কুয়াশার আড়ালে সূর্য পর্ব-০১

0
979

কুয়াশার আড়ালে সূর্য
®সুমাইয়া মনি

১.
একজন ডিভোর্সি নারী সমাজের চোখে অপয়ার সমতুল্য।
ডিভোর্সের পর পুনরায় প্রাক্তন স্বামীর কাছ থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসা স্বাভাবিক নয় বরঞ্চ অস্বাভাবিক ব্যাপার। কুয়াশা স্থির হয়ে নিজ কক্ষে বসে বাহিরের আলোচনা শুনছে। বিয়ের এক বছর অন্তিম হতে না হতেই ডিভোর্সের কাগজ হাতে বাবার বাড়িতে ফিরতে হয়। আজ এক বছর অতিবাহিত হবার পর ফের আহাদের সাথে দেখা। সেবার প্রথম দেখা সাক্ষাৎতে কুয়াশার বেশ মনে ধরেছিল আহাদকে। ভেবেছিল স্বামী হিসেবে সে পুরোপুরি উপযুক্ত। এক বুক আশা নিয়ে ছোট্ট সংসার বাঁধার স্বপ্নে নতুন বাড়িতে পা রেখেছিল কুয়াশা। মাস পেরোতেই স্বপ্নে অভিশাপ যুক্ত হয়েছে। প্রথম দিন থেকেই আহাদ স্ত্রীর মর্যাদা থেকে তাকে বঞ্চিত করে নতুন সম্পর্কে আসক্ত হয়ে পড়েছে। দিনকে দিন আহাদের অবহেলা, অবজ্ঞা পেয়েও কাটিয়েছে কয়েকটি মাস। ভাগ্য শেষ অব্ধি সঙ্গে ছিল না। ডিভোর্সির তালিকায় নামটা তুলেই গেল। আজ চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে সকলকে ‘আমি কোনো খেলনাপাতি নই! যে বাড়িতে শেষ নিশ্বাস অব্ধি থাকার শপথ নিয়েছিলাম। সেখান থেকেই মুখপোড়ার অপবাদ নিয়ে ফিরতে হয়েছে। এখন সেই একই বন্ধনে বাঁধার প্রস্তাব দিচ্ছে, কেন?’ কুয়াশার অন্তরে চাপা আর্তনাদ মুখে প্রকাশ করার সাধ্য নেই। সে নিরুপায়, অসহায়, হৃদয়গত এক নারী। টুপটাপ চোখের পানি টাইলসের ওপর জমাটবদ্ধ হচ্ছে। মাথায় কারো নরম স্পর্শ পেয়ে চোখ তুলে দাদীকে দেখে খুব জোরে ঝাপটে ধরে।
মাঘের এক শীতে ঘন কুয়াশাজড়ানো রাতকে ভেদ করে সূর্যোদয়ের প্রহরে ভূমিষ্ট হয়েছিল তার বড়ো ছেলের ঘরে বড়ো সন্তান। শখ করে নাম রেখেছিল কুয়াশা। তবে তার জীবন যে কুয়াশায় মোড়ানো রাতের মতোই অন্ধকার ছেঁয়ে যাবে কেই বা জানতো। ভেবেই সাদিনা বিবি নাতনির মাথায় হাত বুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
‘বাবা আমি ভুল করেছি কুয়াশাকে ত্যাগ করে। ডায়মন্ডের পিছনে ছুটতে গিয়ে নিকটবর্তী হীরাকে আমি পায়ে ঠেলে দিয়েছি। আমি বড্ড ভুল করেছি। তাই প্রাশচিত্ত করতে চাইছি। আমাকে কী একটা সুযোগ দেওয়া যায় না?’ আহাদ অনুতপ্ত সুরে কুয়াশার বাবা হাকিম সাহেবের নিকটে বললেন।
এতক্ষণ আহাদের বাবার ও মায়ের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন। এখন আহাদের কথা শুনে তিনি বেশ বিচলিত হয়ে গেলেন। কপোলে তার চিন্তিত ভাজ। কুয়াশার ডিভোর্সের পর সবার মুখেই বিচ্ছেদের কারণ জানতে চেয়েছিলেন। তিনি সঠিক কারণ পেশ করতে পারেন নি। যে কোনো অনুষ্ঠানে লোকমুখে তার বড়ো মেয়ের নামে কটুকথা শুনতে হয়েছে। তিনি যথেষ্ট সম্মানিত ব্যক্তির কাতারে নিয়োজিত। মেয়ের ডিভোর্সের ফলে তিনি প্রায় বড়ো-ছোট অনুষ্ঠানে যোগদান ছেড়ে দিয়েছেন। শুধু তার ক্ষেত্রে এমনটা হয়েছে তা নয়। বিভিন্নভাবে তার স্ত্রীকেও কটুবাক্য শুনতে হয়েছে। পরিশেষে দ্বিতীয় বারের বিয়ের জন্য হিল্লা বিয়ের প্রসংগ তো রয়েছেই।
আহাদের বাবা ওসমান মিয়া তার চিন্তিত ভাব কাটিয়ে আশ্বাস দিয়ে বললেন,
‘ভাইসাব আপনি চিন্তা করবেন না। আমি হিল্লা বিয়ের জন্য ছেলে ঠিক করে রেখেছি। আজ বিয়ে হলে কাল তাদের বিচ্ছেদের পর আবার আমরা আহাদের সাথে কুয়াশার বিয়ে দেবো। শুধু আপনি রাজি হয়ে যান।’
তিনি এতক্ষণ এই বিষয়টি নিয়েই বেশি চিন্তিত ছিল। উত্কণ্ঠিত স্বরে বলল,
‘ছেলে কে? সে কী বিবাহিত?’
‘অবিবাহিত। আপনি কী রাজি আছেন?’
ওসমান মিয়ার কথায় সহমত পোষণ করে তিনি বললেন,
‘হ্যাঁ।’
আহাদের পরিবাবের সবাই খুশি হলেন। ওসমান মিয়া জানালেন,
‘আমি কালই ছেলেকে আপনার বাড়িতে আহাদের সঙ্গে পাঠাবো। আজ তাহলে ওঠি আমরা। তবে আপনার কাছে চির কৃতজ্ঞ। আপনি যে এত সহজে মেনে নিবেন আহাদ-কুয়াশার বিয়েটা বুঝিনি।’
‘তবে আমার শর্ত আছে। ছেলে যদি পছন্দ হয় তবেই আমি কুয়াশার সঙ্গে হিল্লা বিয়ের জন্য রাজি হবো।’
‘ঠিক আছে। আপনি নিজ থেকেই কাল পরক করে দেখে নিবেন ছেলে কেমন।’
তিনি মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালেন। তারা বেরিয়ে গেলেন বাড়ি থেকে। আহাদ নিচে নেমে কুয়াশার বেলকনির মানে এক পলক তাকালেন এ আশায় যদি দেখা মিলতো কাঙ্ক্ষিত মানুষটির। কিঞ্চিৎ নিরাশ হয়ে টেক্সিতে উঠে রওয়ানা হলেন। কুয়াশা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে পর্দার আড়ালে প্রাক্তন স্বামীর যাওয়া দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। সে বিশ্বাস রেখেছিল একদিন ঠিক আহাদ ফিরবে তার জীবনে। তার কদর বুঝবে। সে আশাহত হয়নি!
বালিশে মুখ লুকিয়ে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। আজ যেন তার ভীষণ খুশি হওয়ার দিন। চোখ মুছে নিলেন। এত সহজে সব ভুলে গেলে চলবে না। যতটুকু দুঃখ তাকে পেতে হয়েছে, সব সুদে-আসলে ফিরিয়ে দিতে হবে বলে মনস্থির করে কুয়াশা। এখন রইলো দ্বিতীয় মানুষটির কথা। যার সঙ্গে দ্বিতীয় বারের ন্যায় হিল্লা বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হতে চলেছে সে।

