কুয়াশার আড়ালে সূর্য
৫.
নতুন বাড়িতে, নতুন পরিবেশে কুয়াশা নিজেকে কতটুকু মানিয়ে নিতে পারবে জানে না। তবে সে যথাসাধ্য চেষ্টা করবে। একটু আগেই তারা পৌঁছেছে। সবুজ রঙের দ্বিতীয় তলা বিশিষ্ট আলিশান বাড়ি থেকে কম নয় সূর্যদের বাড়ি। দু পাশে রয়েছে ফুলের বাগান। এক প্রান্তে বড়ো লোহার তৈরি দোলনা। আপাতত বাড়িটি বেশ চমৎকার ভাবে ফুল ও মরিচ বাতি দ্বারা সাজানো হয়েছে। তাদের বরণ করতে বাড়ির সব মহিলা এবং যুবতী মেয়েরা গেটের নিকট দাঁড়িয়ে আছে। মিষ্টিমুখ করে তবেই কুয়াশাকে ভেতরে আনা হয়। এক সাথে দু’জনকে বসিয়ে গল্পের বাক্স নিয়ে বসেছে সকলে। কুয়াশা ভাবছে তার ডিভোর্সের ব্যাপারটি। আদৌও সবাই জানে নাকি অজানা? সবার কথা অনুযায়ী সে বুঝতে পারে আজ তাদের জন্য বড়ো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। বাড়িতে হবে অনুষ্ঠান। এজন্য কুয়াশাকে তার কক্ষে নিয়ে আসা হয়। একটু পরেই পার্লারের মেয়েরা আসবে। সূর্যের কাজিনরা কুয়াশাকে ভেতরে রেখে বাহিরে চলে যায়। একটা সুতি শাড়ি নিয়ে কুয়াশা গোসল করে বের হয়। সূর্য তখনো কক্ষে আসেনি দেখে ভাবে তার সাথে কথা বলার ছিল। হুড়মুড়িয়ে দু’জন মেয়ে রুমে প্রবেশ করে উত্তেজিত স্বরে বলল,
‘ভাবি পার্লার থেকে লোক এসেছে।’
ভাবি সম্বোধন করায় কুয়াশা বুঝতে পারে এরাই সূর্যের চাচাতো বোন। সে বলে,
‘লোক বলতে, ছেলে না মেয়ে?’
‘ছেলে।’
‘তোমার ভাইকে একটু ডেকে দিবে? আর না হয় নাম্বারটা দেও আমাকে।’
‘সে-কি, ভাইয়ার নাম্বার নেই।’
কুয়াশা কিঞ্চিৎ লজ্জা অনুভব করে তার কথায়। তবে ইরা মুচকি হেসে নাম্বার দিয়ে দেয়। একবার সূর্যকে কল দেবার পরই রিসিভ করে। কুয়াশা হ্যালো বলতেই সূর্য বলে,
‘বলো কুয়াশা।’
বিস্ময় স্বরে কুয়াশা জানতে চাইলো,
‘কীভাবে বুঝলেন আমিই কুয়াশা?’
‘তোমার কণ্ঠের স্বর আমার মস্তিষ্কে চিরস্থায়ী বাসিন্দায় যুক্ত।’
কুয়াশার ভালো লাগে কথাটা শুনে। সেকেন্ড কয়েক চুপ থেকে বলল,
‘আমি পার্লারে সাজতে চাইছি না।’
‘সেজো না। তোমার সামনে ইরা থাকলে ফোনটা দেও।’
কুয়াশা ইরার দিকে ফোনটা এগিয়ে দিলো।
‘বলো ভাইয়া।’
‘পার্লারের লোকদের নিয়ে আমার কাছে আয়। আমি নিচে আছি।’
‘ওকে ভাইয়া।’ ফোন রেখে দেয় সূর্য।
‘ভাবি তুমি থাকো। আমি অহনা ভাবিকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
কুয়াশা সম্মতি দিলে দরজা ভিড়িয়ে ইরা তাদের নিয়ে বেরিয়ে যায়। অহনা তার বড়ো জা দেখতে সুদর্শনা এবং আচার-আচরণ যথেষ্ট মার্জিত। কুয়াশা টাওয়াল রেখে কক্ষটি মনোযোগ দিয়ে দেখছে। এতদিন এই কক্ষে সূর্য একা বসবাস করতো। এখন থেকে সে যুক্ত হয়েছে। হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজে সেদিকে তাকায়। অহনা এসেছে ভারী লেহেঙ্গা ও গহনা নিয়ে। বিছানার ওপর রাখতে রাখতে বলল,
‘পার্লারের লোকদের পাঠিয়ে দিলে যে। এখন তোমায় কে রেডি করাবে কুয়াশা।’
‘আপনি সাজাবেন আমায়?’ বাচ্চাদের মতো আবদার যেন কুয়াশার। অহনা এগিয়ে এসে সরস গলায় শুধায়,
‘আমি এ বাড়িতে এসেছি তিন বছর হলো। এক বছরের মাথায় শ্বাশুড়ি মারা যায়। এত বড়ো বাড়ি সংসার আমি একা হাতে সামলে এসেছি। তুমি আসায় আমার খুব সুবিধা হলো। আমি তোমার আবদার টুকু রাখবো না, তা কি হয়।’ কুয়াশা মৃদু হাসলো। তিন ঘন্টা বাদে কুয়াশাকে সাজিয়ে তবেই বের হয় সে। নিচে এসে ডেকোরেশনের লোকদের সাথে সূর্যকে কথা বলতে দেখতে পায়। অহনা এগিয়ে আসে। সূর্য লোকটিকে বিদায় দিয়ে বলল,
‘কিছু বলবে ভাবি?’
