কিছু সমাপ্ত পূর্ণতার (পর্ব – ১৫)
সুমাইয়া আক্তার
__________________
পরদিন সকাল সকাল সকল অনুভূতির জোয়ার তানজিমের উপর ঢেলে দিল নাহিদা। ভেজা চুলের বিন্দু বিন্দু স্পর্শে ঘুম ভাঙালো, গল্প করল, বুকে মুখ লুকিয়ে হাজারও অভিযোগ শোনালো। এতদিন পর একে অপরের কাছে এসে ভেঙে ফেলল অভিমান, অভিযোগের দেওয়াল। তানজিম বুকে শক্ত করে জড়িয়ে রেখে দিল নাহিদাকে। মাথায় মাথা ঠেকিয়ে কত শত গল্প করল। গল্পগুলো তাদের বিয়ের। বিয়েতে কী হয়েছিল সব একে একে বলতে লাগল সে। নাহিদা চোখ বন্ধ করে তানজিমের হৃদয়ের ধকধক শব্দ শুনে হাস্যরসে ভরপুর কথাগুলো শুনতে লাগল। সঙ্গী ছিল অধরাও।
সকালের খাবার খেয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্য বেরোনোর প্রস্তুতি নিল অধরা এবং তানজিম। আয়নার সামনে বসে চুল আঁচড়াতে গিয়ে বারবার হাই তুলছিল নাহিদা। অনেকদিন পর এত শান্তির ছোঁয়া পেয়ে সরল ঘুমগুলো চোখের পাতায় ছুটে আসছে। জাপ্টে ধরছে চারদিক থেকে।
তানজিম নাহিদার হাবভাব লক্ষ করে বলল, ‘আজ বরং থেকে যাই। কাল যাব।’
‘না তানজিম। আর সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না।’
নাহিদার দু’কাধে হাত রাখল তানজিম। থুতনিটা আলতো করে মাথায় বসিয়ে বলল, ‘ঘুম পাচ্ছে তো তোমার।’
‘বাইরে গেলেই ঠিক হয়ে যাবে।’ বলে উঠে দাঁড়াল নাহিদা।
তানজিম চুপচাপ তাকিয়ে থাকল তার সহধর্মিণীর দিকে। গত কালকের চেয়ে আজ বেশ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে নাহিদাকে। এই কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে তার বয়স যেন চার বছর কমে গেছে। অতিরিক্ত চিন্তার ছাপ নেই বলে সৌন্দর্যের ঝলক খেলে যাচ্ছে সারা মুখে।
জাফরিন অধরাকে সামলানোর দায়িত্ব নিলেন। তিনি অধরাকে ওই হাসপাতালে যেতে দিতে চান না। যেখানে মানুষের জীবন বাঁচানোর পরিবর্তে জীবনকে হত্যা করা হয়, সেখানে অবস্থিত সকল কিছুই অভিশপ্ত। নাহিদাও কিছু বলল না। অধরাকে কোলে নিয়ে আদর করে মায়ের কাছে ফেরত দিল। মনে করে বাসা থেকে বেরোনোর পূর্বে অপুর ঘরের দরজা ঠেলে দেখল ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগানো। তারমানে অপু এখনও ওঠেনি। উঠলে সে সবার প্রথমে নাহিদাকে খুঁজবে তা ভালো করেই জানে নাহিদা। এই ছেলেকে নিয়েও সমস্যা! গতকাল তো একটা অঘটন প্রায় ঘটিয়ে ফেলছিল এই ছেলে। তানজিমের সামনে ফ্লার্ট করছিল। তানজিম চোয়াল শক্ত করে সব হজম করছিল। নাহিদা কিচ্ছু বলার সাহস করেনি। শুধু তানজিমের দিকে ইশারা করছিল যেন সে শান্ত থাকে। তানজিম কথা রেখেছিল!
বাসা থেকে বের হয়ে রিক্সার জন্য রাস্তায় দাঁড়াল তানজিম। নাহিদা দাঁড়াল না—হেঁটে চলল নিজের মতো। ছোট ছোট পরিধির পা ফেলে আপন মর্জিতে চলল, উড়তে লাগল ফুরফুরে চুলগুলো।
তানজিম ডাকল, ‘নাহিদা, কোথায় যাচ্ছ? রিক্সা নিয়ে নিই—’
নাহিদা হেসে বলল, ‘চলো, আজ তোমার পাশাপাশি একটু হাঁটি।’
নাহিদার আবদারে তানজিমের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। কোমল চোখে তাকাল নাহিদার খুশির ঢেউ উপচে পড়া মুখে। মাথাটা ডান দিকে কিঞ্চিৎ বাঁকিয়ে পলকহীন তাকিয়ে থাকল নাহিদার চোখ দু’টোতে। নাহিদার চোখ হাসির চোটে সরু হয়ে আছে। মিরমির করে তানজিমের দিকে দৃষ্টি ফেলে রেখেছে।
তানজিমকে চুপচাপ দেখে হাত নাড়লো নাহিদা, ‘এই যে! তুমি কি আসবে?’
উপর-নিচে মাথা ঝাঁকিয়ে এগিয়ে গেল তানজিম। এখনও সূর্যের প্রখর তেজ প্রকাশিত হতে শুরু করেনি। পূর্ব আকাশে হেলে পড়ে আছে দুর্বল সূর্য। আজ সে যেন নাহিদার সাথে সখ্যতা গড়ে ফেলেছে; যেন নাহিদা পথে প্রিয় মানুষটির বাহু আঁকড়ে চলতে পারে।
নাহিদা ডান হাত দিয়ে তানজিমের বাম হাতকে জাপ্টে ধরল। তানজিম তাকালে লজ্জায় মুখ নিম্নগামী করে নিজ দৃষ্টি পথে ফেলল। আজকের দিনটা তাদের কাছে খুব’ই মূল্যবান। এই দিনের প্রতিটি বেলা, প্রতিটি মহূর্ত মূল্যবান।
__________
ডাক্টার মোস্তফা আজকাল খুব ব্যস্ত সময় পার করছেন। এতটাই ব্যস্ত সময় যে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁচা চুলের ফাঁকে উঁকি দেওয়া শুভ্র চুলগুলোর দিকে নজর ফেলতে পারেন না। অতিরিক্ত সময় হাসপাতালে থাকতে হয় বলে স্ত্রী, সন্তানের ঠিকমতো খেয়াল রাখতে পারেন না। সেজন্য এবার একজন কাজের মহিলা রাখতে হয়েছে—বেড়ে গেছে টাকার চাহিদা। এই হাসপাতালের স্বনামধন্য ডাক্টার হওয়ার সুবাদে অল্প কিছু জিনিসে সুবিধা পেলেও ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসার এত এত খরচ বহন করা তার উপর অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে। হাসপাতাল কতৃপক্ষের কাছে আকুল আবেদন করেও খুব একটা সুবিধা হয়নি। তবে যতটুকু সুবিধা হয়েছে, ততটুকুর উপরে ভরসা করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বুক হালকা করতে পারছেন মোস্তফা। এখন কতৃপক্ষকে সম্পূর্ণ হাতে করে নিতে পারলেই পরিত্রাণ। যে ক’দিন তার স্ত্রী বেঁচে থাকবে, সে ক’দিন অন্তত শান্তিতে থাকতে পারবে।
আজ নতুন একটা সুপারিশ এসেছে মোস্তফার কাছে—মানুষ মারার সুপারিশ। জমজ বাচ্চাসহ এক মা’কে মেরে ফেলতে হবে অপারেশন থিয়েটারেই। খুব একটা অসুবিধা হবে না। কিন্তু তার কথা শুনে চলা নার্সরা একবার বেঁকে বসলেই সুনামি এসে পড়বে মোস্তফার জীবনে। অবশ্য নার্সরা এমনটা করবে না। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, কিছু টাকা তারাও পায়। আর টাকার প্রতি লোভ মানুষের আদিকাল থেকেই। এই লোভ মানুষকে জ্বালিয়ে মারে, পুড়িয়ে মারে জেনেও লোকে এই লোভ করে। কী আশ্চর্য!
অপারেশন থিয়েটাকে ঢুকতে হবে দশ মিনিটের মধ্যেই। তাই নিজের কেবিন থেকে বের হওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে পড়লেন ডাক্টার মোস্তফা। তার মুখে যে বিষাদ ছুটোছুটি করছে তা নিজেও বুঝতে পারলেন তিনি। এই কয়েকদিনে আঙুলে গোনা কয়েকজন মানুষকে মেরে ফেলে হাতের কাঁপুনি বন্ধ হয়েছে, কিন্তু মনের কাঁপুনি আজও বন্ধ হয়নি। মানুষকে বাঁচানোর জন্য তিনি এই পদে এসেছিলেন। এপ্রোন ছুঁয়ে ঘ্রাণ নিয়েছিলেন নিজের জয়ের। কিন্তু আজ বাস্তবতা তাকে কোথায় নামিয়ে দিল!
টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লের মোস্তফা। অতঃপর সব চিন্তা ফেলে দুর্বল শরীরটাকে টেনে তুললেন। চেয়ার ছেড়ে চুল আঁচড়ে নিজের প্রফেশন অনুযায়ী একটা ভঙ্গি মুখে রেখে দরজা খুললেন তিনি। তখন’ই চোখে পড়ল তানজিম এবং নাহিদাকে। ভ্রু কুঁচকে ঘরে আবারও ঢুকতে যাবেন এমন সময় নাহিদা এ পাশে পা বাড়িয়ে দিল। দম্পতিকে একসাথে দেখে একটু অবাক হলেও নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে যেতে লাগলেন মোস্তফা।
নাহিদা ডাক্টার মোস্তফার কেবিনে ঢুকে পড়ল। মুখে তার কৌতুহল।
তানজিম হাত মিলিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কেমন আছেন?’
ডাক্টার মোস্তফা অপ্রস্তুত গলায় জবাব দিলেন, ‘ভালো।’
আর কথা এগোনোর প্রয়োজন মনে করল না তানজিম। তাই সরাসরি জিজ্ঞাসা করল, ‘আশফিয়াকে মারার জন্য কে আপনাকে টাকা দিয়েছিল?’
নাহিদার সামনে দাঁড়িয়ে তানজিমের এমন প্রশ্ন শুনে আকাশ থেকে পড়ার মতো অনুভূতি হলো মোস্তফার। তিনি ভীত হলেন, শঙ্কিত হলেন।
নাহিদাও এবার প্রশ্ন করল, ‘আমি সব জানি ডাক্টার। আপনি আমার গুরুজন। আশফিয়ার ব্যাপারে খুব সাহায্য করেছিলেন আমায়। তাই আপনাকে সন্মানও করি। আমরা জানি আপনার অপারগতা। স্ত্রী’র সেবার জন্য আপনি এমন কাজ করেন তাও জেনেছি। এবার আমাদের সত্যিটা বলুন। আমরা আপনাকে ক্ষমা করে দেব।’ চুপ থাকলেন মোস্তফা। নাহিদা আবারও বলল, ‘আশফিয়াকে আপনিই মেরেছেন তাই না?’
এবারও মোস্তফা চুপ থাকলেন। একে একে শত শত প্রশ্ন করে যেতে লাগল নাহিদা এবং তানজিম, কিন্তু ডাক্টার মোস্তফা সদুত্তর দিলেন না। অবশেষে তানজিম ক্রোধের বশবর্তী হয়ে অনেক কিছু বলে ফেলল। তবুও কাজ হলো না। তখন হঠাৎ’ই তানজিমের ফোনের স্ক্রিনে ভাসতে লাগল মোস্তফা এবং তানজিমের কথপোকথনের দৃশ্য। অধরাকে মারার জন্য এক লক্ষ টাকা প্রদান সহ সকল কথা রেকর্ড করা আছে দেখে ভয়ঙ্করভাবে ভেঙে পড়লেন মোস্তফা। চেয়ারে বসে পড়লেন তিনি।
তানজিম নিজের রাগকে এক পাশে রেখে ডাক্টারের অতি পরিচিত স্কাল্পেলটা হাতে ঘুরিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, ‘আমি জেলে গেলেও সমস্যা নেই। তবে আপনি জেলে গেলে কী হবে ভাবুন। একদিনে আপনার সন্তান, অন্যদিকে ক্যান্সারে আক্রান্ত সহধর্মিণী। কী করবেন আপনি?’
ডাক্টার মোস্তফা নাহিদা এবং তানজিমের দিকে তাকালেন। দেখলেন তাদের মুখে দৃঢ়তার ছাপ। তার প্রিয় স্কাল্পেলটা যে তার গলায় ঢুকে যাবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সুতরাং সত্যি বলাই তার জন্য মঙ্গলজনক।
একটু কেঁশে উঠলেন মোস্তফা। সত্যি বলার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করলেন বোধহয়। তারপর নাহিদার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনার সাথে যে ছেলেটা এসেছিল সে।’ নাহিদার মুখে তখনও বিস্ময় ফুটে উঠেনি। তার আগেই নামটা বলে দিলেন মোস্তফা, ‘অপু।’
নাহিদা এবং তানজিম একে অপরের দিকে তাকাল৷ কারোরই যেন সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস হচ্ছিল না। পুনরায় মোস্তফা অপুর নাম বললেন। তবে কোন কারণে অপু আশফিয়াকে খুন করতে এত টাকা দিয়েছিল, তা তিনি নিজেও জানেন না।
ধাক্কাটা সামলে নিতে বেশ সময় লাগল নাহিদার। মাথার ভেতরটা কেমন ভোঁ ভোঁ করছে। তারমানে তানজিমের জন্মদিনে অপু’ই আশফিয়াকে মেরে ফেলতে ছুরি চালিয়েছিল।
‘যদি অপুকে চিনতে পারতাম!’ হতাশ হয়ে বলল আশফিয়া।
তানজিম আশফিয়ার হতাশা দেখে কিছুই বলল না। ডাক্টার মোস্তফা সবকিছুর জন্য ক্ষমা চাইলেন এবং স্পষ্ট ভাষায় জানালেন, তার স্ত্রী অসুস্থ। তাকে এমন কিছু করতেই হতো।
তানজিম অন্যসব ভাবনাকে ছুটি দিয়ে মোস্তফার উদ্দেশ্যে বলল, ‘আপনার ক্যান্সারে আক্রান্ত স্ত্রী’র চিকিৎসার সত্তর ভাগ ভার যদি হাসপাতাল কতৃপক্ষ নেয়, তাহলে আপনি এসব ছেড়ে দেবেন তো?’
আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না ডাক্টার মোস্তফা। তানজিমের হাত আঁকড়ে বললেন, ‘আমার খুব উপকার হবে তানজিম সাহেব। আর এত পাপের বোঝা টানতে পারছি না।’
হাতের উপর হাত রেখে সান্ত্বনা দিল তানজিম। আশ্বাস দিল সব ঠিক হওয়ার। মোস্তফা কথা দিলেন কাউকে খুন না করার। শুধু স্ত্রী’র চিকিৎসা না, নিজেকে জেল থেকে দূরে রাখতে হলেও তার এই সিদ্ধান্ত অপরিহার্য।
(চলবে)