কিছু সমাপ্ত পূর্ণতার (পর্ব – ১১)
সুমাইয়া আক্তার
__________________
মেয়েদের জীবনে সবচেয়ে আনন্দের সময় আসে মাতৃত্বে। এই স্বাদ লেপ্টে থাকে শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গে। ছোট ছোট আঙুলগুলো যখন হাত আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করে, তখন ইচ্ছে জাগে—বাচ্চাটা এভাবে রেখে দিক, থেকে যাই! সেই খেলাই খেলে চলেছে নাহিদা। আশফিয়ার কন্যা নাহিদার অনামিকা আঙুল আঁকড়ে রেখে ঘুমিয়ে আছে। পলকহীন চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে নাহিদা। মনে মনে সে ভাবছে, এই সুন্দরী কন্যার নাম কী রাখা যায়!
আশফিয়া একবার বলেছিল, তার মেয়ের নাম রাখবে অধরা। যাকে সহজে ধরা যাবে না। কিন্তু নাহিদা তো অধরাকে ধরে ফেলেছে। আর ছাড়বে না!
নাহিদা ছোট্ট শিশুর গালে চুমু এঁকে কানে কানে বলল, ‘অধরা।’
জাফরিন পাশ থেকে নাহিদাকে সতর্ক করে দিলেন, ‘ঘুমন্ত বাচ্চাকে চুমু দিতে হয় না।’
নাহিদা কারণ জানতে চাইলে বলতে পারলেন না জাফরিন। এটা নাকি তিনি তার মায়ের থেকে শুনেছিলেন। তার মা আবার তার মায়ের থেকে। বলতে গেলে এই কথা পরম্পরার মতো চলে এসেছে। কিন্তু কারণটা কেউ জানে না!
অধরার ফর্সা, লালচে গাল দেখে চুমু না দিয়ে থাকা যায় না। তবুও জাফরিনের কথা অমান্য করার ফলে অধারর উপর এতটুকু মন্দ প্রভাব পড়ুক, তা চায় না নাহিদা। তাই বুকের সাথে মিশে রেখেছে অধরাকে। অধরা নাহিদার কোলে এসেছে ঘণ্টা চার হলো। তখন থেকেই আদরে নিজের কোলে সমাসীন করে রেখেছে নাহিদা। যেন তার নাড়ি ছেঁড়া ধন।
‘আশফিয়ার সাথে কি দেখা করতে দিচ্ছে না?’
জাফরিনের কথায় আশফিয়াকে দেখার ভাবনা উদ্রেক হলো নাহিদার। এতক্ষণ আশফিয়াকে দেখার ভাবনা ভুলে গেছিল প্রায়। এটা সম্পূর্ণ স্বার্থপরের মতো আচরণ হয়েছে। নাহিদা নিজেকেই কয়েকটা ধমক দিয়ে জাফরিনকে বলল, ‘একবার ডাক্টার মোস্তফাকে জিজ্ঞাসা করে দেখি।’
অধরাকে জাফরিনের কোলে দিতে গিয়ে অন্তরটা যেন কেঁপে উঠল নাহিদার। সে আরেকবার ঘুমন্ত অধরাকে নিজের কোলে নিয়ে গালে গাল ঘষল। জাফরিন খুব বেশিই অবাক হলেন। আশফিয়া সম্বন্ধে সব কথা শুনেছেন তিনি। কিন্তু তারপরও অধরার প্রতি নাহিদার এত ভালোবাসা খুব বেখাপ্পা দেখাচ্ছে। অন্যের সন্তানকেও এতটা ভালোবাসা যায় বুঝি?
জাফরিনের অবাক ধ্বনি, ‘মনে হচ্ছে ও তোর সন্তান।’
কথাটি শুনে নাহিদার অন্তরে শীতল স্রোত বয়ে গেল। হেসে বলল, ‘ও তো আমার’ই সন্তান।’ আরেকবার অধরার গালে গাল ঘষলো সে, ‘আমার সম্পদ।’
‘হয়েছে। এবার দ্রুত আশফিয়াকে দেখার ব্যবস্থা কর। বেচারি নিশ্চয় খুব কষ্টে আছে।’
ডাক্টার মোস্তফা কপালে দুই হাতের দুই বুড়ো আঙুল ঠেকিয়ে বসে আছেন। দরজায় আওয়াজ তুলে নাহিদা জানান দিল, তার দোরে কেউ অনুমতির অপেক্ষায়।
মাথা তুলে হাসলেন মোস্তফা। মুখ থেকে দুশ্চিন্তা লুকিয়ে বললেন, ‘আসুন মিসেস নাহিদা। বসুন।’
দ্রুত ভেতরে ঢুকল নাহিদা, ‘ধন্যবাদ।’ চেয়ার টেনে বসল সে, ‘আপনি আমাদের যে সাহায্য করেছেন, আমি ভুলব না। বারবার সাহায্য করছেন আপনি। আমি সত্যিই আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ।’
‘আবার আপনি কৃতজ্ঞতার কথা বলছেন? একজন ডাক্টার হিসেবে এটা আমার দায়িত্ব ছিল।’
‘সবাই তো আর সবার দায়িত্ব পালন করে না। যাই হোক, আমি কি এখন আশফিয়ার সাথে দেখা করতে পারব?’
এবার নিজের ভেতরে বওয়া অশান্তি দমিয়ে রাখতে পারলেন না মোস্তফা। অনেকটা অগোছালোভাবে বললেন, ‘না, না। এখন ওনার সাথে দেখা করা যাবে না।’
আশফিয়ার কথা শুনে ডাক্টার মোস্তফার এমন অশান্ত আচরণ অবাক করল নাহিদাকে। তবে তা ক্ষণস্থায়ী। নাহিদা একটু পর ব্যাপারটা মাথা ঝেড়ে ফেলল। কারণ মোস্তফা তাদের শুভাকাঙ্খী। তিনি যখন বলছেন আশফিয়ার সাথে দেখা করা যাবে না, তখন আসলেই হয়তো দেখা করার অনুমতি নেই। তবে আশফিয়াকে দেখার ইচ্ছা কেন যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেল। গত মধ্যরাতের পর থেকে আর একবারও দেখা মেলেনি মেয়েটির। কেমন অবস্থায় আছে কে জানে!
নাহিদা আমতা আমতা করে জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা ডাক্টার, আশফিয়ার অবস্থা কি বেশি খারাপ?’
মোস্তফা নিজের সুবিধা করার জন্য বললেন, ‘আজকের রাতটা আইসিইউতেই রাখতে হবে। যদি ভালো কিছু হয়, তবে…’
মোস্তফার ফোন বেজে উঠল। ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিললেন তিনি। অতঃপর কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা সাইলেন্ট করে রাখলেন।
পুরোটাই লক্ষ করল নাহিদা। তৎক্ষনাৎ জিজ্ঞাসা করল, ‘ডাক্টার, আপনি কী কোনো অসুবিধায় আছেন?’
