#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৫৯
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি
মেহবিনকে কেউ কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না পাঁচদিন হতে চললো। এই নিয়ে সবার টেনশনের শেষ নেই। অথচ মুখর আর তাজেল বেশ মজায় আছে। এদের দেখে মনে হয় তেমন কিছু হয় নি। মেহবিন ব্যাগপত্র গুছিয়ে পরের দিনই চলে গেছে। না সে কাউকে নেয় নি। শুধু মাত্র চলার সঙ্গী হিসেবে একটা গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে। ও কোথায় গেছে বা যাবে সেই সম্পর্কে মুখর কিছুই জানে না। শুধু এইটুকু জানে মেহবিন ওদের বিয়ের দিন বধুবেশে আসবে ওকে বিয়ে করতে। মুখর মেহবিন যাওয়ার পর তাজেলকে নিয়ে শাহরিয়ার ভিলায় এসেছে। যদিও তাজেল প্রথমে আসতে চায় নি। কিন্তু মুখর অনেক বলে কয়ে রাজি করিয়েছে আর নিয়ে এসেছে। মুখর আগেই বলেছে ওকে যেন ভালোভাবে ওয়েলকাম করা হয় সবাই করেছেও তাই। এই পাঁচদিনে সে হয়ে উঠেছে শাহরিয়ার পরিবার এর মধ্যমনি। সকাল বেলা খাবার টেবিলে বসে মুখর আর তাজেল খাচ্ছিল তখন আছিয়া খাতুন বললেন,,
“ঐ মুখর তুই না পুলিশ। তুই কি তোর পুলিশের টিমরে কাজে লাগাইয়া নাতবউ কোনে হেইডা দেখবার পারোস না?”
মুখর ওর মুখের খাবারটা গিলে বলল,,
“চাইলে তো পারি দাদিজান। তবে আমি জানতে চাইই না যে তোমার নাতবউ কোথায়? সে যখন বলেছে সে আসবে মানে আসবে।”
“হে তো কইছিলো হেতির অনুষ্ঠানে আইবো হে কি আইছিল।”
“সেটার বিষয় আর এটার বিষয় আলাদা।”
তখন তাদের বলল,,
“এই যে দাদি তুমি কি ছোট কাল থেইকাই আমার মতো কতা কও।”
তাজেলের কথায় মেহবিনের কথা ছেড়ে তাজেলের দিকে মনোনিবেশ করলেন আর বললেন,,
“আমি তোর মতো কথা কমু ক্যান? বরং তুই আমার মতো কতা কস।”
“এ তোমারে কইছে আমি তোমার মতো কতা কোম ক্যা? আমি তো আমার মতো কতা কই।”
“ঐ হইলো আমাগো কতা একি পদের।”
“হ হেইডাই তো দেখতাছি। আইচ্ছা তোমাগো বাড়ি কি আমাগো গ্ৰামে আছিল নাকি?”
“না তোগো গ্ৰাম থেইকা মেলা দূর আমাগো বাড়ি আছিল।”
“আইচ্ছা এইগুনা বাদ দাও আর ডাক্তাররে নিয়া চিন্তা কইরো না। ডাক্তার কইছে ঠিক সময় আইয়া পরবো। তুমি চিন্তা কম করো নাইলে কবে জানি স্টক কইরা মইরা যাইবা। অবশ্য তোমার মতো বুড়ি এতদিনে যহন মরে নাই নাইলে সহজে মরবোও না।”
তাজেলের এই কথায় পুরো শাহরিয়ার পরিবার ওর দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল। কিন্তু মুখর হেঁসে উঠল।তখন আছিয়া খাতুন বললেন,,
“ঐ তুই আমারে কি কইলি আমি বুড়ি? তুই বুড়ি তোর চৌদ্দ গুষ্টি বুড়ি। আর আমার মতো কইতে তুই কি বুজাইলি?”
তাজেল দাঁত কেলিয়ে বলল,,
“তোমার মতো ভালো মানুষ আর কি? ভালো মানুষ মেলা দিন বাঁচে তাই না পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা?”
মুখর হেঁসে বলল,,
“হ্যা নেত্রী তাই।
“হ এহন নও আমার খাওয়া হইয়া গেছে। তুমি না আমারে নিয়া কোনে জানি যাইবা।”
বলেই তাজেল দৌড়ে চলে গেল। তখন সবাই হেঁসে উঠলো। আছিয়া খাতুন মেকি রাগ দেখালেও পরে নিজেও হেঁসে বললেন,,
“মাইয়া ডা সত্যিই অনেক ভালো। এ পাঁচদিনেই এই বাড়িটাকে কতটা আনন্দে রাখছে। আর কি সুন্দর তোতাপাখির মতো কথা কয়।”
মুখর হেঁসে বলল,,
“এই কারনেই সবাই আমাদের নেত্রী কে পছন্দ করে। এর পরেও কি তোমাদের কারো আপত্তি আছে ওকে এ বাড়িতে রাখতে?”
সবাই একসাথে চিৎকার করে বলল,,
“না!”
মুখর হেঁসে বলল,,
“নাফি নেত্রীকে রেডি করিয়ে দে। ওকে নিয়ে আজ একটু বেরুবো?”
“কোথায় যাবে?”
“মেহবিন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে নেত্রীর জন্য কিছু জিনিস পাঠিয়েছে ওগুলোই আনতে যাবো। আর ওকে নিয়ে একটু ঘুরেও আসবো। পাঁচদিন হলো এখানে এসেছে কোথাও নিয়ে যেতে পারলাম না।”
“আমরাও যাই তাহলে?”
“আজ না তোরা শপিং এ যাবি। আর মাত্র পাঁচ দিন বাকি তোর বিয়ের। এখন ঘুরা ঘুরি সব বন্ধ। নিজের বিয়েতে মন দে।”
“এমনভাবে বলছে যেন আমার একার বিয়ে?”
“তো তোরই তো প্রথম বিয়ে আমার কি আর প্রথম বিয়ে? আমি তো আগেই বিয়ে করেছি।”
“হুম হইছে বলে দাও নেবে না। এতো জ্ঞান ঝাড়ার কি আছে।”
“এই তো ঠিক বুঝছোস।”
নাফিয়া একটা হু বলে উঠে গেল। পেছনে মুখর ও গেল। তাজেল নাফিয়ার সাথে নাফিয়ার ঘরে থাকে। আর ওর সব জিনিসপত্র ওখানেই। নাফিয়া আর মুখর যেতেই দেখলো তাজেল কি যেন একা একাই বলতেছে ,,
“তুমি যেমনভাবে কইছিলা আমি তেমনভাবেই সবার সাতে মিশতে চাইতেছি ডাক্তার। তুমি তাড়াতাড়ি চইলা আইসো । আমার তোমারে ছাড়া ভাল্লাগে না। এনে তো সবাই আছে কিন্তু তুমি নাই। কিন্তু তুমি নাই দেইহাই এতোজন থাকতেও আমার ভাল্লাগে না।”
“এই তো নেত্রী খুব তাড়াতাড়ি ফিরবে আর পাঁচটা দিন। তারপরেই তোমার ডাক্তার তোমার কাছে থাকবে।”
মুখরের কথায় তাজেল পেছনে তাকালো। আর বলল,,
“হ হ জানি তোমার কওন লাগবো না। এই পাঁচটা দিন মনে হইতেছে পাঁচ বছর। আর পুলিশ পাঞ্জাবি ওয়ালা তাও তুমি রেডি না হইয়া এনে কি কর?”
