#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#সমাপ্তি_পর্ব
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি
“একটা কল করে আসতে বলেছি বলে,আসার সময় তাড়াহুড়োয় জুতোটাও কি খেয়াল করেন নি চেয়ারম্যান সাহেব?”
মেহবিনের কথায় শেখ শাহনাওয়াজ তার পায়ের দিকে তাকালেন। আর তাকিয়ে দেখলেন সে বাড়ির জুতো জোড়াই পড়ে এসেছেন। শেখ শাহনাওয়াজ হেঁসে বললেন,,
‘অতিরিক্ত খুশিতে মানুষ মাঝে মাঝে অনেক কিছুই ভুলে যায়।”
‘আপনি কি খুশি আপনাকে এখানে ডেকেছি বলে?”
“তা নয়তো কি আজ আমার ঈদের দিন।”
মেহবিন শেখ শাহনাওয়াজ এর দিকে তাকালো তার চোখটা ছলছল করছে। মেহবিন তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,,
‘বাবা!”
বাবা বলতেই শেখ শাহনাওয়াজ এর চোখ থেকে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো। তিনি বললেন,,
“এই দিনটার জন্য কতো বছর ধরে অপেক্ষা করছি আম্মা।”
মেহবিন তার বুকে মাথা রেখেই বলল,,
‘জানি তো!”
মেহবিন তাকে ছেড়ে মুচকি হেসে বলল,,
‘হুম অনেক হয়েছে এখন চলুন আমাকে বেলুন আর হাওয়াই মিঠাই কিনে দিন। ছোটবেলার মতো বেলুন নিয়ে হাটবো আর খাবো। যদিও দাঁড়িয়ে খাওয়া উচিত নয়। তবুও আজ খাবো আমি।”
মেয়ের আবদারে শেখ শাহনাওয়াজ হাসলেন। তিনি পকেটে হাত দিলেন তা দেখে মেহবিন আদুরে গলায় বলল,,
‘এবার খুশিতে আবার ওয়ালেট রেখে আসেন নি তো! যদি আসেন তাহলে কিন্তু আমার মনটা ভেঙে যাবে আব্বা।’
আব্বা ডাক শুনে এবার শেখ শাহনাওয়াজ আরো জোরে হাসলেন। কারন যখন ও একটু আদুরে আদুরে ভাব থেকে কথা বলে তখন আব্বা বলে। এটা ছোট বেলায় বলতো। বহু বছর পর আব্বা শুনে তার মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেল। তিনি হেসে বললেন,,
‘না ওয়ালেট রেখে আসি নি নিয়েই এসেছি।”
“যাক আলহামদুলিল্লাহ!”
মেহবিন শেখ শাহনাওয়াজ এর ফোনে ওদের পুরোনো বাড়ির ঠিকানা পাঠিয়েছিল। এখানে কেউ না থাকলে কি হবে শেখ শাহনাওয়াজ এ বাড়ির দেখভাল করার জন্য কেয়ার টেকার রেখে দিয়েছিলেন। কারন এই বাড়িতেই মেহের আর মেহবিনের শেষ স্মৃতি রয়েছে। মেহবিন তার পাঁচ ঘন্টা পর লোকেশন পাঠিয়েছিল। কারন ওর সাজেক থেকে আসতে সময় লাগবে তো তাই। তখনি ও গাড়ি বের করে রওনা দিয়েছিল। পরে লোকেশন পাঠিয়েছে দেখে মেহবিন শেখ শাহনাওয়াজ এর আগেই পৌঁছে গেছে। মেহবিন ওর বাবার এক আঙুল ধরলো যেভাবে ছোটবেলায় ধরতো। শেখ শাহনাওয়াজ হেঁসে রাস্তায় বের হলেন মেয়েকে নিয়ে। সময়টা বিকেল রাস্তার ধারেই বেলুন আর হাওয়াই মিঠাই ওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে। তিনি মেহবিনকে বিশটা বেলুন আর দুটো হাওয়ার মিঠাই কিনে দিল। মেহবিন বাচ্চাদের মতো সেগুলো হাতে নিয়ে হাঁটতে আর খেতে লাগলো। শেখ শাহনাওয়াজ মেয়েকে মন ভরে দেখতে লাগলেন।
রাতে মেহবিন আর শেখ শাহনাওয়াজ একসাথে রান্না করলেন। শেখ শাহনাওয়াজ আজ মেয়েকে খায়িয়ে দিলেন। দু’জনে মিলে ঠিক করলো চাঁদ দেখবে তাই দুজনে ছাদে উঠে গেল। শেখ শাহনাওয়াজ দোলনায় বসলেন মেহবিন ও তার পাশে বসলো। তখন শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,
“আমার কাঁধে একটু মাথা রাখবেন আম্মা!”