আবারও হাসার চেষ্টা করলেন মোস্তফা। এক প্রকার নাহিদাকে তাড়িয়ে দেওয়ার মতো করে বললেন, ‘অসুবিধা আর কী? পেশেন্টের চাপ। আপনি এখন আসুন। আমি… আমি পরে জানিয়ে দেবো, যদি দেখা করার অনুমতি পাওয়া যায়।’
‘ঠিক আছে।’ বলে বেরিয়ে এলো নাহিদা।
ডাক্টার মোস্তফার আচরণ ভালো ঠেকছে না। কপালের চামড়া কুঁচকে হাঁটতে শুরু করল নাহিদা। হাসপাতালে একটা বাচ্চার কান্না শোনা যাচ্ছে। আর সেই কান্না যে অধরার, তা নাহিদার কানে কেউ যেন বলে দিয়ে গেল। দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দৌঁড়াল সে। অধরাকে দুধের বিকল্প হিসেবে বায়োমিল খাওয়াতে হচ্ছে। ছোট বাচ্চাকে এভাবে খাওয়ানো খুব’ই কষ্টকর।
আশফিয়ার ভাবনা’ই ঠিক। অধরা কেঁদে হাসপাতাল মাথায় তুলছে। জাফরিনের কোল থেকে অধরাকে নিয়ে নানান ভঙিমা করে কান্না আটকালো নাহিদা। কিন্তু পর পর’ই আবার কেঁদে উঠল। ক্ষুধার জ্বালা কি আর মিষ্টি কথায় মেটে? জাফরিন দ্রুত অধরার খাবার তৈরি করল। আর পরম মমতায় অধরাকে খাওয়াতে লাগল নাহিদা।অধরার খাওয়া শেষ হতেই ঘুমের রাজ্যে চলে গেল সে।
আজকের দিনটা কেমন যেন বিষণ্ন। রোদ নেই, চোখ ঝলসানো আলো নেই। নাহিদার মনে যেমন শান্তির শীতল হাওয়া বইছে, অন্যদিকে আরবের উত্তপ্ত মরুর মতো গরম হাওয়াও বইছে। তানজিম ফ্ল্যাটে একা আছে। এখন হয়তো আশফিয়ার অবস্থা বাইরের কেউ জানে না বলে সে শান্তিমতো ঘুরছে। কিন্তু সত্যি তো চাপা থাকে না। আইসিইউ থেকে আশফিয়াকে বের করলে একদিনও লাগবে না ব্যাপারটা পুলিশের কানে পৌঁছাতে। এখন পর্যন্ত কয়েকজন স্টুডেন্টস, দুইজন ডাক্টার এবং তিনজন নার্স ব্যাতিত এই হাসপাতালের কেউ এই খবর সঠিকভাবে জানে না। ভালো মতোই ব্যাপারটাকে চাপা দিতে পেরেছেন মোস্তফা আর অপু—তবে বেশিদিন নয়!
নাহিদার ফোন বেজে উঠল। অধরার থেকে চোখ সরিয়ে ফোনটা বের করল সে। আগ্রহবশত জাফরিনও এগিয়ে এলেন।
নাহিদা কল রিসিভ করে কানে ঠেকাতেই ওপাশ থেকে ডাক্টার মোস্তফা বলে উঠলেন, ‘পুলিশ কোনোভাবে ব্যাপারটা জেনে গেছে। তদন্তের জন্য আসছে। তবে সাবধান, আপনি যা দেখেছেন তা বলবেন না। বলবেন এতটুকুই যে, রান্নাঘরে পিছলে সবজি কাটা ছুরির মধ্যে পড়েছিলেন তিনি। পারবেন না?’
নিজের স্বামীকে বাঁচানোর সুপ্ত আশা নিয়ে নাহিদা বলল, ‘পারব।’
কলটা কেটে গেল। নাহিদা ভাবতে লাগল সে কী করবে। মিথ্যা বলা কি ঠিক হবে? নিজের স্বামীকে বাঁচাতে গিয়ে, অন্য একটা মেয়ের সাথে অন্যায় করা হচ্ছে না তো?
__________
তানজিম অনেক্ষণ থেকে বৈঠকঘরের সোফায় পড়ে আছে। নাহিদার আচরণ খুব বেশি কষ্ট দিচ্ছে তাকে। নাহিদা এখন ভালোই কথা বলতে শিখেছে। আজ যখন কথায় কথায় নাহিদা জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আশফিয়া ভুল করেছে মানছি। কিন্তু বাচ্চাটার কী দোষ?’
তানজিম রেগে বলেছিল, ‘ধরে নাও অপুর সাথে তোমার ঢলাঢলির পরিনাম।’
নাহিদা রেগে ঠোঁট বাকিয়েছিল। চিৎকার করেছিল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওর সাথে আমি ঢলাঢলি করি। তোমার যদি তা’ই মনে হয়, তবে শুনে রাখ, সেটাই সত্যি।’
ব্যাস, আর একটা কথা বলতে পারেনি তানজিম। তখন তার ইচ্ছে করছিল নাহিদাকে ঠাটিয়ে একটা চড় মারতে। কিন্তু কথাগুলো শুনে মানসিকভাবে সে ভেঙে পড়েছিল। আর সেই মানসিক ভাঙন শরীরকেও ভেঙে ফেলেছিল। তৎক্ষনাৎ সোফায় বসে পড়েছিল সে। তারপর আর সোফা থেকে ওঠা হয়নি। ক্ষুধার জ্বালায় পেটে ইঁদুর ছুটছে। কিন্তু তবুও মরার মতো পড়ে আছে তানজিম।
আর কিছু পরে সন্ধ্যা নামবে। অন্ধকার এসে আছড়ে পড়বে। গ্রাস করবে সবকিছু। তানজিম উঠে কিছু তৈরি করবে কিনা সে দ্বিধায় আছে৷ ফ্রিজে কিছু নেই। সে পাস্তা ছাড়া অন্যকিছু তৈরি করতেও পারে না। আগে কিছু ইচ্ছে করলে নাহিদাকে বলত। নাহিদা একগাল হেসে রান্নাঘরে যেত। তানজিম পিছু পিছু গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরত। কনুই দিয়ে গুঁতো দিত নাহিদা। তানজিম আরও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে চুলে মুখ গুঁজত। চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নিত। মাথায় আলতো করে মাথা ঠেকাত। নাহিদা তখন গুনগুন করে গান গেয়ে রান্নায় মগ্ন হতো। কোথায় গেল সে দিনগুলো? দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখের কোণ থেকে জল মুছল তানজিম।
__________
আইসিইউতে ঢুকে মাস্কটা ঠিক করলেন ডাক্টার আব্দুল মোস্তফা। স্কাল্পেলটা হাতে চকচক করছে তার। সেটা দেখে নিয়ে টিস্যু দিয়ে মুড়িয়ে নিলেন তিনি। বুক টানটান করে এগিয়ে গেলেন। অক্সিজেন মাস্কটা খুলে দিলেই কাজ শেষ। কিন্তু পরে সমস্যা হতে পারে। একবার যদি কারো সন্দেহ হয়, অক্সিজেনের অভাবে আশফিয়ার মৃত্যু হয়েছে, তবে বিপদটা তার দিকেই ধেয়ে আসবে। তবে এটা আশফিয়ার জন্য সহজ মৃত্যু হতো!
সন্ধ্যার কিছু আগে পুলিশ এসেছিল। কোনোরকম সন্দেহের কিছু না পেয়ে ফিরে গেছেন তারা। পুলিশের কানে খবরটা নিজেই দিয়েছিলেন মোস্তফা। কারণ একটাই, আশফিয়া মারা গেলে যেন হাসপাতালের নাম কোনোভাবেই না আসে। সত্য কখনো চাপা থাকে না। আশফিয়ার মৃত্যুর পর সামান্যতম সন্দেহ হলেও পুলিশি ঝামেলা শুরু হতো। আর তারপর কোনো না কোনোভাবে আলোর খোঁজে নেমে তদন্ত শেষে আলো মিলত। সেদিন কী হতো? এত রিস্ক নিতে চাননি মোস্তফা। ওদিকে দুইজন মানুষ’ই বারবার ফোন করে অতিষ্ট করে ফেলছে। একজন আশফিয়া ও আরেকজন তার সন্তানের মৃত্যুখবর চায়। দ্রুত, দ্রুত!
আশফিয়া শিশুর মতো সাদা বিছানায় শুয়ে আছে। নব মা হয়েছে বলে একটা নিষ্পাপ ভাব এসেছে মুখে। মুখের আনাচে-কানাচে ছোট্ট একটা শিশু দৌড়ে বেড়াচ্ছে।
স্কাল্পেলটা আবরণমুক্ত করে চোখের সামনে ধরলেন মোস্তফা। এটা নতুন। গত পর্ষু নিয়ে এসে আশফিয়া সহ দুইজন নারীর অপারেশন করানো হয়েছে শুধু। বড্ড ধারালো এটা!
মোস্তফা আশফিয়ার ব্যাণ্ডেজটা খুলতেই যাচ্ছিলেন, কিন্তু সকল পরিকল্পনায় জল ঢালতে এলো একজন নার্স। মোস্তফা কোনোমতে এটা সেটা বলে ম্যানেজ করলেন। নার্স সহজভাবে মেনে নিল। আর কোনো কথা না বলে শান্তভাবে বেরিয়ে এলেন মোস্তফা। বাইরে এসে সাদা রঙ করা দেওয়ালে একটা ঘুষি মারলেন তিনি। এরকম অশান্তিতে এর আগে পড়তে হয়নি কখনও। বিষয়টা আসলেই অশান্তির। প্রথম খুন করতে গিয়েও এতটা পরিকল্পনা করতে হয়নি। অপারেশন করার সময় জায়গামতো একটা ব্লেড চালিয়েছিলেন তিনি। একবারেই বাজিমাত!
নাহিদাকে অপর পাশ থেকে আসতে দেখে হাতে হাত আঁকড়ে শান্ত হলেন মোস্তফা। মুখে হাসি টেনে দিলেন। নিজের অগোছালো ভাবটাকে দমিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে লাগলেন। মোস্তফা অপ্রস্তুত গলায় বললেন, ‘কোথায় যাচ্ছেন?’
‘কোথাও না। আপনাকে দেখেই এগিয়ে এলাম।’ সহজ গলায় বলল নাহিদা।
‘কেন?’
‘আশফিয়ার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম যে!’
মাথায় হাত দিয়ে মনে পড়ার ভঙি করলেন মোস্তফা। লম্বা হেসে বললেন, ‘ও হ্যাঁ। আসলে আমার মনে ছিল না। আমি কথা বলে দেখব সমস্যা নেই।’
আইসিইউ-র বাইরে দাঁড়িয়ে আশফিয়াকে দেখার চেষ্টা করল নাহিদা। মোস্তফা তা লক্ষ করে বললেন, ‘কেমন সম্পর্ক আপনাদের? বলতে চাইছিলাম যে, কে হয় উনি আপনার?’
‘বোন।’
‘ওহ্। দেখেই মনে হয়।’ একটু ইতস্তত করে মোস্তফা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বাচ্চাটা কোথায়?’
‘আমার মায়ের কাছে আছে।’
‘আমি মাঝে মাঝে বাচ্চাটাকে দেখতে যাব।’
‘ঠিক আছে।’
‘যে কোনো সময় যেতে পারি।’
চোখ সরু করে মোস্তফার দিকে তাকাল নাহিদা। এই ডাক্টার তো আশ্চর্য মানুষ!
নিজের কেবিনে ঢুকে চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিলেন মোস্তফা। স্কাল্পেল্ ছুঁড়লেন কাচের টেবিলটায়। এমনিতেই টেনশনে মাথা ফেটে যাচ্ছে, তারউপর কিছুক্ষণ আগে নাহিদার চাহনিটাও ভালো ঠেকল না।
সহসা ফোন বেজে উঠল। চমকে উঠলেন মোস্তফা। দু’হাতে মুখ মুছে কল রিসিভ করলেন তিনি। ওপাশ থেকে হুঙ্কার ভেসে এলো, ‘কী করছেনটা কী আপনি? এখন পর্যন্ত সুখবর পেলাম না কেন? আপনার পকেট গরম করা হয়েছে ভুল। ঠাণ্ডা করতে কিন্তু সময় লাগবে না।’
‘আমাকে কালকের দিনটা সময় দিন। আইসিইউ-এ কাজটা সহজ নয়। কাল সকালেই আইসিইউ থেকে বের করা হবে ওনাকে। তারপর আপনাকে আর কিছু মনে করিয়ে দিতে হবে না।’
‘মনে থাকে যেন।’ কলটা কেটে গেল।
পরদিন।
আশফিয়ার অবস্থার উন্নতি হয়েছে বলে তাকে নরমাল বেডে শিফট করা হয়েছে। আশফিয়ার মলিন শিশুসুলভ মুখটা দেখে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো নাহিদার। তার মুখে নিষ্পাপ অধরার মতো একটি শিশু যেন ছুটে বেড়াচ্ছে দিক ভুলে। দিকের দিশা খোঁজা শিশুটি ধুলোয় নিপতিত হচ্ছে, আবারও দাঁড়াচ্ছে। মিটিমিটি করে চোখ খুলল আশফিয়া। আস্তে আস্তে করে অধরার কথা জিজ্ঞাসা করল। নাহিদা অধরাকে পরম মমতায় কোলছাড়া করল। আশফিয়া মৃদু হেসে একটা লম্বা শ্বাস নিল। মা না হয়েও নাহিদার এত আনন্দ হচ্ছে—আশফিয়ার কত আনন্দ হচ্ছে কে জানে! চোখ বেয়ে এক পশলা বৃষ্টির মতো অশ্রু ঝরল আশফিয়ার। নাহিদা তার হাতে আলতো করে চাপ দিল। সহসা ডাক্টার মোস্তফা ঘরে ঢুকলেন। চোখ মুছে উঠে দাঁড়াল নাহিদা। স্বাভাবিকভাবে আশফিয়ার হালচাল জিজ্ঞাসা করলেন মোস্তফা। জাফরিন কোন এক প্রয়োজনে নাহিদাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। অধরাকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে গেল নাহিদা। মোস্তফা যেন সেই সুযোগেই ছিলেন।
মোস্তফা হেসে বললেন, ‘একটা ইঞ্জেকশন দেবো আপনাকে। ব্যথা নিরাময়ের।’
চোখ বন্ধ করল আশফিয়া। কড়া ডোজের একটা ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে দিলেন তিনি।
কিছু পরেই আশফিয়া ঘুমিয়ে পড়ল। প্রিয় পরিচিত স্কাল্পেলটা বের করলেন মোস্তফা। আশফিয়ার ব্যাণ্ডেজটা দ্রুত খুলে ফেললেন তিনি। আশফিয়া ব্যথায় নড়ে উঠল, কিন্তু চোখ খোলারও শক্তি পেল না। পৃথিবীর সকল প্রকার ঘুম তাকে জেঁকে ধরেছে। চারপাশে তাকিয়ে জায়গামতো স্কাল্পেলটা গলার ক্ষতের মাঝে ঢুকিয়ে দিলেন মোস্তফা। কাঁপতে শুরু করল আশফিয়া। মোস্তফা দেরি করলেন না। ঔষধ ছাড়া ফের ব্যাণ্ডেজ করে বেরিয়ে এলেন। বেরোনোর আগে দেখে এলেন ঘুমে মগ্ন মেয়েটার ধড়ফড়। আর মাত্র কিছুক্ষণ এ কষ্ট! তারপর আশফিয়ার চিরতরে মুক্তি!
আহা পৃথিবীটা কত স্বার্থপর! একজনকে জীবন উপহার দেওয়ার তাগিদে আরেকজনের জীবন নিতে হয়।
(চলবে)