কারিনা পর্ব-০৩

0
64

কারিনা (৩)

১৫/০৪/২০২৪

তিনমাসের বেশি হয়ে গেছে ডায়রিতে কিছু লিখিনি। আসলে লিখবার মতো কিছু ছিল না। কারণ আমি বাসায় ছিলাম না। মায়ের বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম।

ব্যপারটা তাহলে খুলেই বলি। ডিসেম্বারের শুরুতে কনসিভ করেছিলাম। টের পাইনি তবে জানুয়ারিতে অল্প অল্প ব্লিডিং হচ্ছিল দেখে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে জানতে পারি। ডাক্তার আমাকে ফুল রেস্টে থাকতে বলল। ইউটেরাসে নাকি বেশকিছু গ্রোথ রয়েছে। যাহোক, প্রাথমিকভাবে আমি আর আকাশ দুজনেই হতবাক হয়ে গেছিলাম। এত তাড়াতাড়ি বাচ্চা নেবার কথা আমরা চিন্তাও করিনি। কিন্তু ঘটেই যখন গেছে, তখন কেমন এক মমতা চলে এল ভ্রুণটার প্রতি। কোনোমতেই একে হারাতে চাই না আমরা। মা’র বাড়িতে গিয়ে থাকবার সিদ্ধান্ত নিলাম, আকাশও বারবার বলতে লাগল। তিনমাস পার হয়ে গেলে বিপদের আশংকা কমে যাবে, ডাক্তার বলল। আমি তাও তিনমাস পার করে আরো একমাস কাটিয়ে আজ বাসায় ফিরে এলাম। আমাকে ছাড়া আকাশের কষ্ট হচ্ছে, ওর মুখ দেখে বুঝতে পারি। যদিও সে কখনো কিছু বলে না।

লিফট আমাদের তলায় পৌঁছে গেল। ল্যান্ডিং এ বের হতে দেখি চারিদিকে জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। আকাশ আমাকে বলেছিল আমাদের পাশের ফ্ল্যাট খালি হয়েছে, আজ নিশ্চয় নতুন ভাড়াটে এসেছে। খোলা দরজা দিয়ে উঁকি দিলাম যদি কিছু দেখা যায়। আমি খুব বেশি মিশুকে না হলেও মানুষ দেখতে পছন্দ করি। লেখায় খুব কাজে দেয়। তাছাড়া প্রতিবেশীর সাথে মৌখিক সদ্ভাব রাখতেও পছন্দ করি। শুধু অকারণে যাওয়া আসা, গসিপ এসব পছন্দ করি না।

ভাবতে না ভাবতেই এক মাঝবয়সী মহিলা বের হয়ে এল। মহিলা আফ্রিকান, পরণে খুব রঙচঙে কাফতান, মাথায় কাফতান কাপড়ের পাগড়ি জাতীয় জিনিস বাঁধা। আমাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে হাসল।
— হাই, আমি আমিনা হই।
— হাই, আমি দীবা।
— নাইস টু মিট ইউ, দীবা। তোমার বাসা হয়?
আঙুল দিয়ে আমাদের এপার্টমেন্ট দেখিয়ে দিল আমিনা। ওর জোড়াতালি দিয়ে বাংলা কথা শুনে আমি হেসে ফেললাম
— হ্যাঁ, আমিনা। তুমি বাংলা জানো?
— হুম। আমি এভ্রি ইয়ার আসি তো। ছাত্রদের পড়াইতে।

প্রথম দেখায় আমিনাকে ভালো লেগে গেল আমার। পরে কথায় কথায় জেনেছিলাম ও মরোক্কোর মেয়ে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। সামারে বাংলাদেশের এক নামকরা ইউনিয়ার্সিটিতে পড়াতে আসে ভিজিটিং প্রফেসার হিসাবে। ইংরেজি সাহিত্য।
বাহ! একজন ভিনদেশী প্রফেসারকে প্রতিবেশী হিসাবে পেয়ে খুব খুশী হলাম আমি। মরক্কো নিয়ে বরাবর কৌতূহল ছিল। মনেমনে ভেবে রেখেছিলাম মরক্কোকে পটভূমি রেখে ফ্যান্টাসী উপন্যাস ফেঁদে ফেলব। আমিনার কাছ থেকে নিশ্চয় অনেক সাহায্য পাওয়া যাবে ভেবে উৎসাহিত হয়ে পড়লাম।

আমিনা খুব করিৎকর্মা। জিনিসপত্র বয়ে নিয়ে যাবার জন্য লোক থাকলেও সে নিজেই একটা বড় বাক্স অবলীলায় তুলে নিল। দেখে আমি বললাম।
— সরি, আমিনা। আমার সাহায্য করা উচিৎ। কিন্তু ডাক্তার আমাকে ভারী তুলতে মানা করেছে।
— না না। নো ওয়ারিজ। প্রেগনেন্সিতে ওয়েট ক্যারি করিতে হইবে না। দেখা হইবে, দীবা।
আমাকে হতবাক করে দিয়ে আমিনা ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। ও জানল কিভাবে যে আমি প্রেগন্যান্ট? আমাকে দেখে কোনোমতেই বোঝা সম্ভব না।

চাবি ঘুরিয়ে দরজা ঠেলে ঢুকে মনটা প্রসন্ন হয়ে গেল। আমার অনুপস্থিতিতে ঘরবাড়ির অবস্থা ছন্নছাড়া হয়ে নাই। দুজন পরিচারিকা রয়েছে। একজন পরিস্কার করে, অন্যজন রান্না। বেডরুমে ঢুকে হাতের ব্যাগটা নামিয়ে রাখছি, আকাশের ফোন এল।
— পৌঁছেছ, দীবা?
— হু, পৌঁছেছি।
— শোনো, রান্নার খালাকে তোমার পছন্দের খিচুড়ি, বেগুন ভাজি, আলু ভর্তা, ভুনা মাংস করে রাখতে বলে দিয়েছিলাম। দেখেছ?
— এইমাত্র ঢুকলাম, আকাশ। ব্যাগ রাখছি বেডরুমে।
— খুব সাবধানে থাকবে কিন্তু। খেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। কিছু ধরতে হবে না। তোমার কিছু লাগলে আমি এসে করে দিব।
— আচ্ছা বাবা!
হাসতে হাসতে ফোন কেটে দিয়ে রান্নাঘরে এসে দাঁড়ালাম। কুকারে হাড়িতে রান্না করা রয়েছে, এখনো গরম। গরম থাকতে থাকতেই খেয়ে নিতে হবে।
খেতে বসে ভাবলাম আমিনা ব্যস্ত, খাবার কিছুটা দিয়ে এলে ওকে আর ঝামেলা করতে হয় না। ঝটপট বক্সের মধ্যে সাজিয়ে ফেললাম। কিন্তু যাবার আগে আমার লেখার ঘরটায় একবার ঢুঁ মারা দরকার। এতক্ষণ এসেছি, একবারও গেলাম না। ঘরটা যেন হাতছানি দিয়ে আমায় ডাকছে।

দরজা ঠেলে ঢুকতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ঘরে জিনিস বেশি নাই কিন্তু যা আছে, সব লন্ডভন্ড হয়ে রয়েছে। বুকশেলফ থেকে কেউ বইগুলি যেন ছুঁড়ে ছুঁড়ে ঘরের চারিদিকে ফেলেছে। মোমবাতি দানটা একদিকে উল্টে পড়ে রয়েছে। শখের জিনিসপত্রের এমন অবস্থা দেখে হাসব না কাঁদব বুঝতে পারলাম না, ঝটপট দুহাতে সবকিছু তাদের নির্দিষ্ট জায়গায় সাজিয়ে ফেললাম। কাজের খালা যখন এসেছিল তখন নিশ্চয় এ ঘরটাও পরিষ্কার করেছিল, একফোঁটা ধূলা কোথাও নাই। তারমানে যা হয়েছে, খালা চলে যাবার পরেই হয়েছে।
চোখের কোণে কী যেন নড়ে উঠল। তাকিয়ে দেখি আয়নায় সে উঁকি দিয়েই সরে পড়ল। মুখখানি থমথমে। মনে হল এ ওরই কাজ। এতদিন আমাকে দেখেনি, তাই রাগ করে জিনিসপত্র ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলেছে।

বাব্বাহ! এত রাগ! মজাই লাগল আমার। আমাকে মিস করেছে দেখি।

খাবারের বক্স দেখে আমিনা খুব খুশি হল
— ওয়াও, আমি বাঙালি ফুড ভালোবাসি, দীবা। থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ।
— মোস্ট ওয়েলকাম, আমিনা। গরম গরম থাকতে খেয়ে নাও। আমি চললাম। ঘুমে পড়ে যাচ্ছি।
— চলো তোমাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেই।
দরজা বন্ধ করবার আগে আমিনা অদ্ভুত এক কথা বলল
— তোমার মাঝে আরেকজনের ছায়া দেখছি, দীবা।
আমি তখন ঘুমে চোখ খুলে রাখতে পারছি না। না শোনার ভান করে ঝটপট ফিরে এসে বিছানায় শুতে না শুতেই ঘুমে তলিয়ে গেলাম।
(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে