কিছু সমাপ্ত পূর্ণতার (পর্ব – ১০)
সুমাইয়া আক্তার
__________________
ডাক্টার আব্দুল মোস্তফা কপালের চামড়া জড়িয়ে অপারেশন থিয়েটারে আশফিয়াকে পুনঃপুন দেখে চলেছেন। আশফিয়ার বাম গালে নিচ থেকে গলা পর্যন্ত নেমে গেছে ছুরির ডগা। হা মেলে আছে ক্ষতটা। অনেক রক্ত বেরিয়ে গেছে এর মধ্যেই। তবে আশফিয়ার চাওয়া অনুযায়ী কোনোমতে তার প্রাথমিক চিকিৎসা শেষ করে সিজার করা হচ্ছে। আশফিয়ার ভয়—তার কিছু হলে বাচ্চাটাও বাঁচবে না। অনেক মানুষ’ই তো ডেটের আগে সিজার করে। ডাক্টার মোস্তফা সময় দিয়েছিলেন বৈশাখের বিশ তারিখে। সতেরো দিন আগে সিজার করা কোনো নতুন কিছু নয়। ডাক্টারও মেনে নিয়েছেন।
আশফিয়ার গালের নিচে যে আঘাতটা লেগেছে, সেটা বেশ দগদগে হয়ে আছে। নিচের মাংসটা অল্প কেটে নিচে ঝুলছিল। বিচ্ছিরি দেখাচ্ছিল। এখন সেটাকে কোনোমতে আটকে রাখা হয়েছে। অর্ধ শরীর অবশ করা হয়েছে বলে আঘাতের যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে বেচারি। টলমল চোখ কখনো টেনে খুলছে, আবার কখনো বন্ধ করে রাখছে।
স্বভাবগত সার্জিকাল মাস্কটা হাতের পিঠ দিয়ে আরেকটু তুললেন মোস্তফা। স্কাল্পেল্ এখনও তার হাতি বিবশ হয়ে আছে। অন্য ডাক্টারেরা নিজেদের কাজ করে চলেছে। সিনিয়র ডাক্টার ডাকলে মোস্তফা আশফিয়ার মুখ থেকে চোখ সরালেন। কিন্তু নিজের মাথার ভেতরে চলা যুদ্ধকে ভুলতে পারলেন না।
একসময় মোস্তফা তার সিনিয়রের হাতে স্কাল্পেল্ দিয়ে বললেন, ‘স্যার, আমি একটু অসুস্থ বোধ করছি।’
‘ব্যাপার না। আমি অপনারেশনটা করছি।’ কাঁধ চাপড়ে বললেন সিনিয়র।
একটু দূরে সরে দাঁড়ালেন মোস্তফা। সামনে আশফিয়াকে ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়ল মেডিকেল কলেজের বেস্ট কিছু স্টুডেন্ট।
হাতে জীবানু নাশক ঔষধ লাগিয়ে পকেট থেকে একটা আয়না বের করলেন মোস্তফা। ছোট আয়নাটায় মাস্কের বাইরে তার চোখগুলো দেখা যাচ্ছে। একচল্লিশ বছর বয়স তার। অথচ সবাই দেখে বলে ত্রিশ না পার হওয়া যুবক। এখনও মুখের চামড়া টানটান, শীতল চোখ, সুঠাম দেহ। বাড়িতে তার একটা সাত বছরের ছেলে আর ক্যান্সারে আক্রান্ত স্ত্রী। সেই স্ত্রী’র চিকিৎসা করাতে গিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন তিনি। আর সেই অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে মানুষ তাকে নানান অপকর্ম করতে বলে। বিনিময়ে দেয় মোটা অঙ্কের টাকা। এখনও দুই লক্ষ টাকা তার পকেটে আছে। এই টাকা দেওয়া হয়েছে অপারেশন থিয়েটারেই আশফিয়াকে শেষ করার জন্য। আশফিয়াকে মৃত ঘোষণা করতে পারলে আরও তিন লক্ষ টাকা পাবেন মোস্তফা। আরেকজন বাচ্চাটাকে শেষ করার সুপারিশ দিয়েছে। অগ্রিম পেমেন্ট করেছে এক লক্ষ টাকা। কাজ হলে আরও এক লক্ষ দেবে। এই কন্যা সন্তান আর তার মায়ের প্রতি সবার এত ক্ষোভ কেন কে জানে!
__________
সোফায় শরীর এলিয়ে মরার মতো পড়ে আছে নাহিদা। মাথাটা প্রচণ্ড ব্যথা করছে তার। পায়ের কাছে একটা প্লাস্টিকের বালতি। লাল রক্তগুলো পানির সাথে মিশে আছে ওতে। রান্নাঘরটা ভালো করে মুছে, বাড়িটা গোছগাছ করে মাত্র’ই বসল সে। বড্ড ক্লান্ত লাগছে। গোসল সেরে দ্রুত আশফিয়ার কাপড়-চোপড় গুছিয়ে হাসপাতালে যেতে হবে। কিন্তু চোখগুলো একটা শান্তির ঘুম চাইছে। হঠাৎ আশফিয়ার এমন অবস্থা প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়েছে তাকে।
আশফিয়া সিঁড়ি থেকে পড়ে যাওয়ার পরেই এমন কিছু জানিয়েছিল, যা নাহিদাকে বাকশক্তিহীন করে ফেলেছিল। সে সহজ গলায় বলেছিল সবটা। তার গর্ভে যে সন্তান আছে, সেটা তানজিমের নয়—সন্তানটি অন্য কারো। তানজিম একসময় আশফিয়াকে পছন্দ করত। সেই সুযোগেই তানজিমের সন্তান বলে এই ফ্ল্যাটে ঢুকেছিল সে। কারণ একটাই, নিজের সন্তানের একটা পরিচয় আর নিরাপত্তা। ইফতেখারও তাকে সাহায্য করেছিল এ ব্যাপারে। ইফতেখার অবশ্য আশফিয়াকে নিয়ে খুব সিরিয়াস ছিল। বিয়ে করতে চেয়েছিল। কিন্তু আশফিয়া এমন একটা মেয়ে, যার চোখে কাউকেই বিয়ে করার মতো ভালো লাগে না। আশফিয়ার গর্ভে কারো সন্তান আছে জানার পর ইফতেখার নিজেই সরে গিয়েছিল। তবে রোজ আশফিয়াকে ফোন করে নাহিদা আর তানজিমের খবর শুনত। উদ্দেশ্য ছিল তানজিমকে খারাপ প্রমাণ করা। ইফতেখার যেহেতু তানজিমকে একদম পছন্দ করে না, সেহেতু আশফিয়াকে সে’ই এই বুদ্ধিটা দেয় যে, ফ্ল্যাটে ঢুকে বলতে এটা তানজিমের সন্তান। তানজিম আশফিয়াকে আগে খুব পছন্দ করে নাহার ডাকত, বিধায় ব্যাপারটা নাহিদাকে বিশ্বাস করানো সহজ ছিল। এখানে ইফতেখারের স্বার্থ একটাই—নাহিদাকে তানজিমের থেকে আলাদা করে অন্য কোথাও বিয়ে দেওয়া। কে জানে কোন কারণে তার মনে হয়, তানজিমের সাথে তার আদরের বোন সুখী নয়। কিন্তু দিন দিন তানজিম আর নাহিদার মাঝে খুব বেশি ফাটল দেখা দিলে আশফিয়ার নিজের’ই খারাপ লাগতে শুরু করে। বিশেষত সে সিঁড়ি থেকে পড়ার পর নাহিদা যেভাবে সব ভুলে এগিয়ে এসেছিল, খোঁজ-খবর রাখছিল; তারপর কিছুতেই আর ঠকাতে পারছিল না সে। তাই সময়মতো সব বলে দেয় নাহিদাকে। নাহিদাও সব শুনে ধীরে ধীরে আশফিয়ার উপর থেকে রাগ, ঘৃণা উঠিয়ে নিতে শুরু করে। সে নিজেকে প্রশ্ন করে, সে এই পরিস্থিতে থাকলে কী করত? একটা মেয়ের কাছে তার সন্তান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তার একটা পরিচয় আর সম্পূর্ণ নিরাপত্তা যে কোনো মা’ই চাইবে। এটা দোষের নয়। তবে আশফিয়া কাজটা সম্পাদনা করতে যে পথ ধরেছিল, সেটা ভুল ছিল।
চোখের কোণ থেকে অশ্রু মুছে কিছু মহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করল নাহিদা। আশফিয়ার এ অবস্থা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না সে।
ফ্ল্যাটের দরজাটা খোলাই ছিল। হঠাৎ সেটা সম্পূর্ণ হা মেলে খুলতেই চোখ খুলল নাহিদা। দেখল, তানজিম দাঁড়িয়ে আছে। নাহিদা চোয়াল শক্ত করে রাগকে নিজের বশে আনার চেষ্টা করল। তানজিম যে এত নিচু মন মানসিকতা পোষণ করে, তা কখনোই জানতে পারেনি সে। নিজের স্বার্থ, নিজের শান্তির জন্য সে একজন মা ও সন্তানকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল! কতটা নিচু মানসিকতা হলে সে এমনটা করতে পারে?
