কারিনা
(৪)
২১/০৯/২০২৪
আমি এক ফুটফুটে মেয়ের মা হয়েছি। নাম রেখেছি আনাহিতা। অর্থাৎ নিষ্পাপ। আকাশ আর আমার দুজনেরই এ নাম পছন্দ। তবে নিষ্পাপ হলেও সে আমাদের কম জ্বালাচ্ছে না। রাত্রি হলেই গলা ফাটিয়ে এই যে চিৎকার আরম্ভ করে, ভোররাতে গিয়ে সেটা শেষ হয়। তারপর সারাদিন ঘুম। ডাক্তার বলেছে কোলিক। চিন্তার কিছু নাই, ঠিক হয়ে যাবে কিছুদিনের মধ্যে। ঠিক হতে হতে তিনমাসে গিয়ে ঠেকল। ইতোমধ্যে আমার রাতের ঘুমের অভ্যাস চলে গেছে, সারারাত ওকে নিয়ে একবার হাঁটি, একবার বসি। দিনের বেলায় পড়ে পড়ে ওরসাথে ঘুমাই।
আনাহিতার কথা পরে বলল। তার আগে আমার প্রেগন্যান্সির সময়ের দুই একটা কথা লিখে রাখা জরুরী মনে করছি।
প্রথম দেখার কিছুদিনের মধ্যে আমিনার সাথে বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেল। প্রতিবেশির সাথে এতখানি যাওয়া আসা এই প্রথম। দিনের বেলায় ও ইউনিভার্সিটি নিয়ে ব্যস্ত থাকত। কিন্তু বাসায় ফিরে প্রায়ই রাঁধতে বসে যেত। মরোক্কান কুসকুস, তাজিন ও আরো অনেক ডিশ সে রেঁধে আমাকে খাওয়াতে লাগল। প্রগন্যান্সির ঐ সময়ে খাওয়া নিয়ে আমি ভীষণ খুঁতখুঁতে হয়ে গিয়েছিলাম। আমিনার খাবারগুলি আমার মরা জিভকে নতুন করে জীবন দিল যেন। গোগ্রাসে খেতাম আমি, দেখে আমিনার চেহারায় সন্তোষটি ফুটে উঠত।
একবার বাসায় একা ছিলাম, আকাশ অফিসের ট্যুরে গেছে, আমিনা আমাকে রাতের খাবারের দাওয়াত দিল। গিয়ে দেখি এলাহী কারবার। টেবিল ভর্তি করে ডিশের পর ডিশ।
খেতে খেতে অনেক গল্প হল। একসময় মনে পড়তে প্রশ্ন করলাম
— আমিনা, তুমি প্রথমদিন আমাকে দেখে কেন বলেছিলে যে আমার মধ্যে ছায়া রয়েছে? কথাটার মানে কী?
অল্প হাসল আমিনা
— আমি দেখেছিলাম ছায়া, দীবা। তোমার চোখে। ভয়ের কিছু নাই। সে তোমারি আরেক সত্ত্বা বা মিরর ইমেজ বলতে পারো।
খুব কৌতূহল হল। আমিনাকে এ পর্যন্ত আধুনিক মানুষ হিসেবে ভেবে এসেছি। ওর মুখ থেকে এমন কথা শুনব, ভাবিনি। প্রশ্ন করলাম
— কেন একথা বলছ খুলে বলবে প্লিজ?
একটু চুপ করে রইল আমিনা। তারপর আরম্ভ করল
— তুমি নিশ্চয় ভাবছ চলনে বলনে আধুনিক মানুষ হয়েও এমন আজগুবি কথা বলছি কেন, তাই না?
আসলে হয়েছে কী, এখন আমরা চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছি, সবাই নানান ধরণের পেশায় নিযুক্ত আছি। কিন্তু দুই পুরুষ আগেও আমরা মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম, ছিলাম এক গুপ্ত সংঘের সদস্য। প্রকাশ্যে কিছু করার সুযোগ ছিল না কারণ আইন করে আমাদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দেয়া হয়েছিল।
খুব কৌতূহল হল। জানতে চাইলাম
— কী করতে তোমরা?
