কুয়াশার আড়ালে সূর্য পর্ব-১০

0
634

কুয়াশার আড়ালে সূর্য

১০.
টানা এক মাস যাবত সূর্য কাজে ব্যস্ত ছিল। কুয়াশাকে সময় দেওয়া আর হয়ে উঠে না। আকাশ এখনো অসুস্থ। দু সপ্তাহ হাসপাতালেও থেকে পরশুদিন বাড়িতে এসেছে। শফিকুল ইসলাম তিনিও এখন বসে নেই। ছোট ছেলের এত খাটনি যাচ্ছে দেখে তিনিও যথাসম্ভব সাহায্য করছে। এত বড়ো কোম্পানি একা হাতে সামলানো চারটে খানের কথা না। বায়ারদের সাথে মিটিং শেষে বেরিয়ে আসতেই কুয়াশার কল আসলো। একটু দূরে এসে ফোন ধরে,
‘বলো কুইন।’
‘আব্বু আমাদের যেতে বলেছে।’
‘এক কাজ করো আলিফকে আসতে বলো। ওর সাথে চলে যাও। দু দিন থেকে এসো।’
‘আপনি যাবেন না?’
‘আমি বরং তোমাকে নিতে যাব।’
‘কবে?’
‘আজ বুধবার, শুক্রবার যাব।’
‘তাহলে কী আমি আলিফকে আসতে বলল?’
‘ওয়েট আমি বলে দিচ্ছি। তুমি রেডি হও।’
‘আচ্ছা। শুনেন?’
‘হুম কুইন।’
‘খেয়ে নিবেন দুপুরে।’
‘ওকে মাই কুইন।’ মুচকি হেসে কথাটা বলে ফোন রেখে দেয় সূর্য। কুয়াশাও মৃদু হাসে। আলিফের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাড়িতে আসতে বলে সূর্য। বারোটার দিকে কুয়াশাকে নিয়ে যায় আলিফ। যাবার সময় সূর্যের সঙ্গে দেখা হয়নি বলে কুয়াশার কিছুটা মনঃক্ষুণ্ন হয়। কীভাবে যেন মানুষটি তার অন্তরে জায়গা করে নিয়েছে। দূরে যাচ্ছে বলেই সেটি অনুভব করতে পারছে সে।
ভাবতে ভাবতে গাড়িতে হেলায় দেয় কুয়াশা। কয়েক মিনিট অতিবাহিত হবার পর বাড়িতে পৌঁছায়। পরিবারের সবাইকে দেখে সে-কি খুশি কুয়াশা। সহিসালামত ভাবে বাড়িতে পৌঁছেছে সেই বার্তা সূর্যকে পাঠিয়ে দেয়।
মিটিংয়ের এক ফাঁকে কুয়াশার বার্তা সূর্য সিন করে। লাঞ্চ টাইম নিজের কেবিনে বসেই খাচ্ছিল। সে-ই সময়ে হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও কল দেয় কুয়াশাকে। দাদীর কোলে মাথা রেখে শুয়েছিল। সূর্যকে নিয়ে নানান রকমের গল্প করছিল। হঠাৎ কল পেয়ে উঠে বসে দ্রুত রিসিভ করে।
‘কী করছো কুইন?’
‘কিছু না।’
‘খেয়েছো?’ মুখে খাবার পুরে ফের জিজ্ঞেস করল।
‘হ্যাঁ।’
‘আমি খাচ্ছি। খাবে?’
‘উঁহু!’ বলে এদিক সেদিক মাথা দুলায়।
‘তুমি বাড়িতে নেই মনে পড়লেই যেতে ইচ্ছে করে না।’
‘আহারে। তাহলে আমাদের বাড়িতে আসো নাতি জামাই।’ পাশ থেকে সাদিনা বিবি বললেন সূর্যের উদ্দেশ্যে।
‘হেই দাদী, হাউ আর ইউ?’ হেসে হেসে বলল।
‘ভালো। তুমি কেমন আছো?’
‘ভালো না। তোমার নাতনি আমায় ভালোবাসে না।’ অভিযোগ স্বরে বলল সূর্য।
‘তুমি পারো না ভালোবাসা আদায় করে নিতে।’
‘তোমার জন বুঝি এমন করেছিল?’ দুষ্টুমির ছলে জিজ্ঞেস করে।
‘হুম, এজন্যই তো বললাম। ভালোবাসা জোর করে আদায় করে নিতে হয়।’
‘ওকে, তাহলে আমিও তাই করব।’
কুয়াশা লজ্জা পেয়ে ফোন দাদীর হাতে দিয়ে বাহিরে চলে গেল। তাদের কথার মধ্যখানে থাকতে চায় না।
‘পালিয়েছে তোমার নাতনি।’
‘সরম পাইছে। তা তুমি কিন্তু শুক্রবার এসো।’
‘ইনশাআল্লাহ! আসবো।’
‘রাখো তাহলে। খাও ঠিকমতো।’
‘আচ্ছা।’ সূর্য ফোন রেখে দিলে সাদিনা বিবি কুয়াশাকে হাঁকিয়ে ডাকলেন। তার নিকটে আসার পর তিনি বললেন,
‘বেডাগো কাছে টেনে নিতে হয়। দূরে দূরে থাকলে অন্য বেডিগো চক্করে পড়বো।’
‘আমার বেডা এরকম না।’ মুখ ভেঙচিয়ে বলল কুয়াশা।
‘হইতে কতক্ষণ। আমার কথা মাথায় রাখিস।’
‘পারব না। সরো আমি এখন ঘুমাবো।’
তিনি পাশে চেপে বসলেন। কুয়াশা বালিশে মাথা রাখলো।

