কারিনা (৬)
২৫/০২/২০২৫
মনের দিক দিয়ে কিছুদিন ধরে এতখানি বিপর্যস্ত ছিলাম যে ডায়রিতে কিছু লিখবার কথা মনেও আসেনি। কিন্তু এখন কাপাকাপা হাতে লিখতে বসলাম। আজকের পর হয়ত আর কোনোদিনই কিছু লেখা হবে না।
হয়ত বলছি কেন, আজকের পর আসলেই কিছু লেখা আর হবে না।
আমার মতো একজন সাহসী, কঠোর মনের মেয়ে এমন একটা সিদ্ধান্ত নেবে, কোনোদিন ভাবতে পারিনি। কিন্তু জীবনের এ মোড়ে এসে এমন ভাববার পিছে যে কারণ রয়েছে, তাতে আমি খুব বেশি অবাক হচ্ছি না। একজন মায়ের পক্ষে সবই সম্ভব। সন্তানের জন্য দুনিয়ার শেষ প্রান্তেও যাওয়া সম্ভব। প্রয়োজন পড়লে নিজের বিনিময়ে সন্তানের সুরক্ষা করা সম্ভব।
হ্যাঁ, আনাহিতার সুরক্ষার জন্যই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি। ওকে সবধরণের বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করব, এ কারণেই এমন চরম সিদ্ধান্ত নিতে আমি বাধ্য হলাম।
আকাশ, তুমি যাতে আমাকে ভুল না বোঝো, এজন্য সবকিছু আমি লিখে রেখে যাচ্ছি। আনাহিতা বড়ো হলে ওকেও বুঝিয়ে বোলো মা ওকে খুবি ভালোবাসে। কিন্তু মা’র পক্ষে সম্ভব হল না ওরসাথে থাকা, ওকে বড়ো হতে দেখা মা’র ভাগ্যে ছিল না।
নাহ, আর কাঁদব না। অনেক কেঁদেছি। কেঁদে কেঁদে চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। অনেকবার ভেঙে পড়েছি। কিন্তু আর না, আমি এখন বদ্ধপরিকর।
সবটুকুই লিখব, কোনোকিছু বাদ দেব না।
আনাহিতা বিছানায় আরামে ঘুমাচ্ছে, ঘুমের মধ্যে ওর ঠোঁটে এক একবার করে স্বর্গীয় হাসি ফুটে উঠছে। আমি তৃষিত চোখে দেখছি আর ঝটপট লিখে চলেছি।
হাতে সময় বেশি নাই।
একমাস আগে আমিনা চলে গেছে। এই প্রথম একজন অনাত্মীয়ের সাথে বিচ্ছেদে আমার মন কেঁদে উঠেছিল। আমিনাকে আমি পছন্দ করে ফেলেছিলাম, হয়ত একটু আধটু ভালোও বেসে ফেলেছিলাম।
যাবার আগে আমিনা একগাদা জিনিস আমাকে আর আনাহিতাকে উপহার দিয়ে গেল। কিসব দোয়া পড়ে আমাকে ফুঁ দিল। ছলছল চোখে আমি বললাম
— আমিনা, তোমাকে খুব মিস করব।
কথা বলতে গিয়ে আমিনার গলা ভেঙে গেল
— আমিও, দীবা। একটা অনুরোধ করছি, প্লিজ রক্ষাকবচটা সাথে রেখো।
কিছু বললাম না। আসলে ইদানিং কারিনার কথা আমার মনেই পড়ত না, আমি আনাহিতাকে নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলাম। লেখার ঘরেও সেভাবে যাওয়া হয় না। আনাহিতা রাতে ঠিকঠাকভাবে ঘুমাতে শুরু করতে ওকে নিয়ে ও ঘরে রাত কাটাবার আর প্রয়োজন পড়েনি। লিখালিখিও আপাতত বন্ধ। তাই লিখবার ঘরে যেতাম না তেমন। কাজের খালা সকালে একবার পরিষ্কার করে দরজা বন্ধ করে চলে যেত। আমি ড্রয়িংরুম আর বেডরুমের মধ্যেই আনাহিতাকে নিয়ে আনাগোণা করতাম।
আমাকে চুপ থাকতে দেখে আমিনা জোর দিয়ে বলল
— আমার কথা একেবারে উড়িয়ে দিও না প্লিজ, দীবা। অনেকসময় কারিনা কোনো কারণে হিংসা করলে সে তোমার দুর্বল জায়গা খুঁজে নেবে। তারপর সেটার ক্ষতি করতে পারে। হয়ত আমি একটু বেশি ভাবছি, তারপরেও…
আমি তাড়াতাড়ি বললাম
— আমার কথা ভাববার জন্য আমি কৃতজ্ঞ, আমিনা। কিন্তু কারিনা আর আসে না। ওকে অনেকদিন দেখি না। হয়ত আমার বোরিং জীবন দেখে বিরক্ত হয়ে গেছে।
কথাটা হাল্কা করবার জন্য হাসলাম আমি।
উত্তরে কিছু বলল না আমিনা। আনাহিতাকে চুমা খেয়ে, আমাকে আরেকবার জড়িয়ে ধরে বিদায় নিল। আগামী বছরে আবার দেখা হবে, দুজনে দুজনকে কথা দিলাম।
আমিনাকে দেয়া কথা রাখতে পারব না ভেবে খুব খারাপ লাগছে।
আমিনা চলে যাবার প্রায় একমাস বাদে আনাহিতার ভীষণ ঠান্ডা লাগল। নিয়ে ছুটলাম ডাক্তারের কাছে। চিকিৎসা চলল। কিন্তু মুশকিল হল রাতে। ওকে যতবার ঘুম পাড়িয়ে শুইয়ে দেই, নাক বন্ধ থাকার কারণে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুম ভেঙে কেঁদে ওঠে। ওকে তখন কোলে নিয়ে হাঁটতে হয়। সোজা হয়ে থাকলে ঘুমিয়ে পড়ে কিন্তু যেই বিছানায় শুইয়ে দেই, পাঁচ মিনিটের মধ্যে উঠে পড়ে।
কয়েকদিন চলবার পর বুঝলাম এভাবে হবে না। আকাশের সকালে কাজ থাকে। দুজনেই জেগে থাকবার কোনো মানে হয় না।
আবার ওকে নিয়ে লিখবার রুমে চলে এলাম। আমাকে তো রাতে উঠতেই হয় আনাহিতাকে খাওয়ানোর জন্য। আকাশ অন্তত ঘুমাক।
তখন থেকেই শুরু হল নতুন ঘটনা।
(চলবে)
সবার কমেন্ট ভীষণ এঞ্জয় করছি। ইদানিং গল্প তেমন দেয়া হয় না আইডি’তে। চুরি হবার ভয়ে। কিন্তু এই যে পাঠকের সাথে ইন্টার একশান, এটা আমি কত মিস করছিলাম বুঝতে পারছি।