেকে। যে মস্তিষ্ক থেকে কখনো ভালো কোনো বুদ্ধি বের হয় না। হবে কী করে? মানুষটা তো নিজেই আস্ত একটা শয় তা ন। তার মস্তিষ্কে থাকা বুদ্ধিগুলোও এমনই হবে স্বাভাবিক। বদ্ধ ঘরে ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে বিরবির করে যাচ্ছে।
“কুয়াশা আমি তোমাকে ছাড়ব না। আমার জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছ তুমি। জীবনে প্রথম কাউকে মন থেকে একটু ভালোবাসতে চাইলাম। আর সেই কিনা আমাকে একলা ফেলে চলে গেল। এই মেয়ে শোনো, তোমার না কখনো ভালো হবে না। একদম ভালো হবে না।”
আচ্ছা শকুনের দোয়ায় কী গরু ম র বে? থুক্কু তুরাবের এমন বদদোয়ায় কী কুয়াশার কোনো ক্ষতি হবে?
চলবে??
#কুয়াশা_মিলিয়ে_যায়_রোদ্দুরে
#পর্ব_২৬
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা
বগুড়ার নাম করা একটা রেস্টুরেন্টে মুখোমুখি বসে আছে কুয়াশা আর তিন্নি। আজ থেকে কয়েক বছর আগে এই জায়গাটা ছিল তাদের দুই বোনের আড্ডা দেওয়া এবং খাওয়ার জন্য সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। আজ একই জায়গায় বসে থেকেও কারোর মধ্যে আগের মত সেই উচ্ছ্বাস নেই। কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে সব!
“বোন কিছু বলবি না?”
“নিজের প্রয়োজনে এখন মুখ থেকে মধু ঝরছে? বোন? সত্যি বোন ভেবেছ কখনো? ভাবলে তো আমার জীবন নিয়ে এভাবে খেলতে পারতে না।”
“মাফ করে দে না আমায়? আমি কথা দিচ্ছি তোর জন্য সেরা একজনকে খুঁজে আনব আমি।”
“তার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি নিজের ভালো এখন নিজেই বুঝতে পারি।”
“মাফ করা যায় না আমাকে?”
“না। কারণ আমি দয়ার সাগর না। যে কেউ আমার কাছে এসে মাফ চাইবে আর আমি মাফ করে দিব? আমি এমন মেয়ে নই।”
“তাহলে তুই আমাকে সাহায্য করবি না?”
“সাহায্য করব বলেই এখানে ডেকেছি। তোমার মত মেয়েকে সাহায্য করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নেই। তবুও আমি রাজি হয়েছি। কারণ তোমার মেয়ে আমার মেয়ের মত। ওও আমার মনি মা। একমাত্র ওর জন্যই আমি তোমাকে সাহায্য করব। নতুবা যে মেয়ে আমার সংসার সুখ চায়নি তার সংসার বাঁচানোর মত মহৎ কাজ করার কোনো ইচ্ছা আমার ছিল না।”
কুয়াশার কথায় তিন্নি কষ্ট পেলেও সহ্য করে নেয়। শান্ত কণ্ঠে কুয়াশার দিকে তাকিয়ে বলে,
“কী করলে আমার সংসারটা বাঁচবে?”
“নিজেকে সময় দাও। শোনো বাচ্চা হওয়া মানেই নিজেকে বিসর্জন দেওয়া নয়। বাচ্চা হয়েছে জন্য যে তুমি নিজের যত্ন নেবে না তা তো হতে পারে না। বাচ্চা হলে মেয়েদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই বেশ কিছু পরিবর্তন আসে। এর জন্য একটু যত্নের দরকার। তুমি তোমার স্বামীর যত্ন নেওয়ার সময় বের করতে পারো। বাচ্চার জন্য সময় বের করতে পারো। সংসার সামলাতে পারো। তাহলে নিজের যত্ন নেওয়ার জন্য কেন সময় বের করতে পারো না?”
“সেটা তো আমাকে ফয়সাল বুঝিয়েও বলতে পারত। সে এসব না করে আমাকে যা নয় তাই বলে কষ্ট দিতে দুইবার ভাবল না।”
“পুরুষ মানুষ এমনই হয়। যদিও সব পুরুষ এক নয়। তবে এখনকার অধিকাংশ পুরুষ নারীর সৌন্দর্যে আটকায়। সুতরাং এসব ভেবে লাভ নেই। কিন্তু এমনি এমনি ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না।”
“তাহলে কী করব?”
“আমি যতটুকু জানি, ছেলেরা আর সব সহ্য করতে পারলেও অবহেলা সহ্য করতে পারে না। তুমি আগে নিজেকে একটু সময় দাও। সত্যি বলতে তোমার সৌন্দর্য আগের থেকে বেড়েছে। আর একটু যত্ন নিলেই ছেলেরা তোমার থেকে চোখ সরাতে পারবে না। আগে নিজের যত্ন নাও। এরপর ফয়সাল ভাইয়া তোমার কাছে আসতে চাইলে তাকে অবহেলা করা শুরু করবে। কিছুদিন এভাবে একটু শাস্তি দাও। এরপর সব ঠিক করে নিয়ো। আর হ্যা, আমার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে একবার কল দিয়ে একটা ধন্যবাদ দিয়ো। আসি!”
“একি! তুই চলে যাচ্ছিস কেন?”
“তো কী করব? তোমার সাথে এখানে বসে খোশগল্প করব? এত ফালতু সময় আমার নেই।”
তিন্নিকে আর কিছু বলতে না দিয়ে তিন্নির মেয়েকে ওর কোলে দিয়ে কুয়াশা বেরিয়ে আসে। আসার আগে বাচ্চার কপালে চুমু দিয়ে বসে এসেছে,
“মনি মা, তুমি কিন্তু মায়ের মত বাইরে এক আর ভেতরে এক হবে না। ভালো মানুষ হবে তুমি। অনেক বড়ো হও দোয়া করি। তোমার মনি মায়ের দোয়া সব সময় তোমার সাথে থাকবে মা। ভালো থেকো।”
রাস্তায় বের হয়ে রিকশা ডেকে তাতে উঠে বসে কুয়াশা। এর মধ্যে সাফওয়ান তাকে কল দেয়।
“আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছ সাফওয়ান?”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। ভালো থাকি কী করে? কুয়াশা ম্যাম তো আমাকে মনেই রাখেনি। এই দুঃখে আমি তো শেষ হয়ে যাচ্ছি।”
সাফওয়ানের কথায় কুয়াশা মুচকি হেসে বলে,
“আমাকে পটানোর চেষ্টা করছ নাকি হ্যা?”
“সে তো শুরু থেকেই চেষ্টা করছি। কিন্তু আপনার মন তো গলছে না ম্যাম।”
“লাভ নেই স্যার। এই মন পাথর হয়ে গিয়েছে। তাই এত সহজে গলবে না। আদৌও গলবে কিনা সেটাই তো জানি না।”
“তাই নাকি?”
“হ্যা তো। অযথা চেষ্টা করে লাভ নেই।”
“চেষ্টা করতে তো ক্ষতি নেই তাই না?”
“করে দেখুন স্যার। তবে আমার মনে হয় না খুব একটা লাভ হবে।”
“আচ্ছা শোনো এসব পরে হবে। আমি তোমাকে যে কারণে কল দিয়েছি আগে সেটা বলি।”
“হ্যা বলো।”
“তুমি ঢাকায় ফিরবে কবে?”
“আগামীকাল ফিরব ইনশাআল্লাহ।”
“বাচ্চাদের নিয়ে ফিরবে?”
“না। ওদের আপাতত রেখে যাব। কারণ ঢাকায় ফিরে আহনাফ আর আর্শিয়ার কেস হাতে নিব। সব সামলে উঠে তারপর ওদের নিয়ে যাব। এই সময়ে ওদেরকে মা আর মলি দেখবে।”
“আচ্ছা তাড়াতাড়ি এসো। তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।”
“সারপ্রাইজ?”
“হ্যা ম্যাম সারপ্রাইজ।”
“কী রকম?”
“সেটা বললে কী আর সারপ্রাইজ থাকবে?”
“তাও ঠিক। আচ্ছা ঢাকায় যাওয়া অবধি অপেক্ষা করি তাহলে।”
“অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয়। তাই ধরে নিতে পারেন আপনার জন্য মিষ্টি কিছু অপেক্ষা করছে ম্যাম।”
“আচ্ছা আচ্ছা।”
কথা বলতে বলতে রিকশা এসে থামে কুয়াশার বাড়ির সামনে। কুয়াশা রিকশা ভাড়া মিটিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে বলে,
“আমি বাড়ি ফিরলাম মাত্র। ফ্রেশ হয়ে এসে তোমাকে কল দিই?”
“ঠিক আছে। কল পরে দিলেও হবে। আগে ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নাও।”
“আচ্ছা।”
কল কেটে দিয়ে কুয়াশা ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়। তারপর বাচ্চাদের সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে নিজের ডায়েরি নিয়ে ছাদে চলে যায়। আজ অনেক দিন পর সে লিখালিখি করতে বসেছে।
“জীবন থেকে প্রায় পঁচিশ বছর কেটে গেল। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে অনেক কিছুই শিখেছি আমি। বারবার ভেঙে গিয়ে উঠে দাঁড়াতে শিখেছি। বারবার আঘাত পেয়েও নিজেকে শেষ করে দিইনি। বরং শক্ত করে তৈরি করেছি নিজেকে। কারণ, আমার মত মেয়ের ভেঙে যাওয়া মানায় না। আমি তো কুয়াশা! যে বারবার মিলিয়ে যাওয়ার পরে আবার ফিরে আসে। নতুন ভোরের সাথে সাথে সে ফিরে আসে।”
এটুকু লিখেই তার কলম চলা থেমে যায়। কিছুক্ষণ বসে থেকে আনমনে হাসে কুয়াশা। আবারো তার কলম চলতে শুরু করে।
“আমার জীবনে আমি এত কিছু শিখেছি একজন মানুষের জন্য। সে হলো আমার প্রথম ভালোবাসা। হুম রায়াদ, তোমার জন্যই আমি আজ এতটা শক্ত হতে পেরেছি। তোমাকে ভালোবেসে বারবার আঘাত পেয়ে আমি যখন নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছি ঠিক তখনই আমি বুঝতে শিখেছি যে তোমার এই আঘাতগুলো আমাকে নতুন করে বাঁচতে সাহায্য করবে। জীবন এত সহজ নয়। এই ছোট্ট জীবনে অনেক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে আমর এগিয়ে যেতে হবে আপন গতিতে। আমি আগে অবুঝ ছিলাম। কথায় কথায় কেঁদে অস্থির হয়ে যেতাম। তুমি আমাকে বদলে দিয়েছ। তবে কী জানো? আমার না এখনো আগের মত চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করে। ওই যে তোমার সাথে যখন কথা বন্ধ হয়ে যেত তখন যেভাবে চিৎকার করে পাগলের মত কাঁদতাম, এখনো সেভাবেই কাঁদতে ইচ্ছা করে মাঝে মাঝে। তোমায় নিয়ে লিখতে গেলে আমার লেখা শেষ হবে না। তুমি আমাকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছ। তুমি এমন একজন মানুষ যে প্রথমে আমাকে আত্ম হননের পথে নিয়ে গিয়েছে, আবার ছেড়ে যাওয়ার সময় সবকিছু মেনে নিয়ে বাঁচতে শিখিয়েছে। তাই তো তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা কখনো শেষ হবে না। ঘৃণার আড়ালে আজও তোমাকে ভালোবাসি আমি। জানো? তুমি আমাকে এতটা শক্ত হতে সাহায্য করেছ বলেই তিন্নি আপু, তুরাব, সমাজের মানুষজন আমাকে আর ভাঙতে পারেনি। সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ তোমাকে। তোমার ক্ষতি কখনো চাইনি। বরাবরই চেয়েছি যেন তুমি ভালো থাকো। আজও তাই চাই। তোমার প্রতি আমার এক সমুদ্র সমান অভিমান। কিন্তু এই অভিমান ভাঙানোর জন্য আজ তুমি নেই। তুমি যদি আমাকে একটু বুঝতে তাহলে হয়তো আমার জীবনটা এত বেশি জটিল হতো না। তুমি বরাবরই আমাকে কাঁদিয়ে শান্তি পাও। যদিও এখন তুমি আমার চোখের পানি দেখতে পাবে না। তবে আশা করছি, অনুভব করতে পারবে। আচ্ছা আজও কী তুমি আমাকে মনে করো? আজও কী তুমি আমাকে কাঁদিয়ে শান্তি অনুভব করো? হুম, হয়তো করো। আবার এমনও হতে পারে যে তুমি আমাকে মনেই রাখোনি। ভুলে গিয়েছ এই আমাকে!”
কথাগুলো লেখার সময় কুয়াশার চোখ বেয়ে অনবরত পানি পড়ছে। সে এই পানি মোছার ব্যর্থ চেষ্টা করল না। এই মুহূর্তে তার কান্না করে নিজেকে শান্ত করা প্রয়োজন। ভীষণভাবে প্রয়োজন!
চলবে??