কারিনা (৭)
আনাহিতাকে নিয়ে আমি আমার লেখার ঘরে চলে এলাম। সাথে এল আনাহিতার জিনিসপত্র। একটা বাচ্চার যে এত জিনিসের প্রয়োজন হয়, আগে জানতাম না। এখন ঘরের যেদিকে তাকাই, সেদিকেই ওর কাপড়চোপর, ওর খেলনাপাতি, ওর দুধের সরঞ্জাম দিয়ে ভর্তি।
আমার সেই লেখার ঘরটাকে আর চিনতেই পারি না। তারজন্য অবশ্য আমার কোনো আক্ষেপ নেই। সবকিছুরই সময় আছে, একসময় আনাহিতাও রুটিনে এসে পড়বে, তখন ওকে আকাশের জিম্মায় ঘন্টা দুয়েকের জন্য দিয়ে আমি আবার লেখালিখি শুরু করব, এমনটাই প্ল্যান আমার।
বলতে ভুলে গেছি, আমিনা চলে যাবার কিছুদিনের মধ্যে মরক্কো থেকে আমার নামে এক প্যাকেজ এসেছিল। ভেতরে আনাহিতার জন্য সুন্দর মরক্কান কাফতান, তারসাথে ছোট এক থলেতে কিছু। কিন্তু থলের মুখটা এমনভাবে বন্ধ করা যে কিছুতেই খুলতে পারলাম না। দেখে মনে হল সীল গালা করা। আমিনার সাথে ফোনে যোগাযোগ করতে ও বলল
— কাফতান আমাদের ঐতিয্যবাহী পোশাক, দীবা। তাই ভাবলাম আনাহিতার জন্য পাঠাই।
— আর থলেতে কী রয়েছে, আমিনা? আমি তো খুলতেই পারছি না।
একটু চুপ করে রইল আমিনা
— থলেতে সাত রকমের চাল রয়েছে। মন্ত্রপূত। আনাহিতাকে সবরকমের বিপদ আপদ থেকে প্রোটেক্ট করবে। এটা ওর বেবি কটের সাথে বেধে দিও, দীবা।
আমি আর কিছু বললাম না এনিয়ে। তবে কাফতানের জন্য আমিনাকে প্রচুর ধন্যবাদ জানালাম। মনেমনে ঠিক করলাম আনাহিতা সুস্থ হলেই ওকে পরিয়ে ফটো তুলে আমিনাকে পাঠিয়ে দিব। এত সুন্দর একটা জিনিস।
আর থলেটা? ওটার জায়গা হল বেডরুমের ড্রয়ারে, সেই মাছ লকেটের পাশে।
লেখার ঘরে প্রথম কয়টা রাত নির্বিঘ্নেই কাটল। আমি লাইট জ্বালিয়ে রাখতাম সারারাত। কারণ একটু পরপরই উঠতে হত। কটে দেয়ামাত্র নাক বন্ধ হয়ে আনাহিতা কেঁদে উঠত। তখন ওকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে হেঁটে বেড়াতাম।
ঘুম না হবার ফলে আমাদের দুজনেরই অবস্থা কাহিল। একরাতে দুজনেই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। লাইটটাও মনে হয় আকাশ কোনো একসময়ে এরুমে এসে নিভিয়ে দিয়ে গেছিল।
আধা ঘুমের মধ্যে মনে হচ্ছিল ঘরময় কে যেন হেঁটে বেড়াচ্ছে, এটাসেটা উলটে পালটে দেখছে। আমি তখন এতোই ক্লান্ত যে চোখ খোলবার শক্তিটুকুও ছিল না। তবে আন্দাজ করে নিলাম যে অন্ধকারে কারিনা এসেছে এতদিন পরে। এখন ঘরময় ঘুরে ঘুরে দেখছে। হয়ত সেও অবাক হয়েছে ঘরের আমূল পরিবর্তনে।
কয়দিন বাদে এক সকালে উঠে দেখি জিনিসপত্র সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। যেখানে যে জিনিসটি থাকবার কথা, সেখানে সেটি নেই।
আমার পিটপিটে স্বভাবের কথা আগেই বলেছি। আনাহিতা হবার পর জিনিসপত্র প্ল্যানমাফিক এমনভাবে সাজিয়ে রাখি যেন হাতের কাছে সবকিছু থাকে, রাতে ওর ডায়াপার চেঞ্জ করতে বা ওকে ফিড করতে যেন আমাকে বারবার বিছানা ছাড়তে না হয়।
সাথেসাথে মনে পড়ে গেল আরেকদিনের কথা। আমি তখন আনাহিতাকে চারমাসের পেটে নিয়ে সবে মা’র বাড়ি থেকে ফিরে এসেছিলাম। সেদিনও কারিনা এমন করেই জিনিসপত্র সব ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলেছিল।
ব্যপারটাতে খুব একটা খুশি না হলেও তেমন পাত্তা দিলাম না। লিখবার ঘর আগের মতো নাই দেখে কারিনাও বিরক্ত হয়ত। কিন্তু কিছু করার নাই। ওকে অভ্যস্ত হতে হবে। নাহলে চলে যেতে হবে।
এরপর কয়েকদিন চুপচাপ গেল। কারিনার উপস্থিতি টের পেতাম না। এলেও অন্তত জিনিসপত্র ছোঁড়াছুড়ি করত না। আমি এদিকে আনাহিতাকে নিয়ে এতোই ব্যতিব্যস্ত যে সেটাকে এমনকিছু গুরুত্ব দিলাম না।
একরাতে আনাহিতাকে অনেক্ষণ কোলে নিয়ে হাটবার পর দুজনেই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ওকে কটে না দিয়ে আমার পাশেই রেখেছিলাম, কিছুক্ষণ পরেই আবার উঠতে হবে দুধ খাওয়াবার জন্য।
চটকা দিয়ে ঘুমটা ভেঙে গেল। কাঁচা ঘুম ভেঙে আধা অন্ধকারে প্রথমে আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ঘরের লাইটটা নিভিয়ে দিলেও স্ট্রিটলাইটের তেরছা আলো পর্দা ভেদ করে ঢুকে ঘরটাকে সামান্য আলোকিত করে রেখেছে।
চোখ প্রথমেই গেল আনাহিতার ওপরে। ভেবেছিলাম ও নিশ্চয় কেঁদে উঠেছে, যারজন্য আমারও ঘুম ভেঙে গেছে। কিন্তু নাহ, দিব্যি ঘুমিয়ে রয়েছে আমার রাজকন্যাটা। নিশ্চিন্ত হয়ে আবার চোখ বন্ধ করব, চমকে বড়সড় একটা ঝাঁকুনি খেলাম।
আনাহিতার ওপরে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে কারিনা ওকে নিবিষ্ট মনে দেখছে। বড়োবড়ো চোখে বিস্ময়।
ধীরে ধীরে আনাহিতার ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে কারিনা আমার দিকে তাকালো। একে অন্যের দিকে আমরা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। তারপরেই এক দৌড়ে গিয়ে কারিনা আয়নাতে ঢুকে পড়ল।
ওরচোখে কিছু একটা ছিল, আমি ঠিক ধরতে পারিনি সেদিন। অভিমান কি?
নাকি ক্ষোভ?
নাকি তারও বেশিকিছু?
(চলবে)