কিছু সমাপ্ত পূর্ণতার (পর্ব – ১৭)
[অন্তিম পর্ব]
সুমাইয়া আক্তার
__________________
পুলিশ স্টেশনে আজ কোনো ভীড় নেই। মনে হয় প্রিয়জনরা ছাড়া পেয়ে গেছে অথবা প্রিয়জনের প্রতি ঘৃণা কাউকে পুলিশ স্টেশন পর্যন্ত আসতে দেয়নি। সম্পূর্ণ পুলিশ স্টেশনে শুধু নাহিদা, তানজিম, অধরা এবং ইয়াসমিন। অপুকে একবার দেখার উদ্দেশ্য ইয়াসমিনের অতৃপ্ত বুক হাহাকার করছে। আজ থেকে পুলিশি হেফাজত থেকে কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হবে আদালতের শুনানিতে। তাই একবার দেখার জন্য এসেছেন ইয়াসমিন। মায়ের অনুভূতি বুঝে সাথে এসেছে নাহিদা ও তানজিম। কখন কী হয়!
ইয়াসমিন সব শুনেছেন, সব বুঝেছেন। তার ছেলে যে এমনটা করতে পারে তা প্রথমে তিনি বিশ্বাস করতে পারেননি অথবা বিশ্বাস করলেও মানতে নারাজ ছিলেন। পরবর্তীতে এক মাস আদালতের চক্কর শেষে সব প্রমাণ অপুর বিরুদ্ধে হওয়ায় এবং অপুর সব দোষ স্বীকারে দশ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তাই ইয়াসমিনের মানবিকতা বাধ্য করেছে সব বুঝতে। সেই মানবিকতার জোরেই নাহিদা আর অপুর উপর থেকে রাগ সরে গেছে। অধরাকে নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিলেন তিনি। নাহিদা কিছুতেই ছাড়েনি। তাই আর জোরও করেননি ইয়াসমিন। এমনিতেও বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের সন্তানকে রাখার তার ইচ্ছে নেই।
অপুকে দেখার অনুমতি মিলল।
ইয়াসমিন একপ্রকার দৌড়ে গেলেন। কালো শিকের ওপাশে চার দেওয়ালের মাঝে আবদ্ধ ভঙুর চেহারার অপুকে দেখে ডুকরে উঠলেন তিনি। তানজিমেরও খারাপ লাগল। কী অদ্ভুত বাজে দেখাচ্ছে অপুকে! কোথায় সেই রঙ করা ঝলমলে চুল আর কোথায় তার মৌখিক সৌন্দর্য। শরীরও ক্লান্ত, অবসাদগ্রস্ত। শরীরে কারাগারের পোশাক। সেই পোশাকের ওপর থেকেই পিঠের হাড় লক্ষ করা যাচ্ছে।
আঁতকে উঠল নাহিদা।
অপু চোখ তুলে প্রথমেই নাহিদার দিকে তাকাল। তিন সেকেণ্ড মতো তাকিয়ে সেই যে চোখ নিচু করল, আর তুলল না। শিকে ডান হাত রেখে চোখ বন্ধ করল। হয়তো নিজের কৃতকর্মের জন্য নিজেই লজ্জিত সে।
ইয়াসমিন হাজারটা কথা বলে চলেছেন। অপু শুধু হুঁ, হা এ উত্তর দিয়ে কথার সমাপ্তি করছে।
তানজিম সৌজন্যতার খাতিরে অপুর হালচাল শুনেই চুপ করল। এমন সময় কারো ছোট্ট ছোট্ট আঙুলের স্পর্শে চোখ তুলে তাকাল অপু। নাহিদার কোলে থাকা তার শুক্রাণুর সুন্দরী কন্যা তার হাতে হাত রেখেছে।
হঠাৎ’ই চোখ উপচে জল এলো অপুর। অধরার ছোট্ট দুই হাত ধরে চুমু খেল। বলল, ‘ক্ষমা করো।’
অধরা কিছুই বলল না। কিছু বুঝতে পারছে না এমন ভঙিতে বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকল। মুচকি হাসল অপু।
নাহিদা অধরার গালে ঠোঁট ডুবিয়ে আদর করল।
ফেরত আসার সময় নাহিদাকে ডেকে উঠল অপু। তখনও তার নিম্নগামী চোখ। নাহিদা ফিরে তাকালে অপু বলল, ‘তুমিও ক্ষমা করো।’
নাহিদা স্বাভাবিক স্বরে প্রশ্ন করল, ‘কেন?’
অপু নাক টেনে বলল, ‘ধরে নাও সময়-অসময়ে ফ্লার্ট করার জন্য।’
হালকা হেসে উঠল নাহিদা। অপুও হাসল।
নাহিদা এগিয়ে এসে শিকের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বলল, ‘ক্ষমা করতে পারব কি না জানি না, তবে চেষ্টা করব। তুমি নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছ জেনে খুশি হলাম। দশ বছর পরে আবার দেখা হবে। সেদিন এই অপুকেই চাইব সবাই।’
‘নিশ্চয়।’
‘আসি।’
‘নাহিদা—’ আবারও অপুর ডাকে পিছু ফিরল নাহিদা। অপু মুখের হাসি মিলিয়ে বলল, ‘কারাগারে দেখতে এসো।’
‘আসব।’
ইয়াসমিন ছেলের হাতে চুমু খেয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে পিছু ফিরলেন। অপু চোখের কোণ থেকে অশ্রু মুছে তাকিয়ে থাকল সবার চলে যাওয়ার দিকে। দশ বছর, দশ বছর! এ তো দীর্ঘ অপেক্ষা…
__________
একটি ছোট্ট শিশু; নরম পা, কোমল শরীর, শীতল দুই অর্থপূর্ণ চোখ। গুটি গুটি পায়ে বৈঠকঘরে ছুটোছুটি করে অবুঝ কিছু শব্দ আউড়ে চলেছে৷ মাঝে মাঝে স্পষ্ট ‘বাবা’ ডাকে মুখরিত করছে আশপাশ। ছোট্ট, ফর্সা-লালচে হাত দু’টো দিয়ে এটা সেটা টেনে ফেলছে। মাঝে মাঝে হাতের ইশারায় খিলখিল করে হেসে উঠছে। এই ছোট্ট শিশু যেন বিধাতার এক অসীম ভালোবাসার সৃষ্টি। সেই ভালোবাসার ঢেউ ছলাৎছলাৎ করে বইতে থাকে নাহিদা ও তানজিমের হৃদয়ে। সেই নদীতে কখনও ভাটা পড়ে না, সেই নদী কখনও অতৃপ্ত হয় না।
অধরার বয়স এখন গুনে গুনে ঠিক দশ মাসে এসে ঠেকেছে। ছোট্ট মেয়েটি এখন হাঁটতে শিখেছে। বলতে গেলে একবারে হাঁটতে শিখেছে—হামাগুড়ি দেওয়ার স্বাদ সে বোঝেনি। বুঝবেই বা কেমন করে? তানজিম তার রাজ্যহীন রাজকন্যাকে কখনো কোলছাড়া করে না। এখন নাহিদার থেকে তানজিম’ই অধরার সব বিষয়ে বেশি খেয়াল রাখে। কাজে যাওয়ার পূর্বে নিজ হাতে অধরাকে খাইয়ে দিয়ে যায়। যাওয়ার পূর্বে বারবার পইপই করে বলে যায়, ‘নাহিদা, আমার এই ফুলের দায়িত্ব দিয়ে গেলাম—তুমি খেয়াল রেখ।’
নাহিদা প্রত্যুত্তরে মিষ্টি একটা হাসি দেয়।
আজও তানজিম অধরাকে নিয়ে বসেছিল খাওয়ানোর জন্য। কিন্তু অধরা আজ কিছুতেই খাবে না। তানজিমও নাছোড়বান্দা। সেই থেকে চলছে বাবা-মেয়ের লুকোচুরি। নাহিদা রান্নাঘর থেকে সব দেখছে আর মিটিমিটি হাসছে। অধরার প্রতি তানজিমের এত ভালোবাসা, স্নেহ নাহিদার মনকে বারংবার শান্ত করে দেয়। স্বস্তি দেয়। আশফিয়ার অবর্তমানে মা-বাবার দায়িত্ব বেশ ভালোভাবেই পালন করতে পারছে, অধরাকে একটা পরিচয় দিতে পেরেছে তারা—তাই স্বস্তিটা একটু বেশি। অন্তত আশফিয়ার আত্মা ভালো থাক! সে দেখুক, তার অনুপস্থিতি অধরার জীবনে এতটুকু আঁচড়ও ফেলতে পারেনি। নাহিদা আঁচড় ফেলতে দেয়নি।
অধরা অন্যের সন্তান তা যেন এক মহূর্তের জন্যেও মনে উদয় না হয়, তাই নিজের গর্ভে কোনো সন্তানের আগমনের ভাবনা ভুলে গেছে নাহিদা। তানজিমকে মিথ্যা ঘটনার জালে হারিয়ে দিয়ে অধরাকে ভালোবাসতে বাধ্য করেছে সে। এক নিঃসন্তান মা যেমন অন্যের সন্তানকে আঁকড়ে নিজের পরিচয় দিতে চায়, তেমনি বাবারাও। আর তাই নিজে মা হতে পারবে জেনেও নিঃসন্তানের অভিনয় করে চলেছে নাহিদা।
ঘটনাটা আশফিয়া যেদিন সব জানিয়েছিল, তার কয়েকদিন পরের। ডাক্টার মোস্তফাকে একটু একটু চিনত আশফিয়া। কারণ প্রায়’ই তার বাবা জোনায়েদ সাহেবকে চেকআপের জন্য নিয়ে যেতে হতো। তাই ডাক্টারদের মধ্যে ভরসার পাত্র ছিলেন তিনিই। তাকে বলে একটা জাল রিপোর্ট তৈরি করায় নাহিদা। টাকাও দেয়। টাকা পেয়ে ডাক্টার মোস্তফা সম্পূর্ণ ঘটনাটা জানার জন্য আর জোরাজুরি করেননি। তিনি সযত্নে জাল রিপোর্ট তৈরি করে পরে লোক দিয়ে রিপোর্টটা ফ্ল্যাটে পৌঁছে দেন। এমনটা করার কারণ তানজিম থাকতেই যেন ডাক্টারের পক্ষ থেকে কেউ এসে রিপোর্টটা দিয়ে যায় এবং তানজিমের সন্দেহ করার সুযোগ তৈরি না হয়। তা না হলেও খামটা ছিঁড়ে ঘরে রেখে বেরিয়ে আসে নাহিদা। বাকিটা নাহিদার পরিকল্পনা অনুযায়ী খুব ভালোভাবেই হয়। তানজিম সত্যিই মনে করে, নাহিদা কোনোদিনও মা হতে পারবে না। নাহিদা ভেবে রেখেছে, অধরা বড় না হওয়া পর্যন্ত এই কথাটাকে ধামাচাপা দিয়েই রাখবে সে। যদিও স্বামীর থেকে এ কথা লুকোনো পাপ, কিন্তু অধরার দায়িত্ব নিয়ে তাকে মানুষ করাও তো পুণ্য!
‘হাহ্, দৌড়াদৌড়ি করে অবশেষে আমার ফুলটাকে খাওয়ালাম। এখন দ্রুত আমার নাস্তাটা দাও সেরে ফেলি। কাজে দেরি হয়ে যাবে।’
তানজিমের কথার সুরে নাহিদার পাপপুণ্যের বিচারের মূর্ছনা ভেঙে গেল। দ্রুত রুটি বেলাতে হাত লাগিয়ে বলল, ‘অনেক বড় উপকার করেছ। এখন বসো গিয়ে। আমি যাচ্ছি।’
তানজিম গেল না। দাঁড়িয়ে নাহিদার ঘর্মাক্ত মুখের দিকে মায়াভরা চোখে তাকিয়ে থাকল।
নাহিদা আড়োচোখে তাকিয়ে বলল, ‘কী দেখছ? এখন কি কাজের দেরি হচ্ছে না?’
‘বউকে ভালোবাসার সময় অন্য কাজের কথা মাথায় রাখতে নেই।’ নিজের আলিঙ্গনে নাহিদাকে বেঁধে ফেলল তানজিম, ‘এত কাজ কাজ করলে বউ পালিয়ে যাবে তো!’
রাগ দেখাতে গিয়েও শেষের কথায় হেসে ফেলল নাহিদা। বলল, ‘উঁহু, একবার পালিয়ে যাওয়াতেই আপনার যে অবস্থা, এবার পালিয়ে গেলে মনে হয় আপনার মুখটা আর দেখার অবস্থায় থাকবে না।’
‘পালিয়ে যাবেই-বা কেন? আর পালাতে দেবো না। এই শক্ত করে ধরেছি।’ বলে আরও শক্ত করে ধরল তানজিম।
নাহিদা কনুই দিয়ে তানজিমের পেটে গুঁতো দিয়ে বলল, ‘অধরা আসছে, ছাড়ো।’
‘ছাড়ব কেন? আমার ফুলটাও দেখুক, তার বাবা কত রোমান্টিক মানুষ। অন্তত পরে যেন তুমি আমাকে আনরোমান্টিক বললে আমার মেয়ে আমার পক্ষে থাকে।’
একটু লজ্জা প্রকাশ পেল নাহিদার মুখে। গাল দু’টিতে হালকা লাল আভা ফুটে উঠল। কিছু বলার জন্য ঠোঁটজোড়া আলাদা করেও পরক্ষণে কিছু বলল না। তানজিম লজ্জার কারণ বুঝতে পেরে নাহিদাকে ছেড়ে দিল। রান্নাঘরের সামনে অধরা একটা আঙুল মুখে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেন সে অষ্টম আশ্চর্য কিছু দেখল!
বিকেলের দিকে হঠাৎ তানজিমের কল। অধরাকে জড়িয়ে রাখা নাহিদার হাতটা ঢের অনিচ্ছা নিয়ে ফোনে গিয়ে পড়ল।
ওপাশ থেকে শোনা গেল তানজিমের উৎফুল্ল কণ্ঠ, ‘কী করছ? তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে বিল্ডিং থেকে বেরোও।’
নাহিদা একটু ‘চ’ ধরনের শব্দ করে বলল, ‘এই অসময়ে কোথায় যাবে? অধরা ঘুমিয়েছে।’
‘আজ দ্রুত ছুটি নিয়ে এসেছি ঘুরতে যাব বলে। আর তুমি এসব বলছ? সমস্যা নেই, আমার ফুলটাও উঠে যাবে।’
অধরা নড়ে উঠল। নাহিদা ভুলে জোরে কথা বলে ফেলেছে। নাহিদার মতোই অধরার ঘুম হালকা। সেজন্য সে উঠে পড়েছে। চোখ মিরমির করে তাকাল অধরা। মুখে ঘুম পূর্ণ না হওয়ায় বিরক্তির ছাপ।
নাহিদা কপাল কুঁচকে বলল, ‘অধরা উঠে গেছে। হয়েছে শান্তি?’
ওপাশ থেকে হাসির সুর কানে এলো। তানজিম বলল, ‘এবার ফটাফট রেডি হও।’
‘কিন্তু যাবে কোথায়?’
‘ঘুরতে।’
‘জায়গার নাম নেই?’
‘আমাদের পাশের পার্কে।’
‘অ্যাহ্!’ মুখ মুচড়ে বলল নাহিদা।
‘অন্যদিন আরেক জায়গায় ঘুরতে যাব। এখন দ্রুত রেডি হয়ে নিচে এসো প্লিজ।’
উঠে দাঁড়াল নাহিদা। অধরাও চোখ কচলে উঠে পড়েছে। বুলি আওড়াতে শুরু করেছে, ‘মা, মা!’
জড়িয়ে ধরে ভীষণ আদর করল নাহিদা। কপালে চুমু এঁকে বলল, ‘আমার মেয়েটা!’
পুরো আধাঘণ্টা পর বিল্ডিং থেকে বের হলো মা-মেয়ে। তাদের দেখে মাথায় হাত দিল তানজিম। বলল, ‘আরও আধাঘণ্টা লাগালে পারতে।’
‘তোমার মেয়েকে সাজাতেই আধাঘণ্টা লাগল।’
‘নিজের দোষ আমার মেয়ের কাঁধে দিচ্ছ কেন?’
মুচকি হেসে থেমে গেল নাহিদা। এই সুন্দর সময়ে ঝগড়াটা ঠিক জমবে না।
অধরার দিকে তাকাল তানজিম। মাথার বড় সিল্কি চুলগুলো সিঁথি করে রাখা, মুখে পাউডার, চোখে কাজল, কপালের মাঝ বরাবর কাজল দিয়ে দেওয়া সুক্ষ্ম একটা টিপ, পরনে সাদা-গোলাপি ফ্রক, হাতে চুড়ি—একজন সদ্য প্রস্ফুটিত ফুলের মতো সজীব, সুন্দর। অধরাকে কোলে তুলে আদর করে দিল তানজিম। পরে নাহিদার দিকে তাকিয়ে দেখল, সেও অধরার মতো সুন্দর করে সেজে আরেকটি ফোটা ফুল হয়ে আছে। নাহিদা অপেক্ষা করছে প্রিয় মানুষটির প্রশংসার।
তানজিম সেই অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে বলে উঠল, ‘আজ আমার বাগানে দুইটি অমূল্য ফুল ফুটেছে। কী দিয়ে এই অমূল্য ফুল ঢাকব? কী করে পৃথিবী থেকে লুকাব?’
লজ্জায় পড়ে গেল নাহিদা। এতক্ষণ প্রশংসার অপেক্ষায় থাকা মুখটা নিম্নগামী হলো। অনেকদিন পর তানজিমের সাথে কাটানো প্রথম দিনের মতো অনুভব হতে লাগল। এই অনুভূতি মহা সুখকর!
মোটরসাইকেলে করে ছয় মিনিটেই পার্কে পৌঁছে গেল তিনজন। বড় একটা মাঠ, ধারে সারি সারি মেহগনি, সুপারিসহ আরও নানান ধরনের গাছ। একধারে একটা পুকুর। পুকুরে ভাসমান নৌকা। সম্পূর্ণ মাঠে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সান বাঁধানো বেঞ্চ। ছুটির দিন না হওয়ায় মাঠে ভীড় কম। কিন্তু তারপরও যে ভীড়টা আছে তা বেশ ভালোই। সবাই কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী। কারোরই বয়স তেইশ পেরোবে না। সবাই নিজেদের মতো সময় কাটাচ্ছে।
মাঠের এক পাশটা খালি দেখে বসে পড়ল তানজিম। নাহিদাও বসল কিন্তু অধরা বসল না। সে ছুটোছুটি করতে লাগল। তানজিমের কাঁধে মাথা রেখে অধরার দিকে তাকিয়ে থাকল নাহিদা।
অধরা মাঠে ছুটছে, ঘুরছে। মাঝে মাঝে মাঠে ফুটে থাকা ছোট্ট কিছু নাম না জানা ফুলগুলো ছিঁড়ে জমা করছে।
তানজিম নাহিদার মাথায় মাথা রেখে বলল, ‘আমাদের অধরা খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেল তাই না?’
নাহিদা মুচকি হেসে জবাব দিল, ‘হুম। দেখতে দেখতে আরও বড় হয়ে যাবে। আমরা বুড়ো-বুড়ির হয়ে যাব আর অধরার বিয়ে হয়ে যাবে। ওরও সংসার হবে। অনেক অপেক্ষার পর তখন এই মুখটুকু দেখা যাবে।’ শেষের কথাগুলো বলতে গিয়ে মন খারাপ হলো নাহিদার।
তানজিম কাঁধ সরিয়ে বলল, ‘কে যেতে দেবে অধরাকে? বিয়ে দিলেও ওকে বাড়িতেই রেখে দেবো। ঘরজামাই রাখব আমি।’
‘এত ভালোবাসো ওকে?’ আবার কাঁধটা টেনে নিল নাহিদা।
‘হুম। অনেক। মেয়েটি তো আমাদের।’
‘এক অসহনীয় ভুলে ফুলের জন্ম হয়েছে। তুমি সেই সজীব, সুন্দর ফুলকে মাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলে। মনে পড়ে?’
‘আর কত ক্ষতের উপরে ক্ষত করবে বলো?’
‘আচ্ছা ছাড়ো। দেখ অধরা নাচছে।’
মন খারাপির পাহাড় ডিঙিয়ে সুখী দম্পতি সামনে তাকাল। অধরা হাত, পা ছড়িয়ে নাচছে। হেসে ফেলল তানজিম। অধরার চোখে পড়ল তার বাবার হাসি, কানে ধাক্কা খেল হাসির শব্দ। ছোট্ট মেয়েটি কী বুঝল কে জানে; সে নাচ থামিয়ে তানজিমের দিকে তাকিয়ে থাকল। পরক্ষণে চোখ উপচে জল এলো। এত মায়াময় মুখে ছলছল আঁখিযুগল দেখে মায়ায় পড়ে মৃতপ্রায় অবস্থা অবস্থা নাহিদার।
নাহিদা অধরাকে কোলে তুলে নিয়ে আগের জায়গায় বসল। তানজিমের দিকে তাকিয়ে মুখ ফুলিয়ে বলল, ‘এই তুমি হাসলে কেন?’
ততক্ষণে তানজিমের হাসি মিলিয়ে গেছে। সে অধরাকে কোলে নিয়ে বলল, ‘স্যরি মাম্মাম।’
কিছু বলল না অধরা। একরাশ অভিমান নিয়ে নাহিদার কোলে ফিরল সে। কী আশ্চর্য! অধরা অভিমানটুকু সম্পূর্ণটাই নাহিদার থেকে রপ্ত করেছে। এ যেন ছোট্ট আরেক নাহিদা৷ কিছু হলেই অভিমানের পাহাড় তৈরি করে ফেলে। সেই পাহাড় ধ্বংসানো কি আর সহজ কাজ!
অধরার সামনে দাঁড়িয়ে দুই হাতে কান রেখে উঠবস করতে শুরু করল তানজিম। হঠাৎ কোনো পূর্বাভাস ছাড়া তানজিমের এমন কাণ্ড দেখে হতবাক নাহিদা।
চারপাশের যুবক-যুবতীরা তখন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। কেউ হাসছে, কেউ আবার নাহিদার অভিমানে তানজিমের এমন কর্মকাণ্ড ভেবে পাশের প্রিয়কে খুঁচিয়ে বলছে, ‘দেখেছ ভালোবাসা? পারবে কখনও এমন?’
নাহিদা বোকা বোকা একটা হাসি দিয়ে বলল, ‘কী করছ এসব? থামো।’
‘আমার ফুলের রাগ না থামা অব্দি থামছি না।’
আসলেই তানজিম থামল না। প্রায় আটত্রিশবার উঠবস করার পর অধরা গিয়ে তানজিমের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তুতলিয়ে ডেকে উঠল, ‘বাবা!’
তানজিমের হৃদয় শান্ত হলো। অপরাধের বোঝা কমলো। অধরকে গোলে নিয়ে ঘুরতে লাগল আর বলতে লাগল, ‘আমার ফুলের অভিমান ভেঙেছে।’
তৎক্ষণাৎ সবাই বুঝল, বাবা তার মেয়ের অভিমান ভাঙাতে কান ধরে উঠবস করেছিল।
ফানি ভিডিও করবে ভেবে এক এন্টারটেইনমেন্ট পেইজের ওনার মুগ্ধ হলো। ভিডিওটা সে ছাড়ল ঠিক’ই, লিখে দিল সত্যটা—“এক কন্যার মান ভাঙাতে সকলের সামনে বাবার কানে ধরে উঠবস। এমন বাবা সবার হোক।”
মহূর্তে ভাইরাল হলো বিষয়টি। নাহিদা বসে থেকেই আপডেট পেল সবটার। সে ঠিক কী অনুভূতি ব্যক্ত করবে বুঝল না—রাগ, অবাক, খুশি; কোন অনুভূতি হচ্ছে তার নিজেও বুঝল না।
এদিকে তানজিম এসে পাশে বসেছে। গর্ব করে বলছে, ‘দেখলে? আমি কিন্তু শ্রেষ্ঠ বাবা।’
‘আর আমি সবসময়’ই শ্রেষ্ঠ মা।’
‘হুম, তুমি নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ মা।’
অবাক হয়ে তাকাল নাহিদা। আগে তানজিমের উত্তরটা হতো, ‘তুমি শ্রেষ্ঠ মা না। আমি শুধু শ্রেষ্ঠ বাবা।’
মানে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া বাঁধানোর সূচনা। কিন্তু অনেকদিন হলো তানজিম এটা নিয়ে আর ঝগড়া করে না। মাথা পেতে মেনে নেয়, নিঃসন্দেহে নাহিদা শ্রেষ্ঠ মা।
তানজিম সবটা জানে।
কী জানে? নাহিদার লুকানো কথাটা জানে। নাহিদা মা হতে পারবে না ব্যাপারটা যে সম্পূর্ণ সাজানো তা আশফিয়ার ডায়েরির শেষে পেয়েছিল সে। অপুর নৃশংসতার কথা জেনে নাহিদা তখন বেকুব বনে বসে আছে। সে সময় বাকিটুকু পড়তে গিয়ে সেই অনাকাঙ্খিত পাতার দেখা মেলে। সব দেখে আকাশ সমান অবাক হয় তানজিম। কী অদ্ভুত তার স্ত্রী! অন্যের সন্তানকে একটা পরিচয় দেওয়ার জন্য কত কর্মকাণ্ড তার। ওই সময় তার অল্প রাগ হলেও নাহিদার মহানুভবতা তানজিমের হৃদয় ছুঁয়ে গেছিল। সে আরও একবার প্রমাণ পেয়েছিল, তার বাবা সঠিক নারীকেই তার জীবনে দিয়ে গেছেন।
তানজিম যে সত্যিটা জানে, তা নাহিদাকে জানায়নি সে। কিছু সত্যি জেনে আড়ালে রাখার আনন্দ তীব্র সুখকর। সেই সুখ থেকে বঞ্চিত হতে চায় না তানজিম, এতটুকুও না।
নাহিদা তানজিমের কাঁধে আগেরমতোই মাথা রেখে আছে। অধরা আর নাচছে না। ছুটোছুটি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে তানজিমের কোলে জায়গা করে নিয়েছে।
সহসা নাহিদার মাথায় মাথা দিয়ে আলতো আঘাত করল তানজিম। জিজ্ঞাসা করল, ‘আমরা কেমন আছি নাহিদা?’
নাহিদা চোখ বন্ধ করে কিছু সুখ কুড়িয়ে সরল গলায় বলল, ‘পৃথিবীতে যতটা ভালো থাকা যায়, তার থেকে একটু-আধটু বেশি।’
‘আমরা এভাবেই ভালো থাকব তো?’
‘ইনশাআল্লাহ্।’
তানজিম দুই হাতে আঁকড়ে ধরল তার বাগানের অমূল্য দুই ফুলকে। এই ফুলগুলো ঝরে না যাক, সদা সজীব থাকুক—এই ভাবনায় বিভোর হলো সে। পার্কের সবাই তাকিয়ে থাকল পবিত্র এক সম্পর্কের দিকে; যে সম্পর্কে ভালোবাসা ঠাসা, স্নেহ ঠাসা। সবাই সন্ধ্যার আগমনে বাড়ি ফিরতে লাগল। বসে থাকল শুধু এই দম্পতি। আঁধারের কোল থেকে শোনা গেল সুখ, স্বস্তির নিঃশ্বাস এবং অধরার হাসির খিলখিল ধ্বনি।
(সমাপ্ত)