— নানান অলৌকিক ব্যপার নিয়ে সাধনা চলত আমাদের সংঘে। এবং সেসব শুধুমাত্র মেয়েদের মাঝেই ছড়িয়ে দেবার নিয়ম ছিল, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। তবে সেসব গুপ্ত রীতি রেওয়াজ মানুষের উপকারে ব্যবহার করা হত। আমাদের সঙ্ঘের অন্তর্ভুক্ত হবার প্রথম শর্তই ছিল কারো অপকার করা যাবে না। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কঠোর সাধনার ফলে প্রাকৃতিকভাবে আমাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় খুব প্রখর হয়, আমরা সহজেই আশেপাশের অনেককিছু অনুভব করতে পারি। যেমন তোমারটা করেছি।
চমতকৃত হয়ে গেলাম আমি। বিশ্বাস করব কী করব না, বুঝতে পারলাম না।
— আমার মাঝে যে ছায়া দেখেছ তা নিয়ে বিস্তারিত জানো কিছু?
— হুম, জানি। আফ্রিকা, মিডল ইস্ট এসব জায়গায় কারিন বা কারিনা কথাটা বেশ প্রচলিত। ছেলেদের কারিন বলা হয় আর মেয়েদের কারিনা। মূলত কারিন বা কারিনা হচ্ছে তোমার ছায়া বা দ্বৈত সত্ত্বা। যাকে বলে মিরর ইমেজ। প্রতিটি মানুষেরই কারিন বা কারিনা রয়েছে। বেশিরভাগ সময়ে দুজনে দুজনার অস্তিত্ব সম্পর্কে আজীবন টের পায় না। যদিও দুজনের মধ্যে গভীর আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। সাধারণত দুজনের জীবন হুবহু একরকম হয়। এমনকি জন্ম মৃত্যুও একসাথে ঘটে। কিন্তু যদি দুজনের জীবনের মধ্যে পার্থক্য দেখা দেয় আর তোমার কারিন/কারিনা যদি সেটা টের পেয়ে যায়, তবে অনেকক্ষেত্রে বিপদ ডেকে আনতে পারে। তখন সে হতে পারে তোমার ইভেল টুইন।
— কেমন বিপদ? সে কি আমাকে মেরে ফেলতে পারে?
যত শুনছি ততোই আগ্রহ পাচ্ছি। আমার লেখার জন্য চমৎকার আইডিয়া, সন্দেহ নাই।
— না, সে তোমাকে কখনোই মেরে ফেলবে না। কারণ তোমাকে মারলে তার নিজের অস্তিত্বও মুছে যাবে।
— যাক বাবা। তাহলে কোনো চিন্তা নাই। একটু আধটু দুষ্টুমি করলে ঠিক আছে। আমি কিছু মনে করব না।
আমার বুকশেলফের বইগুলির দশা মনে পড়তে হাসতে হাসতে বললাম। আমিনাও ঠোঁট টিপে হাসল।
— অন্যান্য দেশের কারিন বা কারিনাকে নিয়ে যে বিশ্বাস রয়েছে তার থেকে আমাদের বিশ্বাসে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে।
— এক মিনিট, আমিনা। অন্যান্য দেশে কী বিশ্বাস করে?
হাসল আমিনা, আমার কৌতূহল দেখে
— ইহুদী লোককথায় বলে তুমি আর তোমার কারিন একদম এক হবে। তুমি মেয়ে হলে, সেও মেয়ে। তোমার বিয়ে, ছেলেমেয়ে হলে তারও হবে। তোমার মৃত্যু হলে সেও সাথেসাথে মারা যাবে।
কিন্তু ইজিপ্সহিয়ান বা কিছু আরব দেশে আবার ভিন্ন মতবাদ। তাদের বিশ্বাস ছেলেদের থাকবে মেয়ে কারিনা আর মেয়েদের ছেলে কারিন। তারপর অবশ্য বিয়ে বা ডিভোর্স হলে অপরদিকেও তাই হবে। মৃত্যুও একই সময়ে হবে।
— এখন তোমাদের মরক্কোতে কী বিশ্বাস, সেটা বলো প্লিজ।
— মরোক্কোতে কারিন/কারিনার সাথে সম্পর্কটা আরো এক ধাপ জটিল। আমাদের বিশ্বাস প্রতিটি মানুষের কারিন/কারিনা তো থাকেই, সাথে আকাশেও একটা তারা থাকে, সেই সাথে স্বর্গের গাছে একটা করে পাতা বরাদ্দ থাকে। সবার ভাগ্য একে অন্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অসুখ করলে কারিন/কারিনারও অসুখ করে, তারার উজ্জলভাব কমে যায়, গাছের পাতা হলদেটে হতে আরম্ভ করে। মরে গেলে কারিন/কারিনাও মরে যায়, তারা খসে পড়ে, পাতাও গাছ থেকে ঝরে পড়ে।
— বাব্বাহ। খুবি ইন্টারেস্টিং।
টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ল আমিনা। বেডরুম থেকে লাল মখমলের ছোট্ট থলে টাইপের ব্যাগ এনে আমার হাতে দিল।
— তোমার জন্য, দীবা।
আমি তো অবাক
— আমার জন্য?
— হুম। মরক্কো থেকে আনিয়ে নিলাম। রক্ষাকবচ। সবসময় পরে থেকো। কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তাছাড়া আমি তো রয়েইছি। এবারে আমি সামারের পরেও কন্ট্রাক্ট এক্সটেন্ড করেছি। কাজেই তোমার ওপরে নজর রাখতে পারব।
বিস্মিত হলাম, খানিকটা সংকুচিত হয়েও গেলাম বলা চলে। কারো কাছ থেকে উপহার নিতে আমি সংকোচবোধ করি। উপহার কেন, কারো সাহায্যও আমি সহজে নেই না। কিন্তু একজন এত ঝামেলা করে সুদূর মরোক্কো থেকে আমার জন্য জিনিস আনিয়ে নিয়েছে আর আমি অকৃতজ্ঞের মতো নিতে অস্বীকার করব, এতখানি অভদ্রও আমি না। ধন্যবাদ দিয়ে থলেটা হাতে করে বাসায় চলে এলাম।
থলে থেকে বেরুলো মাছের আকৃতির এক লকেট, কালো সুতায় বাঁধা। জিনিসটা কাঠের, ওপরে মাছের অবয়ব খোদাই করা। বেশ সুন্দর। আমি হয়ত পরতাম মালা হিসাবে কিন্তু রক্ষাকবচ শব্দটাই আমার মনে অস্বস্তির সৃষ্টি করছে। এসব জিনিসে বিশ্বাস নেই। আমি অতিপ্রাকৃত জিনিসে বিশ্বাস করি ঠিকই, কিন্তু তাদের কাছ থেকে রক্ষা পাবার জন্য তাবিজ কবজ পরে ঘুরে বেড়াব, এতখানি রক্ষণশীল আমি নই। কেউ জানলে হেসে কুটিপাটি হবে। বিশেষ করে আমার মা। এদিকে আকাশ তো হাসতে হাসতে সোফা থেকেই পড়ে যাবে।
কারো হাসির পাত্র হতে আমার খুব অনীহা।
ফ্যান্টাসি নিয়ে লেখালিখি করলেও আসলে আমি ভীষণ বাস্তববাদী, খুব সাহসীও। না হয়ে উপায় ছিল না। আমার সিঙ্গেল প্যারেন্ট মায়ের সান্নিধ্যে বেড়ে উঠতে গিয়ে অনেক ধরণের পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে শিখে গেছিলাম। খুব অল্প বয়স থেকে আমাদের নিয়ে লোকের নোংরা অপবাদ, কুটনামি, অপপ্রচার, এমনকি বিনা কারণে ক্ষতি করবার চেষ্টা, অসহযোগিতা সয়ে এসেছি। মাকে দেখেছি আমার অমানুষ বাবাকে ছেড়ে আসবার জন্য কত ধরণের অনভিপ্রেত ঘটনা বা কথার মুখোমুখি হতে। যা একজন অল্পবয়সী মেয়ের সামনে হওয়া কোনো ভাবেই উচিৎ ছিল না। যারজন্য আমিও খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যেতে বাধ্য হয়ে ছিলাম। অন্তত মনের দিক দিয়ে। ফালতু ভাবালুতা বা অল্প বয়সের অতি আবেগ আমার মনের মধ্যে শিকড় গেড়ে বসবার চান্সই পায়নি। আমি নিজেকে গড়ে তুললাম স্বাধীনচেতা, সাহসী আর বাস্তববোধসম্পন্ন হিসাবে। অন্যের ওপরে নির্ভর করতে শিখিনি। অন্যের উপহাস তো আমার গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেয়।
সেখানে একটা মাছ আকৃতির লকেটের ওপরে নিজের সুরক্ষার ভার ছেড়ে দেব ভাবাটাই হাস্যকর। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার খুলে থলেটা ওখানেই রেখে দিলাম।
(চলবে)
বি দ্র— আমাদের রাত্রে(দেশের সকালে) আরেকটা পর্ব দেয়া হবে এখন থেকে। অর্থাৎ ২৪ ঘন্টায় দুইটা করে পর্ব।
সবাই খুশি তো? আমাকে বাহবা দিন, প্লিজ! 🤣