কালো মেঘের আভাস পর্ব-০৬

0
867

#কালো_মেঘের_আভাস
[পর্ব – ৬]
লেখক – শহীদ উল্লাহ সবুজ

চাকু হাতে নিয়ে মাক্স পড়া লোকটা ধিরে ধিরে মেঘলার দিকে এগিয়ে আসছে। ভয়ে মেঘলা পিছনের দিকে যেতে থাকে।

— কে আপনি? আর কেন আপনি আমার ক্ষতি করার জন্য এমন উঠে পড়ে লেগেছেন? আমি আপনার কী ক্ষতি করেছি?

— তুই আমার কি ক্ষতি করেছিস জানিস না? হাহাহা। তোর জানতেও হবে না। মনে কর আজ তোর জীবনের শেষ রাত। কাল ভোরের আলো তুই দেখতে পাবিনা।

এই কথা বলে লোকটা চাকু দিয়ে মেঘলাকে আঘাত করতে যাবে তখনই মেঘলা চিৎকার দিয়ে ঘুম থেকে উঠে যায়। ভয়ে মেঘলার পুরো শরীর কাপতে শুরু করে। আর মেঘলার কপাল দিয়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে থাকে। মেঘলা বুঝতে পারে এতক্ষণ সে একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু এমন ভয়ানক স্বপ্ন দেখার কারণ কী? কেউ কি আসলেই মেঘলার ক্ষতি করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে? মেঘলা কোনো কিছুই আর ভাবতে পারছেনা। ভয়ে মেঘলার পুরো হাত পা কাপতে শুরু করে। মেঘলা কাল কি নিয়ে যাবে সবার সামনে? তাহলে কি মেঘলা সারাজীবনের জন্য অর্ণবকে হারিয়ে ফেলবে? অর্ণব কীভাবে সব এতো সহজে ভুলে যেতে পারে? অর্ণবের মেঘলার সাথে কাটানোর কোনো মুহূর্ত সে মনে করতে পারছেনা নাকি সে অভিনয় করছে সবার সামনে? মেঘলা ভাবতে থাকে কী করা যায়? মেঘলার কাছে প্রমাণ করার মতো তো কোনো কিছুই নেই আর অবশিষ্ট। যা একটা কাবিন নামা ছিল সেটাও কে যেনো চুরি করে নিয়ে গেছে। কিন্তু কে করতে পারে এমন কাজ? এমন প্রশ্ন যখন মেঘলার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো তখনই তার মাথায় একটা আইডিয়া চলে আসে। অর্ণব কি তাকে আসলেই ভুলে গিয়েছে নাকি অভিনয় করছে। সেটা আগে খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু অর্ণবের বাবা কেন মেঘলাকে চিনতে পারছেনা? উনিও কি মেঘলাকে না চেনার অভিনয় করছে? কিন্তু উনি কেন এমন করবে? সব যেনো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। ঘড়িতে প্রায় একটা বাজে। মেঘলা আর দেরি না করে একটা বোরকা গায়ে দিয়ে ভালো ভাবে মুখ ডেকে বেরিয়ে পড়ে। উদ্দেশ্য অর্ণবের বাসা। কিছুক্ষণের মধ্যেই অর্ণবের বাসার সামনে পৌছে গেলো। মেঘলা এবার অর্ণবের বাসার সামনে গিয়ে দরজার কলিং বেলে চাপ দিতে থাকে।

কলিং বেলের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় অর্ণবের মায়ের। তিনি তার স্বামীকে ডেকে ঘুম থেকে তুলে।

— ঐ উঠুন। কেউ মনে হয় এসেছে। দরজার মধ্যে কলিং বেল বাজাচ্ছে।

— এতো রাতে আবার কে আসতে পারে?

— চলো গিয়ে দেখে আসি।

এবার দু’জনে উঠে দরজা খুলে দেখে একটা মেয়ে বোরকা পড়ে তাদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

— কে তুমি মা? এতো রাতে আমাদের বাসায় কেন আসলে তুমি?

— আমি খুব বিপদে পড়ে এখানে এসেছি।

— কি বিপদ?

মাঝ রাস্তায় আমাদের গাড়িটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। প্লিজ আমাকে আজ রাত টুকো আপনাদের বাসায় আশ্রয় দিবেন? আমি একা একটা মেয়ে এতো রাতে কোথায় যাবো?