মেহবিন মুচকি হেঁসে তার কাঁধে মাথা রাখলো। শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,
“আপনাকে ভিশন ভালোবাসি আমি!”
মেহবিন বলল,,
“আপনার ওপর কোনদিন অভিমান করি নি শুধু অভিযোগ করেছি আমি। আপনি জানেন কেন?”
‘কেন?”
“কারন আমার যদি কারো ওপর অভিমান হয় তখন সেটা আকাশ সম হয়। আর কেউ সেটাকে ভাঙতে পারে না। কিন্তু যদি অভিযোগ থাকে কারো ওপর তাহলে যার ওপর অভিযোগ সে অনুতপ্ত সাথে মাফ চেয়ে নিলেই অভিযোগ শেষ হয়ে যায়। আপনার থেকে আমি সব শুনিনি কেন জানেন কারন আমি চাইছিলাম আপনার ওপর থেকে আমার অভিযোগ শেষ না হোক।যতক্ষন পর্যন্ত না আমি চাই।”
‘আমার ওপর আপনার কি কি অভিযোগ ছিল?”
‘আপনার ওপর আমার এক আকাশ অভিযোগ ছিল বলে শেষ করা যাবে না। তবে মুল অভিযোগ টা হলো, আপনি আমাকে ওভাবে রাস্তায় ছেড়ে না দিয়ে কি নিজের কাছে রেখে আগলে রাখতে পারতেন না।”
কথাটা শুনে শেখ শাহনাওয়াজ এর চোখ ছলছল করে উঠলো।তিনি একটা ঢোক গিলে বললেন,,
“ঐটুকু সময়ের মধ্যে আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। আমি সঠিক ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। মাথার মধ্যে হাজার খানেক চিন্তা বুকে ভয় এমন সময় একটা মানুষ কখনোই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে কি না সন্দেহ। তবে এই সিদ্ধান্ত গ্ৰহনে কতটা কষ্ট হয়েছে আমার সেটা বোঝানোর মতো নয়। তবে যখন পরে বুঝতে পারলাম ভুল হয়ে গেছে। তখন আপনার কাছে গেলাম কিন্তু আপনি আমাকে দেখেই উত্তেজিত হয়ে পরতেন আপনার অবস্থা আরো খারাপের দিকে যাচ্ছিল। এই জন্য একেবারে দুই বছর পর আপনি সুস্থ হলে আপনার সামনে যাই কিন্তু তখন আপনি আমার কথা শুনতে নারাজ। তারপর তো যাই হোক সবকিছুর জন্য আমাকে মাফ করে দিয়েন। আমার ভুল সময়ে ভুল সিদ্ধান্ত গ্ৰহনের জন্যই আপনার জীবনে এতো জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।”
“হুম এখন বাদ দিন এসব। এখন না হয় আমরা বাবা মেয়ে মিলে একটু চাঁদ দেখি।”
“এখন কি সব অভিযোগ শেষ!”
“যদি শেষ না হতো তাহলে আমি এখানে থাকতাম না।”
“ভালোবাসি!”
“হুম আমিও বাসি!”
‘কি বাসেন?”
“ঐ তো ভালোবাসি!”
“আপনি এমন কেন?”
“কেমন?”
‘একটু বেশিই বুদ্ধিমতি।”
কথাটা শুনে মেহবিন আর শেখ শাহনাওয়াজ একসাথে হেঁসে উঠলো। অবশেষে বাবা মেয়ের দূরত্ব শেষ হয়ে কাছাকাছি এলো। এভাবেই দু’টো দিন কেটে গেল। শেখ শাহনাওয়াজ বাড়ি চলে গেলেন ছেলের বিয়ে বলে কথা। মেহবিন ও সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। কোথায় গন্তব্য সেটা একমাত্র সেই জানে।
_______________
শেখ শাহনাওয়াজ তিন ছেলেমেয়ের বিয়ে একসাথে দেবেন আর যেহেতু একসাথে তাই তিনি মাহফুজ শাহরিয়ার আর মেহরব চৌধুরীর সাথে কথা বলে একটা রিসোর্ট বুক করেছিলেন। তবে জায়গা টা মেহবিন চুজ করে দিয়েছিল এটা অবশ্য শেখ শাহনাওয়াজ ছাড়া আর কেউ জানে না। রিসোর্ট এ আসা হয়েছে বিয়ের আগের দিন। সবাই কতো আনন্দ মজা করছে কিন্তু দুজনের মধ্যে আনন্দের রেশ নেই সেটা হলো নেত্রী আর নেত্রীর পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা। সবাই ছাদে নিজেদের মতো রয়েছে। মুখর একটা নীল রঙের পাঞ্জাবি পরেছে আর তাজেল একটা নীল রঙের ফ্রক। তাজেল আর মুখর সুইমিং পুলের একপাশে চুপ করে বসে আছে। মুখর গালে হাত দিয়ে বসে আছে দেখে তাজেল বলল,,
‘এই যে পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা গালে হাত দিছাও ক্যান? হাত নামাও গালে হাত দেওয়া ভালো না। দাদি কইছিলো অশুভ ?”
মুখর গাল থেকে হাত নামিয়ে বলল,,
“উঁহু কোনকিছুকে নেত্রী অশুভ বলবে না। এটা শিরকের অন্তর্ভুক্ত। শিরক মানে বুঝোতো আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা।
‘আবদুল্লাহ্ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেছেন : কোন কিছুকে অশুভ মনে করা শির্ক। (আহমাদ হা/৩৬৮৭, শায়খ আলবানী ও ইবনু হিব্বাস একে সহীহ বলেছেন)
‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস’ঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ কোন বস্তুকে কুলক্ষণ মনে করা ‘শিরক’, কোন বস্তুকে কুলক্ষন ভাবা শিরক। একথা তিনি তিনবার বললেন। আমাদের কারো মনে কিছু জাগা স্বাভাবিক, কিন্তু আল্লাহর উপর ভরসা করলে তিনি তা দূর করে দিবেন।
(সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ৩৯১০)
আর তুমি জানো শিরক ভয়াভহ একটা গুনাহ।
‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস’উদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, অন্য বর্ণনায় রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি। যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে শারীক করে মারা যাবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। আমি বলি, যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শারীক না করা অবস্থায় মারা যায় সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।{ (ই.ফা. ১৭০; ই.সে. ১৭৬),সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ১৬৯}
সব শুনে তাজেল বলল,,
“তোমার এতোকিছু বুঝি নাই আমি খালি বুঝছি শিরক করা যাইবো না। এইডা বড় গুনাহ।”
মুখর বলল,,
“হুম বুঝেছো তবে শিরক থেকে বাঁচতে,
ফারওয়াহ ইবনু নাওফাল (রাঃ) হতে তার পিতার সূত্র থেকে বর্ণিতঃ
নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নাওফাল (রাঃ)-কে বলেনঃ তুমি “কুল ইয়া আয়্যুহাল কাফিরূন” অর্থাৎ সূরা কাফিরুন সূরাটি পড়ে ঘুমাবে। কেননা তা শিরক হতে মুক্তকারী।
(সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ৫০৫৫)
কথাটা শুনে তাজেল বলল,,
“আইচ্ছা আমি সুরা কাফিরুন পারি ডাক্তার শিখাইছিল। এহন কও তুমি চুপচাপ বইসা আছো কেন সবাই না মজা করতেছে?
‘তুমি কেন বসে আছো?”
‘ডাক্তাররে ছাড়া ভাল লাগতেছে না।”
“আমার ও তোমার ডাক্তাররে ছাড়া ভালো লাগতেছে না।”
“তাইলে এহন কি করুম?”
“চলো গানছাড়া নাচি?”
“কোন খুশিতে?”
“আজ খুশিতে না দুঃখে!
‘ধুরু দুঃখে কেউ নাচে নাকি। ডাক্তার একবার কইছিল তুমি নাকি অনেক খুশি হইলে গান ছাড়া নাচো?”
মুখর হেঁসে বলল,,
‘হুম নাচি তো। আজ তো কাজ নাই তোমার আর আমার তাই চলো নাচি।”
‘সত্যি?”
“হ সত্যি কাল তোমার ডাক্তার আইলে তোমার ডাক্তাররে নিয়ে নাচবো।”
‘আইচ্ছা। কিন্তু আমার তো শরম করে।”
‘ধূর আজকে শরম কে বাদ দাও নেত্রী।”
মুখরই আগে শুরু করলো আর তাজেলের হাত ধরে ঘোরাতে লাগলো। তাজেল ও খিলখিল করে হেসে উঠলো। দুজনে হাত উঁচু করে সেই নাচ দিল। সবাই ওপরে দেখে কেউ দেখলো না ওদের নাচ। তবে একজন দেখে হাসতে লাগলো। সে হলো মেহবিন সে সিসিটিভির মাধ্যমে দুজনকে এতোক্ষণ দেখছিল। মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,
‘মাশাআল্লাহ এদের ওপর কারো নজর না লাগুক।’
_________________
অতঃপর আজকে মুখর আর মেহবিনের জীবনে কাঙ্ক্ষিত দিনটা এসেই পড়লো। আজ মুখর আর মেহবিনের বিয়ে সেই সাথে আরবাজ আর নাফিয়া এবং মিহির ওরফে অনুভব আর মিশুর বিয়ে। কাল চুপচাপ বসে থাকলেও আজ সারা বাড়ি দৌড়াচ্ছে তাজেল। সঙ্গী হিসেবে আদরকে নিয়েছে আজ। বিয়ের সময় হয়ে আসছে কিন্তু সবার মাঝে আলাদা উত্তেজনা কাজ করছে। কারনটা মেহবিন কারন সে বিয়ের সময় একেবারে এন্ট্রি নেবে। মন্ত্রী, কমিশনার, চেয়ারম্যান এর ছেলে মেয়ের বিয়ে হচ্ছে এটা কি আর যে সে বিয়ে ধুমধাম করে বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। প্রেসের লোক ও আছে এখানে এছাড়াও বিজনেস ম্যান নেতাকর্মীদের আনাগোনা। মুখর কাজ করা ক্রীম কালারের পাঞ্জাবি পড়েছে এটা মেহবিন দিয়েছে কুরিয়ার বক্সে। আর তাজেলের জন্য লাল লেহেঙ্গা। তাজেল লেহেঙ্গার সাথে সে লাল রঙের হিজাব পরেছে। সবাই রেডি হয়ে নিচে নামলো। মিশু আর অনুভব নীল রঙের পাঞ্জাবি আর লেহেঙ্গা পরেছে। আরবাজ আর নাফিয়া সাদা রঙের পাঞ্জাবি আর লেহেঙ্গা পড়েছে। মেয়েরা অবশ্য সবাই মানে কনেরা লেহেঙ্গার সাথে হিজাব নিকাব পরেছে কারন অনেক লোক। অতঃপর শোনা গেল মেহবিনের গাড়ি এসে পরেছে। কথাটা শুনে মুখর এর হার্টবিট বেড়ে গেল। মুখরের হাত ধরে আছে তাজেল। অতঃপর দরজা দিয়ে মেহবিন কে দেখা গেল লাল বেনারসি শাড়ি মাথায় লাল হিজাব আর মুখে নিকাব। শাড়িটা দুই হাত ধরে আস্তে আস্তে আসছে। সবার নজর সেদিকেই। মুখর বুকের বাম পাশে হাত দিল। মেহবিন দূর থেকে তা দেখে হেঁসে ফেললো। মুখর এগিয়ে গেল ওর দিকে তাজেল ও পেছনে পেছনে গেল। মুখর ওকে কিছু বলবে তার আগেই মেহবিন “নেত্রী বলে তাজেলকে কোলে নিল। তা দেখে মুখর মাথায় হাত দিয়ে হেঁসে ফেললো। তাজেল মুখরকে বলল,,
“পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা দেহো আইজ আমি জিতছি। আইজ ডাক্তার আমার কাছে আগে আইছে তোমার কাছে যায় নাই।”
মুখর হেঁসে ওদের দিকে এগিয়ে এসে তাজেলের গাল টিপে দিয়ে বলল,,
‘এই খুশিতে নাচা যাক একটু।”
“হ !”
তাজেল কোল থেকে নেমে গেল। আর মুখরের হাত ধরে নাচতে লাগলো। তা দেখে পুরো হলের মানুষের মুখে হাঁসি ফুটে উঠল। মুখর মেহবিনের হাত ধরে নাচতে লাগলো। আজ মেহবিন ও হেঁসে তাজেল আর মুখরের সাথে তাল দিল। গান নেই তবুও সবার মনে হচ্ছে এর থেকে সুন্দর নাচ বোধহয় হয় না। একটু পর মেহবিন দুজনকে থামিয়ে বলল,,
“অনেক হয়েছে এবার স্টেজে যাওয়া যাক। আমাদের জন্য সবাই অপেক্ষা করছে। আর কাব্য আজ আপনার বিয়ে এরকম পাগলামো করলে চলে। আর নেত্রী তুমিও।”
তখন তাজেল বলল,,
“আমি কি করুম পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালার সাতে থাকতে থাকতে পাগল হইয়া গেছি গা।”
‘এই তুমি আমায় পাগল বললে?”
দু’জনের ঝগড়ার আগেই মেহবিন থামিয়ে দিল। মুখর এক হাত দিয়ে মেহবিনের হাত ধরলো আরেক হাত দিয়ে তাজেলের। দুজনে স্টেজে উঠলো। মেহবিন সবার সাথে কুশল বিনিময় করলো। আছিয়া খাতুন তো কেঁদেই ফেললেন। মেহবিন হেঁসে তাকে জড়িয়ে ধরলো। অতঃপর মহা ধুমধামে আরবাজ আর নাফিয়ার বিয়ে হলো। কারন তাদের বিয়েটাই মুল আকর্ষন বাকিদের তো আগেই হয়েছে। তবুও বাকিদের বিয়েটাও ধুমধাম করে হয়ে গেল। সবার বিয়ে ডান। মেহবিন শেখ শাহনাওয়াজ এর কাছে গিয়ে বললেন,,
“বাবা খুদা লাগছে খায়িয়ে দেন?”
হুট করে এমন কথা বলায় চমকে ওর দিকে তাকালো। ওদের মধ্যে যে সব ঠিক হয়ে গেছে এটা কেউ জানে না। ওর কথা শুনে আরবাজ আর মিশু এগিয়ে গেল। আর বলল,,
‘ফুল?”
‘কি ?”
‘কি বললি বাবাকে?”
‘বাবাই তো বললাম? আমি কি আংকেল বললাম নাকি?”
“না তুই বাবাকে কি করতে বললি?”
“খায়িয়ে দিতে বললাম। এমন ভাবে বলছো যেন আমি কোনদিন বাবার হাতে খাইনি দুদিন আগেও তো খেলাম বাবা বলেনি তোমাদের?”
কথাটা শুনে সবাই শেখ শাহনাওয়াজ এর দিকে তাকালো তিনি সবার দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলল,,
“আমি খাবার নিয়ে আসছি!”
উনি যাবেন তার আগেই মিশু আর আরবাজ তাকে আটকে ধরলো। আর এমনভাবে তাকালো যেন খেয়েই ফেলবে। তিনি বললেন,,
“আসলে?”
আরবাজ হেঁসে বলল,,
‘হয়েছে আসলে নকলে ছাড়ো এখন শাস্তি হিসেবে আমাদের দুজনের জন্যও খাবার নিয়ে এসো। আর আমরাও তোমার হাতেই খাবো।”
তিনি হেঁসে চলে গেলেন। এদিকে সবাই মেহবিন কে ঘিরে ধরলো। এতদিন কোথায় ছিল কি করেছে। ও কিছুই বললো না। হেঁসে তাজেলকে নিয়ে বসে রইলো। আর কথা বলতে লাগলো। তাজেল ও হেঁসে হেঁসে গল্পের ঝুড়ি খুলে বসলো। মুখর ওর পাশে বসে ওদের দুজনকে দেখতে লাগলো। শেখ শাহনাওয়াজ এসে সবাইকে খায়িয়ে দিলেন। ওদের খাওয়া শেষ হলে মেহবিন মুখরকে খায়িয়ে দিল। সবাই নিজেদের মতো ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মেহবিন আর মুখর এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। হুট করে মুখর মেহবিনের কানের কাছে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,,
“আমার এই হৃদমাজারে তোমায় রাখিব যতন করে, সে তো জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়া কাব্যের বিহঙ্গিনী, সে তো রূপকথার পরী নয়,নয় কোনো আর্মি,সেতো নিরব শান্ত আমার বিহঙ্গিনী,কাব্যের বিহঙ্গিনী।
~ আইভি শিকদার (বিহঙ্গিনীর পাঠক বিহঙ্গিনীর জন্য লিখে পাঠিয়েছেন)
মুখরের কথা শুনে মেহবিন হেঁসে বলল,,
“নিশ্চয়ই রুপকথার কাব্যের বিহঙ্গিনীকে জেনে গেছেন?”
“হুম কারন কাব্যের বিহঙ্গিনী তার জীবন কাহিনী বিহঙ্গিনীর কাব্যের কাছে লেখিকা আজরিনা জ্যামির গল্পের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন। এ কয়েকদিনে কাব্যের বিহঙ্গিনী পেজ থেকে গল্প পোস্ট হয়েছে আর কেউ না বুঝলেও আমি ঠিকই বুঝেছি সেটা আমার বিহঙ্গিনীর গল্প রুপকথার বিহঙ্গিনীর।”
মেহবিন কিছু বললো না শুধু হাসলো। অতঃপর যেহেতু সব এখানেই হবে আর পুরো রিসোর্ট বুক করা। তাই বাসর ঘরের ব্যবস্থা এখানেই করা হয়েছে। কিন্তু বাসর ঘর ধরা হলো ঠিকই মাইশা আর মেহবিন মিহিরের থেকে ঠিকই টাকা নিয়েছে। আর মিশু মেহবিন মাইশা জিনিয়া মুনিয়া নিসা আরবাজ এর থেকে। শেখ শাহনাওয়াজ আরিফ জামান আর শেখ আমজাদের জন্য ওদের কে হেলা করেন নি। ঠিকই ওদের ন্যায্য মর্যাদা দিয়ে রেখেছেন। অতঃপর এবার পালা মুখরের এদিকে মুখর আর তাজেল দুজনে দাঁড়িয়ে ঝগড়া করছে। বিষয়টা মেহবিন মুখর বলল,,
“নেত্রী এমন করো কেন?”
“ডাক্তার মেলা দিন পর আইছে হেতি আমার সাতে থাকবো।”
“না আমার সাথে!”
“না কইলাম না আমার সাতে।”
‘না আমার সাথে থাকবে। আজ আমাদের বিয়ে হলো না আজ আমার কাছে থাকবে। আজ এমন করে না নেত্রী?
“তাইলে তোমারে নাফিয়া আপা টাকা দিতে কইতেছে তুমি দিতাছো না ক্যা? এই জন্যই তো আমি এহন কইতেছি আমার সাতে থাকবো!”
‘আরে ওরা তো একবার আমার থেকে পাঁচ বছর আগে টাকা নিয়েছিল তাই এবার দেবো না।”
“তুমি দিবা নাকি আমি ডাক্তার এর কাছে যাইয়া ঘর আইকাই দিমু। ”
“আরে না দাড়াও দিচ্ছি।”
মুখর বিরস মুখে ওয়ালেট বের করলো আর টাকা নাফিয়ার হাতে দিয়ে বলল,,
‘নিশ্চয়ই তোরা নেত্রীকে এসব শিখিয়ে দিয়েছিস। এখানে কিন্তু নেত্রীর ভাগ বেশি ওর জন্যই টাকাটা পেলি।”
নাফিয়া দাঁত কেলিয়ে বলল,,
“তা আর বলতে?”
তখন তাজেল বলল,,
‘যাও আইজ তোমার বিয়া দেইহা ছাইড়া দিলাম নাইলে?”
‘নাইলে তুমি তোমার ডাক্তারের কাছে থাকতা। যাও আজকের মতো আমাগো হোম মিনিস্টার বুড়ির কাছে থাহো গা। পারলে দুই জন কাইজা করো গা। ”
“পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা!”
কথাটা শুনেই মুখর দরজার ভেতরে ঢুকে দরজা আটকে দিল। আর তাজেল সহ সবাই হেঁসে উঠল। আর চলে গেল। মুখর সামনে তাকাতেই মেহবিনকে দেখলো লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে আছে। মেহবিন কে দেখে সালাম দিল,,
‘আসসালামু আলাইকুম বউ।”
বউ শুনে মেহবিনের বুকটা ধক করে উঠলো। সে বলল,,
‘ওয়ালাইকুমুস সালাম!”
‘মাশাআল্লাহ ফুলের সমারোহে আমার একান্ত ফুলকে অনেক প্রেমময়ী লাগছে।”
মেহবিন মুচকি হাসলো কিন্তু কিছু বললো না। তখন মুখর বলল,,
‘আমাকে কেমন লাগছে বললে না তো?”
মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,
“আপনাকেও প্রেমময় কম লাগছে না।”
‘তাই বুঝি?’
“হুম তাই! এখন কথা বাদ দিয়ে ওযু করে আসুন সালাত আদায় করবো।”
মুখর ওযু করে এলো। মেহবিন জায়নামাজ বিছিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অতঃপর দুজনে সালাত আদায় করলো। এরপর মুখর মেহবিনকে নিয়ে বেলকনিতে গেল। ওখানে দুটো বেতের টুল রাখা। মুখর মেহবিনকে নিয়ে সেখানে বসলো। মুখর হেঁসে বলল,,
“বিহঙ্গিনী কখনো তোমার থেকে ভালোবাসি শোনা হয়নি। ”
মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,
“সব কথা কি মুখেই বলতে হবে? কিছু না হয় থাক অপ্রকাশিত।”
“তার না বলা ভালোবাসার অনুভূতি এতোটা সুন্দর, না জানি তার মুখে ভালোবাসি শোনার অনুভূতি কেমন হবে?”
“সে না হয়, না বলা ভালোবাসার অনুভূতি নিয়েই থাকুক।
‘তার চোখের ভাষা আমায় বুঝিয়ে দেয় সে আমায় ভালোবাসে। কিন্তু মনের আকাংখা মিটাতে সে কি বলবে সে আমাকে ভালোবাসে?”
“যদি না বলি?”
“তাহলে পূর্নতার মাঝেও একটা বড় অপূর্ণতা রয়ে যাবে। ”
“তাহলে তার জীবনে কোন অপূর্নতা না থাকুক।”
“তাহলে সে বলুক মুখ ফুটে সে আমায় ভালোবাসে।”
‘অতঃপর আমি তাকে ভালোবাসি!”
“কে কাকে ভালোবাসে?”
“বিহঙ্গিনী তার কাব্যকে ভালোবাসে।”
“অতঃপর শুনে নাও বিহঙ্গিনী আমি রুপকথার কাব্যের বিহঙ্গিনীকে ভালোবাসি।’
মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,
“এভাবেই আপনার জীবনের সকল ইচ্ছে পূর্নতা পাক।”
“যদি তার আর আমার ভালোবাসা নিয়ে যদি দুই লাইন বলি তাহলে, এতোকিছুর পরও কাব্যের বিহঙ্গিনীর এক হয়েছিল আর পূর্নতা আমাদের ও হয়েছিল তবে সাক্ষাৎ কম ছিল কিন্তু অপেক্ষাটা বেশি ছিল।”
‘অপেক্ষা যদি হয় হালালের প্রতি তাহলে তো পূর্নতা পেতেই হবে তাই না।”
“হুম! আমার মনের রানী আমার রুপকথার কাব্যের বিহঙ্গিনী। অতঃপর ভালোবাসি আমার বিহঙ্গিনী!”
~~~~ সমাপ্ত~~~