‘আপনি হুটহাট রাজি হলেন কেন? একবারও কী মেয়ের ব্যাপারে ভাবলেন না? দ্বিতীয় বার বিয়ে দেওয়া কী আদৌও ঠিক হবে?’ কুয়াশার মা চম্পা খাতুন প্রখরতার সুরে বললেন স্বামীর উদ্দেশ্যে।
‘ভেবেই সব সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সমাজে সবার নজরে ডিভোর্সি মেয়ের বাবা হিসেবে প্রচলিত আমি। এতে আমার সম্মানে কতোটা আঘাত এসেছে তোমরা বুঝবে না। এখন যদি আবার আহাদের সঙ্গে কুয়াশার বিয়ে হয় আমি উঁচু গলায় বলতে পারবো আমার মেয়ের কোনো দোষ ছিল না। নিজ থেকেই ছেলেপক্ষরা এসে বিয়ের জন্য আবার ধরা দিয়েছে। আমার সম্মান সুস্থতা নিশ্চিত।’
‘সম্মানের সুস্থতা ফিরিয়ে আনতে আপনি নিজেই অসুস্থ মস্তিষ্কের কাজ করতে চলেছেন। হিল্লা বিয়ের কোনো রেওয়াজ ইসলামের শরিয়তে নেই। এটি সম্পূর্ণ হারাম। রইলো কুয়াশার কথা। একবারও মেয়েকে জিজ্ঞেস করেছেন ও কী চায়? বা আদৌও বিয়েতে রাজি আছে কি-না?’
‘আমার মেয়ে, আমার কথার খেলাফত করবে না। আমি নিশ্চিত! কালই তার উত্তর তুমি পেয়ে যাবে।’ কথাগুলো উগ্রভাবে বলে হনহনিয়ে চলে গেলেন তার কক্ষে। মলিন মুখে তিনি শূন্যে তাকিয়ে রইলেন। মেয়ের চেয়ে সম্মানের কদর যার বেশি সে কতটুকু সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ তার জানা আছে।
__
‘বাবা আব্বাসকে তুমি বিয়ের কথা জানিয়েছো?’ আহাদ তার বাবার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লেন।
‘বলিনি। বাড়িতে ফিরে ওর সাথে কথা বলব। ভুলেও তাদের প্রকাশ করা যাবে না আব্বাস আমাদের বাড়ির চাকর। আমাদের দুঃসম্পর্কের আত্মীয় বলল।’
‘আমরা কী তাদের বেশিই ঠকিয়ে ফেলছি না। এটা আমাদের উচিত না।’ তার অর্ধাঙ্গিনী সায়মা বানু সরস স্বরে কথাটা বললেন। তিনি শুনেই নাকমুখ কুঁচকে ছেৎ করে বললেন,
‘এত বেশি কথা বলো কেন তুমি? সব তোমার ছেলের জন্য হয়েছে। চেয়েছিলাম কী আর পেলাম কী? ইরিনাকে তো হাতছাড়া করল। এখন আবার কুয়াশাকে হাতছাড়া করতে চাইনা। যে-ভাবে হোক বিয়েটা দিতে চাই ওদের।’
সায়মা বানু স্বামীর এরূপ নির্দয়তা কথাবার্তা শুনে অসহায়ত্ব নিশ্বাস ফেললেন। মানুষ যে টাকা-সম্পত্তির লোভে এতটা নিচু হতে পারে চাক্ষুষ উদাহরণ স্বামী ও ছেলে!
আধাঘন্টা বাদে বাড়িতে ফিরলেন। জরিনাকে হাঁকিয়ে ডেকে আব্বাসকে ডাকার নির্দেশ দিলেন ওসমান মিয়া। কিছুক্ষণ অতিবাহিত হবার পর একজন কম বয়সী যুবক তাদের নিকটে এসে দাঁড়ায়। তীর্যক নয়নে আপাদমস্তক যুবকে দেখে নিলেন তারা। ঢিলাঢালা খয়েরী রঙের শার্ট এবং টাকনুর ওপরে লুঙ্গি পরিহিত যুবকের ঠোঁটে সৌজন্যসূচক হাসি। গায়ের রং কালো। তবে চেহারার কাঠিন যথেষ্ট সুদর্শন যেটা হাসির মাধ্যমে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। ওসমান মিয়া মুখ বাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,
‘তুই কে? আব্বাস কোথায়?’
যুবকটি এক গাল হেসে জবাব দিলো,
‘আব্বাসের মেলা জ্বর উঠছে। ডাক্তারে কইলো টাইফড হইছে। আমি ওর আপনা বন্ধু। হেইতে ওর হইয়া কাজটাজ করতে আপনেগো বাইত্তে আইছি। যদি আমারে মনে না ধরে, কন চইল্লা যামু।’
‘ঠিক আছে, যাবার প্রয়োজন নেই। কিন্তু এ মুহূর্তে আব্বাসকে ভীষণ দরকার।’ আহাদ বাবার পানে চেয়ে নিরাশার প্রশ্বাস নিয়ে বলল। কথাটা শুনেই গমগমে গলায় যুবকটি বলল,
‘কী দরকার আমারে কন খালি। আমি বেক কাম করতে পারি। আব্বাসের লইগ্গা তো সব পারুম।’
‘একটা উপকার করতে হবে তোকে। বিনিময়ে টাকা দিবো।’ ওসমান মিয়া নিচু গলায় বলল।
‘পয়সা পাইলে আমি বেবাক কাজে রাজি। খুইল্লা কন কী করতে হইবো।’ কনফিডেন্স নিয়ে বলল সে।
‘আগে বল তোর নাম কী?’
‘বাপ-দাদায় নাম দিছে উদয়। তয় সূর্য উদয় ছাড়া টাকা কামাইয়ের বিশাল উদয় এহন তামাত দেখলাম না।’ আফসোস সুরে বলল।
‘এবার দেখবি।’ ওসমান মিয়া তাচ্ছিল্য হেসে উত্তর দিলো।

#চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে