কিছু সমাপ্ত পূর্ণতার (পর্ব – ১২)
সুমাইয়া আক্তার
__________________
নাহিদা ঘর গোছাচ্ছে। অগোছালো নিজেকে সামলে নিয়ে এবার অগোছালো ঘরের দিকে হাত বাড়িয়েছে সে। আজকাল উন্মনা, উদাসীনতায় ডুবে থাকে নাহিদা। মাঝে মাঝে দূরে কোথাও চোখ নিবদ্ধ করে তাকিয়ে থাকে। কী ভাবে তার আদ্যোপান্ত কিছুই খুঁজে পায় না সে। শুধু নির্লিপ্ত ভঙিতে দৃষ্টি ফেলে রাখে ছাদের কার্ণিশে অথবা ছোট্ট একটা পুকুরের ঝকঝকে জলে।
গোঙানির মতো অদ্ভুত শব্দ হতেই বিছানায় তাকাল নাহিদা। একটা ছোট্ট শিশু হাত, পা দোলাচ্ছে। অধরা! অধরার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুণি মেয়েটা কেঁদে দেবে। বড্ড চঞ্চল মেয়ে। একদম মায়ের মতো হয়েছে। শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে না মহা রানীর। সারাক্ষণ তাকে কোলে নিয়ে গল্প করলে তবেই ভালো! নইলে ঠোঁট উল্টে কাঁদতে আরম্ভ করবে।
অধরার কাছে গিয়ে বসল নাহিদা। নিজের মুখে হাসি ফুটিয়ে মুখটা অধরার পেটে গুঁজল। সঙ্গে সঙ্গে দাঁত হীন মাড়ির হাসি ঝলকে উঠল অধরার মুখে। এই নিষ্পাপ হাসিতে সব ভুলে থাকতে পারে নাহিদা। অধরা তার যেন দুঃখ ভোলার ট্যাবলেট।
অধরার নামকরণের পেছনে একটা গল্প দাঁড় করানো যায়। আশফিয়া হয়তো কোনোভাবে জানতে পেরেছিল, তার কন্যাকে সে কখনও ধরতে পারবে না। একটাবারও ছুঁতে পারবে না। নয় মাস কষ্ট করে জন্ম দিয়ে আদুরে গলায় দ্বিতীয়বার অধরা ডাকটা ডাকারও সুযোগ পাবে না। আনন্দ অশ্রু ঝরিয়ে কন্যাকে কোলে তুলে, ‘আমর সন্তান’ বলতে পারবে না। তাই হয়তো সৃষ্টিকর্তা আশফিয়ার মনে অধরা নাম উদয় করে দিয়েছিলেন—যাকে ধরা যায় না অথবা যে ধরা দেয় না।
সময় নাহিদার স্মৃতি থেকে অনেক কিছু সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে—আশফিয়ার মৃত্যু কাহিনীও! আশফিরা মারা গেছে এক মাস পেরিয়ে গেল। সবটুকু ভুলতে না পারলেও কিছু সময় ভুলে থাকতে পারে নাহিদা। তা অবশ্য অধরার কারণেই। ছোট্ট মেয়েটা তাকে সারাক্ষণ ব্যস্ত রাখে; বাধ্য করে খুশি থাকতে। সেদিন হাসপাতালে অনাকাঙ্খিতভাবে আশফিয়ার মৃত্যুর খবর পায় নাহিদা। সে সময় অপুর সাথে কি যেন এক আলাপে ব্যস্ত ছিল সে, সঙ্গে জাফরিন এবং জোনায়েদ। খবরটা নিয়ে আসেন ডাক্টার মোস্তফা। হঠাৎ ওমন অস্বাভাবিক একটা ঘটনার সম্মুখীন হয়ে সবার মুখ থেকে কথা হারিয়ে যায়। নাহিদা তখন বুঝে উঠতে পারছিল না তার কী করা উচিৎ। বলতে গেলে, নিজেকে বিকলাঙ্গ মনে হচ্ছিল। যতক্ষণে তার বিকলাঙ্গ ভাব কেটে যায় ততক্ষণে সবাই দৌড় দিয়েছে আশফিয়ার ঘরের উদ্দেশ্যে। চোখের জলের পরোয়া না করে ছুটতে শুরু করে সেও। গিয়ে দেখে, আশফিয়ার গলা থেকে রক্ত বেরিয়ে ব্যাণ্ডেজ ভিজে গেছে। মোস্তফার দিকে স্বপ্রশ্নে তাকালে তিনি আফসোসের সুরে বলেন, কোনোভাবে গলায় হয়তো আঘাত লেগেছিল। যার ফলে ক্ষতটা আরও আঘাতপ্রাপ্ত হয় এবং রক্ত বেরোতে শুরু করে। আঘাতের জন্য জ্ঞান হারায় নাহিদা। জ্ঞানহীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার। উত্তরটা নাহিদার মনকে শান্ত করতে পারেনি। কিন্তু অশান্ত মনে কিছু প্রশ্ন করেও লাভ হতো না।
সেদিন’ই আশফিয়ার লাশকে ফেরত আনা হয়। আশফিয়ার মা-বাবা যদিও আশফিয়াকে বের করে দিয়েছিল, তবুও আশফিয়ার মৃত্যুর খবর শুনে ছুটে আসেন। অনেক কান্নাকাটি করেন। অতঃপর আশফিয়ার লাশ নিয়ে যান আশফিয়ার দাদা, চাচার মতের ভ্রুক্ষেপ না করে। সেদিন মা-বাবার মূল্যটা নতুনভাবে বুঝেছিল নাহিদা।
পুলিশের ঝামেলা হয়নি বলে তানজিমের ব্যাপারটাও সামনে আসেনি। তবে নাহিদা এতটাও অমানুষ নয় যে, আশফিয়া আর অধরাকে খুন করতে চাওয়া তানজিমের সাথে শান্তিতে ঘর-সংসার করার লোভে মনুষ্যত্বকে বিসর্জন দেবে। তানজিমের চোখের অবাধ্য অশ্রু দেখেও বিগলিত হয়নি নাহিদা৷ নিজের অশ্রুকে সামলে নিয়ে বেশ ভালোভাবেই বাবার বাড়িতে ফিরেছে সে। এ নিয়ে বেশ খুশি ইফতেখার। তার ভাবনায় দখল এখন কীভাবে তানজিমকে ছাড়া নাহিদাকে খুশি রাখা যায়। তাছাড়া এই ক’দিনে ভাই-বোনের ভুল বুঝাবুঝিও মিটে গেছে। তাই বেশ প্রফুল্ল ইফতেখার।
‘নাহিদা, নাহিদা।’ ইফতেখারের চড়াও গলা।
হঠাৎ করে অসময়ে ইফতেখারের গলা শুনে একটু অবাক’ই হলো নাহিদা। অধরাকে একটু আদর করে উঠে দাঁড়াল সে।
ইফতেখার নাহিদার ঘরের দরজায় এসে হাসি মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, ‘কী করছিস?’
‘কিছু না ভাইয়া। কিন্তু তুই এই অসময়ে?’
‘কেন রে? আসতে নেই বুঝি?’
ইফতেখারের এক বাহুতে ঢুকে হাসল নাহিদা, ‘এটা তো তোর’ই বাড়ি।’
‘না, আমাদের বাড়ি।’ হাতে থাকা কয়েকটা শপিং-ব্যাগ বিছানায় রাখল ইফতেখার, ‘দেখ-তো পছন্দ হয় কিনা।’
শপিং-ব্যাগ থেকে সব কাপড় বের করল নাহিদা। ইফতেখার অধরা আর নাহিদার জন্য নতুন কিছু কাপড়চোপড় কিনেছে। কিছু বললে হয়তো ভুল হবে—বলতে হবে অনেক।
নাহিদা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইফতেখারের দিকে তাকাল। ইফতেখার আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। সে অধরাকে কোলে নিয়ে নানান ভঙিমা করছে৷ অধরাকে খুব ভালোবাসে ইফতেখার। এ নিয়ে মাঝে মাঝে অকারণে কেমন সন্দেহ হয় নাহিদার৷ আশফিয়া বলেছিল অধরা তানজিমের বাচ্চা না। নিজের অপরাধবোধ থেকে সত্যিটা সে বলেছিল। কিন্তু কখনও বলেনি অধরা আসলে কার বাচ্চা। সেটা জানার জন্য বেশ জোরাজুরি করেছিল নাহিদা। আশফিয়া শুধু বলেছিল, দ্রুত জানিয়ে দেবে। কিন্তু তার আগেই অনাকাঙ্খিতভাবে মারা গেল সে। আশফিয়ার মৃত্যুর পর অধরার বাবা কে, তা একবারও জানার চেষ্টা করেনি নাহিদা। কারণটা হলো ভয়। তার এখন ভয় হয় অধরাকে হারিয়ে ফেলার। যদি এখন অধরার বাবা নিজের সন্তানকে নিয়ে যেতে চায়, তবে কী হবে?
আশফিয়ার মা অধরাকে নিয়ে যেতে চাইলেও নাহিদা নিজের থেকে আলাদা করেনি। ঝাপসা চোখে বলেছিল, ‘এই সন্তানটিকে আমার পরিচয়ে বড় হতে দিন। আশফিয়াও চেয়েছিল তার সন্তানের জন্য পবিত্র একটা পরিচয়৷ আমি সেই পরিচয়ের বাহন হয়ে এসেছি৷ আমাকে ফেরাবেন না।’
আশফিয়ার মা মেনে নিয়েছিলেন স্বামীর মুখ দেখে। আশফিয়ার বাবার মুখে ভেসে ওঠা ভাষা বলে দিচ্ছিল, তার মেয়ের সাথে শুধু তার সম্পর্ক। এই সন্তান উটকো ঝামেলা।
জাফরিন বেগম ইতিমধ্যে মেয়ের ঘরে এসে গেছেন। এত কাপড়চোপড় দেখে বিস্ময় নিয়ে নাহিদার দিকে তাকালেন তিনি। নাহিদা মুচকি হেসে ইফতেখারের দিকে ইশারা করল। ইফতেখার তখনও অধরাকে হাসাতে ব্যস্ত। একজন সামাজিক, দাম্ভিক পুরুষ যখন কোনো বাচ্চাকে হাসানোর জন্য নিজের মুখ বিকৃত করে, তখন ব্যাপারটা অন্যরকম হয়ে দাঁড়ায়। এখনও অন্যরকম লাগছে। একজন শিশুর সংস্পর্শে এলে যে অধিকাংশ মানুষ নরম প্রকৃতির হয়ে যায়—প্রমাণ স্বয়ং ইফতেখার।
‘আমার জন্য কিছু কিনিসনি?’
অধরাকে কাঁধে নিয়ে জাফরিনের দিকে তাকাল ইফতেখার, ‘এনেছি তো। বাবার জন্যেও এনেছি। ওগুলো তোমার ঘরে রেখে এসেছি।’
জাফরিন নিজের ঘরে গিয়ে শপিং-ব্যাগগুলো নিয়ে এলেন। তার চোখ-মুখ দেখেই বুঝা গেল, শাড়িটা বেশ পছন্দ হয়েছে।
জাফরিন মুচকি হেসে বললেন, ‘কী উপলক্ষ্যে এতকিছু?’
‘উপলক্ষ্য ছাড়া কি আনতে নেই?’
‘তা নয়। কিন্তু আগে তুই কখনও এভাবে কিছু আনিসনি।’
‘এবার থেকে আনব।’ গলার টাই ঠিক করতে করতে বলল ইফতেখার।
ইফতেখানের এই সুক্ষ্ম পরিবর্তন আনন্দের জোয়ার আনলো জাফরিনের হৃদয়ে। তার অন্তরে কে যেন হাতপাখা দিয়ে প্রশান্তির বাতাস করতে লাগল। কারণটা এমন নয় যে ইফতেখার এতকিছু কিনেছে বলে, বরং কেনাকাটার আড়ালে ইফতেখারের পরিবর্তনে।
চোখের কোণ থেকে জল মুছলেন জাফরিন। ইফতেখারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি তোর জন্য খাবার বেড়ে দিচ্ছি। হাত-মুখ ধুঁয়ে নে।’
‘উঁহু। সময় নেই মা। আমাকে এক্ষুণি যেতে হবে।আমি তো শুধু কাপড়গুলো দিতে এসেছিলাম।’
‘না খেয়ে যাবি?’
ইফতেখার সযত্নে জাফরিনকে আলিঙ্গন করে বলে গেল, ‘বাইরে গিয়ে খেয়ে নেব মা। এখন আসি।’
জাফরিনের দু’রকম অনুভূতি হচ্ছে। একটা কান্নার, আরেকটা খুশির। সেই খুশির ঝলক চোখে-মুখে ছড়িয়ে পড়ল মহূর্তে। নাহিদা বুঝতে পেরে জাফরিনকে জড়িয়ে ধরল।
জাফরিন বললেন, ‘সেই ইন্টারের রেজাল্ট বেরিয়েছিল যখন, তখন এসে ও জড়িয়ে ধরেছিল। তারপর তো অনেক কয় বছর কেটে গেল। মাঝে যে ওর কী হয়ে গেল। আর এভাবে জড়িয়ে ধরত না। আজ জড়িয়ে ধরল বলে মনটা কেমন ভরে গেল।’
হাসল নাহিদা। দুই ঠোঁট প্রসারিত হয়ে আলাদা হলো কিছু বলার জন্য। তখন’ই জাফরিন আবারও বললেন, ‘মাঝখানে তানজিমের সন্মান, মমতা ইফতেখারের অভাবগুলো একটু হলেও পূরণ করত।’
আর কিছু বলা হলো না নাহিদার। চুপ করে গেল সে। তানজিমের কথা শুনে বুকটা হুহু করে উঠল। হাজারও হোক, স্বামী তো! একটা মেয়ের কাছে স্বামীর চেয়ে বেশি দামি আর কিছু হয় না। তারপরও সত্যের কাছে মিথ্যার চাদরকে জয়ী হতে দেবে না বলে নাহিদার এতসব পদক্ষেপ। এভাবে সারাজীবন আলাদা থাকতে পারবে নাহিদা। শুধু স্বামীর পদবিটুকু সঙ্গে থাক। ওটুকু নিয়েই বাঁচা যাবে।
__________
অপু নিজের বড় বড় ঝাঁকড়া চুলগুলো আঁচড়ে ঠিক করছে। ফরমাল পোশাক পরে সাহেবি ভাব নিয়ে বারবার দেখছে নিজেকে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি রেখেছে। সেগুলোতে হাত বুলিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে সে৷ অনেকদিন হয়ে গেল নাহিদার সাথে অপুর দেখা হয় না। ঠিকমতো কথাও হয় না। উদাসীন মেয়েটিকে একটু হাসির পৃথিবীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চায় সে। তারউপর তানজিম যেহেতু নাহিদার আশেপাশে আর ভিড়তে পারে না, সেহেতু নাহিদার সাথে সময়ও ভালো কাটবে। খুব বেশিই ভালো কাটবে। পরপর ঝড় বয়ে গেছে নাহিদার উপর দিয়ে—এই তো অপুর সুযোগ, নাহিদার আরেকটু আপন হওয়ার।
শরীরে পার্ফিউম ছড়িয়ে লম্বা একটা শ্বাস নিল অপু। পাশে জানালার ধারে রজনীগন্ধার সুবাসও মিলিয়ে গেল সেই কড়া ঘ্রাণে। ইয়াসমিন ছেলের কর্মকাণ্ড দেখে কিছুই বললেন না। আজকাল বড্ড রাগ হয় তার ছেলের প্রতি। তানজিমের কড়া আচরণের পরেও এই বিল্ডিংয়ে রাখতে বলেছে অপু। ইয়াসমিনের খুব ক্ষোভ জন্মেছে তানজিমের প্রতি। কারণও আছে। সেদিন নাহিদা বাবার বাড়ির উদ্দেশ্যে নিজের কাপড়চোপড় গুছিয়ে চলে গেছে। ইয়াসমিন একটু তানজিমের প্রতি দুর্বল। অপুর মতোই তানজিমের বয়স। নিজের ছেলের মতোই তাই দেখেন তিনি। সেজন্য খাবার ঢেকে তানজিমের ঘরে ঢুকেছিলেন ইয়াসমিন। তানজিম খেতে চাইছিল না। ইয়াসমিন খাওয়ার জন্যে একটু জোর করায় তানজিমের সে কী রাগ! চোখ-মুখ কুঁচকে চিৎকার করে উঠেছিল তার প্রতি। সেদিন খুব রাগান্বিত হয়েছিলেন ইয়াসমিন৷ তবে রাগের চেয়ে মনে আঘাত পেয়েছিলেন বেশি। রাগটা সময়ের সাথে চলে গেলেও, মনের আঘাতটা বেশ তাজা রয়ে গেছে। সেজন্য ইয়াসমিন তানজিমকে ফ্ল্যাট থেকে বের করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু অপু বের হতে দিল না। সে খুব ভালো মানুষ সাজলো তানজিমের কাছে।
মুখ ঘুরিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন ইয়াসমিন। অপু ভ্রুক্ষেপ না করে গুন-গুন করতে করতে ফিটফাট হয়ে একগুচ্ছ গোলাপ নিয়ে বিল্ডিং থেকে বের হলো। খুব ভালো সময়ে বের হয়েছে সে। নাহিদার বাড়িতে যেতে চল্লিশ মিনিটের মতো সময় লাগবে। যেতেই বাজবে নয়টা। খেতে, আড্ডা দিতে এগারোটা বেজে যাবে। মনে হয় না আজ নাহিদা আসতে দেবে। তাছাড়া জাফরিন বেগমও বেশ পছন্দ করেন অপুকে। হাসপাতালে খুব আতিথেয়তা করা হয়েছিল তো তাদের, সেজন্য।
গুন-গুন করতে করতে গাড়িতে উঠল অপু। গাড়ি স্টার্ট করে কিছু সময় পর তানজিমের নাম্বারে কল করল সে। কয়েকবার কল করেও কোনো উত্তর না পেয়ে বিরক্তিকর শব্দ করে গাড়ি চালানোয় মন দিল। কোনো তাড়া নেই তার। আজ জোনায়েদ সাহেবের বাড়িতে থাকার ইচ্ছা নিয়েই বেরিয়েছে সে!
__________
জাফরিনের কোলে মাথা রেখে আছে নাহিদা। অধরা ঘুমিয়ে পড়েছে অনেক আগেই। নিজে মাতৃত্বের ছোঁয়া বিলিয়ে, সেই ছোঁয়া এখন নিজের মায়ের থেকে শুষে নিচ্ছে সে। কেন যেন চোখ ভরে জল আসছে বারবার৷ ইচ্ছে করছে ডুকরে কাঁদতে। এক ফোঁটা জল নাহিদার অজান্তে জাফরিনের হাতে পড়তেই চমকে উঠলেন তিনি। নাহিদা তৎক্ষনাৎ চোখের জলটুকু মুছে নিল। কিন্তু ভেজা চোখ আড়াল করতে পারল না৷
জাফরিন বাম হাতের পাঁচটা আঙুল বেশ যত্নে নাহিদার মাথার চুলে ঢুকিয়ে দিলেন৷ আদুরে কণ্ঠে বললেন, ‘অনেকদিন তো হয়ে গেল। আর কতদিন এভাবে? একবার তানজিমকে কল কর। নিশ্চয় এতদিনে ও নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে।’
তানজিমের কথা শুনেই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয় নাহিদার। ইচ্ছে করে তানজিমকে কল করে একটাবার তার পুরু কণ্ঠে ‘তোমাকে ছাড়া ভালো নেই’ শুনতে। কিন্তু বারংবার কোথায় যেন হোঁচট খায় আত্মাটা।
নাহিদার কোনো উত্তর না পেয়ে জাফরিন আবারও বলেলন, ‘মেয়েদের আসল বাড়ি হলো স্বামীর বাড়ি। বিয়ের পর স্বামী’ই সব। সংসার টিকিয়ে রাখতে গেলে মাঝে মাঝে একটু ছাড় দিতে হয়।’
নাহিদা সিক্ত গলায় বলে ওঠে, ‘ওর এমন ঘৃণ্য অপরাধে আর কত ছাড় দেবো মা? পুলিশকে এখন পর্যন্ত কিছু জানাইনি আমি। এর থেকে বেশি ছাড় দিলে ওর অপরাধ বেড়েই চলবে।’
‘দোষ স্বীকার করে সঠিক পথে ফিরে আসাই সবচেয়ে বড় গুণ। আমার মন বলছে, তানজিম সুধরে গেছে। ওর জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও এমন করত।’
‘অন্য কেউ থাকলে কী করত জানি না, তবে একটা ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশুকে সে হত্যা করার কথা ভাবতে পারত না। প্রথমবারে অসফল হয়ে দ্বিতীয়বার আবারও চেষ্টা করতে পারত না।’
জাফরিন বেগম একটু অবাক হলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘দ্বিতীয়বার মানে?’
জাফরিনের কোল থেকে উঠে বসল নাহিদা। সোজা মা জননীর মুখের দিকে চেয়ে বলল, ‘তোমাকে বলা হয়নি। অধরাকে অপারেশন থিয়েটারে মেরে ফেলার জন্য সুপারিশ করেছিল তানজিম। অগ্রিম এক লক্ষ টাকাও দিয়ে এসেছিল।’ শেষাংশ বলতে গিয়ে কান্নায় কণ্ঠরোধ হয়ে গেল নাহিদার।
জাফরিন যেন কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। তানজিম তো এমন ছেলে না। তিনি হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে বলেছে তোকে?’
নাহিদা দু’হাতে মুখ ঢেকে একবার ডুকরে কেঁদে বলল, ‘ডাক্টার আব্দুল মোস্তফা।’
(চলবে)