তাজেলের কথায় মুখর হেঁসে বলল,,
“দেখতে এলাম তুমি কি রঙের ড্রেস পড় আজ তোমার সাথে ড্রেস মিলিয়ে পড়বো আমি।”
“আমি তো ডাক্তারের মতো কালা কালারের বোরকা পড়ুম।”
“তাহলে আমিও কালা কালারের পাঞ্জাবি পরুম ।”
“তুমি এমনে কতা কও ক্যা আমার শরম করে না।”
এবার নাফিয়া আর মুখর দুইজনেই হেসে উঠল। আর বলল,,
“আহ ভাইয়া যাও তো তাজেল লজ্জা পাচ্ছে।”
“বুঝলি নাফি এই কথা টা শোনার জন্যই এতো গুলো কথা খরচ করলাম।”
“হুম।”
মুখর হেঁসে চলে গেল। নাফিয়া কালো বোরকা বের করলো। মেহবিনকে বোরকা পরতে দেখে তাদের একদিন বায়না করলো ওর মতো বোরকা পড়বে তাই মেহবিন নাফিয়ার কাছ থেকে তিনটা বোরকা অর্ডার দিয়ে বানিয়ে নিয়েছিল। সেখান থেকেই একটা আজ পরবে। নাফিয়া ওকে বোরকা পড়িয়ে হিজাব বেঁধে দিল। পায়ের জুতাও পড়িয়ে দিল। আয়নার সামনে তাজেল অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে বলল,,
“দ্যাখ তাজেল আইজকা তরে ডাক্তারের মতো লাগতেছে মাশাআল্লাহ।”
বলে নিজেই হেঁসে উঠল। তাজেল বোরকা ধরে লাফাতে লাফাতে সিঁড়ি দিয়ে নামলো। এটা ওর অভ্যেস সিড়ি দেখলেই লাফিয়ে লাফিয়ে নামবে সে। মুখর এসেই তাজেলের অনেক প্রশংসা করলো। এতে তো আমাদের নেত্রী লজ্জায় লাল হয়ে গেল। মুখর ওকে কোলে নিয়ে বের হলো।
______________
এদিকে মেহবিন দাঁড়িয়ে আছে মেঘের দেশে । সে এমন একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে যেখানে হাত বাড়ালেই মেঘ ধরা যায়। কালকেই এসেছে এখানে। মেহবিন চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস নিলো। পাশে কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে বলল,,
“তো এখন তোমার অনুভূতি কি?”
“এই মেঘের মতো যেন হাওয়ায় ভাসছি।”
মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,
“খুশি হয়েছো আমাকে এভাবে দেখে।”
“অতঃপর আমার বিহঙ্গিনী ভালো থাকবে।”
মেহবিন হেঁসে বলল,,
“যদি না থাকি?”
“থাকবে সে এটা আমার বিশ্বাস।”
“এই বিশ্বাসের জোরেই কি আমায় ছেড়ে দিয়েছিলে।’
“না তখন বিশ্বাস করেছিলাম তাকে অথৈ সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে যাচ্ছি। তবে সময়ের ব্যবধানে এখন বলছি সে ভালো থাকবে।”
“তাহলে বলছো ভালো থাকবো?”
“যেখানে মুখর শাহরিয়ার এর মতো একজন জীবনসঙ্গী আছে আর নেত্রীর মতো বিশ্বস্ত ভালো বন্ধু আছে সেখানে তো ভালো থাকতেই হবে।”
মেহবিন মুচকি হাসলো আর বলল,,
“সবাই থাকলেও কারো না থাকার শূন্যতা সবসময়ই রয়ে যায়। সবাই বলে সব শোকের তীব্রতাই সময় চলে যাবার সাথে সাথে কমে আসে। কিন্তু আমার ওপর সেটা হয়নি সময় ঠিকই চলে গেছে কিন্তু শোকের তীব্রতা কমে নি। একজনের শূন্যতা বারবার আমাকে গভীর অসহ্যকর যন্ত্রনা দেয়।”
“এতটা ভালো না বাসলেই কি হতো না আমায়?”
মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,
“না হতো না! কারন এই একটা মানুষকেই যে খুব বাজে ভাবে হাড়িয়েছি। আর হাড়িয়েছি বলেই হয়তো এতো ভালোবাসি।”
“আমি তো তোমাকে এতটা কঠিন হতে বলিনি তবুও কিসের এতো কঠোরতা? যে দুঃখের কথা বলতেই মুখে হাঁসি থাকে। এতোটা কঠোরতা তো চাইনি।”
‘আমার মুচকি হাঁসি কি তোমায় পীড়া দেয়?”
‘ভয়ঙ্কর রকমের পীড়া দেয়।”
“কই কখনো কাঁদতে দেখলাম না তো? তোমাকেও তো সবসময় মুচকি হাসিতে দেখি। তাহলে আমি কিভাবে বিশ্বাস করবো আমার মুচকি হেঁসে কষ্টের বলা কথাগুলো তোমায় পীড়া দেয়।”
কথাটা শুনে মানুষটার মুখে হাঁসিখানা প্রসারিত হলো। আর বলল,,
‘এতটা বুদ্ধিমতিও ঠিক না কিন্তু? তবে আমি তো কাঁদতে চাইলেও কাঁদতে পারবো না। কারন এই আমি শুধু তোমার। তুমি যেমনটা আমাকে দেখতে চাও তেমনটাই দেখতে পাবে। আমি চাইলেও নিজের মতো করে কিছু প্রকাশ করতে পারবো না।”
মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,
“তোমার মুখে সর্বদা হাসিটাই মানায় বুঝলে?”
“আপু আপনি কার সাথে কথা বলছেন?”
হুট করে অপরিচিত কারো আগমনে মেহবিন একটু চমকে গেল। ও দেখলো একটা মেয়ে । ও কিছু বললো না দেখে মেয়েটা আবারও বলল,,
“কি হলো আপু আপনি কার সাথে কথা বলছেন? বললেন না তো?
মেহবিন মুচকি হেঁসে পাশে তাকিয়ে বলল,,
‘নিজের অস্তিত্বের সাথে।”
“কি অস্তিত্ব! অস্তিত্ব কারো নাম হয় না কি? তাছাড়া আমি তো আপনার আশেপাশে কাউকে দেখছি না।”
মেহবিন কিছু বললো না সামনের দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটা কোন জবাব না পেয়ে মেহবিন কে পাগল উপাধিতে ভূষিত করে চলে গেল। মেহবিন সামনে মেঘের দিকে তাকিয়ে বলল,,
‘মেহবিন মুসকান নামক মানুষটাকে সবাই কঠোর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন বলে জানে। অথচ কেউ জানেই না মেয়েটার একটা মানসিক রোগ আছে। যাকে নরমালি বলা যায় পাগল। সে তার মাকে দেখতে পায় তার সাথে কথা বলে তার মাকে নিয়ে তার আলাদা জগৎ। এই যে সবাইকে ছেড়েছুড়ে সে তার মায়ের সাথে ঘুরতে এসেছে। এই যে পাগল মেয়েটার মা তুমি কি মেয়েটাকে দেখে লুকিয়ে গেলে নাকি?
তখন মেহবিনের মা মুচকি হেসে তার পাশে দাঁড়িয়ে বলল,,
“না তো লুকাই নি। আমি তো তোমার সাথেই আছি। আর সর্বদা তোমার সাথেই থাকি। কখনো তোমার থেকে দূরে যেতে পারি না।
মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,
“যেতে দিলে না যাবে তুমি। তুমি তো সর্বদা আমার সাথেই থাকবে।”
‘হুম সেটা তো আছিই আমি। তবে আমি তোমার জীবনে এমন একজন মানুষ যাকে ছায়ায় মতো ধরতে গেলেই নেই।”
“এই জন্যই তো কখনো ধরতে যাইনি। এখন চলো অনেকটা বেলা হয়ে গেছে। এখন যে কাজের জন্য এখানে এসেছি সেটা করা যাক।”
মেহবিন কিছুক্ষণ একা একাই ওর মাকে কথা বলে চলে গেল। এটা বলতে গেলে মেহবিনের একটা আলাদা জগৎ যা ওর মায়ের মৃত্যুর পর থেকে তৈরি। মেহবিন যখন একা একা থাকতো তখন ও ওর মায়ের সাথে কথা বলতো। যেহেতু ওর জীবনে বেশি মানুষের আগমন নেই তাই বেশিরভাগ সময়ই ও একা একা ওর মায়ের সাথে কথা বলতো আর সময়ের ব্যবধানে এটাই ওর জীবনে রয়ে গেছে। এমন কি মেহবিনের ধারনা ও ওর জীবনের সবকিছু ওর মায়ের সাথে ডিসকাস করে সিদ্ধান্ত নেয়। আসলে তো সে নিজেই নিজের সব ডিসিশন নেয়। যদিও ও নিজের সবকিছু অনেক ভালোভাবে মেইনটেইন করে এই জন্য কেউ বুঝতেই পারবে না ওর এমন একটা মানসিক রোগ আছে। হয়তো কেউ কোনদিন জানতেও পারবে না এই বিষয়ে।
____________
মুখর কুরিয়ার অফিসে গিয়ে দেখলো শুধু তাজেলের জন্য নয় মুখরের জন্যও একটা বড় বক্স আছে। মুখরের কিছু একটা আন্দাজ করে মুখে মুচকি হাঁসি ফুটে উঠল। ও তাজেল কে কোলে নিয়ে বলল,,
“বুঝলে নেত্রী এখনকার যুগে বর বউকে কে পড়ার জন্য জিনিসপত্র দেয়। কিন্তু তোমার ডাক্তার বউ হয়ে বরের জন্য পড়ার জিনিসপত্র পাঠিয়েছে।”
তাজেল হেঁসে বলল,,
“আমার ডাক্তার সবসময় আলাদা।”
‘হুম তা তো বটেই কার বউ দেখতে হবে না আমার বউ।”
‘মোটেই না আমার ডাক্তার দেইহা এমনে। তোমার বউ তো কি হইছে? তোমার তো এনে কোন দাম নাই।”
‘তাহলে তো বলবো তোমার ডাক্তার তো কি হইছে? তোমার ও দাম নাই।”
“না থাকলো আমার দাম। তোমারও তো নাই এইডাই বড় কথা।”
‘নেত্রী!”
‘কি হইছে চিললাও ক্যা?”
ব্যস দুজনে লেগে গেল। এদিকে ওদের এরকম ঝগড়া দেখে কুরিয়ার অফিসের সকলে হাসছে। আজ তো মেহবিন নেই যে দুজনকে সামলাবে। ওরা দুজনে দুজনের মতো ঝগড়া করে আবার একসাথেই চলে গেল মুখে হাঁসি ফুটিয়ে। সবাই ভাবলো এরকম ও মিষ্টি সম্পর্ক হয়।
___________
“কি মিস ফারজানা? বয়ফ্রেন্ড রেখে আরেক জনের সাথে সাজেক ভ্যালি এসে মার খেলেন এইভাবে। আরে আমার একটু ভুল হলো অবশ্য এটাও তো বয়ফ্রেন্ড ছিল তাই না।”
মেহবিনের কথায় মুখরের মামাতো বোন ফারজানার মনে হলো কেউ ওর গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। ও চিৎকার করে বলল,,
“আবার তুই? তুই এখানে কিভাবে এলি?”
“ঐ তো গাড়ি দিয়ে। আমার তো ডানা নেই যে উড়ে উড়ে আসবো।”
আজ ফারজানা তার এক বয়ফ্রেন্ড কে নিয়ে রুমে ঢুকে রুমডেট করতে যাচ্ছিল। এমন সময় তার আরেক বয়ফ্রেন্ড এসে তাকে হাতেনাতে ধরে। হুট করে তার এক বয়ফ্রেন্ডকে দেখে ও চমকে উঠে আর ভয় পেয়েও যায়। কারন ও বলে এসেছে বন্ধুদের সাথে সাজেক ট্যুর এ এসেছে। আর তার সাথে থাকা বয়ফ্রেন্ড জানে সেই তার একমাত্র বয়ফ্রেন্ড। ব্যস লেগে গেল দুজন বয়ফ্রেন্ডের মধ্যে ঝগড়া। এদিকে ফারজানা পরেছে ফান্দে কাকে রেখে কার দিকে যাবে দু’জনেই পয়সাওয়ালা ছেলে। একটাকে বিয়ে করতে পারলে লাইফ সেট। যদিও তার বাবা নিজে খুব একটা নিচুশ্রেনির মানুষ নন। একটা সময় পর দুই বয়ফ্রেন্ডই বুঝতে পারে যে আসলে ফারজানাই ওদের ধোঁকা দিয়েছে। দুজনই ফারজানা কে ইচ্ছে মতো মারতে থাকে। মার সহ্য করতে না পেরে ফারজানা নিচে পড়ে যায়। তবুও তারা থামেনা তাদের দেওয়া ধোঁকার মূল্য তাকে তো দিতেই হবে। মার খেয়ে ফারজানা কোথাও আঘাত পেল সে জোরে চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেলে তারা দু’জনেই ভয় পেয়ে যায় আর তাড়াতাড়ি করে ওকে রেখেই চলে যায়। এদিকে মেহবিন তার পাশের রুমটাতেই ছিল তাদের বের হতে দেখে মেহবিন ফারজানার রুমে গিয়ে মার খেয়ে অজ্ঞান হয়ে পরে আছে। মেহবিন ফারজানা কে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যায়। রাতে জ্ঞান ফিরতেই মেহবিন মুচকি হেঁসে ঐ কথাগুলো জিজ্ঞেস করলো। ফারজানা রেগে উঠতে চাইলো কিন্তু প্রচন্ড ব্যাথায় সে আবার শুয়ে পড়লো। মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,
“কেউ সাহায্য করলে তার শুকরিয়া আদায় করা শিখুন মিস ফারজানা। আমি যদি ঠিক সময় আপনাকে হাসপাতালে না আনতাম তাহলে এতক্ষনে আপনি পরপারে চলে যেতেন।”
তখন ডক্টর এসে বলল,,
“উনাকে কিছু জানিয়েছেন?”
মেহবিন বলল,,
“না সময় পেলাম না এখনি বলতাম।”
তখন ফারজানা বলল,,
“কি বলবে ও?”
“এই যে আপনি কখনো মা হতে পারবেন না। আপনি পেটে প্রচন্ড আঘাত পেয়েছেন। নিচে কিছু একটা ছিল আপনি হয়তো খেয়াল করেন নি। সেখান থেকেই আপনার জড়ায়ু,,
আর বলতে পারলো না ডাক্তার তার আগেই ফারজানা না বলে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। ডাক্তার চলে গেল। তখন মেহবিন বলল,,
“আল্লাহ তায়ালা কিছু কিছু শাস্তি দুনিয়াতেই প্রদান করেন। নাফিয়া আপুর তো দুই পার্সেন্ট ছিল কিন্তু আপনার তো তাও নেই।”
মেহবিনের কথা শুনে ফারজানা ওর দিকে তাকালো। আর বলল,,
‘মানে?”
“মানে টা খুব সহজ মিস ফারজানা। আমাকে দাদি জানের কাছে খারাপ বানিয়ে নিজেকে অনেক বুদ্ধিমতি ভেবেছিলেন না। যদিও আপনি শুধু তুলে আনতে বলেছিলেন। কিন্তু আমি আর নাফিয়া আপু তাদের আঘাত করলে আপনার লোকেরা ভুল করে নাফিয়া আপুর পেটে আঘাত করে যার জন্য নাফিয়া আপুর মা হওয়ার চান্স থাকে না। আর আপনি সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আপনি দাদি জানের কাছে এডিট করা ছবি পাঠিয়ে আমায় সেই কাজের জন্য দায়ী করেছিলেন না। ”
ফারজানা অবাক হয়ে বলল,,
“এসব তুমি জানলে কিভাবে?”
“বাহ তুই থেকে তুমি তে চলে গেলেন। তার মানে স্বীকার করলেন যে আপনিই সবকিছুর জন্য দায়ী।”
মেহবিনের কথা শুনে ও বুঝতে পারলো কি বলে ফেলেছে। চোর ধরে পড়ার ন্যয় নজর লুকালো। তখন মেহবিন বলল,,
“যাই হোক তা এসব কিছু কিসের জন্য করেছিলেন বলুন তো?”
ফারজানা মুখ ছোট করে বলল,,
“আমি মুখর কে বিয়ে করতে চাইছিলাম। তোমার কথা জানার পর এরকম সিদ্ধান্ত নিই।”
“কি!!শুধু মুখর কে বিয়ে করতে। সব থেকে বড় কথা সবকিছু না বলে করার কথা ছিল। তাহলে আপনি জানলেন কি করে যে মুখরের সাথে আমার বিয়ের কথা চলছে?”
‘ফুপি একদিন মাকে বলছিল একটা মেয়ে পেয়েছে মুখরের জন্য। আর আমিও একটা মেয়েকে মানে তোমাকে মুখরের সাথে দেখেছিলাম বেশ কয়েকদিন। মুখর কোন মেয়ের সাথে মেশা তো দূর চোখ তুলেও তাকাতো না। অথচ তোমার সাথে কি সুন্দর হেঁসে হেঁসে কথা বলতো। আমি ছোট থেকেই ওকে পছন্দ করতাম। ওকে ভালোবাসতাম ওর সাথে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখতাম কিন্তু তুমি আসায় আমার সব স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল তবে থেকেই মনে মনে পন করলাম তোমায় মুখরের বউ হতে দেব না। এই জন্য তোমায় তুলে নিয়ে চেয়েছিলাম দুদিন পর ফেরত দিয়ে বলতাম তোমাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু তোমার সাথে নাফিয়া ছিল। তাই ওরা না বুঝতে পেরে ওকেও তুলতে চাইলো কিন্তু বাঁধা পেল। নাফিয়ার আঘাতে আহত একজন ওর ওপর ক্ষেপে গেল তাই ওভাবে মেরেছে। পরে জানলাম নাফিয়া মা হতে পারবে না পেটের আঘাতের কারনে। কথাটা শুনে খারাপ লেগেছিল কারন আমি এটা চাইনি আমি তো শুধু মুখরের বউ হতে চেয়েছিলাম। তবে পরে মাথায় বুদ্ধি আসে এভাবে তোমাকে ফাঁসাতে পারি। এই জন্য আছিয়া খাতুন কে সব পাঠালাম আর তোমার সাথে বিয়ে ক্যানসেল করে দিল। সেদিন রেস্টুরেন্টে তোমাকে দেখেই চিনে ফেলিছিলাম কিন্তু কেউ কিছু বলছে না দেখে আমিও চুপ করে রইলাম।
সব শুনে মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,
“এতো কিছু করেও তুমি মুখরের বউ হতে পারলে না। অথচ পারবে কি করে মুখর ছিল সুন্দর চরিত্রের অধিকারী কিন্তু তুমি নও। আর কুরআন এর সূরা আন নুর এর ২৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে,,
“দুশ্চরিত্রা নারীরা দুশ্চরিত্র পুরুষদের জন্য এবং দুশ্চরিত্র পুরুষরা দুশ্চরিত্রা নারীদের জন্য। আর সচ্চরিত্রা নারীরা সচ্চরিত্র পুরুষদের জন্য এবং সচ্চরিত্র পুরুষরা সচ্চরিত্রা নারীদের জন্য; লোকেরা যা বলে, তারা তা থেকে মুক্ত। তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও সম্মানজনক রিযিক।” (আন নূর -২৬)
আর আমার মনে হয় তুমি মুখরকে কখনো ভালোইবাসোনি যদি বাসতে তাহলে তোমার দুই দুইটা বয়ফ্রেন্ড থাকতো না। তুমি শুধু ওকে পেতে চাইছিলে কিন্তু ওকে ভালোবাসে না। আর তোমার জন্য একটা মেয়ের এতো বড় ক্ষতি হলো ছিঃ। জানি তুমি চাও নি তবুও তুমিই তো কারন টা তাই নয় কি? শুধু মাত্র মুখরকে পাওয়ার জন্য?
“আমি আগে এমন ছিলাম না তোমার বিয়ে ক্যানসেল হওয়ার আমি মুখর কে প্রপোজ করি। তখন না বলে আমি কয়েকবার বলেছি ও আমায় রিজেক্ট করেছে। তখন একটা ছেলে আসে আমার কাছে আমাকে নানা কথা বলে ওর থেকে ভালো ছেলে ডিজার্ভ করি আরো অনেক কথা। আমাকে অপমান জনক ও কথা বলে পরে আমি একজনের সাথে রিলেশনে যাই। আমার পুরুষ সঙ্গ ভালো লাগতে লাগে। এরপর থেকেই আমি এসবে জড়িয়ে তাই এর থেকে বের হতে পারি না।”
মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,
“ওহ আচ্ছা। তবে যার জন্য তুমি এসব করলে এতে কিন্তু তোমার লাভ হলো না। কারন আমাদের বিয়ে আরো পাঁচ বছর আগেই হয়ে গেছে। তবে আছিয়া খাতুন কাউকে জানান নি। উনি তোমার কথা বিশ্বাস করেছিলেন ঠিকই তবে আমায় একেবারের জন্য তাদের থেকে দূর করে দেন নি। এক মাস আগে আমার জন্যই অনুষ্ঠান রাখা হয়েছিল।আর পাঁচ দিন পর আমার সাথেই মুখরের বিয়ে। আর হ্যা তোমার সাথে যা হলো তা তোমার কর্মফল। ইচ্ছে তো ছিল তোমায় মেরে ফেলি কিন্তু যেহেতু এতো বড় একটা শাস্তি পেয়েছো তাই কিছু বললাম না। এখন ও সময় আছে সুদরে যাও নাহলে ভবিষ্যতে তোমায় অনেক ভুগতে হতে পারে। আর হ্যা আমার পরিবার থেকে দূরে থাকো যা করেছো তার সাথে এই শাস্তি টা কম। ”
বলেই মেহবিন বেরিয়ে গেল। কিছুদিন আগেই আছিয়া খাতুন সবকিছু মেহবিন কে জানিয়েছে যে কিসের জন্য মুখরদের এই বিচ্ছেদ। মেহবিন মনোযোগ দিয়ে শুনে শুধু বলেছিল,,
‘আপনি একবার শুধু আমার কাছে জিজ্ঞেস করতেন নাহলেই এসব কিছু হতো না।”
আছিয়া খাতুন কেঁদে কেটে অস্থির। পরে মেহবিনই তাকে সামলেছে। উনি আগে থেকেই অনুতপ্ত ছিলেন এই জন্য মেহবিন তেমন কিছু বলে নি। আর এসবের পেছনে যে ফারজানা এটা মারিয়ার জন্য হয়েছে। যেদিন তাজেলের এক্সিডেন্ট হলো সেদিন মেহবিনের জন্য যে অনুষ্ঠান ছিল। সেখানে মুখরের বউ এর কথা শুনেই ফারজানা নিজের রুমে রেগে এসব বলছিল কি কি করেছে। মারিয়া ওকে ডাকতে গিয়ে এসব শুনে ফেলে। সব শুনে মারিয়া তো পুরো থম মেরে ছিল। কাউকে বলার তেমন সাহস পায়নি। তবে মেহবিনের সাথে খুব ভালো সম্পর্ক এই জন্য ওকে আগে জানিয়েছে। এ কথা শুনে মেহবিন বলেছে কাউকে কিছু না বলতে ও সব ব্যবস্থা করবে। মারিয়াও আর কাউকে কিছু বলেনি। মেহবিন ফারজানার ওপর নজর রেখেছিল ও জানতে পেরেছে ফারজানা এখানে আসবে তাই সে এখানে এসেছে। যদিও নিজের সাথে সময় কাটানোর জন্য দশদিন সময় নিয়ে বেরিয়েছে। মাঝে কাজটাও সেরে নিল। ও শুধু ওর বয়ফ্রেন্ড কে খবরটা জানিয়েছিল বাকি সব কিছু একাই হয়েছে ওর কিছু করতে হয় নি। কথায় আছে না ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। এসব ভেবে মেহবিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ও ফোনটা নিয়ে একজন কে ফোন দিয়ে বলল,,
“আপনার মেয়ের সাথে যদি দুদিন সময় কাটাতে চান তাহলে আমি একটা লোকেশন পাঠাচ্ছি সেখানে চলে আসুন। তবে খবরদার কেউ যেন কিছু ভুলেও জানতে না পারে। আর যদি জানে তাহলে আপনার মেয়েকে ভুলে যান।”
~চলবে