কারিনা (শেষ পর্ব)
আনাহিতা খুব ভয় পেয়ে গেছিল। তীব্রভাবে কাঁদছিল। ওকে নিয়ে পায়চারী করতে করতে বুঝতে পারলাম খুব বড়ো ধরণের একটা ভুল করে ফেলেছি। বেডরুমে না ঢুকে যদি সোজা বাইরে বেরিয়ে পড়ে দরজা বন্ধ করে দিতাম তবে বিড়ালটা কোনোভাবে বাড়ির বাইরে আসতে পারত না। এখন বেডরুমে আমি পুরাপুরিভাবে আটকা পড়ে গেলাম, সাথে ফোনও নাই যে কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারব। উপরন্ত সাথে রয়েছে আনাহিতা যার ওপরে বিড়ালটার তীব্র আক্রোশ দেখা যাচ্ছে।
এই প্রথম খুব অসহায় লাগল। মনে হল আমি একেবারে কোণঠাসা হয়ে পৃথিবীর এককোণে পড়ে গেছি। সমস্ত পৃথিবী যেন যোগসাজশ করে আমাকে বিপদে ফেলবার মতলব করছে। আমি কি নিজেকে বাঁচাতে পারব? আমার বাচ্চাকে বাঁচাতে পারব?
সাথেসাথে আরেকজনের কথা চকিতে মনে পড়ে গেল।
মা!
মাও কি বাবার সাথে ছাড়াছাড়ির পর এমনটা অনুভব করেছিল? ছোট আমাকে নিয়ে অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশে পড়ে গিয়ে কি তারও মনে হয়েছিল যে সে এ পৃথিবীতে সম্পূর্ণ একা? কেউ একজন নেই যে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে? এজন্যই কি সে বদলে গেছিল?
আনাহিতাকে নিয়ে বেশ অনেক্ষণ হাঁটলাম। কিছুক্ষণ আগেই ওকে ওষুধ খাইয়েছিলাম, তার প্রভাবে ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ল সে। ওদিকে ড্রয়িংরুম থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছি না। মরে গেল নাকি বিড়ালটা? যে শক্তিতে তাকে আমি লাথি মেরেছি, তাতে মরেও যেতে পারে। দেয়ালের সাথে বাড়ি খেয়েও বেমক্কা চোট লাগতে পারে।
হঠাত করে দরজায় ঘষঘষ শব্দ আরম্ভ হল। কান পেতে শুনে বুঝতে চেষ্টা করলাম এ কীসের শব্দ। মনে হচ্ছে কেউ ধারাল কিছু দিয়ে দরজার নীচের অংশ চিড়বার চেষ্টা করছে।
— ম্যাও!
নিশ্চিত হয়ে গেলাম আমি। ও মানে কারিনা মরেনি। লাথি খেয়ে কিছুক্ষণ পড়ে ছিল। এখন দরজা আঁচড়ে কামড়ে শেষ করে দেবার চেষ্টা করছে।
ভাবতেই শিরদাঁড়া দিয়ে হিমশীতল একটা স্রোত নেমে গেল।
আনাহিতাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আমি ওরদিকে পলকহীন চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। ধীরে ধীরে শিরদাঁড়া সোজা হয়ে এল আমার। আমি আবার পায়চারী শুরু করলাম।
আমার চরিত্রের একটা উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে বিপদে আমার মাথা একেবারে ঠান্ডা হয়ে যায়। খুব ঠান্ডা মাথায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারি আমি তখন। বিপদের গুরুত্ব নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করে তার সবচাইতে ভালো সলিউশান একচক্ষু দানবের মতো, গোয়ারের মতো আঁকড়ে ধরি।
এও আমার ছেলেবেলা থেকে পাওয়া শিক্ষা। মনে আছে কিশোরীকালে একবার মা অফিসের কাজে আটকা পড়েছিল। আমাকে ফোন করে বলেছিল আসতে দেরী হবে, আজ যেন প্রাইভেট টিউটারকে আসতে মানা করে দেই।
ফোন রাখতে না রাখতেই দরজায় টিউটার কলিং বেল বাজালো। আমি দরজা খুলে তাকে জানালাম যে আজ পড়ব না। সে এক গ্লাস পানি চাইল। তাকে ড্রইং রুমে বসিয়ে পানি নিয়ে এসে তার সামনে ধরতেই সে আমাকে এক ঝটকায় তার কোলে বসিয়ে আমার সদ্য উদ্ভিন্ন বুকে হাত দিয়েছিল। নিশ্চয় বুঝে ফেলেছিল বাসায় কেউ নাই। ছাড়া পাবার জন্য আমি তখন ছটফট করছি। তাতে সে যেন মজা পেয়ে গেল। সাপের মতো তার হাত আমার শরীরের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াতে থাকল।
সেদিনও বিপদ বুঝে হুট করে আমার মাথা একদম ঠান্ডা হয়ে গেছিল। আমি ছটফট করা বন্ধ করলাম। টিউটারের অলক্ষ্যে সাইড টেবিল থেকে ফুলদানিটা তুলে নিয়ে স্যারের মাথার পিছে সর্বশক্তি দিয়ে বাড়ি দিয়েই লাফ মেরে কোল থেকে উঠে পড়লাম।
স্যার ততক্ষণে দুহাতে মাথা চেপে ধরে সামনে ঝুঁকে পড়েছে।
ফুলদানি উঁচিয়ে বরফের মতো ঠান্ডা গলায় আমি হিসহিস করে উঠলাম
— আপনি যাবেন নাকি আরেকটা বাড়ি দিব? আমার এক চিৎকারে কিন্তু ফ্ল্যাটের অন্যেরা দৌড়ে আসবে।
কোনোমতে উঠে দৌড়ে পালিয়ে গেছিল সে সেদিন। আর কোনোদিন তাকে দেখিনি।
আমি খুব স্বাভাবিকভাবে দরজাটা লাগিয়ে গোসলে চলে গেলাম। অনেক্ষণ গোসল করবার পর শরীরের নোংরা, ক্লেদাক্তভাবটা যখন কমল, তখন বের হয়েই মা’র মুখোমুখি পড়ে গেলাম। মা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল
— এই রাতে গোসল করলে?
আমার অভিব্যক্তি খুব স্বাভাবিক থাকল
— বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলাম। ওপরতলার দুষ্টু ছেলেটা ময়লা ফেলল, বাতাসে পুরোটাই গায়ে এসে লেগেছিল। গোসল না করে উপায় ছিল না, মা।
আজো যখন দেখছি আমার ওপরে, না আমার ওপরে না, আমার আনাহিতার ওপরে বিপদ নেমে আসছে তখন হুট করেই আমি একদম শান্ত হয়ে গেলাম। উত্তপ্ত মাথাটা নিমেষে ধীরভাবে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য সমাধান খুঁজতে লাগল।
দরজায় ক্রমাগত আঁচড় দিচ্ছে কারিনা। ধীরে ধীরে ওর শক্তি বেড়ে যাচ্ছে টের পাচ্ছি। এক একবার করে কাঠ চিড়ে যাবার শব্দও পাচ্ছি। কিন্তু ভিতরে আমি নিস্কম্প। পায়চারী করতে করতে ভাবতে লাগলাম কেন কারিনা এমন করছে? এতদিন ধরে যাওয়া আসা করছে, কখনো তো ওকে হিংস্র দেখিনি। ও তো আমি। আমার মধ্যে যদি হিংস্রতা না থাকে, ওরমধ্যে আসবে কেন?
কারণ বের করতে মনের মধ্যে আঁতিপাঁতি করে খুজতে থাকলাম আমি।
মনে পড়ল আমিনা বলেছিল
— তোমার আর কারিনার জীবন হুবহু একরকম হবে। এমনকি জন্ম মৃত্যুও একসাথে ঘটবে। কিন্তু যদি দুজনের জীবনের মধ্যে পার্থক্য দেখা দেয় আর তোমার কারিনা যদি সেটা টের পেয়ে যায়, তবে অনেকক্ষেত্রে বিপদ ডেকে আনতে পারে। তখন সে হতে পারে তোমার ইভেল টুইন। কিন্তু সে তোমাকে কখনোই মেরে ফেলবে না। কারণ তোমাকে মারলে তার নিজের অস্তিত্বও মুছে যাবে।
আরেকবার নীচে বিড়াল যখন আমাকে প্রায় আক্রমণ করছিল তখন আমিনা বলেছিল
— ব্যাপারটা আমার ভালো লাগল না, দীবা। হয়ত ওর বাচ্চা নাই। তাই তোমাকে হিংসা করছে। কিছু একটা আছে তো বটেই।
হুট করে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি।
পেয়েছি!
এটাই একমাত্র ব্যাখ্যা।
কারিনার সাথে আমার আত্মিক যোগাযোগ রয়েছে। কোনোভাবে সে আমার সন্ধান পেয়ে কৌতূহলী হয়ে বারবার এসেছে। আমিও নিজের লেখার কাজে ওকে ব্যবহার করব বলে প্রশ্রয় দিয়েছি। একসময়ে ওর কৌতূহল অনেকটাই কমে এসেছিল। তার আসা অনিয়মিত হয়ে পড়ল।
কিন্তু অনেকদিন বাদে এসে আনাহিতাকে আবিষ্কার করে সবকিছু বদলে গেল।
হাতের উল্টাপিঠের মতোই কারিনা আমাকে চেনে, চেনে আমার মনের অলিগলি। কারণ সে তো আমিই। দীবা ও কারিনা একই ব্যক্তি। কিন্তু আনাহিতা হবার পর আমি ওর কাছে হয়ে গেলাম অপরিচিত। কারণ ও আমার মাতৃরূপটা চিনতে পারছে না।
কেন চিনতে পারছে না?
তার একমাত্র কারণ হচ্ছে কারিনা নিজে মা না। যারজন্য আনাহিতাকে নিয়ে আমার অবসেশানটা ও ধরতে পারছে না। আর পারছে না বলেই ওর মাঝে এসেছে অভিমান। অভিমান থেকে ক্ষোভ, ক্ষোভ থেকে তীব্র প্রতিশোধের ইচ্ছা। এদিকে আমার মাতৃত্ব হচ্ছে আমার সবচাইতে বড় দুর্বলতা। এটাকেই কারিনা টার্গেট করেছে।
তারমানে কারিনা যদি কোনোভাবে দরজা ভাঙতেও পারে, তবে সে আমার কোনো ক্ষতি করবে না, আনাহিতার ক্ষতি করবে। হয়ত তাকে মেরে ফেলবে। হয়ত বলছি কেন, নিশ্চয় মারবে।
এর সমাধান একটাই। কারিনাকে চলে যেতে হবে।
কিন্তু কিভাবে?
দরজার মাঝবরাবর পর্যন্ত চিড়বার শব্দ পেলাম। এতক্ষণ শব্দটা আসছিল দরজার নীচে থেকে।
তবে কি? তবে কি কারিনা আরও শক্তিশালী হচ্ছে? আমার আর ওর মানসিক দ্বন্দে কি ও জিতে যাচ্ছে? ও কি বিড়াল থেকে ধীরে ধীরে মানুষের রূপ নিচ্ছে?
মানুষেররূপে এলে তো ওর শক্তিও বহুগুণে বেড়ে যাবে। তখন কী হবে?
দৌড়ে গিয়ে ড্রয়ারটা টেনে খুললাম। ভেতর থেকে মাছ লকেট আর থলেটা বের করলাম। পাগলের মতো দৌড়ে গেলাম আনাহিতার কাছে। ওর বালিশের তলায় গুঁজে দিলাম থলেটা।
চড়াৎ!
দরজার কিছু অংশ নখের আঁচড়ে ভেঙে এল টের পেলাম। কারিনা কি তাহলে এখন বিড়াল মানবী? আঁচড়ের শব্দটা আবার দরজার মাঝবরাবর থেকে এল। এত উঁচুতে কোনো বিড়াল পৌঁছাতে পারবে না।
মাছ লকেট হাতে দরজার দিকে দৌড়ে গেলাম। এ দরজার হাতলে চাবির ফুটা নাই, অটোমেটিক লক। নাহলে কারিনা নিশ্চয় ফুটা গলে চলে আসবার চেষ্টা করত। পারছে না বলে দরজা আঁচড়ে কামড়ে ভেঙে দিতে চাইছে।
মাছ লকেটটা দরজা ঘেঁষে মেঝেতে রাখতেই ম্যাও শব্দে ভারী কিছু ছিটকে পড়বার শব্দ পেলাম। কিন্তু পরমুহূর্তেই দ্বিগুণ আক্রোশে কারিনা দরজার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মনে হচ্ছে যেন সে এবারে দরজা ভেঙেই ছাড়বে। শব্দটাও দরজার ওপরভাগ থেকে আসছে। তারমানে কি কারিনা এখন আমার চাইতেও শক্তিশালী হয়ে গেছে?
রাগ! ক্ষোভ! প্রতিশোধের ইচ্ছা!
সবকয়টাই কারিনার মধ্যে বিদ্যমান। এসবই কি ওর শক্তির উৎস?
তাহলে যত বাধাপ্রাপ্ত হবে, ততোই ওর হিংস্রতা বেড়ে যাবে!
কিন্তু কেন এমন হল? মাছ লকেট কাজ করছে না কেন?
মনে পড়ল আমিনা বলেছিল
— প্লিজ লকেটটা পরে থেকো, দীবা। কবচের শক্তি বাড়ে পরে থাকলে, ফেলে রাখলে একসময়ে এর ক্ষমতা নাই হয়ে যাবে।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত বারোটা। আকাশ পৌঁছাবে সকাল আটটার ফ্লাইটে। তারপরে ট্রাফিক জাম ঠেলে বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকাল দশটা।
চড়াৎ।
দরজার আরো একটা অংশ চিড়ে গেল বুঝতে পারলাম। কারিনা ভীষণ শক্তিশালী হয়ে উঠছে।
পরিষ্কার বুঝতে পারলাম সকাল দশটা পর্যন্ত কারিনাকে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। তার আগেই ও দরজা ভেঙে ফেলে ঘরে ঢুকে পড়বে। তারপরে…তারপরে… আনাহিতাকে!
না!
চিৎকার করে উঠলাম আমি।
না! আনাহিতার গায়ে একটা আঁচড়ও পড়তে দিব না আমি। সারা পৃথিবীও যদি আমার বিপক্ষে যায়, তাও আনাহিতাকে আমি রক্ষা করব।
সে রক্ষা করবার একটাই উপায়।
বাথরুমে গেলাম, কাউন্টারের ওপরে আকাশকে দেয়া আমার উপহার পুরানো আমলের রেজার সেট সাজানো রয়েছে, সাথে সোনামুখী ব্লেড।
ব্লেডটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলাম।
তারপর নির্বিকার মুখে লাইট অফ করে দিয়ে বেরিয়ে এলাম।
টেবিল চেয়ারে বসলাম, ড্রয়ার খুলে ডায়রীটা বের করলাম। তারপর ব্লেডটা হাতে তুলে নিয়ে পরপর দুই কব্জীতে কয়েকটা পোঁচ দিলাম। গলগল করে রক্ত বেরুতে লাগল।
ঠান্ডা চোখে একবার সেদিকে দেখলাম। তারপর নিস্কম্প হাতে পেন তুলে লিখতে আরম্ভ করলাম।
মা, তোমাকে আমি যেন বুঝতে পারছি। তুমি শুধু মা ছিলে না। ছিলে দোষ গুণে মেলানো একজন মানুষ।
ভুল তুমিও করেছিলে, ভুল আমিও করেছি। আমরা তো মানুষ, মহামানব না।
আকাশ, তোমার সাথে অল্প কয়দিনই থাকতে পারলাম। কিন্তু তারমাঝেই পুরুষদের প্রতি আমার ঘৃণা তুমি অনেকখানি মুছে দিয়েছিলে। এ কথাটা তোমাকে কোনোদিন বলিনি, এ দুঃখ আমার রয়ে যাবে।
আনাহিতা, মা তোমাকে খুবি ভালোবাসে। মা’কে ভুল বুঝো না।
মাসখানেক পরের কথা
দরজায় চাবি ঘুরিয়ে ঘরে ঢুকল আকাশ। দরজা থেকেই একবার চারিদিক তাকিয়ে দেখল।
দীবার সাজানো সংসার। কী খুঁতখুঁতে ছিল দীবা। অথচ আজ ওর হাতে গড়া সংসারটা লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়ে রয়েছে। চারিদিকে ধূলা।
দরজা বন্ধ করে ভিতরে এসে দাঁড়াল আকাশ। সেদিন সকালের কথা ও পারতপক্ষে মনে করতে চায় না। ঐদিনের পর আর এখানে আসেওনি। কিন্তু আজ আসতেই হল। এগারোটায় টাইম দেয়া আছে। ওরা এসে সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে যাবে। এ অভিশপ্ত জায়গার কিছুই রাখবে না আকাশ। তারপরে চাবি বুঝিয়ে দিয়ে ও এ বাড়ির সাথে সব সম্পর্ক চুকিয়ে দেবে।
সেদিন সকালে জ্যামটা একটু বেশিই ছিল। তিতিবিরক্ত হয়ে গেছিল ও। উবারে বসে কয়েকবার দীবাকে কল দিতে চেষ্টা করেছিল। দীবা ধরেনি। ভেবেছিল ঘুমুচ্ছে।
এত সুন্দর একটা দিন ছিল সেদিন। আসতে আসতে ভাবছিল অপ্রত্যাশিতভাবে একটা দিন ছুটি পেয়েছে, দীবাকে বলবে
— চল, আজ আমরা বাইরে কোথাও খেয়ে আসি।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল আকাশ। মানুষ ভাবে কী আর হয় কী।
ঘরে ঢুকেই চমকে গেছিল। সারা ঘর লণ্ডভণ্ড।
— দীবা! দীবা!
বেডরুম থেকে আনাহিতার কান্নার শব্দ ভেসে আসতেই সেদিকে ছুটে গেছিল। গিয়ে দেখল দরজা ভেতর থেকে লক করা। বারবার ডাকা সত্ত্বেও দীবার সাড়া নাই। দরজাটাও নীচের দিকে কেউ ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেছে কিন্তু পুরাটা পারেনি।
দিশেহারার মতো কিচেনে দৌড়ে গিয়ে কাবার্ডে রাখা হাতুড়িটা নিয়ে ফিরে এসে দরজার নবে পাগলের মতো বাড়ি মারতে থাকল ও।
কেমন করে একসময়ে দরজা খুলেছিল এখন আর মনে করতে পারে না। কিন্তু ভিতরে ঢুকে যে দৃশ্য দেখল, সেটা ওর আজীবন মনে থাকবে।
আনাহিতা বিছানায় গলা ফাটিয়ে কাঁদছে। আর দীবা ঘরের চেয়ার টেবিলে বসে রয়েছে। চোখদুটো খোলা, হাতদুটো দুপাশে ঝুলছে, চারিদিকে শুধু রক্ত আর রক্ত।
তারপরে তেমনকিছু মনে করতে পারে না ও।
একসময় দেখে পুলিশ, বাবামা, দীবার মা’কে। কে জানি অনাহিতাকে কোলে করে নিয়ে গেল।
শুধু এটুকু মনে আছে, পুলিশ আসবার আগেই ও দীবার রক্তমাখা খোলা ডায়রিটা নিজের ব্যাকপ্যাকে ঢুকিয়ে ফেলেছিল। কারণ সেখানে আকাশ নামটা দেখেছিল। ও চায়নি দীবা ওকে ব্যক্তিগতভাবে যা লিখে রেখে গেছে তা সবার হাতেহাতে ঘুরুক।
দরজার সামনে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল আকাশ। কার্পেটে বেশ বড় জায়গা জুড়ে গোল কালো দাগ। যেন তেলতেলে আলকাতরা শুকিয়ে রয়েছে। আজ আকাশ জানে ও কিসের দাগ। সেদিন খুব আশ্চর্য হয়েছিল।
রুমে ঢুকবার সাহস হল না আকাশের। পুরা রুমজুড়ে শুকনো রক্তের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে।
বুকটা মুচড়ে উঠল আকাশের। লক্ষ কোটিবারের মতো আজকেও মনের মধ্যে হাহাকার উঠল
— কেন, দীবা, কেন? কেন বিশ্বাস করে আমাকে একটিবার বললে না?
দীবার ডায়রীটা পড়েছে আকাশ। বুঝতে পেরেছে কতখানি আত্মত্যাগ দীবা করেছে। অথচ ঘরে বাইরে দীবার দুর্নামে কান পাতা যাচ্ছে না।
সবাই ছিঃ ছিঃ করছে। এতটুকু বাচ্চাকে অরক্ষিত রেখে কোনো মা এভাবে আত্মহত্যা করে?
এতোই যদি মরবার শখ তো আকাশের ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে। ওর হাতে বাচ্চাটাকে বুঝিয়ে দিয়ে নাহয় যে জাহান্নামে খুশি চলে যেতে। এটা একটা মায়ের কাজ হল?
শুধু আকাশ জানে সত্যটা। কিন্তু এ সত্য প্রকাশ করার নয়। দীবা এখন সবার স্মৃতিতে থাকবে শুধু মিথ্যা দুর্নাম নিয়ে।
দীবার মা মেয়ের শোকে উদ্ভ্রান্তের মতো হয়ে গেছেন। কিছুদিন আগে ওদিকের আত্মীয়স্বজনেরা এসেছিল। খুব কুন্ঠার সাথে আনাহিতাকে চেয়েছিল। বলেছিল উনি শোকে মারাও যেতে পারেন। আনাহিতাকে ওর কোলে দিলে হয়ত উনি এ শোক সামলে উঠতে পারবেন।
আকাশের মাবাবার একেবারে ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু আকাশই আনাহিতাকে দিয়ে দিল। ডায়রিটা পড়ে শাশুড়িকেও সে আগের চাইতে ভালো করে বুঝতে পারছে। মাঝে দুবার গেছিল উনার বাসায়। মুখোমুখি সোফায় দুজনে চুপ করে বসেছিল। কিছু তো বলবার নাই। একসময়ে উনি বুকফাটা আর্তনাদ করে কেঁদে উঠলেন কিন্তু আকাশের চোখ দিয়ে এক ফোঁটাও পানি বেরুলো না।
মাবাবা খুব আফসোস করছেন। সিঙ্গেল প্যারেন্ট মায়ের মেয়ের সাথে বিয়ে দেওয়াই উচিত হয়নি বলছেন। নাহলে কোন মেয়ের এমন মাথাখারাপ হয় যে দুধের বাচ্চা সামনে রেখে এভাবে নিজের মৃত্যু ডেকে আনে?
কী একটা তামাশা!
আত্মীয়স্বজনের কাছে মুখ দেখাবার আর জো রইল না।
তাদেরকে টুকটাক বলতেও শুনেছে
— আকাশকে আবার বিয়ে দিতে হবে। মুখ শুকনা করে ঘুরে বেড়ায় ছেলেটা। এবারে ভালো ফ্যামিলি দেখে মেয়ে আনব।
শুনে এত দুঃখেও ওর হাসি পেয়েছে।
বিয়ে!
আবার!
দীবা যে ওর মনজুড়ে, শরীরের প্রতিটা কোষজুড়ে বাস করছে। সম্ভব হবে কি সে জায়গাটা অন্য কাউকে দেয়া?
মনে হয় না।
আর দীবা যারজন্য এত বড়ো আত্মত্যাগ করল, সেই আনাহিতাকে পুরা মনোযোগে বড়ো করাই কি ওর জীবনের লক্ষ হবে না এখন?
নাহলে দীবার স্মৃতিকে যে ভয়ংকরভাবে অপমান করা হবে।
ওদের সাজানো গোছানো জীবন কারিনা এসে তছনছ করে দিল। ভাবতে চায় না আকাশ, কিন্তু না চাইলেও এসে পড়ে। রাতে ঘুমাতে পারে না, শুধু পায়চারী করে। বারবার মনেহয় যদি সেসময়ে ও বাড়িতে থাকত তাহলে কি আজ দীবা বেঁচে থাকত?
কেন দীবা ওকে বলল না?
— আকাশ, তোমার সাথে অল্প কয়দিনই থাকতে পারলাম। কিন্তু তারমাঝেই পুরুষদের প্রতি আমার ঘৃণা তুমি অনেকখানি মুছে দিয়েছিলে। এ কথাটা তোমাকে কোনোদিন বলিনি, এ দুঃখ আমার রয়ে যাবে।
— এ দুঃখ তো আমারও রয়ে যাবে, দীবা। কেন বলোনি? তাহলে আমি বুঝতাম যে স্বামী হিসাবে, একজন পুরুষ হিসাবে আমি খুব একটা খারাপ নই।
দরজার একপাশে হাতুড়িটা এখনো পড়ে রয়েছে। ঝুঁকে কুড়িয়ে নিল আকাশ। তারপর ধীরপায়ে দীবার লেখার রুমের দিকে চলল।
দীবার লেখার টেবিলের ওপরে আয়নাটা রয়েছে। ধূলা পড়েছে ওর ওপরে।
একবার তাকিয়ে দেখল আকাশ।
তারপরে হাতুড়ি উঠিয়ে সমস্ত শক্তি দিয়ে আয়নাটার ওপরে বাড়ি মারল।
(সমাপ্ত)