#কুয়াশা_মিলিয়ে_যায়_রোদ্দুরে
#পর্ব_১৯
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা
“কী এটা?”
“ডিভোর্স পেপার!”
কুয়াশার কথায় তুরাব দুই পা পিছিয়ে যায়। একটু আগেই তার হাতে কুয়াশা এই ডিভোর্স পেপার ধরিয়ে দিয়েছে।
“কী হলো তুরাব? খুশি হননি আপনি?”
“কুয়াশা তুমি কি পাগল হয়ে গিয়েছ? এসবের মানে কী?”
“আপনি নিজেই তো আমার থেকে ডিভোর্স চেয়েছিলেন। তাহলে আজ কেন এত অবাক হচ্ছেন?”
“দেখ কুয়াশা আমি এখন ডিভোর্স চাই না। আমি তোমার সাথে থাকতে চাই।”
“কিন্তু আমি যে এমন জঘন্য চরিত্রের কারোর সাথে আর এক মুহূর্ত থাকতে চাই না।”
কুয়াশার এহেন কথায় তুরাব অসহায় চাহুনি নিয়ে তাকায় তার দিকে। এমন চাহুনি দিয়েও সে কুয়াশার মন গলাতে পারে না।
“আমি যখন ডিভোর্স চেয়েছিলাম তখন তো ডিভোর্স দাওনি। তাহলে আজ কেন?”
“আজ আপনি চান না বলেই তো আমি চাচ্ছি।”
“মানে?”
কুয়াশা আনমনে হেসে উত্তর দেয়,
“অনুভূতিগুলো চোখের সামনে শেষ হয়ে যাওয়ার কষ্ট বোঝেন? আজ আপনি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন একদিন এই জায়গায় আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। সেদিন চলে আসার পর ভেবেছিলাম আপনি আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। কিন্তু না, আপনি তো আমাকে ছেড়ে দিতে চাইলেন! নিজের কাজ শেষে ছুঁড়ে ফেললেন আমাকে। আমার যন্ত্রণা সেদিন আপনি বুঝতে পারেননি। বুঝতে পারেননি আপনাকে নিয়ে আমার মনের কোণে জমে থাকা সুপ্ত অনুভূতিগুলোকে। আর আজ আপনিও ঠিক একই রকম কষ্ট পাচ্ছেন। নিরব প্রতিশোধ নিতে কখনো কাউকে দেখেছেন? আমিই সে যে আপনার উপর নিরব প্রতিশোধ নিলো আজ!”
“তার মানে এজন্যই তুমি আমাকে এতদিন ডিভোর্স দাওনি?”
“হ্যা। আমি তো আপনাকে ছেড়ে আসার দিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। যেদিন আপনার মনে আমাকে নিয়ে অনুভূতি জন্মাবে ঠিক সেই মুহূর্তে আমি আপনাকে ছেড়ে দিব। সবাই ভেবেছে সমাজের কথা ভেবে আমি আপনাকে ডিভোর্স দিচ্ছি না। আসলে কিন্তু তা নয়। সমাজের কথা আমি কেনই বা ভাবতে যাব? যে সমাজের মানুষজন অসহায় মেয়েদের বলে, স্বামী যেমনই হোক সংসার করতেই হবে। স্বামী যদি পরনারীতে আসক্ত হয় তবুও সংসার করতে হবে। স্বামী যদি প্রাক্তন প্রেমিকার উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য স্ত্রীকে ব্যবহার করে তবুও সেই স্বামীর সংসার করতে হবে। স্বামী যদি ভালো না বাসে তবুও তার সংসার করতেই হবে। স্বামী হাজারো অপরাধ করবে। তবুও চুপ করে সংসার করতে হবে। স্বামী যদি একবার ক্ষমা চায় তাহলে সাথে সাথে ক্ষমা করে দিতে হবে। কোনো অবস্থাতেই সংসার ছাড়া যাবে না। কারণ মেয়েদের আসল ঘর হলো স্বামীর ঘর। এইসব ভাবা সমাজের মানুষজনকে আমি ঘৃণা করি। কেন জানেন? কারণ তারা আমাদের মত মেয়েদের এসব বুঝিয়ে আমাদের আত্মসম্মান বিসর্জন দিতে শেখায়। এমন সমাজ আমাকে নিয়ে কি বলল তাতে আমার কিচ্ছু যায় কিংবা আসে না!”
তুরাব নিজেকে সামলাতে না পেরে কুয়াশার দুই হাত ধরে অনুনয়ের সুরে বলে,
“একটা বার কী আমাকে ক্ষমা করা যায় না?”
“কাকে ক্ষমা করব? যে আমাকে খেলার গুটি বানিয়েছে? যে আমাকে ভালোবেসে কখনো স্পর্শ করেনি তাকে ক্ষমা করব? যে আমার জীবন নিয়ে খেলেছে তাকে ক্ষমা করতে বলছেন আপনি? যে মানুষটা আমার অনুভূতির মূল্য দেয়নি তাকে কী করে ক্ষমা করব আমি? যে আমাকে এক কথায় ডিভোর্স দিতে চেয়েছে তাকে ক্ষমা করব আমি? তাহলে আমাকে মাফ করবেন। আমি এত দয়ালু নই। আমার জীবনের দাম আছে। আমি ফেলনা নই তুরাব। আমার আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে আমি আপনার কাছে ফিরতে পারব না। আমি আপনার ছায়াও আর কখনো দেখতে চাই না।”
“আমি তোমাকে ডিভোর্স দিব না কুয়াশা। তুমি যা ইচ্ছা করতে পারো।”
“আপনি ডিভোর্স দিতে না চাইলেও তিন মাস পর, উর্ধ্বে ছয় মাস পর এমনিতেই আমাদের ডিভোর্স হয়ে যাবে। আর কী জানেন তো? জোর করে কখনো সম্পর্ক টেকানো যায় না।”
“তুমি এভাবে কষ্ট দিতে পারো না আমাকে।”
“ওহ্ তাই? আপনি মনে হয় আমাকে খুব সুখ দিয়েছেন? আপনি এমন এক পুরুষ যে কিনা শতশত মেয়েকে ছুঁয়েছে। আচ্ছা এত মেয়েকে স্পর্শ করলেন। আপুকে কেন ছেড়ে দিলেন?”
“তার প্রতি আমার ওই টান কখনো কাজই করেনি। তাকে ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছা করেনি।”
“সম্পর্কে ছিলেন কেন তাহলে?”
“জানি না। সত্যি বলতে এর উত্তর আমার কাছে নেই।”
“যাইহোক, একটা শেষ অনুরোধ করি? যদি আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দিতে চান তাহলে এই পেপারে সই করে দিবেন। আর কোনোদিন আমার সামনে আসবেন না। ভালো থাকবেন!”
কথাটা বলে কুয়াশা নিজ মনে হাঁটতে শুরু করে। তার চোখের কোণে পানি জমেছে। এই পানি সে কাউকে দেখাতে চায় না। তাই যথাসম্ভব চোখের পানি লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে সে। সাফওয়ান তার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে প্রশ্ন করে,
“কেন এমন সিদ্ধান্ত নিলে? যে সিদ্ধান্ত তোমার চোখে পানি নিয়ে আসে।”
“আমি তুরাবকে হারানোর জন্য কাঁদছি না। আমি আজ থেকে আমার নামের পাশে ডিভোর্সি তকমা বসবে তার জন্যও কাঁদছি না। আমি কাঁদছি নিজের জন্য। সত্যিকারের ভালোবাসা না পাওয়া এক অভাগী আমি। আমার কপালে এক মুঠো ভালোবাসা নেই। আমি কি ভালোবাসার যোগ্য নই? এই বিশ্বে কেউ কেন ভালোবেসে কাছে টেনে নিলো না আমায়? আমি কি এতটাই খারাপ? ভালোবাসা পাওয়ার কোনো অধিকার কি আমার নেই? আমি তো শুধু এক মুঠো ভালোবাসার আশায় বেঁচেছি এতদিন। কিন্তু আমার ভাগ্যে ভালোবাসার সেই সুখ নেই!”
“এভাবে কেঁদো না। তোমার জীবনেও সত্যিকারের ভালোবাসা আসবে। অপেক্ষা করতে ক্ষতি কোথায়? অপেক্ষার ফল মধুর হয়। তোমার অপেক্ষাও একদিন স্বার্থক হবে। মিলিয়ে নিয়ো আমার কথা।”
কুয়াশা আর কোনো কথা বলে না। সাফওয়ান কুয়াশাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে চলে যায়। তার আগে আদ্রিতাকে বলে দেয়,
“ওর খেয়াল রেখো। পারলে সব সময় ওর পাশে থেকো। আজকের রাতটা ওকে একদম একা রাখবে না।”
সাথে কুয়াশার যত্ন নেওয়ার কথা বলতেও ভোলে না সে। মেয়েটার চোখের পানি একদম ভালো লাগে না তার।
কুয়াশা নিশ্চুপ হয়ে জানালার পাশে বসে আছে। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির বিন্দু বিন্দু ফোঁটা এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে তাকে। চোখের পানি আর বৃষ্টির পানিতে একাকার হয়ে গিয়েছে তার মুখখানা। আদ্রিতা তার পাশে বসে। সেদিকে মেয়েটার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
“তোর খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না?”
আদ্রিতার এমন কথায় কুয়াশার মধ্যে কোনোরকম পরিবর্তন খেয়াল করে না সে।
“উত্তর দিবি না?”
“আমার না অবাক লাগে।”
“কেন?”
“তুরাবের মত ছেলের সাথে যারা আমাকে সংসার টিকিয়ে রাখতে বলেছে সেই সকল মেয়েদের দেখে অবাক লাগে। তাদের মধ্যে কী আত্মসম্মান বলতে কিছু নেই? ডিভোর্সি মেয়েদের কেন আলাদা চোখে দেখা হয়? মানছি সব মেয়ে ভালো হয় না। কিন্তু কিছু খারাপ মেয়ের জন্য সবাই কেন শাস্তি পায়? কেউ কি নিজ ইচ্ছায় এমন জীবন বেছে নেয়? আমাদের মত মেয়েদের অবস্থা কেন বুঝতে পারে না ওরা?”
“মানুষের কথায় কান দিবি না। তুই যা করেছিস একদম ঠিক করেছিস। চরিত্র যার ঠিক নেই তার সাথে থাকার থেকে ছেড়ে দেওয়া অনেক ভালো।”
হঠাৎ কুয়াশার ফোন বেজে ওঠে। আদ্রিতা ফোন হাতে নিয়ে বলে,
“আন্টি কল দিয়েছে। কথা বল।”
কুয়াশা কানের কাছে ফোন নিয়ে মলিন কণ্ঠে বলে,
“মা!”
“মন খারাপ?”
“ভীষণ!”
“কেন?”
“আমায় কেউ কেন ভালোবাসে না মা?”
“কে বলেছে ভালোবাসে না? তোমাকে সবাই ভালোবাসে।”
“তবে যে আমি স্বামীর ভালোবাসা পেলাম না। পেলাম না নিজের হাতে তৈরি করা সুন্দর সাজানো একটা সংসার। পেলাম না সন্তান সুখ!”
মেয়ের প্রশ্নের জবাবে কোনো উত্তর খুঁজে পান না মিসেস নাহার। এমন প্রশ্নের উত্তরে কী বলা যায়? আদৌও কী এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর আছে? না, এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর হয় না। হয় শুধু নিরবতা!
চলবে??
#কুয়াশা_মিলিয়ে_যায়_রোদ্দুরে
#পর্ব_২০
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা
র ক্ত মাখা হাত নিয়ে ছাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে কুয়াশা। আর মাত্র দুই পা এগোলেই ছাদ থেকে পড়ে মৃ ত্যু নিশ্চিত। কিন্তু তার চোখে কোনো ভয় নেই আজ। সে নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশেরও আজ মন ভালো নেই। তাই তো নিজের কষ্টগুলোকে বৃষ্টিতে রূপ দিয়েছে। ঝুম বৃষ্টিতে একটা মেয়ে র ক্তা ক্ত হাতে ছাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে। কারণ, আজ তার মন ভালো নেই!
“রায়াদ জানো? আমি না আজ ভীষণভাবে ভেঙে গিয়েছি। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না। বারবার মনে হচ্ছে এমন জীবন নিয়ে বেঁচে থাকা খুব কঠিন। আমার পাশে অনেকেই আছে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, আমার পাশে কেউ নেই। কোথাও কেউ নেই! আচ্ছা তুমি আমায় কেন ভালোবাসলে না? ভালো না বাসার কারণটা বললে না কেন আমায়? তুমি যদি আমার জীবনে না আসতে তাহলে হটকারিতায় আমি তুরাবকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিতাম না। আমার জীবনটা আজ অন্য রকম হতে পারতো। হলো না কেন? কী এমন ভুল করেছিলাম তোমায় ভালোবেসে? তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে। কিন্তু আমাকে ভালো না বাসার কারণটা বলে গেলে না।”
লাল রঙে ছেয়ে যাওয়া হাত দিয়ে চুলগুলো মুষ্টিবদ্ধ করে নেয় কুয়াশা। কিছুক্ষণ নিরব থেকে হঠাৎ করেই চিৎকার করে বলে ওঠে,
“প্রতি রাতে কান্নারা যখন চিৎকার করে ওঠে, তখন ভীষণ বলতে ইচ্ছে করে, কেন বুঝলে না আমায়? আমায় একটু ভালোবাসলে খুব কি ক্ষতি হয়ে যেত তোমার? আমি না আর পারছি না। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। এই প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত আমি শান্তিতে নিঃশ্বাস নিতে পারব না। কিন্তু তোমার নতুন সংসারেও অশান্তি সৃষ্টি করতে পারব না আমি। আমি সবার প্রতি কঠিন হতে পারি। সবাইকে শাস্তি দিতে পারি। সবার মনে অনুশোচনা বোধ জাগ্রত করে পারি। শুধুমাত্র তোমাকে কোনো শাস্তি দিতে পারছি না। তোমার মনে আমি অনুশোচনা বোধ জাগ্রত করতে ব্যর্থ হয়েছি বারবার। আজ সেই দিন, যেদিন তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে আমাকে তুমি নিজের করে নিবে। তুমি কথা রাখোনি। তুমি কথা দিয়ে কথা না রাখা মানুষ। এমন মানুষের প্রতি আমার এক সমুদ্র সমান ঘৃণা জন্মাক!”
“কুয়াশা!”
হঠাৎ কারোর ডাকে কুয়াশা চুপ হয়ে যায়। আদ্রিতা ছুটে এসে কুয়াশাকে জড়িয়ে ধরে প্রশ্ন করে,
“কী হয়েছে তোর? নিজের কী অবস্থা করেছিস তুই?”
“আমার না দম বন্ধ লাগছে রে। প্রতিনিয়ত ভালো থাকার মিথ্যা অভিনয় করতে করতে আমি ক্লান্ত। যে কখনো আমার হবে না, সে কেন এসেছিল আমার জীবনে?”
“শান্ত হ কুয়াশা। আমাদের জীবনে এমন অনেক কিছু হয় যা আমরা চাই না। তবে কী জানিস? আমাদের জীবনে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো আমাদের অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে যায়। এই যেমন তোকে লড়াই করতে শিখিয়েছে। রায়াদ ভাইয়া তোর জীবনে না আসলে তোর মত অতি আবেগি মেয়ে কি এমন কঠোর হতে পারত? আগে তুই সামান্য কারণেও কেঁদে অস্থির হয়ে যেতিস। আর এখন জীবনের এমন পর্যায়ে আছিস যেখানে তোকে বারবার আঘাত করলেও তুই শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারিস। এই শিক্ষাটা কিন্তু রায়াদ ভাইয়ার চলে যাওয়ার মাধ্যমেই পেয়েছিস তুই। সুতরাং সবকিছুর ভালো দিকটা গ্রহণ করার চেষ্টা কর।”
কথা বলার এক পর্যায়ে আদ্রিতার চোখ যায় কুয়াশার হাতের দিকে।
“হাত কে টে গেল কীভাবে?”
“পানি খাওয়ার সময় গ্লাস এত জোরে চেপে ধরেছিলাম যে ভেঙে গিয়েছে।”
“সমস্ত রাগ গ্লাসের উপর ঝাড়লি?”
“আর কী করতাম বল? নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলাম।”
“ঘরে চল। হাতে ওষুধ লাগাতে হবে। আর এই অসময়ে বৃষ্টিতে ভেজার কোনো মানে হয়? রাতে জ্বর আসবে দেখিস।”
“কিছু হবে না।”
“হ্যা তুই তো রোবট তাই না? এজন্য কিছু হবে না।”
“ধীরে ধীরে একটা যন্ত্রেই তো পরিণত হয়েছি।”
“অনেক কথা হয়েছে। এখন ঘরে চল বলছি।”
কুয়াশাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আদ্রিতা নিজেই তাকে টানতে টানতে ঘরে নিয়ে যায়। অতঃপর তার হাতে ওষুধ লাগিয়ে দিয়ে গোসল করতে পাঠায়। বিকাল পাঁচটা থেকে প্রায় পঞ্চাশ মিনিট সে বৃষ্টিতে ভিজেছে। তার এলোমেলো কোমড় অবধি চুলগুলো থেকে টুপটুপ করে পানি পড়তে পড়তে ঘরটাও ভিজে একাকার হয়ে গিয়েছে!
“কুয়াশার কী অবস্থা এখন? টানা দুই ঘন্টা ধরে কল দিয়ে যাচ্ছি। রিসিভ করছে না কেন?”
“সাফওয়ান ভাইয়া ওর অবস্থা একদম ভালো না। কখন কি করছে নিজেই বুঝতে পারছে না।”
“ওকে সামলাও। আমি একটু পর আসছি।”
“আপনি এখানে আসবেন?”
“হ্যা।”
“ঠিক আছে। তাড়াতাড়িই আসুন তাহলে। এসে ওকে একটু বোঝান। ওও সচারাচর এমন করে না। আজ কেন যে এমন পাগলামি করছে সেটা বুঝতে পারছি না।”
“মানসিক অশান্তিতে থাকতে থাকতে ওও ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে। এবার ওর একটু শান্তি দরকার।”
“ঠিকই বলেছেন। এত অল্প বয়সেই অনেক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে লড়াই করেছে মেয়েটা। এখনো লড়াই করেই যাচ্ছে। পঁচিশ বছর বয়সে পা রাখার আগেই ওর জীবনটা কেমন যেন বেরঙিন হয়ে গেল!”
“তুমি ওর পাশেই থাকো আদ্রিতা। আমি আসছি।”
“আচ্ছা।”
ফোন রেখে রান্নাঘরে চলে যায় আদ্রিতা। সন্ধ্যার নাস্তায় পাস্তা তৈরি করবে সে এখন।
“ইশ হাতের কি অবস্থা করেছি। এমন পাগলের মত কাজ করলাম কিভাবে আমি!”
“পাগল হয়ে গিয়েছ যে তাই এমন করে নিজের ক্ষতি করলে।”
“সাফওয়ান তুমি এখানে!”