‘টাকা লাগবে?’
‘কত দিবো বলো?’ মানিব্যাগ বের করতে করতে সূর্য জানতে চাইলো।
‘সাত দিলেই হবে।’
সূর্য গুনে গুনে এক হাজারের সাতটি নোট অহনার হাতে দেয়। অহনা সরু চোখে তাকিয়ে বলে,
‘কেন চেয়েছি জিজ্ঞেস করবে না?’
‘প্রয়োজন নেই ভাবি।’
‘তোমার রুমে যাও। বুঝতে পারবে।’
‘এখনই যেতে হবে?’
‘হ্যাঁ।’
সূর্য ভাবির কথা অনুযায়ী বড়ো বড়ো পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে আসলো। দরজা নক করে ভেতরে এসে দেখে কুয়াশা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে রয়েছে। সূর্য দ্রুত দরজা লাগিয়ে দিলো। কুয়াশা সূর্যকে এক পলক দেখে নজর সরিয়ে নিলো। এগিয়ে আসলো সূর্য। কুয়াশাকে দাঁড় করিয়ে ঠোঁটে শাহাদাত আঙুল স্পর্শ করিয়ে ভাবুক নজরে দেখছে। লজ্জায় কুয়াশা লেহেঙ্গার ওড়না হাতের মুঠোবন্দী করে রেখেছে।
সূর্য ভাবলেশহীন স্বরে বলল,
‘সাত হাজার টাকা কাজে জলে যায় নি।’
কুয়াশা কথাটা শুনে সূর্যের পানে তাকিয়ে আবার নজর সরিয়ে নিলো। সূর্য মুচকি হেসে বলল,
‘মাশাল্লাহ! সুন্দর লাগছে তোমাকে।’
লজ্জা যেন আরো জেকে বসলো কুয়াশার ওপর। বিনাবাক্যে আগের স্থানে বসলো। সূর্য মৃদু হেসে আলমারি থেকে জামা বের করে গোসল করতে গেল। বের হবার পর আয়নার সামনে এসে কুয়াশার ঠিক পেছনে দাঁড়ায়। কুয়াশা আয়ানার মাধ্যমে সূর্যের পানে চেয়ে বলল,
‘আমি যে ডিভোর্সি সবাই জানে।’
‘ঢোল পিটিয়ে কী সবাইকে জানাবো? আমার সামনে ফারদার ডিভোর্সি বাক্যটা তুলবে না।’ সূর্যের গলায় রাগ। টিশার্ট পড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বলল,
‘যাদের জানার প্রয়োজন তারা জানে।’ প্রস্থান করে। বিষাদময় দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে। সূর্য তাকে নিয়ে কতটা সেনসিটিভ সেটা ঠের বুঝায় তার কথার ধরনে। একটার দিকে কুয়াশাকে নিচে স্টেজে নিয়ে আসে। কুয়াশা চমকপ্রদ। বাবা, মা, ভাই ও দাদীকে দেখে আবেগে কেঁদে দিলো। সে কখনো ভাবেনি পাথরের ন্যায় নিষ্ঠুরতম তার বাবা এত দ্রুত সব মেনে নিবে। না নিয়েই বা উপায় কী? এক মাত্র মেয়ে তার। সমাজের রীতিনীতি সংস্কৃতিতে পড়ে মেয়ের সুখের কথা ভুলেই গিয়েছিল। ভাগ্যিস! শেষ অব্ধি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। অভিমান, অভিযোগ ফেলে ফের বাবা-মেয়ের মিলন হয়। পুনরায় তাদের বিয়ে পড়ায়। সুন্দর ভাবে বিয়ের চিত্র এবং ভিডিও ধারন করা হয় ক্যামেরায়। মেয়েকে সূর্যের হাতে তুলে দিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলেন তারা।
সকালে যে কক্ষটি সাধারণ ছিল। এখন তেমন নেই। ফুল দিয়ে চমৎকার ভাবে সাজানো হয়েছে ঘরটি। এগারোটার দিকে অহনা কুয়াশাকে নিয়ে ভেতরে এসেছে।
বিছানায় বসিয়ে এ বাড়ির রীতিনীতি বলছে। বলছে সূর্যের বিষয়ে।
‘সকাল ছয়টার দিকে এয়ারপোর্ট থেকে বাড়িতে ফিরছিল সূর্য। ভাগ্যটা খারাপ ছিল বলে পথিমধ্যে গাড়ির চাকা পামচার হয়। আবহাওয়া তখন বেশ শীতল ছিল। চারদিক কুয়াশায় অচ্ছন্ন। রাস্তা পরিপূর্ণ কোলাহল মুক্ত। পাশে এক ঢং দোকান ব্যতীত আর কোনো দোকান খোলা ছিল না। অতিরিক্ত ঠাণ্ডার ফলে দোকানে গেল এক কাপ গরম চায়ের স্বাদ নিতে।
বরফ জড়িত হাতে কেবলই চায়ের কাপ হাতে নিল। ঠিক তখনই দূর থেকে সাইকেলের হন শুনে তাকাল সূর্য। কুয়াশা, প্রচণ্ড কুয়াশা ভেদ করে একটি উজ্জ্বল মুখশ্রীর দেখা মিললো। ঠোঁটে ভুবনমোহিনী হাসি, এক রাশ উচ্ছ্বাসময় আঁখিযুগলের প্রেমে পড়ে গেল আমার দেবর। সেদিনই তোমায় প্রথম দেখেছিল। খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারলো তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। সূর্য পিছিয়ে গেল। তবে সে নিরাশ হয়নি। আবার তোমাকে ভুলেও যায়নি। দু বছরের মাথায় হঠাৎ একদিন তোমার দেখা পেল। সম্ভবত তুমি রিলেটিভদের বাড়িতে যাচ্ছিলে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারে তোমার ডিভোর্স হয়েছে। সূর্য তোমায় নিয়ে হতাশ ছিল এবং খুশিও ছিল। পরদিনই চেয়েছিল তোমাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব দিবে। কিন্তু মাঝখানে কত কিছু ঘটে গেল। তুমি তো সব জনোই।’
নৈঃশব্দে প্রশ্বাস নিলো কুয়াশা। অহনা ফের বলল,
‘আমার দেবরটা যথেষ্ট ধার্মিক। ও তোমায় হালাল ভাবে চেয়েছে এবং পেয়েছেও।’
দরজা খোলার শব্দে সেদিকে তাকিয়ে দেখে সূর্য এসেছে। দু’জনকে একত্রে দেখে হেসে বলল,
‘হ্যাঁ, খুব সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে বলো আমার সম্পর্কে। যাতে পরবর্তীতে সমস্যা না হয়।’
অহনা কুয়াশার পানে চেয়ে মুচকি হেসে চোখ টিপ দিয়ে বলল,
‘বাসর রাত কাল রাত হয়, জানো নিশ্চয়?’
‘এসব কুসংস্কার তুমিও মানো নাকি?’
‘হ্যাঁ।’
‘ডিজগাস্টিং। শোনো, ইসলামের কুসংস্কারের কোনো স্থান নেই। এই কুসংস্কারের জন্যই আল্লাহর উপর আস্থা ও ধর্মবিশ্বাস এবং আল্লাহর প্রতি পরম নির্ভরতা বা তাওয়াক্কুল বহুলাংশে লোভ পায়।’
‘বুঝেছি।’ চটপট গলায় বলল।
‘তাহলে যাও। নয়তো ভাইয়াকে ডাকবো।’
‘যাচ্ছি।’ অহনা হেসে হেসে চলে যায়।
সূর্য কুয়াশার পানে তাকিয়ে বলল,
‘সব চেঞ্জ করে ওজু করে আসলে ভালো হয়।’
চলবে?
®সুমাইয়া মনি