কারিনা
(১)
দরজায় অনেকবার নক করছি, চাবি নিয়ে বেরুতে ভুলে গেছি দেখে নিজেকে একচোট গালাগাল করলাম। চারবার নক করবার পর ঘুমঘুম চোখে দরজা খুলে দিল আকাশ। আমাকে দেখে ভুরূতে ভাঁজ ফেলে বলল
— তুমি? আমি ভেবেছিলাম তুমি পাশের রুমে।
ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললাম
— তুমি তো জানোই এসময়ে আমি জগিং করতে যাই। পাশের রুমে আছি ভাবলে কেন?
আকাশের চোখে তখনো ঘুম লেগে রয়েছে। বাচ্চাদের মতো মাথা চুলকে বলল
— কী জানি। মনে হল একবার শব্দ পেলাম ওঘর থেকে। ভাবলাম তুমি হয়ত লিখছ।
— ওপরের তালায় শব্দ হলে অনেকসময় ওরকম মনে হয়।
— তাই হবে। সোফায় বসে পড়ল আকাশ।— উঠিয়েই যখন দিলে, এক কাপ চা খাওয়াও দেখি, ডার্লিং।
— তাহলে একটু অপেক্ষা করতে হবে, ডার্লিং। জগিং শেষে গোসল না করে কিচেনে যাই না আমি, জানোই তো।
ওমনি আকশের মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি চাপল। তড়াক করে উঠে আমার পিছু নিতে নিতে বলল
— গোসলেই যখন যাবে, তার আগে নাহয়…
আমি ওর হাতের নাগালের বাইরে গিয়ে হাসতে হাসতে খুন হয়ে গেলাম
— এই অসভ্য। দিনে দুপুরে এসব কী! তোমার অফিস নাই বুঝি!
— শালার অফিস! অবলীলাক্রমে অফিসের গুষ্টি কিলালো আকাশ।
মাত্র ছয়মাস আমাদের বিয়ে হয়েছে। ৯০% সম্বন্ধের বিয়ে, ১০% প্রেম। মানে বিয়ের কথা পাকা হতে হতে যতটুকু প্রেমে পড়া যায় আরকি। গত ছয়মাস ধরে তাই একে অন্যকে চিনে নিচ্ছি। বিবাহিত জীবন উপভোগ করছি। ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে আমি, সেজন্য বিয়ে নিয়ে মনেমনে অনেক ভয় ছিল। যারজন্য ভেবেচিন্তে আকাশকে বেছে নিয়েছিলাম। এ সিদ্ধান্ত নিতে মনের থেকে মগজকে অগ্রভাগে রেখেছিলাম। মায়ের জীবনের প্রতিফলন নিজের জীবনে দেখতে চাইনি বলে। এখন মনে হচ্ছে হয়তবা আমি ভুল করিনি। আকাশের সাথে এ কয়মাসের যৌথ জীবনে ছন্দপতন একবারও হয়নি। ছোট্ট একটা সংসার হয়েছে আমাদের। নিজের হাতে গুছিয়ে নিচ্ছি। ফাঁকেফাঁকে আমার লেখালিখিও চলছে। দুই বেডরুমের বাসার সেকেন্ড বেডরুমটাকে আমার লেখার ঘর হিসেবে সাজিয়ে নিয়েছি।
ভার্জিনিয়া উলফের এ রুম অফ ওয়ান’স ওন।
লেখার টেবিল, ল্যাপটপ আর একটা বুকশেলফ ছাড়া রুমটাকে অযথা জিনিসপত্র দিয়ে জঙ্গল বানাইনি। টেবিলের ওপরে অবশ্য দুটো প্রিয় জিনিস রয়েছে। সুগন্ধী মোমবাতি। সাথে এন্টিক দোকান থেকে কেনা সোনালি আয়না। ছোট গোলাকৃতি আয়নাটার নিজস্ব স্ট্যান্ড আছে। সুন্দর কারুকাজ করা তাতে। মোমবাতি জ্বালিয়ে লিখতে লিখতে যখন আয়নায় মাঝেমাঝে উঁকি দিয়ে দেখি, নিজেকে ভীনদেশের এক রাজকুমারী বলে মনে হয়। অবশ্য আমি লিখিও ফ্যান্টাসী। সেজন্য এ অনুভূতিটা লেখার সময় খুব কাজে দেয়।
— ওকি, গোসলে না গিয়ে ওঘরে যাচ্ছ কেন? এসেই লিখতে বসবে নাকি?
— আসছি। একটা ইমেইল এক্সপেক্ট করছি। দেখি এলো কিনা। জরুরি ইমেইল।
লেখার ঘরে ঢুকে ল্যাপটপ অন করে চেক করলাম। আসেনি। টেবিলের সামনে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে চোখ বুলিয়ে নিলাম। লেখার টেবিলটা আমার অতি প্রিয়। এখানে শুধু ল্যাপটপ, আয়না আর মোমবাতি থাকে। আর কিছু রাখি না। ওহ, আমার প্রিয় চায়ের মগটাও থাকে। লিখবার সময় চা চাই আমার। সাথে একটা ছোট্ট নোটবুক আর আকাশের কাছ থেকে উপহার পাওয়া দামী কলম। নোটবুকে নানান আইডিয়া টুকে রাখি, চা খেতে খেতে প্লটিং করি।
চিন্তিতভাবে মগটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমি ডানহাতি। মগটাও ডানদিকে থাকে সবসময়। আজ সকালে উঠে যখন চা খেয়েছিলাম তখন ডানদিকে রেখেই উঠে পড়েছিলাম যতদূর মনে পড়ে।
কিন্তু এখন মগটা বাদিকে আয়নার গা ঘেঁষে রয়েছে।
এখানে বলে রাখি, আমার একটু পিটপিটে স্বভাব রয়েছে। যে জিনিস যেখানে থাকবার কথা, সে জিনিস সেখানেই থাকতে হবে। চা খেতে হলে আমি ডানহাতে মগ ধরে লেখার টেবিলের ডানদিকে রাখি। এর অন্যথা কখনো হয়েছে বলে মনে পড়ে না। আজ হঠাত বাদিকে কেন?
ঘরের চারদিকে ভালো করে দেখলাম। সবকিছু ঠিকঠাক, যেভাবে রেখে গেছিলাম, সেভাবেই রয়েছে। শুধু মগটা মনে অস্বস্তির জন্ম দিচ্ছে।
মগ তুলে ডানদিকে রাখলাম। কী মনে করে সাথে নিয়েই বের হলাম। যদিও এ সময়ে আমি চা খাই না, তাও আজ নাহয় খেলামই আকাশের সাথে।
ড্রইংরুম থেকে বেরিয়ে বাথরুমের দিকে যেতে যেতে প্রশ্ন করলাম
— আকাশ, তুমি কি আমার রুমে গেছিলে?
আকাশের চেহারায় কনফিউশান দেখা দিল
— আমি? আমি তো ঘুমাচ্ছিলাম, দীবা। তোমার রুমে কখন যাব?
মন থেকে ব্যপারটা ঝেড়ে ফেলে আমি বাথরুমে ঢুকে পড়লাম। মনের ভুলে বা দিকে রেখেছি, এনিয়ে এত চিন্তার কী আছে?
(চলবে)