#কুয়াশা_মিলিয়ে_যায়_রোদ্দুরে
#পর্ব_১০
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা
“কুয়াশাকে মে রে ফেলব আমি।”
তিন্নির মুখে এমন কথা শুনে ফয়সাল চমকে যায়। তিন্নির সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“এসব কী বলছো তুমি? পাগল হয়ে গেলে নাকি?”
“ওই মেয়ের জন্য এখনো আমার রাগ কমছে না। ওকে আমি পাঠালাম আমার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। আর সে কী করলো? আমাকেই পিঠ পিছে ছু ড়ি মা র লো!”
“শান্ত হও তিন্নি। আমরা তো সুখে আছি। তাহলে কুয়াশা কেন সুখী হবে না? কুয়াশা যদি তুরাবের সাথে সুখী হয় তাহলে আমাদের তো সমস্যা নেই।”
“আরে তুরাব কুয়াশাকে ভালোবাসে না। ওর সবকিছুই নাটক। কুয়াশা এত বোকা যে এসব কিছুই বুঝতে পারলো না।”
“আচ্ছা বাদ দাও। বোনের সাথে ঝামেলা করে সম্পর্ক নষ্ট করে লাভ আছে কী? সামনেই তুমি মা হবে। কুয়াশার খুব ইচ্ছা ছিল আমাদের বাচ্চাকে সবার আগে ওও কোলে নিবে। রাগ, অভিমান বাদ দিয়ে ওকে কল দিয়ে সব মিটিয়ে নাও।”
“দরকার নাই ওকে আমার। লাগবে না এমন বোনকে।”
“এসবের জন্য তোমার মা-বাবার সাথে ফুপির সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এটা কী বুঝতে পারছো তুমি?”
ফয়সালের কথায় তিন্নির কথা বন্ধ হয়ে যায়। সে ভাবে, সত্যিই তো আমাদের ঝামেলার জন্য পরিবারের অন্যদের সম্পর্কে ফাটল ধরছে। এখন আমার কী করা উচিত?
সকাল থেকে কুয়াশার মন খারাপ। কোনোকিছুতেই মন বসছে না তার। প্র্যাকটিসে এসেও চুপচাপ বসে আছে সে। সাফওয়ান কুয়াশার কাছে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করে,
“তোমার কী হয়েছে বলো তো? সকাল থেকে কথা না বলে চুপ করে বসে আছো।”
কুয়াশা বিষন্ন চাহুনি নিয়ে তাকায় সাফওয়ানের দিকে। তার চোখ দু’টো বলে দিচ্ছে, সে ভালো নেই।
“আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই সাফওয়ান।”
“কী কথা? বলো।”
“এখন না। প্র্যাকটিস শেষে কোথাও বসে বলবো।”
“ঠিক আছে। এখন চলো স্যারের কাছে যাই।”
কুয়াশা সাফওয়ানের সাথে কাজের জায়গায় চলে যায়। এদিকে তুরাব এখন পুরোপুরি সুস্থ। কিন্তু তার মা থা য় কুয়াশাকে নিয়ে অনেক প্রশ্ন জমে আছে। দুই মাস আগে সেই দুর্ঘটনার সময় কুয়াশা কেন তাকে হাসপাতালে দেখতে এসেছিল এই প্রশ্নের উত্তর এখনো সে জানে না। তুরাব কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছে না। তার বারবার মনে হচ্ছে, কুয়াশা তাকে ভালোবাসে।
“আমি আর নিতে পারছি না এসব। কুয়াশা যদি সত্যি আমাকে ভালোবাসে তাহলে আমি ওর প্রতি অন্যায় করেছি। আমি যত খারাপ মানুষই হই, কখনো কোনো নিষ্পাপ মেয়েকে কষ্ট দিইনি। কুয়াশার মতো মেয়েকে কষ্ট দিলে আমি নিজেও তো ভালো থাকতে পারব না। আমরা দু’জন আলাদা আছি প্রায় পাঁচ মাস হয়ে গেল। এই পাঁচ মাসে কুয়াশার কথা কথা কম করে হলেও পাঁচশ বার মনে পড়েছে। আমার কুয়াশার সাথে কথা বলতে হবে।”
কুয়াশাকে কল দেওয়ার পূর্ব মুহূর্তে সে নিজের সিদ্ধান্ত বদলে নিয়ে মলিকে কল দেয়। মলি কল রিসিভ করে বলে,
“আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আমি তুরাব বলছি।”
“আপনি আমাকে কেন কল দিয়েছেন?”
“মলি তোমার সাথে আমার জরুরি কিছু কথা আছে কুয়াশাকে নিয়ে।”
“কী কথা?”
“কুয়াশা কী আমাকে ভালোবাসে?”
তুরাবের এমন প্রশ্নে হতবাক হয়ে যায় মলি। এই প্রশ্নের উত্তর যে তার কাছেও নেই।
“আমি এই বিষয়ে কিছু জানি না। তবে গত দুই মাস আগে আপনার যে অবস্থা হয়েছিল তাতে কুয়াশা খুব অস্থির হয়ে গিয়েছিল। আপনাকে একবার দেখার জন্য ঢাকা থেকে ছুটে এসেছিল সেদিন রাতেই।”
“কী? কুয়াশা বগুড়ায় নেই এখন?”
“কুয়াশা প্রায় পাঁচ মাস ধরে ঢাকায় আছে। ওর উকিল হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।”
“ওর ঢাকার ঠিকানা আমাকে দিতে পারবে?”
“না। আমরা কেউ চাই না যে আপনি কুয়াশার সাথে পুনরায় যোগাযোগ করুন। ওকে ওর মতো করে থাকতে দিন ভাইয়া। ওর জীবনের সমস্ত সুখ যারা কেঁড়ে নিয়েছে তাদের ওর জীবনে ফিরে যাওয়ার কোনো অধিকার নেই।”
“মলি এমন করে বলো না।”
“এর থেকে ভালো করে বলতে আমি জানি না। আমাকে মাফ করবেন। রাখছি।”
তুরাবকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মলি কল কেটে দেয়। এই ছেলের সাথে কথা বলতে বিরক্ত লাগে তার।
প্র্যাকটিস শেষে কুয়াশা আর সাফওয়ান একটা ক্যাফেতে বসে। কুয়াশার মুখে এখনো বিষন্নতার ছাপ স্পষ্ট। সাফওয়ান কুয়াশার চোখের দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে,
“এবার বলো কী বলতে চাও?”
“সাফওয়ান তোমার সাথে আমার পরিচয়ের পাঁচ মাস হয়ে গেল। আর কিছু দিন পর আমাদের প্র্যাকটিস শেষ হয়ে যাবে। এই পাঁচ মাসে তুমি আমাকে অনেক সুন্দর সুন্দর মুহূর্ত উপহার দিয়েছো। আমার খুব কাছের একজন হয়ে উঠেছো। এবার সময় এসেছে তোমাকে আমার জীবন সম্পর্কে সবকিছু বলার।”
“আমি তো তোমার সম্পর্কে জানার জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছি। অবশেষে আমার অপেক্ষার প্রহর আজ শেষ হলো তবে!”
“হুম শেষ হলো। আমি আর নিজেদের মধ্যে কথাগুলো চেপে রাখতে পারছি না। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার।”
“তুমি ঠিক আছো তো কুয়াশা?”
“না, আমি ঠিক নেই। আমার জীবনে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যার জন্য আমি আগের মতো নেই। জানো? আমি এক সময় খুব চঞ্চল ছিলাম। আমার মতো হাসিখুশি মেয়ে খুব কমই হয়। আমি আগে এত কথা বলতাম যে অনেকে আমাকে বাঁচাল পরি বল ডাকতো। আমার মুখে সারাক্ষণ হাসি লেগে থাকতো।”
পুরোনো স্মৃতিচারণ করতে করতে কুয়াশার ঠোঁটে নিজের অজান্তেই হাসি ফুটে ওঠে। সে যেন আগের কুয়াশা হয়ে উঠেছে। সাফওয়ান কুয়াশার কথা শুনে এটুকু অনুমান করতে পারছে অতীতে তার সাথে বাজে কিছু হয়েছে। যার জন্য কুয়াশা সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়েছে। কুয়াশা কিছুক্ষণ থেমে আবারো বলতে শুরু করে,
“আর কিছু দিন পর হয়তো আমরা আলাদা হয়ে যাব। আমাদের প্র্যাকটিস শেষ হয়ে যাবে। তারপর কে কোথায় চলে যাবো জানি না। তোমার সাথে আমার যোগাযোগ সেই সময় সময় থাকবে কিনা সেটাও জানি না। তাই এখনই কথাগুলো তোমাকে না বললে বড্ড দেরি হয়ে যাবে। আমি নিজের মধ্যে কথা বেশি দিন চেপে রাখতে পারি না। আর তুমি এখন আমার বন্ধু হয়ে উঠেছো। এজন্য এসব জানার অধিকার তোমার আছে।”
“আমি জানতে চাই সবকিছু। তুমি বলো আমাকে।”
“হ্যা বলছি।”
কুয়াশা আর কিছু বলার আগেই তার ফোন বেজে ওঠে। মলি কল দিয়েছে।
“মলি কল দিয়েছে। আমি ওর সাথে কথা বলে আসছি। পাঁচ মিনিট লাগবে। তুমি এখানে বসে থাকো।”
“আচ্ছা।”
কুয়াশা সাফওয়ানের থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে কল রিসিভ করে।
“হ্যা মলি বল।”
“তুরাব ভাইয়া আজকে আমাকে কল দিয়েছিল।”
“তোকে কল দিয়েছিল? কিন্তু কেন?”
“তুই তাকে ভালোবাসিস কিনা এটা জানার জন্য। ভাইয়ার সাথে কথা বলে মনে হলো সে কিছু নিয়ে চিন্তিত। তুই ঢাকায় যেখানে থাকিস সেখানকার ঠিকানা চাচ্ছিল আমার কাছে।”
“তুই ঠিকানা দিয়ে দিয়েছিস নাকি?”
“আরে না। আমি ঠিকানা দিব কেন? আমি আরো বলেছি তোর সাথে কখনো যোগাযোগ না করতে।”
“ভালো করেছিস। তবে আমার কী মনে হয় জানিস?”
“কী?”
“তুরাব আমাকে কল দিবে। আমার সাথে কথা বলতে চাইবে।”
“এমন মনে হচ্ছে কেন তোর?”
“এমনিই মনে হচ্ছে।”
“তোর মা থা য় ঠিক কী চলছে বল তো? আমার না তোর কথাগুলো কেমন রহস্যময় মনে হচ্ছে। তুই কী আমার কাছে কিছু লুকাচ্ছিস?”
“তোর কাছে আমি কখনো কিছু লুকিয়েছি? শোন তোর সাথে আমার অনেক কথা আছে। কিন্তু এখন আমি বাইরে আছি। বাসায় গিয়ে কথা বলবো এসব নিয়ে৷ এখন রাখছি।”
“ঠিক আছে। সাবধানে থাকিস।”
মলির সাথে কথা বলা শেষে কুয়াশার ঠোঁটে রহস্যময় হাসি ফুটে ওঠে। সে আপনমনে বিরবির করে বলে,
“খেলা শুরু হয়ে গিয়েছে!”
চলবে??