— চিনিনা জানিনা, অচেনা একটা মানুষকে কীভাবে থাকতে দেবো?

— আমি তো আপনার মেয়ের সমান। আমাকে একটি রাতের জন্য আশ্রয় দিন। আমাকে যে কোনো একটা কোণে থাকতে দিলেই হবে। আমি শুধুই রাত টুকুন কাটিয়ে সকাল হলেই চলে যাবো।

অর্ণবের আম্মু তার স্বামীর কাছে বলল — মেয়েটাকে থাকতে দেওয়া উচিৎ। কারণ আমাদের এখানকার মানুষ গুলোও তেমন একটা ভালো না। মেয়েটার সাথে কেউ যদি খারাপ কিছু করে বসে?

— তুমি কথাটা খারাপ বলোনি। কিন্তু অচেনা একটা মেয়ে।

— আংকেল প্লিজ আমাকে একটু সাহায্য করুন।

— আচ্ছা ঠিক আছে। আজকে রাতে তুমি আমাদের বাসায় থাকতে পারো। যাও ফ্রেশ হয়ে আসো। আর কিছু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।

— ধন্যবাদ আপনাদের। আর আমি কিছু খাবনা। আমাকে আমার থাকার রুমটা দেখিয়ে দিলে হবে।

— আমি রুমে যাচ্ছি। তুমি মেয়ে টাকে একটা খালি রুম দেখিয়ে দাও। আর তুমি এভাবে হিজাব পড়ে আছো কেন গরম লাগছেনা? বোরকা আর হিজাব টা খুলে পেলো।

— আংকেল মাপ করবেন। আমি পরপুরুষের সামনে হিজাব খুলি না। আমি পর্দা করি।

মেঘলার কথা শুনে অর্ণবের বাবা আর কোনো কথা বলল না। তিনি তার রুমে চলে গেলো। এবার অর্ণবের আম্মু মেঘলাকে একটা রুমে নিয়ে গেলো। তারপর তিনি আবার চলে গেলেন ঘুমানোর জন্য। মেঘলা রুমের ভিতরে গিয়ে ভালো ভাবে দরজা বন্ধ করে বোরকা আর হিজাব খুলে পেলে। মেঘলা বসে বসে ভাবতে থাকে এখন সে কী করবে? মেঘলার বিশ্বাস যে বিয়ের আরেকটা কাবিন নামা তো এই বাসায় আছে। কারণ কাবিন নামা দুইটা হয়েছে একটা মেঘলার কাছে ছিল আরেকটা এই বাসায়। মেঘলার এই বাড়ির সব কিছুই পরিচিত। কোথায় কি রাখা আছে মেঘলা সব কিছুই জানে। অর্ণবের মৃত্যুর এক মাস পরেই মেঘলা এই বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। চলে যায় বললে ভুল হবে মেঘলাকে বাধ্য করা হয় এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে। মেঘলা কিছুক্ষণ পরে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে তার শ্বশুর শ্বাশুড়ির রুমের দিকে যায়। আড়ালে দাঁড়িয়ে উঁকি মেরে দেখে উনারা ঘুমিয়েছে কি-না। মেঘলা দেখে তারা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মেঘলা এবার তাদের স্টোর রুমে চলে গেলো। মেঘলা ভিতর গিয়ে সব কিছুই খুজতে থাকে। সব কাগজ খুঁজেও সে কাবিন নামা পায়না। মেঘলা একটা আলমারি দেখতে পায়। মেঘলা আলমারি খুলতে গিয়ে দেখে আলমারি লোক করা। বাসার সব চাবি কই থাকে মেঘলা সেটাও জানে। মেঘলা আবার তার শ্বশুর শ্বাশুড়ির রুমে চলে গেলো। সেখানে গিয়ে দেখে একটা চাবির গোছা পড়ে আছে খাটের কোণে। মেঘলা চাবির গোছাটা হাতে নিয়ে আবার সেই আলমারির কাছে চলে গেলো। পুরো আলমারি তন্নতন্ন করে খুঁজেও সে বিয়ের কাবিন নামা বা প্রমাণ করার মতো কিছুই পায়নি। মেঘলা সেখানে বসে কান্না করতে শুরু করে। মেঘলা এবার কি করবে? এসব ভাবতেই মেঘলা কান্না করতে থাকে।

এবার মেঘলা অর্ণবের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে দেখে অর্ণব ঘুমিয়ে আছে। মেঘলা এবার অর্ণবের পায়ের কাছে বসে কান্না করতে শুরু করে।

— অর্ণব, তুমি কীভাবে এতো সহজে আমাকে ভুলে যেতে পারলে? আমাদের ভালোবাসা তো মিথ্যা ছিলনা। তুমি কীভাবে পারলে? তুমি তো আগে এমন ছিলেনা! আমি কীভাবে প্রমাণ করব যে তুমি শুধুই আমার? তুমিও আমাকে চিনতে পারছোনা। না আছে আমার কাছে কোনো প্রমাণ। আমি কি করব প্লিজ আমাকে তুমি বলে দাও। আমি যে আর পারছিনা অর্ণব। আমি তোমাকে কখনও অন্যকারো সাথে সহ্য করতে পারবোনা।

হঠাৎ করে অর্ণব নড়েচড়ে উঠে। সাথে সাথে মেঘলা লুকিয়ে যায়। অর্ণব আবার ঘুমিয়ে পড়ে। মেঘলা এবার অর্ণবের রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আর সে বাসা থেকেও বেরিয়ে নিজের বাসায় চলে গেলো। মেঘলা বাসায় গিয়ে কান্না করতে থাকে। সে তার ভালোবাসার মানুষকে পেয়ে আবার হারিয়ে ফেলছে।

দেখতে দেখতে সকাল হয়ে গেলো। মেঘলা সারারাত না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিল। আজ যদি প্রমাণ করতে না পারে অর্ণব মেঘলার স্বামী তাহলে মেঘলা চিরদিনের জন্য অর্ণবকে হারিয়ে ফেলবে। এইদিকে অর্ণবের বাবা-মা ঘুম থেকে উঠে দেখে মেয়েটা নেই। তারা বুঝতে পারে মেয়েটা হয়তো সকাল সকাল চলে গিয়েছে। তারা তাই আর এসব নিয়ে আলোচনা করেনি আর। তারা অবাক হলো মেয়েটা তাদের না বলেই চলে গেলো।

সবাই রেডি হয়ে নীলার বাসায় চলে আসে। অর্ণব আর তার বাবাও চলে আসে। সবাই মেঘলার অপেক্ষা করছে। নীলা এবার মেঘলার নাম্বারে ফোন দেয়।

— কিরে মেঘলা তুই কখন আসবি? সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে। আর তোর কোনো খবর নেই। আর হে সরিরে কাল আমার ফোন অফ হয়ে গিয়েছিলো। তাই আর তোর সাথে কথা বলতে পারিনি। তুই এখানে আয় বাকি কথা এখানে আসলে হবে।

— নীলা তোকে কিছু কথা বলার ছিল আমার।

— এখানে আয় আগে তারপর তোর সব কথা শুনবো। এখানে সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করে আছে। রাখলাম তাড়াতাড়ি চলে আয়।

নীলা আর মেঘলাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দিলো।

অর্ণবের বাবা বলল — নীলা মা মেঘলা কি বলল? আসছে নাকি পালিয়ে গিয়েছে?

— না আংকেল ও আসছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন।

— আমার তো মনে হচ্ছে ও আর আসবেনা। আসলে আরো আগেই আসতো। আমার কেমন জানি মনে হচ্ছে সব কিছুই মেঘলার সাজানো নাটক।

বাবার কথা শুনে অর্ণব বলে উঠে — বাবা এখনও কোনো কিছুই প্রমাণ হয়নি। আগে প্রমাণ হোক। তারপর কাওকে নিয়ে কথা বলবেন। একটা মেয়ে কেন তার স্বামীকে নিয়ে মিথ্যে কথা বলবে? হয়তো ওর কোনো ভুল হচ্ছে। মেয়েটার স্বামী মারা গিয়েছে। হয়তো সে এখনও তার স্বামীকে ভুলতে পারেনি। তাই আমাকে দেখে ভুল করেছে। মেয়ে আসুক তারপর দেখা যাবে কী হয়। এখন আমরা অপেক্ষা করি তার আসার।

অর্ণবের কথা শুনে নীলা আর অর্ণবের বাবা অবাক হয়ে গেলো। এবার সবাই চুপচাপ মেঘলার অপেক্ষা করতে থাকে।

চলবে??

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে