কিছু সমাপ্ত পূর্ণতার (পর্ব – ৫)
সুমাইয়া আক্তার
__________________
হাসপাতালের বাইরে একটা কফিশপে টলছে তানজিম। শরীরে তার মোটা জ্যাকেট। টেবিলে থাকা ব্ল্যাক কফির মগে দু’পাশে দুই হাত রেখে আদ্রতা নিচ্ছে সে। বাইরে অল্প করে হাওয়া বইছে। আকাশটাও গুমোট মেরে আছে। এই শীতে যদি এক পশলা বৃষ্টি হয় তবে কথাই নেই! আরও ভারি পোশাক পরতে হবে। বুটজোড়া ঘষাঘষি করে কফিতে চুমুক দিল সে। কাচের দেওয়াল ভেদ করে ডান পাশের উচ্চ ভবনের মতো আলোকিত হাসপাতালের দিকে তাকাল। বিল্ডিংয়ের মানুষের কথা এড়াতে আর সৌজন্যতার খাতিরে আশফিয়ার সাথে এসেছে সে। নাহিদা এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে আশফিয়াকে একা এভাবে ছেড়ে দিলে যে নাহিদা নিজেই খারাপ পরিস্থিতি দাঁড় করাতো, তা তানজিম অনুমান করেছে। শেষমেশ এলো সে। তবে আশফিয়ার পাশাপাশি থাকতে ইচ্ছে করছে না। তার সংসারে আগুন লাগানো মেয়েটার খারাপ হোক—সেই চাওয়াই যেন তানজিমের। বেশ অনেকক্ষণ হয়ে গেল। এবার ফেরা দরকার ভেবে উঠে দাঁড়াল সে।
হাসপাতালে ঢুকতেই কাউন্টারে থাকা মেয়েটি বলে উঠল, ‘আপনি তানজিম হাসান না? আপনাকে ডাক্টার কতক্ষণ থেকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। পেশেন্ট রেখে এভাবে উধাও হয়ে গেলেন কোথায়? যান, গিয়ে ডাক্টারের সাথে দেখা করুন।’
অস্বস্তি হলো তানজিমের। সে খুব শান্ত থেকে জিজ্ঞাসা করল, ‘ডাক্টারের রুমটা কোন দিকে?’
‘সোজা গিয়ে ডান দিক ফিরে চতুর্থ নম্বর রুমটি।’
‘ধন্যবাদ।’
ডাক্টারের ঘরের দরজায় আঘাত করল তানজিম। ভেতর থেকে জবাব এলো, ‘আসুন।’
তানজিম ঘরে ঢুকে দেখল, ডাক্টার কিছু কাগজপত্র ঘাঁটছেন। নেমপ্লেটে তার নাম শোভা পাচ্ছে ‘আব্দুল মোস্তফা’। তানজিমকে দেখে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি ঘণ্টা দুয়েক আগে একজন পেশেন্ট এনেছিলেন তাই না?’
‘জি ডাক্টার। আসলে বাইরে কিছু কাজ পড়ে গেছিল, সেজন্য আসতে পারিনি।’ মিথ্যা বলল তানজিম। ‘পেশেন্টের কী অবস্থা?’
তানজিম আশা করছে ডাক্টার এমন কিছু উত্তর দেবে যা তানজিমকে খুশি করবে। এই যেমন বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গেছে! এই হীন চিন্তা-ভাবনা মাথায় স্থান দিতে সংকোচ হচ্ছে না তানজিমের। বরং এরকম হলে ল্যাটা চুকে যাবে ভেবে স্বস্তি বোধ হচ্ছে তার।
ডাক্টার বললেন, ‘পেশেন্ট যে খুব ভালো আছেন, তা বলা যাবে না। তবে তিনি এখন মোটামুটি ভালো।’
অনেক্ষণ উশখুশ করে তানজিম বলল, ‘বাচ্চাটার কিছু হয়েছে কী?’
দ্বিতীয়বারের মতো ডাক্টার মুখ তুলে তানজিমকে দেখে নিলেন। তারপর দুই হাতের আঙুলগুলো একটা আরেকটার সাথে যুক্ত করে বললেন, ‘এটা কেমন প্রশ্নের ধরণ? মনে হচ্ছে স্ত্রী’র গর্ভের বাচ্চাটাকে আপনি চান না।’
‘না, না ডাক্টার। ওটা আমার বাচ্চা নয়।’
‘কিন্তু উনি তো তা’ই বললেন।’ তানজিমের নীরবতা দেখে ডাক্টার মুচকি হাসলেন। বললেন, ‘আর হ্যাঁ, বাচ্চাটার কোনো ক্ষতি হয়নি। একদম সুস্থ আছে। শুধু পেশেন্টের মাথা, আর পায়ে আঘাত লেগেছে। কিছুদিন সময় লাগবে ঠিক হতে। উনার সাথে আপনি এখন দেখা করতে পারেন। আসুন।’ কথা শেষে ডাক্টার দাঁড়ালেন।
তানজিমও দাঁড়িয়ে পড়ল। ডাক্টারের সাথে সাথে এলো আশফিয়ার রুমে।
আশফিয়া মরার মতো হাসপাতালের সাদা বিছানায় শুয়ে আছে। শরীরে ফিনফিনে কম্বল। চোখ বন্ধ। চোখের পাতা পিটপিট করছে—দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে জেগে আছে।
ডাক্টার আলতো সুরে ডাকলেন, ‘মিসেস, এখন কেমন অনুভব করছেন?’
চোখ খুলে প্রথমেই তানজিমের দিকে তাকাল আশফিয়া। তানজিম মহূর্তেই চোখ সরিয়ে নিল।
আশফিয়া খুব ধীরে ধীরে বলল, ‘এখন মোটামুটি ভালো লাগছে। আমি কবে সম্পূর্ণ সুস্থ হব?’
‘আপনাকে কালকেই ছেড়ে দেওয়া হবে। আশা করা যায়, এক সপ্তাহের মধ্যেই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবেন।’
তানজিম নিরব দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ডাক্টার তার সাথে হাত মিলিয়ে বলল, ‘চিন্তা করবেন না।’ দরজায় গিয়ে আবারও ফিরে এলেন ডাক্টার। তানজিমকে বললেন, ‘আপনি একটু আমার সাথে আসুন।’
ফের ডাক্টারের ঘরে এসে বসল তানজিম। ডাক্টার নির্দেশনা দিতে লাগলেন আশফিয়ার দেখাশোনার ব্যাপারে। কথায় কথায় তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনাদের বিয়ে হওয়া কতদিন হচ্ছে?’
তানজিম প্রচণ্ড উদাশ কণ্ঠে বলল, ‘ও আমার স্ত্রী নয় ডাক্টার—আমার কলেজফ্রেণ্ড।’
‘কী আশ্চর্য! উনি দাবি করছেন আপনি ওনার স্বামী, অথচ আপনি বলছেন, উনি আপনার স্ত্রী নন!’
‘ও হয়তো মজা করে বলেছে।’
‘এটা মজার বিষয় নয় তানজিম হাসান। ব্যাপারটা চাইলে আমাকে জানাতে পারেন।’
টেবিলে দুই হাত রেখে মুখ এগিয়ে নিয়ে তানজিম বলল, ‘আপনি কী আমাকে একটা সাহায্য করবেন?’