আজ সন্ধ্যার আগে আগে বাড়ি ফিরেছে সূর্য। কাজের চাপ কম ছিল। বেশিক্ষণ বাড়িতে থাকেনি। আধাঘন্টা বাদে আকাশকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেছে বাহিরে। ফিরেছে রাত এগারোটায়। দু’জনে বাহির থেকে খেয়ে এসেছে।
এটা জানার সঙ্গে সঙ্গে অহনা দু ভাইয়ের ওপর গর্জে উঠলো।
‘আমি তাদের জন্য খাবার বেড়ে বসে আছি। তারা কি-না খেয়ে এসেছে।’
‘তোমার খাবার খাওয়ার চেয়ে না খাওয়াই উত্তম।’ কিছুটা রাগী গলায় শুধায় আকাশ। সূর্য আকাশের চোখের পানে তাকিয়ে ইশারায় কিছু একটা বোঝায়। অহনা আরো ক্ষে পে উঠল। বলল,
‘মানে? কী বলতে চাইছো?’
‘আপাতত তর্কবিতর্কে যাচ্ছি না। ঘুমাবো।’ বলেই প্রস্থান করে আকাশ। সূর্য বিনাবাক্যে রুমে চলে এলো। অহনা ওপরের দিকে শূন্যে মনঃকষ্টে তাকিয়ে রইলো। আকাশের এরূপ কথায় সে ভীষণ পীড়িত।
__
মাঝখানে একদিন অতিবাহিত হবার পর শুক্রবার সকালের দিকে সূর্য কুয়াশাদের বাড়িতে এসেছে। চা-নাস্তা খাবার পর সূর্য কুয়াশার রুমে এসে বিছানায় বসল। অপেক্ষা করছে কখন কুয়াশা রুমে আসবে। তার অপেক্ষার অবসান ঘটে, আধাঘন্টা পর কুয়াশা রুমে এলো। সূর্য দ্রুতই কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে। হতবাক সে! সূর্য নরম স্বরে বলল,
‘এক দিন তোমায় ছেড়ে থাকা আমার জন্য প্রচুর কষ্টকর ব্যাপার কুয়াশা।’
কি বলতে ভেবে পাচ্ছে না সে। লজ্জায় জড়িয়েও নিতে পারছে না তাকে। অবশ্য সে-ও প্রচুর মিস করেছে তাকে।
‘কবে তুমি আমায় বুঝবে।’ কুয়াশার দু গালে হাত রেখে বলল সূর্য। তার নরম নেশারু চোখের চাহনি উপেক্ষা করতে পারে না কুয়াশা। পলকহীন নয়নে চেয়ে থাকে। এক ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত সৃষ্টি হয়। সূর্য কুয়াশার খুব কাছাকাছি আসার পূর্বেই ছেড়ে দেয়। ম্লান হেসে বলে,
‘যেদিন তুমি মন থেকে ভালোবেসে মেনে নিবে। সেদিনই আপন করে জড়িয়ে নিবো আমার ভালোবাসা দিয়ে তোমায়।’ কপালে চুমু দিয়ে আগের ন্যায় বিছানায় বসল। কুশায়া দ্রুত পায় রুম থেকে বেরিয়ে গেল। দাদীর রুম এসে বড়ো বড়ো নিশ্বাস ফেলে আয়নার পানে তাকিয়ে নিজেকে দেখছে। সূর্যের কাছাকাছি আসার দরুন নার্ভাসনেস পুরোপুরি তাকে ঘিরে ধরেছে। মুচকি হাসি দেখা গেল তার ঠোঁটে। আস্তেধীরে সে-ও ভালোবেসে ফেলেছে তাকে। শুধু বলার অপেক্ষা। নিজেকে ধাতস্থ করে রান্না ঘরে এলো। দুপুরে একত্রে খেতে বসে সবাই। খাওয়াদাওয়ার পর সূর্য সবাইকে নিয়ে নন্দন পার্কে ঘুরতে আসে।

রাতে বাড়ি ফিরে সবাই ঘুমাতে যায়। কেননা বাহির থেকে সবাই খেয়ে এসেছে। সূর্য জোরপূর্বক সকলকে খাইয়েছে। ঘুমানোর পূর্বে সাদিনা বিবি তাদের কক্ষে এলো। দু’জনকে পাশাপাশি বসিয়ে তিনি বললেন,
‘আমায় যখন প্রথম বাসর হয়েছিল। দাদী আমায় সুন্দর ভাবে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বুঝিয়ে বলেছিল। দাম্পত্যজীবন আল্লাহর অশেষ নিয়ামত। পরিস্থিতি যাই হোক না কেন একজন যেনো আরেকজনকে কখনো ছেড়ে না যান সেই পরিমাণ মজবুত হতে হবে সম্পর্কের ভিত তোমাদের। বিবাহিত জীবনে স্বামী স্ত্রীর মাঝে শারীরিক সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বামী স্ত্রীর মাঝে যে শারীরিক সম্পর্ক হয়ে থাকে তা সদকা সরূপ। আমি চাই তোমাদের মধ্যকার সম্পর্ক আর চারটে সম্পর্কের মতোই সুন্দর হোক। দৃঢ় বন্ধন তৈরি হোক তোমাদের।’ বলতে বলতে দু’জনার হাত একত্রিত করে দিয়ে তিনি বেরিয়ে গেল। ত্রিশ সেকেন্ড অতিবাহিত হবার পরও সূর্য হাত ছাড়ে না। কুয়াশা হাত ছাড়ানোর জন্য সূর্যের চোখের পানে তাকিয়ে দেখে সে হাসছে। বলে,
‘দাদী কী বলল বুঝোনি?’
কুয়াশা নজর সরিয়ে নিয়ে নিচু গলায় বলল,
‘আমি সব কিছুর জন্য প্রস্তুত আছি। আপনি আপনার অধিকার বুঝে নিতে পারেন।’
‘উঁহু! আগে আমায় ভালোবাসতে হবে।’ এদিক সেদিক মাথা নাড়িয়ে বলল।
‘যদি বলি ভালোবাসি।’ কথাটা বলেই মুচকি হেসে চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেলে সে। লজ্জায় গরম হয়ে গেছে তার সর্বাঙ্গ। সূর্য দুষ্টুমি করে এক প্রকার জোরেসোরে বলল,
‘জলদি দরজা বন্ধ করো।’
কুয়াশা উঁচু স্বরে হেসে ফেলে। সূর্যও হাসে। এক পর্যায়ে কুয়াশার উষ্ণ ওষ্ঠদ্বয়ে তার ওষ্ঠ জোড়া রাখল। ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হয় তাঁদের বন্ধন। হালকা কুয়াশার আড়ালে এবার চাঁদ ঢা’কা পড়ে।

চলবে?

®সুমাইয়া মনি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে