কারিনা পর্ব-০৯

0
49

কারিনা (৯)

অনেকদিন পর আজ রাত্রে আনাহিতা শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল দেখে আমিও দিলাম এক ঘুম। এন্টিহিস্টামিনের প্রভাবে হয়ত। একবার ভেবেছিলাম বেডরুমেই চলে যাব কিন্তু সাথে আনাহিতার এত জিনিস, কট এসব কিভাবে নিয়ে যাব ভেবে আকাশ আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করাই ঠিক করলাম।
এরমধ্যে মা ফোন করে খোঁজ খবর নিল। জিজ্ঞেস করল
— আমি এসে থাকব?
— না, মা। আমি একদম ঠিক আছি, আনাহিতাও অনেকটা সেরে উঠেছে। তুমি আর এ ঝামেলাটা কোরো না।
— আচ্ছা, প্রয়োজন পড়লে জানিও।

আসলে ঠিক কথা বলিনি আমি। একটানা রাত্রি জেগে আমার অবস্থা ক্লান্ত বিধ্বস্ত। সকালে ঘুম থেকে নিজেকে টেনে হিঁচড়ে বিছানা থেকে তুলতে হয়। এক একদিন মনে হয় আর এক সেকেন্ডও আমি পার করতে পারব না।

তারপরেও আমি মা’কে আসতে বললাম না কেন?
অনেক ভাবলাম এনিয়ে। একসময়ে আবিষ্কার করলাম আমি আসলে আনাহিতাকে আমার একান্ত নিজস্ব জিনিস বলে মনে করি। আমার আর আনাহিতার এক আলাদা পৃথিবী রয়েছে। এখানে কারো প্রবেশাধিকার নেই। কারণ কাউকেই আমি তেমন বিশ্বাস করতে পারি না, কারো ওপর ভরসা করতে পারি না। এর মূলে রয়েছে আমার ছেলেবেলা। বাবার ওপরে ভরসা বা বিশ্বাস করার তো প্রশ্নই ওঠে না। সে একজন ব্যর্থ বাবা, ব্যর্থ স্বামী। মা যদিও আমাকে নিয়ে আলাদা হয়ে গেছিল কিন্তু বাবার সাথে ছাড়াছাড়ির পর মার মাঝে পরিবর্তন এসে গেছিল। সে তখন তার চাকরী, তার নতুন স্বাধীন জীবন নিয়ে এতোটাই ব্যতিব্যস্ত ছিল যে আমাকে খানিকটা অবহেলার মাঝেই বড়ো হতে হয়েছে। এক এক সময়ে মনে হয়েছে মা হয়ত আমাকে কিছুটা রেজেন্টই করে। আমি না থাকলে হয়ত সে নতুনভাবে জীবনটা গড়ে তুলতে পারত, এ ভাবে।
আরো ভেবে দেখলাম বয়সের সাথে সাথে মায়ের সাথে আমার সম্পর্কটা শান্ত হয়ে এলেও ছোটবেলার কিছু ব্যপারের জন্য আমি এখনো মা’কে পুরাপুরি ক্ষমা করতে পারিনি।
এজন্য মা’কেও আমি ভরসার বা বিশ্বাসের জায়গা ভাবি না।
বাকি রইল আকাশ। আকাশের সাথে আমার সম্পর্ক চমৎকার, বোঝাপড়া চমৎকার। কিন্তু আকাশের সাথে আমার সম্পর্কটার বয়স কতটুকু?
মাত্র দুই বছর বা তার একটু বেশি। আমি যে মানসিকতার মেয়ে তাতে এত তাড়াতাড়ি কারো ওপরে ভরসাও করি না, বিশ্বাসও করি না।
কিন্তু আনাহিতা সম্পূর্ণ আমার। আমার রক্ত মাংসে গড়া, আমার দেহে তিলতিল করে বড় হওয়া সন্তান। তাই পৃথিবীতে আমার সবচাইতে প্রিয়, সবচাইতে আপন, সবচাইতে বিশ্বাসের কিছু যদি থাকে তো সে আনাহিতা।

যাক, অনেক আবোল তাবোল ভাবলাম। অনেকদিন আমিনার সাথে কথা হয় না। ডায়াল করতেই ওপার থেকে আমিনা ধরল।
— কেমন আছ দীবা? ছোট্ট আনাহিতা কেমন আছে?
— দুজনেই ভালো আছি, আমিনা। তোমার খবর বলো।
টুকটাক কথা বললাম। আমিনার তাড়া ছিল। কিছুক্ষণ পরে সে যাবে ওর মায়ের সাথে দেখা করতে। ওর মা কাছের এক মরুভূমিতে একা বাস করে। সেখানে গোপনে ওরা ওদের সংঘের কিছু কাজ করবে।
— আমি দেখতে চাই, আমিনা। লেখার কাজের জন্য। ওখানে পৌঁছে আমাকে ভিডিও কল দিতে পারবে?
— সম্ভব না, দীবা। সেখানে সেল ফোন নিষিদ্ধ। বললাম না আমাদের সব কার্যকলাপ নিষিদ্ধ। আমি তো ফোন বাড়িতেই রেখে যাব। কয়টা দিন দুনিয়ার সাথে বলতে গেলে আমার কোনো সম্পর্ক থাকবে না।
— ওহ।
আমি আর আমিনাকে বেশিক্ষণ আটকে রাখলাম না।

রাতে আনাহিতাকে নিয়ে শোবার সাথেসাথে দুজনে গভীর ঘুমে ঢলে পড়লাম। সেই ঘুম একেবারে গিয়ে ভাঙল ভোরবেলায়। আজও লাইট নিভিয়ে শুয়েছিলাম। ঘরের মধ্যে আলো আধারি। ঘুম ভাংতেই শুনলাম অদ্ভুত এক শব্দ, যেন ঘরের মধ্যে সাপ হিসহিস করছে। বা কেউ খুব রেগে রয়েছে।
সাথেসাথে চোখ খুলে গেল। সামনে যা দেখলাম, তাতে আমার বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল।
কারিনা!
কটের ওপরে ঝুঁকে পড়ে আনাহিতার মুখের প্রায় এক ইঞ্চি দূরত্বে নিজের মুখ নিয়ে রাগতভাবে এমন শব্দ করছে। তারপরে কর্কশ গলায় বিজাতীয় ভাষায় কী যেন বলতে লাগল। পুরা অবয়বে ফুটে উঠছে তীব্র রোষ।
চোখের পলকে আমি বিছানায় উঠে বসলাম। তারপর কারিনাকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে উঠলাম
— এই এই। সরো সরো।
কারিনা এবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মুখ ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল। ঘরের অল্প আলোতে মনে হল ওর চোখদুটোতে সাদা অংশ বলে কিছু নেই, পুরোটাই কালো।
আমি আবার চেঁচিয়ে উঠলাম
— সরো সরো, সরে যাও ওর কাছ থেকে।

বলতে বলতেই আমি দৌড়ে গিয়ে কারিনা’কে এক ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিলাম। ওর শরীরটা ঠিক মানুষের শরীরের মতো বলে বোধ হল না, কেমন নরম, হাত দিলে দেবে যাচ্ছে যেন। তারপরেও আমি এত জোরে ওকে ধাক্কা দিয়েছিলাম যে সামলাতে না পেরে ও মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল।
নিমেষে আমি আনাহিতাকে কোলে তুলে নিয়ে ড্রয়িংরুমে বের হয়ে এলাম। কী মনে করে দৌড়ে বেডরুম থেকে চাবি এনে লেখার রুমের দরজা লক করে দিলাম। কারিনা কখনো লেখার রুমের বাইরে আসে না, তারপরেও সাবধানতা অবলম্বন করতে ছাড়লাম না।
একটু ধাতস্থ হবার পর কান পেতে শুনবার চেষ্টা করলাম। ও ঘরে নিশ্ছিদ্র নীরবতা। কারিনার উপস্থিতির কোনো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমি। যাক, চলে গেছে ও। নিশ্চয় বুঝেছে সে এখানে আর ওয়েলকাম না। আর আসবে না হয়ত। তারপরেও আমি এ বাসায় আর থাকব না। কাল আকাশ এলেই আমরা নতুন বাসার খোঁজে নেমে পড়ব। কাল কেন, আমি আজই খোঁজ শুরু করে দিব। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, বাসা বদল করে ফেলতে হবে।
আয়না!
আয়নাটা দিয়ে কারিনা আসা যাওয়া করে। কাজেই আয়নাটা সরিয়ে ফেললেই ও আর আমার বা আনাহিতার নাগাল পাবে না। বুঝলাম আয়নাটাকে বিদায় করতে হবে।
কিন্তু কিভাবে?
এ মুহূর্তে ও ঘরে যাওয়া কি ঠিক হবে?
মাথাটা দপ দপ করছিল। বাথরুমে গিয়ে আমি চোখেমুখে পানি দিলাম।
ঠিক করলাম আপাতত দরজা লক করা আছে, কাজেই আমরা নিরাপদেই আছি। কাল আকাশ এলে ও ঘরে ঢুকে আয়নাটা প্রথমে ভাঙব, তারপরে ভাঙা অংশ দূরে কোথাও ফেলে দিয়ে আসব।
প্ল্যানটা সাজিয়ে ফেলে আমি একটু শান্ত হলাম। আনাহিতাকে চেঞ্জ করে খাওয়ালাম, নিজেও নাস্তা করলাম।

ও ঘর থেকে টু শব্দ পেলাম না। বুঝে নিলাম কারিনা চলে গেছে। ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়াতে নিশ্চয় অপমানিতবোধ করেছে, তাই চলে গেছে। আর আসবেও না হয়ত। এতক্ষণে আমি রিলাক্স করে দৈনন্দিন কাজ শুরু করলাম। কালকেই আকাশ চলে আসবে ভেবে আরেকটু স্বস্তিবোধ করলাম।
বাকি দিনটা আনাহিতার সাথে খেলা করে, ফোনে আকাশের সাথে খুনসুটি করে, বাড়ির খোঁজ করে কাটিয়ে দিলাম।

আকাশ, প্লিজ আমাকে ভুল বুঝো না। তোমাকে আসল কথাটা বলিনি কারণ মনে করেছিলাম তুমি হেসে উড়িয়ে দেবে। শুধু বলেছিলাম বাড়িতে জিনিসপত্র রাখবার জায়গা হচ্ছে না, এজন্য তিন বেডরুমের বাড়িতে সিফট করতে চাই। কেন যে তখন বললাম না! জানালে তুমি হয়ত আমাকে এ বাড়িতে থাকতে মানা করতে। কিম্বা আমার কথা শুনে হাসতে। কিন্তু আমি যে সাহসী, আমি যে স্বাধীনচেতা, আমি যে অন্যের উপহাস সহ্য করতে পারি না, তাই তোমাকে বাড়ি বদলের আসল কারণ জানালাম না। ভেবেছিলাম নিজেই সব সামলে নিতে পারব।
(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে