কুয়াশার আড়ালে সূর্য
৭.
নয়টার দিকে শপিং শেষে বাড়ি ফিরে তিনজন। সূর্য দু’জনকে নামিয়ে আবার বের হয় বাহিরে। খেয়ে এসেছে তারা। এক ঘন্টা পর সূর্য বাড়িতে ফিরে। ড্রইংরুম থেকে আসার সময় অহনাকে জিজ্ঞেস করে,
‘কুয়াশা কোথায় ভাবি?’
‘ঘুমাচ্ছে মেবি।’
‘এত তাড়াতাড়ি।’
‘বেশি ক্লান্ত ছিল হয়তো। এজন্য ঘুমিয়ে গেছে। তুমি বরং ওঁকে ডেকো না। খাবার ভাড়ছি খেতে এসো।’
‘খাব না ভাবি খুদা নেই। আমিও ঘুমাতে গেলাম।’ বলতে বলতে এগিয়ে গেল সিঁড়ির দিকে। অহনা টিভির দিকে মনোযোগ দেয়। রুমে এসে বিছানায় এলোমেলো ভাবে উপুড় হয়ে কুয়াশাকে শুতে দেখে। দরজাটা লাগিয়ে এগিয়ে আসে। চিৎ করে শুইয়ে গায়ে কম্বল টেনে দেয়। পাশের শপিং ব্যাগগুলো আলমারিতে তুলে রাখে। আলামিনের সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা হয় নতুন মেশিন সম্পর্কে। তারপর এগারটার দিকে ঘুমাতে আসে সূর্য। কুয়াশাকে একবার ডেকেও ছিল। তবে ঘুমে বিভোর দেখে আর ডাকল না। ঘুমিয়ে যায় সেও।
আজ সূর্যের আগেই ঘুম থেকে উঠেছে কুয়াশা। অহনার সাথে সকালের নাস্তা বানাতে সাহায্য করে সেও।
‘আচ্ছা ভাবি তোমরা বেবি নিচ্ছো না কেন?’
কুয়াশার কথায় অহনা সরু নিশ্বাস টেনে বলল,
‘আল্লাহ হুকুম ছাড়া হবে কীভাবে বলো? আমার তো চাইছি নিতে।’
‘কোনো সমস্যা আছে কী?’
‘নাহ। তবুও কেন এমন হচ্ছে বুঝতে পারছি না। শোনো, তুমিও তাড়াতাড়ি নিয়ে ফেলো বেবি। নয়তো পরে আমার মতো সমস্যা হবে।’
কুয়াশা কিঞ্চিৎ লজ্জা অনুভব করে চুপ হয়ে রইলো। ফের বলল,
‘আপনার দেবর কী রং পছন্দ করে?’
‘সেটা সূর্যকেই জিজ্ঞেস করে নিও।’ হেসে হেসে বলল।
‘আমি ব্যতীত আর কোনো মেয়েকে সে পছন্দ বা ভালোবেসেছিল?’
‘নাহ! তুমিই আমার অনলি ওয়ান পিস প্রেয়সী এবং অর্ধাঙ্গিনী।’ সূর্য কথাটা বলে এগিয়ে আসে তাদের নিকট। কুয়াশা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়। অহনা সূর্যের বুকে কনুই দ্বারা গুঁতো দিয়ে বলল,
‘তোমার বউকে বলো প্রিয় রং কী তোমার।’
‘ব্লু রং আমার বেশি প্রিয়। আর কিছু জানার আছে?’ লাস্টের কথাটা কুয়াশার একটু কাছে এসে বলল।
অহনা মৃদু কেশে বলল,
‘আমি কী চলে যাব?’
‘নাহ! আমিই যাচ্ছি। বাকিটা রাতের জন্য তোলা রইলো আই মিন কথা আর কি।’ কুয়াশার পানে তাকিয়ে বলল সূর্য।
অহনা হাসে। সূর্য বেরিয়ে যায়। সে বলে,
‘কত রোমান্টিক আমার দেবর দেখেছো?’
‘দেখলাম। বাকি গুলোও দেখাতে বোলো।’
‘কেন দেখনি?’ অহনা কথাটা বলেই উঁচু স্বরে হেসে দেয়। কুয়াশাও লজ্জায় হাসে। সে তো সূর্যের অন্যান কাজের কথা বলতে বলেছে। কিন্তু অহনা দুষ্টুমি করে সিরিয়াস বিষয় বলে ফেলেছে। তিন বাবা-ছেলে একই সাথে ফ্যাক্টরিতে আসছে। আজ ইন্টারভিউ রয়েছে। লোক নেওয়া হবে তাদের ফ্যাক্টরিতে। সূর্য ও আকাশ ইন্টারভিউ নিবে। সিসি ক্যামেরায় সব ইন্টারভিউ দেওয়া লোকদের দেখছে সূর্য। হঠাৎ সেখানে আব্দুল আহাদকে দেখে রিসিভার তুলে তাকে আগে ডাকে। ভেতরে আসার পর খুব মার্জিত ভাবে আব্দুল আহাদ তাদের সালাম দিয়ে কথা বলে।
‘এত কোম্পানি রয়েছে। আমাদেরটাই কেন?’ সূর্য তার কাছে জানতে চাইলো।
‘পেটের দায়ে। সম্পর্কে যাই হই না কেন। এখন তো আপনার আমার মাঝে অনেক পার্থক্য।’
সূর্য আর কিছু না বলে আব্দুল আহাদের ফাইল নিয়ে ঘাটছে। তারপর আকাশের হাতে তুলে দিয়ে তার চাকরি কনফার্ম করে দেয়। এবং কাল থেকে কাজে আসার নির্দেশ দেয়। আব্দুল আহাদ খুশি। নিসন্দেহে সূর্য একজন ভালো মানুষের কাতারে পড়ে।
_
আজকে সূর্যের পছন্দ অনুযায়ী কুয়াশা ব্লু রঙের থ্রিপিস পড়েছে। অহনার রুমে এসে দেখতে পায় সেও একই রঙের থ্রিপিস পড়েছে। কুয়াশা জিজ্ঞেস করল,
‘ভাইয়ারও ব্লু রং পছন্দ?’
‘না, আমার পছন্দ। তবে তারও ভালো লাগে মোটামুটি।’
‘আচ্ছা ভাবি আপনাদের বিয়েটা কী পারিবারিক মতে ছিল?’
‘হ্যাঁ। তবে আমাদের ভালোবাসাটা লাভ ম্যারেজের মতো গভীর।’
‘আর..’ কুয়াশা ফের কিছু বলার পূর্বে আকাশ রুমে প্রবেশ করে। অহনাকে বলে সে বেরিয়ে এলো। রুমে এসে দেখে সূর্য ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে শার্টের বোতাম খুলছে। কুয়াশা বিছানায় বসলো ফোন নিয়ে। সূর্য আয়নার মাধ্যমে কুয়াশার পানে চেয়ে বলল,
‘কাল এত ক্লান্ত ছিলে, এসেই যে ঘুমিয়ে গেলে।’
‘প্রচুর ঘুম পাচ্ছিল। কাত হতেই কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম টেরও পাইনি।’
‘ও, আজ টাওয়াল এগিয়ে দিবে না?’
কুয়াশা দ্রুত টাওয়াল এগিয়ে দেয়। সূর্য টাওয়াল সহ টান দিয়ে নিজের কাছে আনলো তাকে। কুয়াশা নজর নিচু করে রাখে। আলতোভাবে কুয়াশার কপালে আঙুল বুলিয়ে গালে এসে থামে। কোমল গলায় বলে,
‘ব্লু রঙে দারুণ মানিয়েছে তোমায়। আমার কাছে আসলেই এত লজ্জা পাও কেন তুমি? আমি কি তোমায় হাগ, কিস করছি।’
কুয়াশা ধীরে সূর্যের হাত সরিয়ে দিয়ে চলে যাবার জন্য দু কদম এগোয়। সূর্য মুচকি হেসে পেছন থেকে কোমড় জড়িয়ে নিজের সঙ্গে মিষিয়ে ধরলো। সরস গলায় কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
‘তোমার মধ্যকার হাজারো কুয়াশাকে ভেদ করে সূর্যোদয় ঘটাবো।’
কুয়াশার বুকে ইতিমধ্যে দ্রিমদ্রিম শব্দ আরম্ভ হয়েছে। হাত কোমড় থেকে সরাতে চাইলে আরো শক্তভাবে ধরে রাখে সূর্য। কুয়াশা একই চেষ্টা চালাচ্ছে।
‘অহেতুক চেষ্টা। ছাড়ব না। এক মুহূর্তের জন্য তোমায় কাছে টানার সময় নষ্ট করতে চাই না।’ বলতে বলতে কুয়াশার ঘাড়ের কাছে মুখ নিতেই পিছন থেকে অহনার কাশির আওয়াজ শুনে দ্রুতই ছেড়ে দেয়। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে তারা। অহনা হেসে হেসে এগিয়ে এসে পিঞ্চ মেরে বলল,
‘ইশ! ডিস্টার্ব করলাম। এটা দিতে বলল তোমায় ভাইয়া।’ একটি সবুজ রঙের ফাইল এগিয়ে দেয় সে। সূর্য হাতে নিয়ে বলল,
‘পরেও দিতে পারতে। হুদাই.. ‘
‘আহারে। আচ্ছা ক্যারি অন। তবে রাতের কাজ রাতেই ভালো মানায়।’ বলতে বলতে হেসে বেরিয়ে যায় অহনা। কুয়াশা দ্রুত বিছানায় কাছে এসে বালিশ কোলে নিয়ে বসল। সূর্য কুয়াশার কাণ্ড দেখে টাওয়াল নিয়ে এগিয়ে গেল বাথরুমের দিকে। বুকে হাত রেখে বড়ো নিশ্বাস নিলো সে। শুধু রোমান্টিক নয়, মাত্রাতিরিক্ত রোমান্টিক সূর্য।
বিকেলের দিকে কুয়াশাকে নিয়ে বাহিরে ঘুরতে বের হয় সূর্য।
রমনাপার্ক থেকে ঘুরেফিরে রিভার ভিউ রেস্টুরেন্টে এসে বসে। সূর্য খেয়াল করে কুয়াশা আশেপাশের কপোত-কপোতীদের পানে চেয়ে আছে। খাবার দিয়ে যাবার পর কুয়াশার মনোযোগ পরিবর্তন হয় না। সূর্য মিল্কশেকে এক চুমুক দিয়ে কুয়াশাকে জিজ্ঞেস করে,
‘কুয়াশা, তুমি কী আব্দুল আহাদকে ভালোবাসো না ভালোবেসেছিলে?’
কিছুটা বিব্রত বোধ করে কুয়াশা। সে চেয়েছিল তাকে ভালোবেসে তবেই স্বামীর স্থান দিয়ে আপন করে নিবে। কিন্তু দিনের পর দিন তার অবহেলায় সেসব স্বপ্ন হয়েই রয়ে গেছে।
ভালোবাসা আর হলো না। কুয়াশা সেকেন্ড কয়েক এসব ভেবে বলল,
‘চাইলেই যে কাউকে ভালোবাসা যায় না। আমি এটা তার সাথে থেকেই বুঝতে পেরেছি। তাকে আমি পছন্দ করতাম ঠিকিই। কিন্তু মন থেকে ভালোবাসতে পারিনি।’
‘তবে কী ধরে নিবো ঐখানে আমার স্থান হবে?’
কুয়াশা মৃদু হেসে দৃষ্টি নত করে ফেলে। সূর্য নরম গলায় বলল,
‘চুপ থাকা সম্মতির লক্ষণ।’
তবুও কুয়াশা কিছু বলে না। সূর্য মুচকি হেসে বলল,
‘বাড়িতে ফিরি, চুপ থাকার পানিশমেন্ট ফেরৎ দিবো।’
কুয়াশা বাঁকা চোখে তাকিয়ে চাউমিং মুখে তুলে নিলো।
সূর্যের কথায় পাত্তা দিলো না। ঘোরাঘুরি করে রাত দশটায় বাড়িতে ফিরে। ড্রইংরুমে আকাশ ও অহনা উপস্থিত ছিল। তাদেরকে বসতে বলে রান্না ঘর থেকে দু’জনার জন্য হালিম নিয়ে আসে। খুদা না থাকা স্বত্তেও তাদের খেয়ে হয়। যেহেতু অহনা রান্না করেছিল। তাদের সাথে কিছুক্ষণ গল্পগুজব সেরে এগারোটার দিকে রুমে আসলো।
চলবে?
®সুমাইয়া মনি