সাফওয়ানকে দেখে বিছানা থেকে এক লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় কুয়াশা। এখনো চুল থেকে পানি পড়ছে। সেদিকে তার বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। সে তো এখন সাফওয়ানকে দেখে চকিত দৃষ্টে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
“এমন করে দেখার কী আছে? আজ নতুন দেখছ নাকি আমাকে?”
“না। কিন্তু তুমি কিছু না বলে চলে এলে যে?”
“আদ্রিতাকে বলে এসেছি। ওকে কল দেওয়ার পর শুনলাম তুমি এই অবেলায় গোসল করছ।”
“কিন্তু এখন তুমি এখানে কেন?”
“আসতে পারি না?”
“তা নয়। আচ্ছা তুমি এখানে বসো।”
“আমি একা আসিনি। আমার সাথে আরো একজন এসেছে।”
“কে?”
“কলি!”
দরজার সামনে আচমকা মল্লিকাকে দেখে কুয়াশা থমকে যায়। যখন বুঝতে পারে সত্যি তার বেস্ট ফ্রেন্ড তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তখন ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে।
“তুই আমাকে কিছু না বলে চলে আসলি কেন? আমাকে একবার জানাবি তো। তোকে বাস স্ট্যান্ডে নিতে যেতাম আমি।”
“আমাকে বাস স্ট্যান্ড থেকে সাফওয়ান ভাইয়া নিয়ে এসেছে।”
কুয়াশা অবাক হয়ে বলে,
“তুমি?”
সাফওয়ান কুয়াশার এমন অবস্থা দেখে হেসে উত্তর দেয়,
“হ্যা, আমি নিয়ে এসেছি। শুধু যে নিয়ে এসেছি তা কিন্তু নয়। ওকে ঢাকায় আসতে আমিই বলেছি।”
“কেন?”
“তোমার মন ঠিক করার জন্য।”
কুয়াশা আবেগাপ্লুত হয়ে বলে ওঠে,
“অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।”
“একি! তুমি কাঁদছ কেন?”
কুয়াশার চোখে পানি দেখে মলি তার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,
“আর কান্না নয়। অনেক কেঁদেছিস। এখন থেকে তোকে ভালো থাকতে হবে। ভালো থাকার অভিনয় নয়। বরং সত্যিকারের ভালো থাকতে হবে তোকে।”
“পারব?”
“অবশ্যই পারবি। কেন পারবি না? তোর সাথে তোর আপনজন সবাই আছে। তাহলে ঘুরে দাঁড়াতে সমস্যা কোথায়? তোর এমন অবস্থা দেখে আন্টির অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মেয়ের কষ্ট তিনি মেনে নিতে পারছেন না।”
এর মধ্যে আদ্রিতা সবার জন্য খাবার নিয়ে আসে। খাবার সব টেবিলে রেখে মলিকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“তুই এসে খুব ভালো করেছিস। আমি একা তো এই শাঁকচুন্নিকে সামলাতেই পারছিলাম না।”
“ওই তুই আমাকে শাঁকচুন্নি বললি?”
“শাঁকচুন্নিকে তো শাঁকচুন্নিই বলব।”
“তবে রে!”
কথাটা বলে কুয়াশা দৌড়ে আদ্রিতাকে ধরতে গেলে সেও দৌড় লাগায়। দু’জনের এমন দুষ্টুমি দেখে সাফওয়ান বলে,
“দৌড়াদৌড়ি পরে করো। আগে আমার কথা শোনো।”
“কী?”
“আমরা চারজন মিলে ঘুরতে যাব সেন্ট মার্টিনে।”
“কবে? কখন? আর কেন?”
“আমি টিকিট কেটে রেখেছি। আগামী পরশু আমরা রওনা দিব। আর উদ্দেশ্য হলো তোমার মন ভালো করা। মূলত এই কারণেই মল্লিকাকে ঢাকায় নিয়ে আসা।”
চলবে??