কারিনা (১০)
সারাদিন একদম স্বাভাবিকভাবে কাটল দেখে প্রাথমিক যে ভীতি আমার মনের মধ্যে গেড়ে বসেছিল, বিকেল হতে হতে অনেকখানিই মুছে গেল। আনাহিতাকে নিয়ে নীচে নামলাম। দূরে বাচ্চারা খেলছে, খানিক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম, আনাহিতাকেও দেখালাম। আগে বাচ্চাদের কখনো মনোযোগ দিয়ে দেখিনি আমি। এখন দেখি। নিজে মা হয়েছি বলেই হয়ত। একদিন আমার আনাহিতাও এভাবেই বড় হবে, খেলবে, ছোটাছুটি করবে, স্কুলে যাবে। ভাবতেই ভালো লাগল।
সন্ধ্যা নেমে আসতে বাড়িতে ফিরে এলাম। ঘর একদম চুপচাপ, কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। আমি আরেকটু নিশ্চিন্ত হলাম। যাক, কারিনা চিরতরে চলে গেছে। আর আসবে না।
টিভিটা চালিয়ে দিয়ে ড্রয়িং রুমের মেঝেতে বিছানো কার্পেটে আনাহিতাকে ছেড়ে দিয়ে আমি নিজেও বসে পড়লাম।
আমাদের বাসায় একটা কুক্কু ক্লক আছে। প্রতি ঘন্টায় পাখি বের হয়ে কুক্কু ডেকে সময়ের হিসাব দেয়। আমি খুব শখ করে গুলশান থেকে কিনে এনেছিলাম।
সেই কুক্কু বার্ড জানান দিল রাত নয়টা বেজে গেছে। আমি আনাহিতাকে খাওয়াব বলে উঠে পড়লাম। ওর ব্যবহৃত অধিকাংশ জিনিস লেখার রুমে রয়ে গেলেও যা আছে তাই দিয়ে আপাতত কাজ চালাচ্ছি। কালকে আকাশ এলে দেখা যাবে।
ঠাস করে শব্দ হল। কান খাড়া করলাম আমি। শব্দটা লেখার ঘর থেকে আসছে। কেউ যেন কিছু একটা দেয়ালের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে মারল।
আবার শব্দ! তারপর পরপর!
এবারে বুঝে গেলাম।
সারাদিন পর কারিনা ফিরে এসেছে। এসেই জিনিসপত্র ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছে।
প্রথমে ভাবলাম উপেক্ষা করব। কতক্ষণ আর জিনিস ছোঁড়াছুড়ি করবে? একসময় না একসময় ওকে থেমে যেতেই হবে। তাছাড়া ও ঐ ঘরের মধ্যেই থাকে। ড্রইংরুমে আসে না। আসতে চাইলেও পারবে না। দরজা লক করা রয়েছে।
স্যান্ডেলটা পায়ে গলিয়ে আমি পাশের ডাইনিং টেবিলে গেলাম আনাহিতার খাবার তৈরী করতে। ফিডার ভরতে ভরতে টের পেলাম শব্দের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। এখন তারসাথে যুক্ত হয়েছে বিজাতীয় ভাষায় তর্জন গর্জন। যেন কারিনা ভোরের অপমানের জবাব দিতে এসেছে।
তাড়াতাড়ি গিয়ে আনাহিতাকে কোলে তুলে নিলাম। দরজা উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে উঠলাম
— কারিনা, তুমি চলে যাও। তোমাকে আমি আর চাই না। আর কখনো এসো না প্লিজ।
জবাবে কারিনা যেন তান্ডব আরম্ভ করল ও ঘরে। এতক্ষণে আমার সাহসী মনোভাবে চিড় ধরল। আমি এবারে অনুনয়ের সুরে বললাম
— প্লিজ কারিনা। যদি আমার ব্যবহারে মনকষ্ট পেয়ে থাকো তো আমি সরি। কিন্তু তুমি চলে যাও। আমি জানি তুমিই আমি। তোমাকে আমি ভয় পেতে চাই না।
জবারে দরজায় ভারী কিছু আছড়ে পড়ল। খুব সম্ভব মোমদানিটা।
পরমুহূর্তে দরজায় ধাম ধাম বাড়ি পরতে থাকল। আমি এবারে সত্যি ভয় পেয়ে গেলাম। যদিও দরজাটা লক করা রয়েছে, ভারী দরজা খোলা ওরপক্ষে সম্ভবও হবে না, তাও। কেন যেন মনে হল ভোরে যে কারিনাকে দেখেছিলাম, তার চাইতে এ কারিনা অনেক শক্তিশালী। এমনভাবে দরজা ঝাঁকাচ্ছে যে সেটা এক একবার করে কেঁপে কেঁপে উঠছে।
আনাহিতাকে কার্পেটের ওপরে নামিয়ে রেখে আমি দরজার দিকে ছুটে গেলাম
— প্লিজ প্লিজ কারিনা। তোমাকে আমি চাই না। প্লিজ তুমি চলে যাও।
উপায়ান্ত না দেখে আমি পাশের ভারী সোফা টেনে দরজার সামনে বসিয়ে দিলাম।
আনাহিতা কাঁদতে শুরু করল। ওদিকে দরজায় অবিরাম বাড়ি পড়লে। সাথে বিজাতীয় ভাষায় তর্জন গর্জন। কারিনার রাগ যেন বেড়েই চলছে।
ভয় পেয়ে আমি ফোনের খোঁজ করতে থাকলাম। রাত বেশ হয়ে গেছে কিন্তু মা’কে জানিয়ে দেব যে আমি আসছি আজ রাতে। এখানে থাকা আর উচিত হচ্ছে না।
কিন্তু ফোন কোথাও খুঁজে পেলাম না। তাড়াহুড়া করতে গিয়ে ড্রয়িং রুম লণ্ডভণ্ড করে ফেললাম কিন্তু ফোনের হদিস মিলল না।
হঠাত মনে পড়ল আনাহিতাকে নিয়ে নীচে যখন গেছিলাম, তখন এক ব্যাগে করে ওর ডায়াপার, দুধের বোতলের সাথে ফোনটাও রেখেছিলাম।
কিন্তু এখন সে ব্যাগ দেখছি না।
তাহলে কি আমি ব্যগটা নীচে ফেলে এসেছি? ভাবতেই মাথা খারাপ হয়ে গেল। ওদিকে দরজায় সমানে বাড়ি পড়ছে।
এক মুহূর্তের জন্য আমি হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। আধুনিক যুগের মানুষ, ফোন ছাড়া আমার চলবে কেমন করে? উবারই বা ডাকব কেমন করে?
এ বিপদে আমিনার কথা মনে পড়ল। ওকে ফোন করে বুদ্ধি নেয়া দরকার। কিন্তু ফোন তো নেই।
সাথেসাথে মনে পড়ল ফোন থাকলেই বা কী! আমিনা নিজেও ফোন বাড়িতে রেখে মায়ের কাছে চলে গেছে।
জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করতে চাইলাম। হুট করে দরজায় বাড়ি মারা থেমে গেল। বদলে শুরু হল ভোরের সেই অদ্ভুত হিসহিসে শব্দ। আমি মন্ত্রপূতের মতো দরজার দিকে তাকিয়ে রইলাম। দরজার হাতলের ফুটো দিয়ে ঘন কালো রঙের আধা তরল আধা বায়বীয় কিছু একটা বের হয়ে চুইয়ে চুইয়ে সোফার ওপরে পড়তে লাগল।
অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। এসব কী হচ্ছে। আমি কি ভুল দেখছি? এ কি কোনো দুঃস্বপ্ন?
একসময়ে হ্যান্ডেলের ফুটা দিয়ে কালো জিনিস চুইয়ে পড়া বন্ধ হল। কিন্তু সোফার ওপরে থাকা আধা তরল আধা বায়বীয় জিনিসটা যেন প্রাণ পেল। ওল্টাতে পাল্টাতে লাগল, বেশ কয়েকবার মোচড়ামুচড়ি করবার পর আমারি চোখের সামনে সেটা এক বিড়ালের রূপ নিল।
কালো, মোটাতাজা!
দেখেই চিনলাম। সেই কালো বিড়ালটা! আমিনার সাথে নীচে হাঁটতে গিয়ে একবার এর সামনে পড়েছিলাম।
বিড়ালটা থাবা উঁচিয়ে আমার উদ্দেশ্যে রাগতভাবে “ম্যাও” করে উঠল। পরমুহূর্তে সোফা থেকে লাফ দিয়ে আনাহিতার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
এতক্ষণ আমি পাথর হয়ে সব দেখছিলাম। আনাহিতার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়তেই সাথেসাথে আমার যেন প্রাণ ফিরে এল। এক ছুটে গিয়ে প্রচন্ড জোরে লাথি কশালাম। লাথির চোটে বিড়ালটা ছিটকে সামনের দেয়ালের সাথে বাড়ি খেয়ে পড়ে গেল।
তিলমাত্র দেরী করলাম না। ক্রন্দনরত আনাহিতাকে তুলে নিয়ে দৌড়ে বেডরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকলাম।
(আগামী পর্বে সমাপ্য)