__________
বাড়িতে একা খুব খারাপ সময় পার করছে নাহিদা। আশফিয়ার অ্যাক্সিডেন্টের এক সপ্তাহ হয়ে গেল। আজ আরও একবার চেক-আপের জন্য গেছে সে। বাধ্য হয়ে যেতে হয়েছে তানজিমকেও। বিল্ডিংয়ের মানুষের মুখ বন্ধ করতে নাহিদাও আর কিছু করতে পারছে না। নিষ্ঠুর জীবনে সে টিকিট বিহীন দর্শক। শুধু দেখেই চলেছে, দেখেই চলেছে। আজকাল খুব বেশি কষ্ট হয়। তানজিমের উপর অভিমানে অভিমানে বোধহীন নাহিদা। শুধু পাশাপাশি শোয়া হয়, কিন্তু কথা হয় না। তানজিম কখনও জোর করে—নাহিদার মুখ থেকে একটা শব্দও বেরোয় না। চুপচাপ থেকে থেকে নাহিদা কাটখোট্টা হয়ে যাচ্ছে।
ছাদের দিকে পা বাড়ালো নাহিদা। ছাদে রঙবেরঙের টবে মসরোজ ফুলগাছের মেলা। ফুটেছে নানান রঙের ফুল। সেগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলে মনে এক প্রকার শান্তি আসে। সেজন্য ঘরের থেকে এখন তার ছাদ’ই বেশি প্রিয়। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে আশরাফিয়ার মতো পড়ে যাওয়ার ভাবনাটা মাথায় এলো নাহিদার। সিঁড়ি থেকে তারও পড়ে যাওয়া উচিৎ বলে মনে হচ্ছে। তবে আহত হতে নয়, একদম মৃতা হতে। এ জীবনে আর কী’ই-বা নিজের থাকল? মা-বাবাও বলছে মানিয়ে নিতে, ভাই জানলে বেশি অশান্তি হবে ভেবে তাকেও মন খুলে কিছু বলা যায় না। রইল তানজিম, সে’ই তো এখন…
ছাদে উঠে দোলনায় বসল নাহিদা। আকাশ সমান এক দীর্ঘশ্বাস বুক ফেটে এলো তার। আবছা দৃষ্টি টেনে ফেলল মসরোজের নানান রঙের সাজে। একসময় নাহিদাও এত সাজগোজ করত। মা জাফরিন নিজ হাতে সাজিয়ে দিতেন। মুখে হালকা প্রসাধনির ছোঁয়া, চোখে গাঢ় কাজল, কপালে ছোট্ট একটা কালো টিপ। নাহিদার ঠোঁট এমনিতেই রক্তিম দেখায়, তাই লিপস্টিক খুব একটা দিত না সে। অল্প সাজেই জাফরিন আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিতেন। নাহিদা যদিও নিজেকে দেখে কখনও মুগ্ধ হয়নি, কিন্তু আজকাল আয়নায় দাঁড়ালে যেমনটা অপছন্দ হয়—ততটা অসুন্দর সে ছিল না। জাফরিন শক্ত হাতে মেয়েকে আগলে রাখেন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তিনিও যে ভেঙে পড়েছেন তা জানে নাহিদা। তাই আগের মতো দিনে পাঁচ/সাতবার কল করা হয় না। জাফরিনের এক টুকরো কান্না বিজড়িত গলা শুনলে নাহিদা ভেঙে টুকরো হয়ে যাবে। আজকাল তানজিমের উপর খুব একটা রাগ হয় না। শুধু বিরক্ত হয়। রাগের অনুভূতি হয়তো লোপ পাচ্ছে ধীরে ধীরে।
দুপুরের আযানের সময় নিচে নেমে এলো নাহিদা। এতক্ষণে নিশ্চয়ই তানজিম আর আশফিয়া এসে গেছে। ফ্ল্যাটে গিয়ে আবারও একা নাহিদা। তারা এখনও ফেরেনি। সে সদর দরজাটা ভেজানোর তাগিদে চোখ বাইরে রাখতেই দেখল একজন তার দিকেই এগিয়ে আসছে। হাতে একটা খাম৷ সেটা বাড়িয়ে দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, ‘ডাক্টার পাঠিয়েছেন। এগুলো আপনার রিপোর্ট।’
‘ধন্যবাদ।’
ঘরে ঢুকে খামটা একপাশে ফেলে রাখল নাহিদা। কী মনে করে গত মাসে প্রেগন্যান্সি টেস্ট করিয়েছিল সে। এটার এখন আর প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। পজেটিভ হলেই বা কী আর নেগেটিভ হলেই বা কী!
নাহিদা বাথরুমে ঢোকার কিছু পরেই তানজিম আর আশফিয়া ফ্ল্যাটে ফিরল। আশফিয়ার জন্য কেনা ফলমূলগুলো সোফায় ফেলে দিল তানজিম। বলল, ‘এবার নিজের ঘরে গিয়ে আমাকে শান্তি দাও।’
আশফিয়া মলিন মুখে হাসার চেষ্টা করে ফলমূলগুলো হাতে নিয়ে ঘরে গেল। ফিরল কিছু টাকা নিয়ে৷ তানজিমের দিকে সেগুলো বাড়িয়ে বলল, ‘তোমার যতটুকু টাকা খরচ হয়েছে, তার সবটুকুই আছে এখানে।’
জুতার ফিতা খুলতেই থাকল তানজিম। কোনো উত্তর দিল না।
আশফিয়া টি-টেবিলে টাকাগুলো রেখে দিল, ‘এখানে রাখলাম।’
‘ভিখিরি মনে করো আমাকে?’
‘কী আশ্চর্য! ভিখিরি মনে করব কেন? এখন আমার কাছে টাকা আছে বলে দিচ্ছি। যখন থাকবে না, তখন তো বাচ্চার সবকিছুর দায়িত্ব তোমার।’
ডান পায়ের জুতো দেয়ালে ছুঁড়ে মারল তানজিম। সেই শব্দে আশফিয়া চমকে উঠল। দেখল, তানজিম প্রচণ্ড রেগে গেছে। চোখের পলকে টাকাগুলো তুলে কয়েক টুকরো করে আশফিয়ার মুখে ছুড়ল সে। মেঘের মতো গর্জে বলল, ‘খবরদার এসব কথা আমার সামনে বলবে না। জীবনটাকে নরক বানিয়ে রেখে দিয়েছ। তারউপর এসব ফালতু কথা! নিজের ঘরে যাও নইলে বেরিয়ে যাও ফ্ল্যাট থেকে।’ ঘরে চলে গেল তানজিম।
টাকার টুকরোগুলো এক জায়গায় জড়িয়ে নিয়ে আশফিয়া ভাবতে লাগল, এখানের এই পাঁচ হাজার টাকা হলে একটা পথশিশুর পঞ্চাশ দিন চলতো। অথচ টাকাওয়ালারা একজনের পঞ্চাশ দিনের খাবার পাঁচ সেকেণ্ডে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে!
ঘরে ঢুকে বিছানার ওপরে একটা খাম দেখে হাতে নিল তানজিম। ডান হাতে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে খামটা ছিঁড়ল। তখন’ই বাথরুম থেকে বেরোলো নাহিদা। ‘এটা তোমার অপ্রয়োজনীয়।’ বলে খামটা নিজের হাতে নিল সে।
তানজিম কিছু বলল না। আস্তে আস্তে নাহিদার খুব কাছে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রাখল। নাহিদার শীতল চোখগুলো দেখে তার বুক হাহাকার করে উঠল—রাগ করবে ভেবেও তা আর সম্ভব হলো না। দু’হাতে নাহিদার মুখটিকে আগলে কপালে চুমু দিতে যাবে সেই সময় দূরে সরে দাঁড়াল নাহিদা। তানজিম কথা বাড়ালো না, জোরও করল না। মুচকি হেসে বাথরুমে ঢুকে পড়ল। কিছু সময় নীরবতা পালন করে খামের দিকে তাকাল নাহিদা। ছেঁড়া খামের ভেতরে থাকা রিপোর্টটা দেখবে না ভেবেও দেখল। রিপোর্ট নেগেটিভ। পেপারওয়েট দিয়ে সেটাকে টেবিলে রেখে ভেজা চোখ নিয়ে আবারও ছাদে উঠে গেল নাহিদা। ছাদের কার্ণিশে দাঁড়িয়ে নিচে তাকিয়ে থাকল। এত উচ্চতা! এর থেকেও উচ্চতায় ওঠার ইচ্ছা ছিল তার। কিন্তু হলো না! জীবনের সব রং একে একে হারিয়ে যাচ্ছে। সাদাকালো টিভির মতো ঝিরঝির করছে। জীবনটা বড্ড অন্ধকার হয়ে গেছে। আলোর সন্ধান দরকার।
প্রেগন্যান্সি রিপোর্টে শুধু নেগেটিভ রিপোর্ট আসেনি। ওখানে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া আছে, নাহিদা কোনোদিনও মা হতে পারবে না! আর এই আঘাতটাই সবথেকে বেশি ক্ষত করেছে তাকে। সবথেকে বেশি! ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। যে মা হতে চায়নি, সে মা হয়ে আছে। আর যে মা হতে চেয়েছিল, তার ভাগ্যে ‘মা’ ডাক জুড়ে দেওয়া হয়নি! বিধাতা এখন অলক্ষ্যে হাসছেন বোধহয়।
নাহিদার কানে কে যেন এসে বলে গেল, এই শাস্তি নিজের স্বামীর অপরাধ ঢেকে আশফিয়াকে এত অপমান করার শাস্তি নয়তো?
(চলবে)