কারিনা (৮)
আকাশ যাবে কয়েকদিনের অফিস ট্যুরে। যদিও যেতে চাইছিল না। আমিই ওকে ঠেলে পাঠালাম। ক্যারিয়ারের এ পর্যায়ে কোনো ছন্দপতন হতে দেয়া ঠিক না। এদিক দিয়ে আমি খুবি বাস্তববাদী। যা করতে হবে, তা করতে হবে। বললাম
— আমি আনাহিতাকে নিয়ে ঠিক থাকতে পারব। চিন্তার কিছু নাই।
— কিন্তু, দীবা…
— কোনো কিন্তু না, আকাশ। এমনিতেও রাত্রের অধিকাংশ সময় তো আমিই দেখে রাখি। এখন পুরাটাই নাহয় দেখলাম।
চিন্তিত সুরে আকাশ বলল
— তারপরেও, দীবা। তোমার মা’কে বলবে কয়দিন এসে থেকে যেতে?
— আরে নাহ। এত সামান্য ব্যপারে মা’কে ডাকাডাকি করবার কোনো দরকার নাই। মা নিজেই অফিস বাসা করে ক্লান্ত থাকে।
— তাহলে তুমিই কয়টা দিন গিয়ে থাকো না।
— আরে বাবা, এত চিন্তা কোরো না তো। আমরা ঠিক থাকব। তোমার মেয়ের আড়াই মাইল লটবহর দুদিনের জন্য বাঁধাছাঁদা করবার কোনো ইচ্ছা নাই আমার।
বাধ্য হয়ে রাজি হল আকাশ। কিন্তু আমাকে বারবার বলতে লাগল সাবধানে থাকবার জন্য, ওকে ফোনে আপডেট দিতে থাকবার জন্য।
আজ সকালে আকাশ রওনা দিবে। আনাহিতা ভোরবেলার দিকে এই যে ঘুমায়, সে ঘুম ভাংতে ভাংতে একেবারে বারোটার মতো বেজে যায়। সেই ফাঁকে আমিও ওরসাথে ঘুমিয়ে নেই। তবে আজ আকাশ যাবে বলে উঠে পড়েছি। বহুদিন পরে আমরা একসাথে নাস্তা খেতে বসলাম।
আকাশের রওনা দেবার তাড়া ছিল। আমাকে শেষবারের মতো সাবধান করে দিয়ে, চুমু খেয়ে আকাশ চলে গেল। দরজা বন্ধ করে টেবিল থেকে পাউরুটি মাখন ফ্রিজে তুলে রাখছি, ওঘর থেকে আনাহিতা তীব্রভাবে কেঁদে উঠল
— এই যে আসছি আমি!
ফ্রিজে জিনিস তুলতে তুলতে উঁচু গলায় সাড়া দিলাম আমি।
আনাহিতা এখন আমার গলা চেনে। ঘুম ভেঙে কাউকে না দেখলে যখন কেঁদে উঠে, তখন আমি সাড়া দিলেই ওর কান্না বন্ধ হয়ে যায়। বোঝে মা একটু পরেই আসছে।
তবে বেশি দেরী করা যায় না অবশ্য। তখন আবার শুরু করে দেয় কান্না।
কিন্তু আজ আমার গলার সাড়া পেয়েও আনাহিতার কান্না থামল না। বরং আরো বাড়ল। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগল।
— আসছি! আসছি।
বলতে বলতে দরজা খুলে ঢুকে ওকে কোলে তুলে নিলাম। সাধারণত কোলে নিলেই ওর কান্না বন্ধ হয়ে যায়, আজ হল না। ওকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে অনেক্ষণ হাটলাম। বহু সময় লাগল ওকে ঠান্ডা করতে। একসময়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ওকে কটে শুইয়ে দিয়ে আমি গোসলে চলে গেলাম। উঠেই যখন পড়েছি, দিন শুরু করি, এখন আর ঘুম আসবে না।
গোসল সেরে বেডরুমে কাপড় পড়ছি, আনাহিতা আগেরবারের মতোই তীব্র, তীক্ষ্ণ গলায় কেঁদে উঠল। কোনোমতে ড্রেসিং গাউনটা গায়ে চাপিয়ে দিয়েই ছুটলাম। গিয়ে ওকে কোলে তুলে নিলাম। এবারে ওকে ঠান্ডা করতে আরো সময় নিল। কোনো কারণে আনাহিতা আজ খুবি ইরিটেটেড হয়ে আছে।
ভাবলাম ওকে গোসলটা দিয়েই দেই। একয়দিন ঠান্ডার জন্য শুধু গা মুছিয়ে দিয়েছি। গোসল দিলে আরাম লাগবে ওর।
জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে ওর কাপড় খুলতেই চমকে চেঁচিয়ে উঠলাম।
এ কী!
আনাহিতার হাতে পায়ে এসব দাগ কেন? একবার মনে হচ্ছে ফুসকুড়ি, একবার মনে হচ্ছে খামচির দাগ। ওর কি কোনো অসুখ হয়েছে? গাটাও গরম লাগল।
নিয়ে ছুটলাম ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার অনেক সময় নিয়ে পরীক্ষা করে দেখল। তারপর প্রশ্ন করল
— ঘরে কি পোকামাকড়ের উপদ্রব রয়েছে? ইঁদুর? কিছু খামচে দিয়েছে মনে হচ্ছে।
— না, ডাক্তার। আমি অসম্ভব খুঁতখুঁতে মানুষ। আমার ঘরে পোকা থাকবে, ইঁদুর ঘুরে বেড়াবে, খাবারে মুখ দিবে, ভাবলেই তো আমার ঘেন্না লাগবে। তাছাড়া এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের ম্যানেজমেন্ট থেকে সবসময় পোকার ওষুধ দেয়া হয়। কাজেই ঘর একদম ঝকঝকে তকতকে থাকে।
— তাহলে আনাহিতার সাবান শ্যাম্পুতে কোনো চেঞ্জ হয়েছে কি?
— তাও হয়নি, ডক্টর।
— হুম।
ওষুধ লিখে দিলেন তিনি। নিয়ে আমি বাসায় চলে এলাম। তিনি বললেন খেয়াল রাখতে। হয়ত আনাহিতার কিছু একটাতে এলার্জি রয়েছে যা এ মুহূর্তে বোঝা যাচ্ছে না।
ফিরে এসে ওর সমস্ত জামাকাপড়, বেডিং ধুলাম। বাকি দিনটা ভালোভাবেই কাটল। পরেরদিনও।
(চলবে)