কারিনা (৫)
২০/১২/২০২৪
আনাহিতা যখন তিনমাস শেষ করে চারমাসে পড়ল, তখন একদিন হঠাত করে সারারাতের কান্না বন্ধ করে দিল। ধীরে ধীরে আমাদের জীবন কিছুটা আয়ত্তে চলে এল। রাতে কিছুটা হলেও ঘুমাতে পারলাম। যদিও ওকে খাওয়াতে আমাকে উঠতেই হত।
এরমাঝে লেখালিখি একরকম বন্ধই হয়ে গেছিল। আনাহিতা পেটে আসতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ওরদিকে পুরা মনোযোগ দেব, ওর সমস্ত কাজ নিজে হাতে করব। ও একটু বড় না হওয়া পর্যন্ত অন্য কিছুতে মনোযোগ দিব না। এ কয়মাসে আমার কারিনাকেও তেমন দেখিনি, অথবা বলা যেতে পারে আমি খেয়াল করেই দেখিনি। আনাহিতাকে দেখভাল, ঘুমের ওলটপালট এসব নিয়ে এমন বিদ্ধস্ত ছিলাম যে কোনোদিকে আর মনোযোগ ছিল না আমার। একা হাতে সবকিছু করতে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে আমার কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তে আমি অনড় থাকলাম। আসলে ছোটবেলায় বহুসময় একা থাকতে হয়েছে আমাকে। অনেকসময় বেশ রাত পর্যন্ত। বাবার সাথে মার প্রচন্ড তিক্ততার মধ্য দিয়ে ছাড়াছাড়ি, জীবিকার প্রয়োজনে মা’র লম্বা সময় ধরে বাইরে থাকা, এসব কারণে সে আমাকে ঠিকমতো সময় দিতে পারেনি। এখন মা’র সাথে সম্পর্ক অনেকখানি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে ঠিকই কিন্তু একসময় এনিয়ে মনে প্রচুর রাগ আর অভিমান পুষে রাখতাম। মা’র সাথে এনিয়ে বহু চিল্লাচিলি রাগারাগিও হয়েছিল। আনাহিতাকে যেন এর ভেতর দিয়ে যেতে না হয়, এ ব্যপারে আমি বদ্ধ পরিকর। বিয়ে যখন করেইছি, তখন আমার একটা ছোট্ট সুন্দর ছবির মতো সংসার থাকবে, ফুটফুটে বাচ্চা থাকবে, এ প্রতিজ্ঞা করেই আমি আকাশকে বিয়ে করেছিলাম। বিয়ে হবার পরে আমি আমার বিবাহিত জীবন ও মাতৃত্বকে এতখানি উপভোগ করছি যে অনুভব করতে পারছি এমন এক স্বপ্ন আমি ছোটবেলা থেকেই মনের খুব গোপনে লালন করে রাখতাম।
আজ দুপুরে আমি আর আনাহিতা একচোট ঘুম দিয়ে উঠলাম। বিকালে বারান্দায় ওকে কোলে নিয়ে হাঁটছি, দরজায় কে জানি নক করল। খুলে দেখি আমিনা। আমাকে দেখে হাসল
— ভয়েভয়ে নক করেছি, দীবা। ভাবলাম ঘুমিয়ে আছ কিনা।
— নাহ, আমিনা। উঠে পড়েছি। ভেতরে এসো।
— থাক। বরং চলো নীচে এক চক্কর হেঁটে আসি। তুমি তো বাইরে যাওয়া বন্ধই করে দিয়েছ। এভাবে থাকা ঠিক না। মাঝেমাঝে বাইরে বের হবে, দেখবে মন ফ্রেশ হবে।
কী মনে করে সাথেসাথে রাজি হয়ে গেলাম। যেমন ছিলাম তেমন ভাবেই আনাহিতাকে কোলে করে বের হয়ে এলাম। কম্পাউন্ডের মধ্যেই থাকব, কে আর দেখবে।
— চলো তাহলে। দুইটা চক্কর দিয়ে আসি।
নীচে নেমে এক পাক হাঁটতে ফ্রেশ বাতাসে আসলেই মন চনমন করে উঠল। আনাহিতাকে কোলে নিয়ে আমিনার সাথে গল্প করতে করতে হাঁটছি, সামনে পড়ল এক কুচকুচে কালো বিড়াল। ভালো মোটাতাজা। আমার ঠিক সামনে পড়তে আমি থমকে দাঁড়ালাম। বিড়ালটাও দাঁড়িয়ে পড়ল, সটান আমার চোখে তার হলুদ চোখ রাখল, তারপর থাবা উঠিয়ে মিয়াঁও মিয়াঁও করতে লাগল। বিড়ালটার কান্ড দেখে আমি রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলাম। এমনিতেই বিড়ালের প্রতি বিশেষ প্রীতি নাই আমার।
দেখতে দেখতে বিড়ালটা দুই কদম এগিয়ে এল। আমার স্যান্ডেল পরা পায়ে খামচি দিতে পারে ভেবে চমকে দুই কদম পিছিয়ে গেলাম। আমিনা রাগত স্বরে মরোক্কান ভাষায় কিযেন বলতে বলতে বিড়ালটাকে তাড়া লাগাতে সে পালিয়ে গেল।
আনাহিতাকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে বললাম
— কী আশ্চর্য! এমন করল কেন? আমি তো ওকে কিছুই করিনি। বরং ওকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে ওকে চলে যাবার সুযোগ করে দিলাম।
আমিনা এক অদ্ভুত প্রশ্ন করল
— দীবা, তোমাকে যে রক্ষাকবচটা দিয়েছিলাম, ওটা পরে থাকো তো, তাই না?
আমাকে চুপ থাকতে দেখে আবার প্রশ্ন করল
— পরো না? আধুনিক মানুষ, এসব বুজরুকি বিশ্বাস করো না, তাই না?
আমাকে এবারেও চুপ থাকতে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
— সম্ভব হলে পরে থেক। ব্যপারটা আমার ভালো লাগল না।
— কী ভালো লাগল না, আমিনা?
— বিড়ালটাকে। স্বাভাবিক লাগল না।
— স্বাভাবিক না? কী হতে পারে? বিড়াল হয়ত ভেবেছে আমি ওর লেজে পাড়া দিব বা কিছু।
— না দীবা। ওটা বিড়াল নাও হতে পারে।
— তো কী হতে পারে?
— কেন যেন মনে হচ্ছে এ তোমার কারিনা। অনেকসময় ওরা বিড়ালের রূপ ধরেও আসে। কোনো কারণে তোমার ওপরে রেগে রয়েছে হয়ত। ঠিক বুঝতে পারছি না।
— সে কী! রাগবে কেন? আমি তো ওকে অনেকদিন ধরে দেখি না। এমনকি রাতের বেলায় আকাশের যাতে ঘুমের অসুবিধা না হয়, তারজন্য লেখার ঘরে একটা খাট ফেলে আনাহিতাকে নিয়ে দুই একদিন থেকেছি। তখনও ওকে দেখিনি।
চিন্তিতমুখে আমাকে দেখল খানিক আমিনা
— ও ঘরে আনাহিতাকে নিয়ে থাকো? তাহলে নিশ্চয় ও তোমাকে আর আনাহিতাকে দেখেছে। কিন্তু জানতে দেয়নি।
— কেন?
— কেন বলতে পারব না, দীবা। কিন্তু ব্যাপারটা আমার ভালো লাগল না এটুকু বলতে পারি। হয়ত ওর বাচ্চা নাই। তাই তোমাকে হিংসা করছে। কিছু একটা আছে তো বটেই।
আমি হাসলাম। সামান্য বিড়ালের কান্ড নিয়ে এত সিরিয়াস হবারও কিছু নাই
— চলো ফিরে যাই। আকাশের আসবার সময় হয়ে গেছে।
লিফট থেকে বের হয়ে বিদায় নেবার সময় আমিনা গম্ভীরভাবে বলল
— পারলে রক্ষাকবচটা পরে থেকো, দীবা। তোমাকে অনেক স্নেহ করি। তোমার কিছু হোক, আমি চাই না। আমিও মাসখানেকের মধ্যে ফিরে যাচ্ছি। তোমাকে দেখে রাখতেও পারব না।
আমিনা চলে যাচ্ছে বলে আন্তরিকভাবে দুঃখিত হলাম। তাই বলে মাছ লকেটটা পরতেও মন সায় দিল না। যত্তসব বুজরুকি।
আসলে শক্ত, সাহসী আর বাস্তববাদী হিসাবে বড়ো হবার কারণে এসবকে দুর্বল চিত্তের লক্ষণ বলে ভাবতে শিখেছিলাম। মন কিছুতেই সায় দিল না এক সামান্য লকেটের ওপরে নিজের সুরক্ষার ভার ছেড়ে দিতে।
(চলবে)