টলতে টলতে ভেতরে ঢুকল তানজিম। এবড়োখেবড়ো পথে হাঁটলে যেমন হয়, তেমন হাঁটার ধরন তার। চোখগুলো লালচে। আশফিয়ার ওমন অবস্থার পর থেকে গায়েব ছিল তানজিম। আশফিয়াকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে আরেক কেলেঙ্কারি। ডাক্টাররা পুলিশকে না জানিয়ে অপারেশন করবেন না বলছিলেন। অপু আর ডাক্টার মোস্তফা সাহায্য করেছিল বলে অবশেষে আশফিয়াকে ওটিতে ঢোকানো গেছে। আর সব দোষ করে এখন টলতে টলতে ফ্ল্যাটে ফিরছে তানজিম। সে’ই যে আশফিয়াকে খুন করার চেষ্টা করেছিল, তা বুঝাই যাচ্ছে। কারণ তার মতো আশফিয়ার উপর আর কেউ রেগে নেই।
নাহিদা নিজের রাগ দমাতে পারছে না। রাগে চোখের পাতা ভিজে যাচ্ছে তার। শরীর কাঁপছে।
তানজিম নাহিদার খুব কাছে দাঁড়াল। জড়ানো কণ্ঠে বলল, ‘মুখটা এমন করে রেখেছ কেন? মনে হচ্ছে তোমার সন্তান মরে গেছে।’
সঙ্গে সঙ্গে তানজিমকে থাপ্পড় দেওয়ার জন্য হাত ওঠালো নাহিদা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তানজিমের জন্য মনে লালন করা সুপ্ত ভালোবাসা মাঝপথেই হাতটাকে থামিয়ে দিল।
নাহিদা দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘তানজিম, কতটা নোংরা তুমি! আজ ওদের কোনো ক্ষতি হয়ে গেলে তুমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে তো?’
‘কেন? ক্ষমা না করতে পারার কী আছে? যে মেয়েটা আমার শান্তির সংসারটা ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে, তোমার থেকে আমাকে আলাদা করে দিয়েছে; সেই মেয়ের এমনটাই হওয়া উচিৎ।’
‘চুপ করো তানজিম।’ চিৎকার করে উঠল নাহিদা, ‘চুপ করো। ওই মেয়েটা আমাদের সংসার ভাঙতে আসেনি। ও শুধু নিজের সন্তানের জন্য একটা নিরাপদ জায়গা চাইছিল।’
‘তুমি ওর পক্ষ নেওয়া বন্ধ করো।’
তানজিমের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নাহিদা বলল, ‘খুনি তুমি একটা।’
‘হ্যাঁ, তো?’
তানজিমের এমন স্বাভাবিক কথা দেখে অবাক না হয়ে পারল না নাহিদা। কত সহজ গলা তার! অবাক না হয়ে পারা যায় না।
__________
জাফরিন রোজকার মতোই নির্দিষ্ট সময়ে রান্নাঘরে আবদ্ধ। আজ জোনায়েদ সাহেবের কী যেন হয়েছে। নিশ্চুপে রান্নাঘরের এক কোণে টুল নিয়ে বসে আছেন। তাকিয়ে দেখছেন প্রিয় সহধর্মিণীকে। আটাশ বছর হচ্ছে তাদের বিয়ের। অথচ কখনও এত ঝগড়া হয়নি যে ব্যাপারটা ছাড়াছাড়ি পর্যন্ত গড়িয়েছে। দাম্পত্য জীবনে ঝগড়া হবে, রাগ, অভিমান সব হবে—সেটাকে বাড়তে দিয়ে ভাঙন পর্যন্ত নিয়ে যাওয়াটা কোনো যুক্তিযুক্ত বিষয় না। অথচ তাদের মেয়ের সম্পর্কটা এই কারণেই ভাঙনের পথে; বিশ্বাস কম।
জুতো না খুলেই ভেতরে প্রবেশ করে জাফরিনকে ডাকতে লাগল ইফতেখার। এই অসময়ে ছেলের আগমন কখনও হয়নি। তাই চুলোটা বন্ধ করে বেরিয়ে এলেন জাফরিন এবং জোনায়েদ।
ইফতেখার রাগে কিড়মিড় করে বলল, ‘বলেছিলাম তানজিম ছেলেটা ভালো না। এখন শোনা যাচ্ছে আশফিয়াকে ও খুন করতে চেয়েছিল। কতটা সাইকো ছেলে ভাবা যায়? নাহিদাকে তুমি এখানে ফেরত আসতে বলো।’
চমকে উঠলেন জাফরিন। অবুঝ কণ্ঠে বললেন, ‘কী বলছিস এসব?’
‘তুমি কিছু জানো না? আমি বাবাকে তো সবটা বলেছিলাম।’
জাফরিন জোনায়েদের দিকে তাকালেন। আটচল্লিশ বছরের মানুষটা কেমন নিমেষেই গুটিয়ে গেলেন। উদাশ গলায় বললেন, ‘তুমি চিন্তা করবে। তাই বলিনি।’
‘তুমি জানো আমি সহজে কোনোকিছু নিয়ে চিন্তা করি না। তাছাড়া আমি সবটা কেমন সামলে নিতে পারি, তাও তুমি জানো।’
আর কথা বাড়ালেন না জোনায়েদ।
ঘর থেকে ফোনটা নিয়ে জাফরিন কল করলেন নাহিদাকে। না জানি বেচারি মেয়েটির কী অবস্থা হচ্ছে! নাহিদা ফোন তুলে কিছু না বলে চুপ থাকল। তবে ওপাশ থেকে কান্না চাপিয়ে কাঁদলে যেমন অদ্ভুত শব্দ হয়, তেমন শব্দ হচ্ছে।
জাফরিন কোমল স্বরে ডাকলেন, ‘মা নাহিদা।’
এবার শব্দ করেই কাঁদল নাহিদা। জাফরিন বারণ করলেন না। কাঁদলে একটু মন হালকা হবে ভেবে সময় দিলেন।
নাহিদার কান্নার শব্দ কমলে জাফরিন বললেন, ‘তানজিম কোথায়?’ উত্তর দিল না নাহিদা। জাফরিন বুঝলেন, এই সময় তানজিমকে নিয়ে কোনো কথাই শুনবে না নাহিদা। তাই তিনি বললেন, ‘যা শুনছি, সব সত্যি?’
‘হ্যাঁ মা। তুমি—’ কান্নার দমকে মাঝখানেই কথা আটকে গেল নাহিদার।
ফোনে সব কথা হওয়া সম্ভব না ভেবে কল কেটে দিলেন জাফরিন। অর্ধ সেদ্ধ ভাত চুলোর উপরে রেখেই বুরখা পরে বেরিয়ে পড়লেন তিনি।
__________
সঠিক-ভুল ভাবতে ভাবতেই অপারেশন শেষ হলো আশফিয়ার। ডাক্টার মোস্তফা তখনও স্কাল্পেলটা হাতে ধরে রেখেছেন। ভাবছেন পকেটে থাকা টাকাগুলোর কথা। এর আগেও নৈপুণ্যতার সাথে তিনটা খুন করেছেন তিনি। পেয়েছেন মোটা অঙ্কের টাকা। কিন্তু ডাক্টার হওয়ার খাতিরে খুনগুলো বেশ ভোগান্তিতে ফেলে তাকে। ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসা তার কামাই দিয়ে সম্ভব না। তাই এই পথ বেছে নেওয়া। নিজের স্ত্রী ও সন্তানের জন্য এই পথ খুব কী পাপের হবে?
‘মোস্তফা—’ ডাকলেন সিনিয়র, ‘এখন ঠিক আছ তুমি?’
মোস্তফা মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘জি স্যার।’
‘রোগীকে আইসিইউ-তে রাখার ব্যবস্থা করো। তার অবস্থা খুব একটা ভালো ঠেকছে না আমার। সেকেণ্ডে সেকেণ্ডে গালের ক্ষতটা ভয়ঙ্কর হচ্ছে। অক্সিজেনেরও অভাব হচ্ছে।’
‘জি স্যার।’
আশফিয়ার দিকে তাকালেন মোস্তফা। আইসিইউ-তে রাখলে আশফিয়া ঠিক হয়ে যাবে তার সম্ভাবনা বেশি। তারমানে তাকেই কিছু করতে হবে। এখন সিনিয়রের উপর কথা বলা যাবে না। হিতে বিপরীত হতে পারে।
আশফিয়ার গলার আঘাতটা ভালো করে দেখলেন মোস্তফা। ব্যাণ্ডেজ করা হয়েছে ভালোভাবে। সেই ব্যাণ্ডেজটা খুলে স্কাল্পেলটা গলার ক্ষততে লাগিয়ে ঠেসে দিয়ে, উপরে ঔষধ না লাগিয়ে ব্যাণ্ডেজটা করে দিলেই কাজ শেষ। আশফিয়া আর বাঁচবে না! তারপর তার কন্যা সন্তানটির ব্যবস্থা করতে হবে!
(চলবে)