কুয়াশার আড়ালে সূর্য
১১.(অন্তিম পর্ব)
অহনা রেগে আছে আকাশের ওপর। সকাল থেকেই কোনো প্রকার কথা বলেনি। আকাশ বহুবার কথা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কোনো প্রকার জবাব আসেনি। প্রতি বার ইগনোর করেছে। সকাল এগারোটায় আকাশ তৈরি হচ্ছিল বের হবার জন্য। স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞেস করে,
‘বাবা খেয়েছে?’
অহনা শুনেও না শোনার বান ধরে আয়নার সামনে কসমেটিক নাড়াচাড়া করছে। আকাশ ফের জিজ্ঞেস করে,
‘তুমি খেয়েছো?’
এবারও উত্তর এলো না। আকার এবার প্রচণ্ড ক্ষে পে যায়। অহনার নিকটে এসে বাহু ধরে কাছে টেনে চ্যাঁচিয়ে বলে,
‘কী চাইছো তুমি? সমস্যা কী তোমার?’
অহনা আকাশের চোখের পানে ক্ষীণ রাগ নিয়ে বলে,
‘সমস্যা আপনি।’
‘হ্যাঁ! এজন্যই তো চাইছো আমি যাতে ম’রে যাই।’
অহনা বিস্মিত নয়নে তাকায়। সূর্য ও কুয়াশা রুমে পর্বে করে।আকাশের কথা অনুযায়ী সকাল সকালই ফিরে এসেছে। আকাশ অহনাকে ছেড়ে দেয় তাদের দেখে। সেকেন্ড কয়েক চুপ থেকে কুয়াশার দিকে আঙুল তাক করে আকাশ বলে,
‘কুয়াশা ওর প্রাক্তন স্বামীর জন্য অপেক্ষা করেছে কত মাস। শেষে তার ভাগ্য আমার হীরার টুকরো ভাইয়ের সাথে জুড়ে যায়। তবুও তো ভুল পদক্ষেপ নেয়নি কখনো। আর তুমি, আমারই ভাইয়ের জন্য আমাকেই তীলে তীলে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছো? কীভাবে পারলে অহনা? কীভাবে?’
বলতে বলতে গলা ধরে আসে আকাশের।
অহনা প্রচণ্ড ক্ষেপে যায়, সঙ্গে সে অবাকও হয় আকাশ সব জেনে গেছে দেখে। সে উঁচুস্বরে বলে,
‘কারণ আমি আপনাকে ভালোবাসি না। স্বামী হিসেবে চাই না।আপনি সূর্যের মতো না।’
নিস্তব্ধ সবাই। পিনপতন নীরবতা রুমের আনাচকানাচে। অহনা পুনরায় চ্যাঁচিয়ে বলে,
‘আপনি যেদিন আমাকে দেখতে গিয়েছিলেন। সেদিনই আমার সূর্যকে পছন্দ হয়েছিল। জোর খাটিয়ে ভাইয়া-ভাবিকে বলতে পারিনি। তারা আমার মতামত নেবার চেষ্টাও করেনি। সব সময় আমার ওপর জুলুম করেছে। ইচ্ছের বিরুদ্ধে চাপিয়ে দিয়েছে সব। বিয়ে হয়ে এ বাড়িতে আসার পর আমি কোনো না কোনো ভাবে আপনার থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছি। আপনার থেকে দূরে সরে থেকেছি। সূর্য আমেরিকায় যাবার পর আমি আরো একা হয়ে যায়। কোনো ভাবেও আমি একাকিত্ব কাটিয়ে উঠতে পারিনি। সূর্যের জন্য দেখা প্রতিটা মেয়েকে আমি রিজেক্ট করেছি। ভেবেছি একদিন সূর্যকে আমার করব। সব প্লানও সাজিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু কুয়াশা আমার পথের কাঁটা হয়ে এ বাড়িতে এসেছে। আমি ওদের মেলামেশা সহ্য করতে পারতাম না। কখনো কুয়াশার চায়ে ঘুমের ঔষধ মিশাতাম, কখনো আবার সূর্যের। যাতে ওদের মাঝে ফিজিক্যাল রিলেশনশিপ না হয়। আর…’ আকাশ বাকিটা বলতে না দিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে অহনাকে থা প্প ড় দেয়। ড্রেসিং টেবিলের কোণায় পড়ে যায় সে। ঠোঁটের কোণা কেঁ টে যায় অহনার। কুয়াশা ধরতে যেতে চাইলে আকাশ সামনে দাঁড়িয়ে বাঁধা সৃষ্টি করে। চিল্লিয়ে বলে,
‘কার কাছে যেতে চাইছো? ও তোমাকে ছাদ থেকে ফেলে দিতে চেয়েছিল। সিসি ক্যামেরায় ওর সব মুখোশ উন্মোচন হয়েছে সেদিন। ওর মতো দুশ্চরিত্র নারী সমাজের জন্য অকল্যাণকর। তুমি জানো, ও আমায় অসুস্থ বানিয়ে বাড়িতে রেখেছে। যাতে সূর্যের ওপর সব চাপ পড়ে তোমায় সময় দিতে না পারে। আমার গরুর গোস্তে প্রচণ্ড এলার্জি জেনেও স্যুপের সাথে মিক্স করে যত্নসহকারে খাওয়াতো। এই আমার অর্ধাঙ্গিনী! যাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি।’ বলতে বলতে আকাশ কেঁদে ফেলে উল্টোদিক ফিরে।
সূর্য সব কথাগুলো শুনে বড়ো নিশ্বাস নেয়। স্বাভাবিক গলায় বলে,
‘ভাবি আপনি প্রথম দিন বলতে পারতেন আমায় পছন্দ করেন। তাহলে হয়তো আজ এরূপ ভয়াবহ দিন দেখতে হতো না। আপনার দুঃখগুলো বুঝি, অনুভব করি। তবে একটা কথা কী জানেন? আমি ভাইয়ার মতো না। ভাইয়া আমার মতো না। যদি হতো তাহলে আপনার বেবি হবে না জেনেও সে আপনাকেই চিরসঙ্গী হিসেবে বেঁছে নিতো না। ত্যাগ করতো।’
অহনার টনক নড়ে। ভেজা চোখে সূর্যের ওপর থেকে নজর আকাশের ওপর নিবদ্ধ করে। উল্টোদিকে ফিরে আকাশ হাতের উল্টোপিটে চোখ মুছছে। এই লোকটিকে অহনা এই প্রথম কাঁদতে দেখলো। শুধুমাত্র তার জন্য। সূর্য দৃঢ় গলায় ফের বলে,
‘আপনি আমার রূপেগুনে মুগ্ধ হয়েছেন। কিন্তু ভাইয়ার ভালোবাসা দেখেও বুঝলেন না। ভাইয়া আপনার জন্য নিঃসন্তান থাকতে প্রস্তুত তবুও আপনাকে ত্যাগ করতে সে রাজি না। চাইলেই দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারতো। তবে ভালোবাসা নামক একটা বাক্য আছে। ভাইয়া ভীষণ ভালোবাসে আপনাকে। বাঁজা নারী সমাজে উঁচু ভাবে চলতে পারে না। নিঃস্বার্থে ভাইয়া এই বিষয়টি লুগিয়েছে সবার এবং আপনার থেকে। আব্বা পর্যন্ত জানে না। ভাইয়ার মতো এমন মহাপুরুষের সংখ্যা সমাজে খুবই কম রয়েছে। আমি ভাগ্য করে এমন বড়ো ভাই পেয়েছি। ভাইয়াকে পেয়ে নিজেকে যদি এতটা ভাগ্যবান, গর্বিত মনে করি। তাহলে আপনি কতটা ভাগ্যবতী নারী ভাবুন। সব কিছুর শেষ রয়েছে। আমি চাই আপনার চিন্তাদ্বারা পরিবর্তন হোক। ভুল পথ থেকে বেরিয়ে আসুন।’ সূর্য বাকি কথাগুলো বলে আকাশের হাত ধরে টেনে বাহিরে বেরিয়ে গেল। রয়ে গেল শুধু অহনা ও কুয়াশা। ফ্লোরে বসে আছে সৃষ্টি নিচু করে। এক পা দু পা করে এগিয়ে গেল অহনার নিকট কুয়াশা। হাঁটু গেড়ে কাছে বসে কাঁধে হাত রেখে নরম গলায় বলল,
‘ভাবি তুমি ভুল নও, ভুল তোমার চিন্তাভাবনা, তোমার পদক্ষেপ। তোমার ভেতরে এতদিন যে ভালো মানুষটিকে আমি দেখেছি। তাকে একবার জিজ্ঞেস করো, তুমি কতটা ভুল ছিলে। জানো ভাবি, আমরা দু’জন অনেক ভাগ্যবতী। এমন স্বামী আমাদের জীবনে এসেছে যাদের নিয়ে এক জনম কেন, সাত জমন বলে যদি কিছু থাকে নিঃসন্দেহে পাড়ি জমাতে পারবো। একটা সুযোগই কেবল মানুষের জীবনে আসে না। তুমি চাইলে এখনো সব কিছু পরিবর্তন করতে পারে। নারী যেমন ধ্বংসের লীলা দেখায়, আবার বিনাশও ঘটাতে পারে। তোমার প্রতি আমার ভেতরে যে শ্রদ্ধা – সম্মান আছে সেটা এখনো বজায় রয়েছে। চলো না ভাবি আগের মতো দু’জনে সংসারের হাল ধরি। শেষ থেকেই না হয় শুরু করি।’
অহনা হাউমাউ করে কেঁদে কুয়াশাকে ঝাপটে ধরে। এত এত ভালো মানুষগুলোর সাথে সে বড্ড অন্যায় করেছে, ভেবে নিজেকে শেষ করে দিতে মন চাইছে তার। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
‘আমি বড্ড অন্যায় করে ফেলেছি রে কুয়াশা। ক্ষমার অযোগ্য। কীভাবে আমি তার কাছে ক্ষমা চাইবো? কোন মুখ নিয়ে আকাশ, সূর্য, আব্বার সামনে দাঁড়াব। কোন মুখ নিয়ে? তুই কী আমায় ক্ষমা করবি?’
কুয়াশাকে ঝাঁকিয়ে প্রশ্নটি করল অহনা। কুয়াশা কান্নারত নয়নে অহনার চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলল,
‘মানুষ মাত্রই ভুল। তারা তোমায় ঠিকিই ক্ষমা করবে। তোমার ওপর আমার কোনো রাগ-ক্ষোভ নেই। আগের ন্যায় শ্রদ্ধেয় বড়ো ভাবি তুমি।’
অহনা আরো জোরে কেঁদে উঠে কুয়াশাকে জড়িয়ে রাখে। সে আজ অনুতপ্ত। প্রচণ্ড অনুতপ্ত!
তিন বছর পর….
সন্ধ্যার লগ্নে মাগরিবের আজানের সময়কালীন কুয়াশার দুই জময ছেলের জন্ম হয়। আনন্দে বিমোহিত পরিবারপরিজন। সূর্য বাবার হবার আনন্দে আবেগে কেঁদে ফেলেছে। অহনা এক প্রান্তে উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজ এই খুশির মুহূর্তে সেদিনের কথা স্মরন করছে সে। সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে এ বাড়ি ত্যাগ করতে চেয়েছিল। কিন্তু আকাশ তার ভালোবাসায় পুনরায় একই ভাবে তাকে আগলে রেখেছে। অহনার থেকে বিচ্ছেদ হয়নি। পুরোপুরিভাবে আগের ন্যায় তাকে অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গ্রহণ করেছে। অহনা নিজেকে পুরোপুরি পাল্টে ফেলে। পরিবর্তন করে ফেলে তার চিন্তাভাবনা। অসৎ ভালোবাসাকে হৃদয় থেকে ত্যাগ করে। আকাশকে তার জীবনের শেষটা দিয়ে ভালোবাসার শপথ নেয়। নিঃস্বার্থ ভাবে সবার প্রতি বড়ো বউয়ের দায়িত্ব পালন করেছে। ত্রুটি ছিল না কোনো। তবে সে ভেতরে ভেতরে জ্বলেপুড়ে ক্ষণে ক্ষণে ছাঁইতে পরিনত হচ্ছিল।
সন্তান বিহীন একটি নারীর জীবন কতটা কঠিক। এটা তারাই কেবল বুঝবে যারা এরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। বহুবার বলেছিল দ্বিতীয় বিয়ে করতে। তবে আকাশ অহনাতেই সীমাবদ্ধ! এক বানী তার।
একা দাঁড়িয়ে আছে থেকে আকাশ অহনার নিকটে এলো। উদাসীন মুখশ্রী দেখে আকাশ আলতোভাবে অহনার হাতের ভাজে হাত রাখলো। আকাশের চোখের পানে তাকাতেই স্নান হাসে সে। তার দৃঢ় ব্যথা আকাশ বোঝার ক্ষমতা রাখে। তারও যে একই কষ্ট অনুভব হচ্ছে সেটা অহনাকে বুঝতে দেয় না।
কুয়াশাকে বেডে দেওয়া হয়। দু ছেলেকে তুলে দেওয়া হয় চাচা ও দাদার কাছে। সূর্য কুয়াশার পাশে বসে ক্যানেলার লাগানো হাত ধরে রেখেছে। টিমটিম নয়নে সূর্যকে দেখে কার্ণিশ বেয়ে অশ্রু ঝড়ে তার। মুচকি হাসি প্রধান করে সূয। মাথায় আলতো হাত বুঝিয়ে বলে,
‘আমায় তুমি আজ যে সুখ দিয়েছো। চিরজীবন কৃতজ্ঞ থাকব কুয়াশা।’
মৃদু হাসি প্রধান করে কুয়াশা। দু ছেলেকে কোলে নিয়ে এলো সকলে। একজনকে কুয়াশার পাশে শুইয়ে, অপর জনকে কোলে নেয় সূর্য। কুয়াশা উঠার চেষ্টা করলে আলিফ ও আব্দুল হাকিম উঠে বসায়। আলতো ভাবে ছেলেকে কোলে নিয়ে চুমুতে ভরিয়ে দেয় মুখশ্রী। চোখ তুলে সূর্যের পানে চেয়ে বলল,
‘আপনার কাছে আজ আমি একটি জিনিস চাইবো। দিবেন?’
সূর্য ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল,
‘শুধু বলে দেখো।’
কুয়াশা আকাশ ও অহনার পানে তাকায়। ছলছল নয়নে শুধায়,
‘আজ থেকে ও তোমাদের ছেলে। আকাশ ভাইয়া, অহনা আপুর ছেলে। তোমার ছোট বোনের ছোট্ট উপহার আশা করি গ্রহন করবে।’
থমকে গেল সকলে। নিরব পুরো কেবিন। কুয়াশার এত বড়ো ত্যাগে যেন সবাই বিস্মিত। অহনা ঠোঁটে হাসি ফুটন্ত অবস্থায় কেঁদে ফেলে। আকাশ সেকেন্ড কয়েক চেয়ে থেকে অন্য প্রান্তে চেয়ে চোখের জল মুছে। সূর্য হেসে হেসে বলল,
‘কুয়াশা তুমি আমার মনের অনাকাঙ্ক্ষিত ইচ্ছে কীভাবে বুঝলে, জানি না। আই এম সো লাকি!’ সকলের সামনেই কুয়াশার কপালে আলতো চুমু এঁকে দেয় সূর্য।
অহনা কোলে তুলে নেয় কুয়াশার কোল থেকে। কান্না জড়িত গলায় বলল,
‘আমাদের মা-বাবা হবার ভাগ্য তুমি আমাদের করে দিলে। অনেক বড়ো মন তোমাদের। কৃতজ্ঞ তোমাদের কাছে।’
কুয়াশা হাসে। কুয়াশা ও সূর্যের দয়ালুপনায় সবাই বেশ আনন্দিত। সূর্য বলে,
‘ভাইয়া তোমাদের ছেলে যেন আমাদের ছেলেকে বড়ো হলে না বকে বা মা’রা’মা’রি করে। যত্নসহকারে ট্রেনিং দিবে।’
সবাই হেসে ফেলে। এরূপ সুন্দর দৃশ্যটি আলিফ তার ফোনের ক্যামেরায় ভিডিও আকারে ধারণ করে। কুয়াশার আড়াল থেকে সূর্যের প্রভাব পুরোপুরিভাবে পরিবারের ওপর উষ্ণতা ছড়িয়ে উজ্জ্বল করে তুলেছে এবার। পরিপূর্ণ তাদের পরিবার।
সমাপ্ত।
®সুমাইয়া মনি