কুয়াশার আড়ালে সূর্য পর্ব-০৬

0
603

কুয়াশার আড়ালে সূর্য

৬.
‘লুকোচুরি কথা পছন্দ না আমার। যা বলব সামনাসামনি। অন্য স্বামীদের মতো বলতে পারব না আমি সোফায় ঘুমাবো। আমার পাশেই তুমি ঘুমাবে উইদাউট কোলবালিশ।’ জায়নামাজ ভাজ করতে করতে কথাগুলো কুয়াশার উদ্দেশ্যে বলল সূর্য। কুয়াশা কিঞ্চিৎ বিরক্ত নিয়ে বলল,
‘আমি কখন বললাম আপনি সোফায় ঘুমাবেন?’
‘অনুমান।’
‘আ’জা’ই’রা।’ বিড়বিড় করে বলল কুয়াশা।
প্রথমে সূর্য ডান পাশে শোয়। কুয়াশা বাঁ পাশে শুয়ে হালকা শীত লাগার কারণে পাতলা কম্বল গায়ে জড়ায়। টেবিল লাইট অফ করে দেয় সূর্য। আপাতত ডিল লাইট জ্বলছে। দু’জনেই চিৎ হয়ে শুয়ে ওপরের পানে শূন্যে তাকিয়ে ছিল। কুয়াশার মনে পড়ে অহনার কথা। সে বলে,
‘বিয়ে ঠিক হবার পর আমরা পাঁচজন বান্ধবী মিলে ভোর সকালে সাইকেল নিয়ে বের হয়েছিলাম ঘুরতে। সেদিন খুব আনন্দ করেছি আমরা।’
‘ভাবি তোমাকে বলেছে সেদিনের কথা?’
‘হ্যাঁ।’
‘তুমি আমায় দেখনি?’
‘নাহ! শুধু গাড়িটা নজরে এসেছিল।’
সূর্য চুপ হয়ে রয়। কুয়াশা জিজ্ঞেস করে,
‘আমার বাবা আপনাদের বাড়িতে আসবে আমি ভাবতেও পারিনি। আপনি কী তাকে এনেছেন?’
‘আব্বাকে পাঠিয়েছিলাম।’
‘ধন্যবাদ আপনাকে।’ কুয়াশা হাসিমুখে বলল।
‘শোনো আমি চাই..’ দ্রুততার সঙ্গে কথাটা বলল সূর্য।
কুয়াশা ভ্রূকুটি করে জানতে চাইলো,
‘কী?’
‘আমার কাছে এসে ঘুমাও।’ বলতে বলতে কুয়াশার বাহু ধরে কাছে টেনে আনলো। প্রখর ভাবে বুকের হার্টবিট চলছে তার। এক রাশ লজ্জায় হালকা সরে যেতেই সূর্য গা ঘেঁষে শোয় তার। ফের কুয়াশা সরে গেল। সূর্যও নাছোড়বান্দা। পুনরায় কুয়াশার গা ঘেঁষলো। কুয়াশা আবার সরে গেল। সূর্য এবার কুয়াশার ওপর ঝুঁকে দু পাশে দু হাত রেখে বলল,
‘এবার?’
কুয়াশা লজ্জায় কম্বল দিয়ে মুখ ডেকে নিলো। সূর্য ফিক করে হেসে নেমে গেল। কম্বলের নিচে মুখ লুকিয়ে সেও হাসছে।
‘হাসতে হবে না ঘুমাও।’
কথাটা শুনে কুয়াশার ঠোঁটের হাসি আরো চওড়া হয়।

সকাল নয়টার দিকে ঘুম ভাঙে কুয়াশার। তার আগেই সূর্য উঠে জগিংয়ের জন্য বেরিয়েছে। অবশ্য কুয়াশা সেটা জানে না। ফ্রেশ হয়ে নিচে এসে দেখে অহনা টেবিলে খাবার সাজাচ্ছে। কুয়াশা পাশে দাঁড়িয়েছে দেখে অহনা আস্তে করে বলল,
‘কী ব্যাপার দেবরনি গা শুঁকনো যে?’
‘ভিজিয়ে আসবো?’ মৃদু হেসে কুয়াশাও উল্টো মজার ছলে জবাব দিলো।
‘তুমিও দেখছি ভালো সেয়ানা।’
কুয়াশা হাসে। অহনাও হেসে দেয়। শফিকুল ইসলাম ওপর থেকে নামলো তার বড়ো ছেলে আকাশকে নিয়ে। সে হাসি মুখে তাদের উদ্দেশ্যে বলল,
‘সূর্য এখনো আসেনি?’
‘না আব্বা। এখনো বোধহয় জগিং করছে।’
‘এত ফিটনেস থাকার পরও জগিং এর কী প্রয়োজন বুঝিনা।’ লতিফ এহসান আসন গ্রহণ করতে করতে বলল।
‘যদি বুঝতে, তাহলে তোমার ডায়েবিটিসই থাকতো না।’ কথাটা বলতে বলতে এগিয়ে আসলো সূর্য।
‘পিঞ্চ মারলে?’
‘নাহ! হালকা খোঁ চা দিলাম। সময় আছে চাইলে আমার সাথে জয়েন্ট দিতে পারো আব্বা।’ মৃদু হেসে বলল সূর্য।
‘নো থ্যাংকস।’
‘বোরিং ওল্ড ম্যান।’ সূর্য বিড়বিড় করে বললেও লতিফ এহসান সহ সবাই শুনেছে। তিনি রেগেমেগে বলল,
‘কী বললে?’
সূর্য ছোট ছোট চোখ করে দু কানে হাত রেখে মাফ চাওয়ার ভঙ্গিমায় তার আব্বার পানে তাকায়। তিনি সহ সবাই হেসে ফেলে। সূর্যও ঠোঁটে হাসি টেনে উপরের দিকে অগ্রসর হয়। কয়েক দাপ এগিয়ে এসে একদম ওপরের সিঁড়িতে বসে জোরে অহনাকে ডাক দিলো,
‘ভাবি জলদি এখানে এসো।’
‘কী হয়েছে?’ কিছুটা উদ্বিগ্ন স্বরে বলে এগিয়ে গেল অহনা। বাকিরাও সেদিকে চেয়ে আছে। অহনা নবমতম সিঁড়িতে উঠার পর সূর্য চটপট গলায় ‘কিছু হয়নি যাও’ বলেই হনহনিয়ে ওপরে চলে গেল। অহনা থমথম খেয়ে যায়। সূর্য যে ওঁকে ঘোল খাইয়েছে অহনা সহ বাকিরাও এটা বুঝতে পারে। অহনার করুন পরিস্থিতি দেখে তারা হাসে। অহনা রাগে গজগজ করতে করতে নিচে নেমে চেয়ারে বসে। কুয়াশা অহনার পানে তাকিয়ে মৃদু হাসে। সূর্যের দুষ্টুমিগুলোয় বেশ মজাদার। ঠের বিনোদন দেয় সবাইকে। অহনাও হেসে দেয় সবার সাথে। তারা দু’জনও খেতে বসে। সূর্য কয়েক মিনিট পর এলো। অহনার পানে তাকিয়ে হাসতেই চোখ পাকিয়ে তাকায় সে। সূর্য ফিক করে হেসে দেয়। কুয়াশা এক পলকে সবার পানে তাকায়। এ বাড়ির সবার সাথে সম্পর্ক কতটা বন্ধুত্বসূলভ। দেখে কুয়াশার বেশ ভালো লাগে।
সূর্য খেতে খেতে বলল,
‘বিকেলে মার্কেটে যাব। ঘরের রমণী দু’জন কী যাবে?’
‘এক পায়ে খাঁ’ড়া।’ অহনা অকপটে বলে।
‘সে-কি? লেঙরা হলে কখন?’ সূর্য গম্ভীর মুখে জানতে চাইলো অহনার কাছ থেকে। অহনা ছোট চামিচ তুলে সূর্যের পানে নিক্ষেপ করতে গেলেই সে বলে,
‘স্যরি, স্যরি।’
‘গুড।’ বলেই অহনা চামিচটি টেবিলে রাখলো। কুয়াশার এতটা হাসি পাচ্ছে যে আটকে রাখতেও কষ্ট হচ্ছে। হাসি সংযোগ রেখে খেয়ে ওপরে এলো। সূর্য সেখান থেকেই কুয়াশাকে বলে একত্রে বের হয় তাদের সাথে।
__
‘বাবা আমি কী সত্যি আসল হিরাকে হারিয়ে ফেলেছি?’ আব্দুল আহাদ অসহায়ত্ব স্বরে বলল। ওসমান মিয়া এক প্রকার ক্ষোভিত গলায় বলল,
‘নাহ! ওমন মেয়ে কত আসবে যাবে। তুই আবার টোপ ফেল।’
‘আসবে যাবে, কিন্তু কুয়াশার মতো মেয়ে আমার নসীবে জুটবে না। আমি তোমার এ কাজ করতে পারব না।’
‘তুই আমার কথা শুনতে চাস না?’
‘অন্যায় পথ থেকে আমায় বের হতে দেও বাবা।’ করুণ গলায় বলল।
‘আমি তোকে ত্যাজ্যপুত্র করব।’
‘আমি চলে যাচ্ছি।’
মায়ের কান্নারত মুখের পানে একবার তাকিয়ে আব্দুল আহাদ বেরিয়ে গেল। দুঃখিনী মা তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারল না। স্বামীর ওপর কথা বলার সাহস তার নেই।
_
পুরো সকাল জুড়ে কুয়াশা অহনার সঙ্গে সময় অতিবাহিত করে। দু জা-য়ে রান্নার কাজবাজ সেরে গোসল করে নামাজ পড়ে নেয়। দু টার দিকে তারা বাড়িতে ফিরে। কুয়াশা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে পুরনো দিনের কথা মনে করছে। যদি তার আগেই সূর্যের সাথে দেখা হতো। তাহলে ডিভোর্সি নামটি থাকতো না। ভাগ্যে ছিল বলে ছেড়ে দেয় সে।
‘কুয়াশা।’ সূর্যের ডাকে চৈতন্য ফিরে পায় সে। রুমে এসে দেখে সূর্য পায়ের মুজা খুলছে। পাশে তার টাওয়াল নিয়ে এগিয়ে দেয় কুয়াশা। সূর্য একবার তাকিয়ে দু’টি চকলেট দিয়ে বলল,
‘খেয়ে দেখো কেমন মিষ্টি।’
কুয়াশা সরু চোখে তাকিয়ে হাতে নেয়। সে হেসে টাওয়াল নিয়ে বাথরুম দিকে এগোয়। খেতে খেতে নিচে আসার পর দেখে অহনা একই চকলেট খাচ্ছে এবং টেবিলে খাবার ভাড়ছে। কুয়াশা কাছে এসে জিজ্ঞেস করল,
‘কে দিলো?’
‘সূর্য।’
‘আমাকেও দিয়েছে।’
অহনা মলিন হেসে আগের ন্যায় কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ বাদে সবাই দুপুরের আহার করতে নিচে এলো। সূর্য এসেই কুয়াশার মাথায় ঘোনটা দিয়ে বলল,
‘মাথায় কাপড় দিয়ে খাওয়া উত্তম।’
কুয়াশা সূর্যের পানে এক পলক তাকিয়ে প্লেটে ভাত বেড়ে দেয়। সূর্য গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বলল,
‘পাঁচটার দিকে বের হবো। যে দেরি করবে তাকে নিবো না।’
‘হবে না দেরি।’ অহনা শুধায়।

চলবে?

®সুমাইয়া মনি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে